পরবর্তী অংশ…
পদ্ম পাতায় জল( দুই)
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
” সংসারে থাকতে গেলেই সুখ- দ:খ আছে,
একটু – আধটু অশান্তি আছে। কাজলের ঘরে
থাকলে, গায়ে একটু কালি লাগেই
-( শ্রী রামকৃষ্ণ কথামৃত।। দ্বিতীয় খন্ড।। পৃষ্ঠা ৬৬৫)
ওপরের কথা গুলি কথামৃত থেকে নেওয়া।
মা সারদার সংসারে ও সুখ – দু:খ ছিলো। অশান্তি ও ছিলো। আর একটু আধটু নয়। বেশ ভালো পরিমাণেই ছিলো। আর মা’য়ের সংসারে সবচেয়ে বেশি অশান্তি দিয়েছে কারা? মা’য়ের একবারে কাছের মানুষজনরা। মায়ের নিজের সহোদর ভাইয়েরা। তাদের স্ত্রীরা, মা’য়ের ভাইঝিরা।
★
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মা সারদাকে বিয়ে করার পর
দীর্ঘদিন দক্ষিণেশ্বরে থাকতেন, আর মা থাকতেন
বাপের বাড়ি জয়রামবাটি তে। তখনই মায়ের
সংগে মায়ের পিতৃকুলের সকলে একসাথে বাস
করতেন। মা’ য়ের কাছের মানুষদের নির্বুদ্ধিতা,লোভ, অন্যায়, মিথ্যে চাওয়া,
আর স্বার্থপরতা মা বুঝেও আদর্শ গৃহীর মত সব কিছুকে এড়িয়ে চলতেন। গৃহে থেকেও তিনি
ছিলেন সন্ন্যাসীণী। সম্পূর্ণ নির্বাসনা। কোনো
বাসনাই তাঁর মনে কোনোরকম রেখাপাত করতে
পারতো না। একজন ভাস্কর যেমন পাথর খোদাই করে দেবতার মূর্তি বানায়, ঠিক তেমনই মা সারদা
নিজের জীবনকে কুঁদে এক দৈবী ক্ষমতা আরোপ
করতে পেরেছিলেন নিজের গার্হস্থ্য জীবনে।তাঁর
ব্যাক্তিত্ব ছিল অসাধারণ, কিন্তু বাইরে থেকে তা
বোঝার জো ছিল না। তিনি ছিলেন এক টুকরো
হীরে। এক হীরকখণ্ড। তাঁকে চিনেছিলেন এক
জন মাত্র জহুরী। তিনি কে? তিনি আর কেউ নন। আমাদের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ স্বয়ং। তাই তো পরবর্তী কালে বিভিন্ন সময়ে, বিভিন্ন জায়গায়, কথা প্রসঙ্গে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ আমাদের চিনিয়ে দিয়ে বলেছেন, “ও কী যে সে। ও আমার শক্তি। ” কখনো বলেছেন, “ও সারদা, সরস্বতী। ও জ্ঞান দিতে এসেছে।” আবার কখনো সোজাসুজি মা সারদাকেই বলেছেন, “( নিজেকে দেখিয়ে), এ আর কি করেছে! তোমাকে আরও অনেক অনেক কিছু করতে হবে”। এর থেকেই বোঝা যায়- মা সারদা,কতটা অনন্ত আত্মশক্তির আধিকারী ছিলেন। তাঁর আধার ছিলো দৈব শক্তির ভান্ডার।
★
শ্রী গিরিশ চন্দ্র ঘোষ, সেই সময় কালের একজন
বিখ্যাত নাট্যব্যক্তিত্ব, শিক্ষিত ও সম্ভান্ত্র পরিবারের
এক সাহিত্যকর্মী বলে গেছেন,”তোমরা কী ভাবতে
পার তোমাদের সামনে পল্লীবালার বেশে যিনি
দাঁড়িয়ে আছেন, তোমাদের কার কী লাগবে তার সুচারু বন্দোবস্ত করছেন, খেতে দিচ্ছেন, তোমাদের এঁটো পরিষ্কার করছেন – তিনি স্বয়ং মা জগতজ্জননী, মা জগদ্ধাত্রী, মা জগদম্বা। সর্ব জীবের মুক্তির জন্য, মংগলের জন্য,কল্যানের জন্য – তিনি সদা তৎপর। সর্বদা ব্যস্ত। তাঁর জীবনের ঈশ্বরত্ব এইখানেই। তাঁর মনে কোনোরকম ” অহং ” নেই। মানুষ থেকে, পশুপাখি থেকে, কীটটি পর্যন্ত তাঁর আপন সন্তান।
মানুষ মাত্রই অহং এ ভরা। অহংকার ত্যাগ করা
খুব সহজ নয়। দু একজন ক্ষণজন্মা মানুষ আর
ব্রহ্মজ্ঞানী সাধক ছাড়া অহংকার মুছে ফেলা কঠিন। তাও একটু আঁশ থেকেই যায়। ঠাকুর বলেছেন ” ঈশ্বরই একটু ধোঁয়াশা রেখে দেন। সেটাই মায়া। “
বেশির ভাগ মানুষের মধ্যেই ‘ আমি’ আর’ আমি’ ।
‘আমার ‘আর ‘আমার’। এটা আমার বাড়ি। আমার
জায়গা। আমার বাংলো। শুধু” আমি “আর “আমার”।
★
একবার জয়রামবাটিতে মায়ের দুই ভাইয়ের মধ্যে
ভীষণ ঝগড়া। মেজভাই কালীকুমারের সঙ্গে সেজ
ভাই বরদাপ্রসাদের। মা সারদা দুজনকেই কোলে
পিঠে করে লালন- পালন করেছেন।বড় করেছেন।
মা এক শীতের দুপুরে নিজের ঘরের দাওয়ায় বসে
আছেন, হঠাৎ শুনলেন ঝগড়া, কোলাহল। কী ব্যাপার? না, সেই আমার আর আমার।কালী
কুমারের গরুর গাড়ি তার খামারে ঢুকতে পারছে
না, বরদার বেড়া দেওয়ার জন্যে। ‘আমার ‘নিজের
জায়গায় ‘আমি ‘ বেড়া দিয়েছি। বেশ করেছি।
— বেশ করেছিস? তাহলে দেখ, আমি তোর বেড়া কেমন ভেঙে দিচ্ছি।ঝগড়া থেকে মারামারি
হাতাহাতি। ” চল, দিদির কাছে। দিদি যা বলবেন
তাই মানবি তো? –চল তাহলে।
মা সারদা মিটিয়ে দিলেন ঝামেলা। নিরস্ত করলেন
দুই অপগন্ড ভাইকে মারামারির হাত থেকে।
তারপর আবার নিজের ঘরের দাওয়াতে ফিরে
এসে হেসেই কুটোপাটি। হাসছেন আর বলছেন, ” মহামায়ার কী মায়া গো! অনন্ত পৃথিবীটা পড়ে আছে, এ সব পড়েও থাকবে! জীব এটুকু আর বুঝতে পারে না।” শুধু আমার আমার করেই মরে — এ পর্যন্ত বলেই মা হেসেই অস্থির ; সে হাসি আর থামে না।
★
মা ছিলেন যোগিনী। সংসারের এই কঠিন ঘূর্নাবর্তে, সংসারী- স্বার্থপর- লোভী- মানুষদের
সঠিক দিশা দেখাতে তিনি সদা তৎপর। তা সত্বেও
তাঁরই ছত্রছায়ায় লালিত পালিত আপন ভাতৃদ্বয়
এক বিঘৎখানেক জায়গার জন্য যেভাবে লড়াই-
ঝগড়ায় মেতেছিল, তাতে অবশ্যই ক্ষুন্ন হয়েছিলেন, তাই আমার মনে হয় এই হাসির আড়ালে ছিল কান্না। ছিলো হতাশা।অন্তরের অন্তস্তল থেকে ওঠা ওই হাসির গভীরে লুকানো ছিল অনেক দু:খ।
মা সারদা ছিলেন অনেক পুন্যাত্মার দীক্ষাগুরু।
অন্ধকার থেকে আলোর পথ দেখান যিনি, তিনিই
গুরু।তাঁর কৃপা পেয়ে শতশত মানুষ উদ্ধার হয়ে
গেছে। অথচ মায়ের পেটের ভাইরা এক বিঘৎ
পরিমাণ জমি কার দিকে বেশি গেছে সেই হিসাবে
দ্বন্দ্বে জড়াচ্ছে। যাদের জড়ানো উচিত ধর্মের
আঙিনায়, যাদের স্বতঃস্ফূর্ত প্রকাশ হওয়া উচিত
ঈশ্বর বন্দনায়, যাদের আপন দিদির জীবনচর্চা
অনুসরণ করা উচিত ; তারা এতটাই মানসিক নি:স্ব, যে তাদের ক্রিয়াকলাপে মা সারদা হাসছেন! আসলে এই হাসি আনন্দের নয়। এই হাসি দু:খের। সেজন্যই তিনি আক্ষেপের সঙ্গে বলেছেন,” এই গোটা জগতটাই পড়ে আছে আর পড়েও থাকবে, শুধু, আমরা চলে যাবো। মুছে যাবো। আমাদের প্রানটা চলে গেলে কোনো অস্তিত্বই থাকবে না। তবু আমরা লড়াই করি। ঝগড়া করি। “আমার আমার” করি। কেন? সেটা বুঝি না। সত্যিই সেটা হাসির কারণই বটে! এসবই এক ধরনের ” মায়া”। তাই মা সারদা বলছেন, ” মহামায়ার কী মায়া গো!” এই মায়াই সেই পরমপুরুষকে, মায়াধীশকে স্মরণে- মননে- অনুভবে আনতে দেয় না। ঈশ্বর প্রসঙ্গ ভাললাগে না।
★
কথামৃতে আছে, ” কাজলের ঘরে থাকলে একটু
আধটু কালি লাগেই। ” এখানে “কাজলের “ঘর
অর্থে এই গৃহবাসী সংসারী দের বোঝানো হয়েছে।
সংসারী মানুষদের জীবন চর্চায় ষোলআনা সাধু
জীবন, পুরোপুরি ত্রুটিহীন জীবনধারন সম্ভব
নয়।একটু কম- বেশি দোষ ত্রুটি থেকেই যায়।
কিন্তু আমরা মা সারদা কে দেখেছি, কী অসামান্য
মাতৃত্বের মহিমান্বিত জীবনধারা।কোনো ছোট বড়
নেই। বলছেন, ” আমার শরৎ ও যা, আমার আমজাদ ও তাই।” শরৎ কে? একজন ক্ষণজন্মা উচ্চমার্গের ব্রহ্মজ্ঞানী সাধক এবং সেইসাথে শ্রীরামকৃষ্ণ মঠ ও মিশনের প্রধান কর্মকর্তা। মা সারদা অবলীলায় তাঁকে শুধু ভালবাসার অমৃত ধারায়, এনে বসিয়ে দিলেন আমজাদের সঙ্গে, যে কি না একজন পেশায়, চুরি- ডাকাতির সঙ্গে যুক্ত মানুষ। মানুষ তো! সুতরাং মায়ের কাছে সব সমান। আপন আত্মার আত্মীয়। একান্ত আপনজন।
★
” পদ্ম পাতায় জল ” ( এক) এই শিরোনামে আমার লেখা গত ২৭ তম পর্বে উল্লেখ ছিলো,
” দেবতারা যখন এই মাটির পৃথিবীতে আবির্ভূত
হন, তখন আগে থেকে তাঁদের কেউ চিনতে পারে
না। ইত্যাদি “…
এই প্রসঙ্গে একটি সত্যি ঘটনার কথা বলি :
মা সারদাকেও জন্মানোর সঙ্গে সঙ্গেই কেউ
বুঝতে পারেনি, জানতে পারেনি, তিনি কী প্রচন্ড
আধ্যাত্মিক শক্তির আধার।তিনি স্বয়ং মা
জগদ্ধাত্রী। এক দিনের কথা। স্থান – মা সারদার বাপের বাড়ি, জয়রামবাটি গ্রাম।তখন সব গ্রামেই একজন করে চৌকিদার থাকতো। জয়রামবাটিতেও
ছিল। তার নাম ছিলো অম্বিকা। সে মা সারদাকে
রাম মুখুজ্জের বড় সন্তান সারু হিসেবেই জানতো।
অনেক দুরদুরান্ত থেকে মানুষ জন আসতো তখন মায়ের কাছে, মায়ের বাড়িতে। মায়ের কাছে মন্ত্রদীক্ষা নিতে, মায়ের কৃপা ভিক্ষা চাইতেও, বহু
মানুষজন ভীড় জমাতেন। এমনকি কোলকাতার
শহুরে মানুষরাও এসে মায়ের মহিমা কীর্তন করতেন। আশীর্বাদ প্রার্থনা করতেন। এসব দেখে অম্বিকা, অর্থাৎ গ্রামের সেই চৌকিদার খুব অবাক। যাকে সে এতটুকু থেকে চেনে,সে কী করে অন্য অন্য এত মানুষের খাতির সম্মানের উপযুক্ত হয়ে উঠলো – তা তার কাছে এক বিস্ময়!
সে আর থাকতে পারলে না। একদিন সরাসরি এসে মা’ কেই প্রশ্নটা করলে। “বলি ও মেয়ে, তুমি তো আমাদের সেই ‘সারু’! তাহলে লোকজন যে কেউ বলে, -ভগবতী, আবার কেউ বলে তুমি জগদ্ধাত্রী , কিন্তু আমি তো কিছুই বুঝি না। তুমি কে গো? আমাকে একটু বুঝিয়ে দাও তো? সহজ মানুষের সহজ জিজ্ঞাসা।
মা সারদা মৃদু মৃদু হাসলেন। তারপর বললেন,
“তোমার বুঝে দরকারটাই বা কী? তুমি আমার
সেই অম্বিকা দাদা আর আমি তোমার সেই ছোট্ট
সারদা বোন। ” ব্যাস গোল মিলে গেল।
চলবে..