পরবর্তী অংশ…
পদ্ম পাতায় জল(চার)
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
আজ মহা পুণ্যময় এক দিন। আজ প্রভু যীশুর
জন্মদিন। জেরুজালেমের এক আস্তাবলে, যেখানে ঘোড়াদের রাখা হয়, তেমনি এক পূতিগন্ধময় পরিবেশে, মাতা মেরীর কোল আলো করে আবির্ভূত হলেন, ঈশ্বর। এই পবিত্র দিনে
পৃথিবীর সব চার্চে চার্চে আজ, নানা ধর্মানুষ্ঠানের প্রার্থনা চলছে, আড়ম্বরপূর্ণ আবহাওয়ার মধ্যে।
উৎসব চলছে মহা ধূমধামের মধ্যে। কেন না আজ বড়দিন।
★
ভগবান রা যখন জীব-কল্যান হেতু এই মর্তধামে নেবে আসেন, তখন তাঁরা এক অসামঞ্জস্য পূর্ন পরিবেশে ও পরিস্থিতিতে মায়ের কোলে আবির্ভূত হন। এঘটনা, লক্ষ্য করে দেখুন প্রায় সব অবতারদের ক্ষেত্রেই ঘটেছে। প্রভু যীশু জন্মালেন অস্তাবলে।
পশুদের থাকার জায়গায় জন্মালেন জগত-
কল্যান কারী ঈশ্বর । আস্তাবল আর যাই হোক প্রসূতিসদন তো নয়!
আর অন্যদিকে শ্রীকৃষ্ণ। কোথায় জন্মালেন ? না এক কারাগৃহে। সেখানে কারা থাকে? চোর বদমাস দুষ্কর্ম্মে জড়িত মানুষ জন। লৌহকারাগারে মা দেবকী র গর্ভে এলেন বংশীধারী মদনমোহন গোবিন্দ গোপাল। আবার আামাদের ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ, জন্মালেন ঢেঁকিশালে। বাড়িতে আর বাড়তি ঘর নেই যেটাকে আঁতুড়ঘর করা যায় কয়েকদিনের জন্য।অতএব ঢেঁকিশাল। জন্মের পরই হড়কে চলে গেলেন ধানসেদ্ধ করার উনোনের ছাইগাদার মধ্যে। ভাগ্যিস সে সময় উনানে আগুন ছিলো না, তাই রক্ষে! আর তাই ধানী কামারনী, দাই- মা, ওই ছোট্ট পূর্ণব্রহ্ম নাারয়নকে খুঁজে পেলেন উনানের ছাই মাখা অবস্থায়। কী অপূর্ব লীলা! তখন তিনি ভোলানাথ। মহাদেব। সারা অঙ্গে ভস্ম মাখা!
★
প্রিয় পাঠক, একেই কী বলে ধান ভানতে শিবের
গীত? শুরু করেছিলাম, মা সারদার কথা।আজ
কের শিরোনাম ও তাই। অথচ তিথি নক্ষত্র ধরে
পৌঁছে গেলাম যীশু- জন্মদিনে। তাঁকে বন্দনা করে
তাঁর চরণ স্পর্শ করে, তাঁকে একটু স্মরণ – মননে এনে, এবার আমরা এগোবো মা সারদা র প্রসঙ্গে।
তাঁর জীবন চর্চায়। আমরা এই লক্ষ লক্ষ সংসার তাপিত গৃহবাসী, আমাদের উদ্দেশ্য দয়াল ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ মা সারদাকে বলে গেছিলেন,”কোলকাতার লোক গুলো কে তুমি দেখো।” কোলকাতার লোক একটা প্রতীক মাত্র। আসলে সমস্ত জগতবাসী -কেই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বুঝিয়েছিলেন। তাই মা সারদাও আমাদের মত গৃহবাসীদের ই সব সময় আগলে আগলে রেখেছেন।
★
পৌষমাস বড় আদরের মাস। বড় শুদ্ধ মাস। বড়
পবিত্র মাস। মা লক্ষীর মাস। ফসল ঘরে তোলার
মাস। চাষী পরিবারে নতুন ফসল খামারে এনে
গোলায় রাখার মাস। নবান্নের মাস।এই পৌষমাসেই কৃষ্ণা সপ্তমীর পুন্য তিথিতে, মা লক্ষ্মীর বার -বৃহস্পতিবারে, ৮ ই পৌষ, বাংলা ১২৬০ সনের এক পবিত্র লগ্নে,মা সারদা জগজ্জননী রূপে এই ধরাধামে আবির্ভূত হন।
জয়রামবাটিতে শ্রী রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় এক
সজ্জন ব্রহ্ম জ্ঞানী দরিদ্র চাষীবাসি গৃহস্থ আর
তাঁর স্ত্রী শ্যামাসুন্দরী দেবী অতীব ধর্মপ্রাণা, দ্বেব-
দ্বিজে একগলা ভক্তি, সেই গৃহে জন্ম নিলেন
জগতের মা, মা সারদা।বাবা- মা অমন পুন্যবান
পুন্যবতী হলেই সেখানে ভগবান – ভগবতী জন্ম নেন। মায়ের জন্মের আগে, আশ্বিন মাস থেকেই এই পৃথিবীতে একটা পূজার বাতাবরণ আকাশে – বাতাসে ধ্বনিত প্রতিধ্বনিত হচ্ছে । মা দশভুজা
এসেছেন আশ্বিনে। তার পর পরই মা লক্ষীর
পদার্পণ। এসেছেন এবং পূজা গ্রহণ করে ফিরে
গেছেন মা কালিকা,মা জগদ্ধাত্রী। এই জগতের
সন্তানদের মন মাতৃমুখী করেছেন তাঁরা। আর
ঠিক সেই প্রেক্ষাপটে, পৌষমাসের কৃষ্ণাসপ্তমীর
পুন্যলগ্নে এলেন মা সারদা।
তাঁর কথা, তাঁর দৈবী মহিমা, তাঁর নিরাসক্ত
অথচ সব সময় আনন্দ – পূর্ণ মন, “যেন
আনন্দের ঘট পূর্ণ হয়ে আছে “, এমন ভাব, যা তিনি নিজেই পরবর্তীকালে বলেছেন আর তাঁর
শুদ্ধতামাখা আচরণ – সবার সাথে, সবাই কে নিয়ে, একটি পাখি পর্যন্ত, সেক্ষেত্রে কোনখান
থেকে শুরু করব ভেবে পাচ্ছি না। কোথা থেকে
শুরু করব আর কোথায় শেষ টানব এই ভেবে
অনেক তাবড় তাবড় লেখক হিমসিম খেতেন বা
বিড়ম্বনায় পড়তেন। সেখানে আমি এক ফোঁটা,
ক্ষুদ্র, এক অর্বাচীন। আমি শুধু মায়ের শ্রী চরণে
জানাতে পারি, জগজ্জননী মা গো, তুমি আমাকে
তোমার কথা বলার সাহস দাও। যেন ঠিক ঠাক
তোমার পুন্য জীবনের পথ অন্য অন্য মানুষের
কাছে তুলে ধরতে পারি। তোমার শুদ্ধতামাখা
জীবন চর্চায় যেন আমরা ও আলোকিত হতে পারি। মন্ত্র তন্ত্র সাধনা ভজনা কিচ্ছু জানি না ।
ভক্তিভরে তোমার অমৃতবাণী, যা এ যাবৎ পড়েছি
ও শুনেছি – তা যেন এই এই লেখার মধ্যে দিয়ে
জগতকে জানাতে পারি। আশীর্বাদ করো মা
যেন তোমার জীবন চর্চায় জীবন কাটাতে পারি।
★
মা সারদা নিজেই নিজের স্বরূপ, পরবর্তী কালে
আমাদের জানিয়ে গেছেন। বলেছেন,” আমার মা
একদিন শিওড়ে ( জয়রামবাটি র নিকটবর্তী এক
গ্রাম) ঠাকুর দেখতে গিয়েছিলেন। ফেরবার সময়
এক দেবালয়ের কাছে একটা বায়ু যেন হঠাৎ
কোথা থেকে এসে তাঁর উদরে ঢুকে পড়ল। আর
তারপরই মায়ের উদর ভারি হয়ে উঠল। তখন
মা দ্যাখেন – লাল চেলি পরা এক পাঁচ- ছ বছরের
অতি সুন্দরী ফুটফুটে মেয়ে এসে মায়ের গলা জড়িয়ে ধরল, পিছন দিক থেকে। তারপর বলল,
আমি তোমার ঘরে এলাম, মা। তখন মা অচৈতন্য
হয়ে পড়েন। অনান্য যারা ছিলেন মা’ কে ধরাধরি
করে নিয়ে আসেন বাড়িতে। সেই মেয়েই মায়ের
উদরে প্রবেশ করে ; — তা থেকেই আমার জন্ম। “
★
অর্থাৎ এটা বেশ বোঝা যায় মায়ের জন্মবৃত্তান্ত
এক দৈবী ঘটনা। এক অন্য লোক থেকে তাঁর
আগমন। তিনি দেবী। তাঁর জন্ম এবং কর্ম দিব্য।
গীতাতেও শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং বলেছেন : ” জন্মকর্ম
চ মে দিব্যম্। ” অর্থাৎ যাঁরা দেব- দেবী হয়ে এই
মর্ত্যে আসেন, তাঁদের জন্মের সময় এবং পরবর্তী
কালে সমস্ত কর্মের মধ্যে অলৌকিক দৈবী শক্তি
লুকিয়ে থাকে । কেউ বোঝে, কেউ বোঝে না।
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ যখন জন্মান তখনো এমনই সব
দৈবী ঘটনা ঘটেছিল। — যা অন্য কোথাও, অন্য
কোনো সময়ে , সুযোগ মত শোনা যাবে ।
★
মা সারদা, কথা প্রসঙ্গে, ভক্তদের সামনে নিজের
স্মৃতিচারণ করতে গিয়ে বলেছেন, : ” অনেক
সময় ভাবি, আমি তো সেই রাম মুখুজ্জের মেয়ে।
এই জয়রামবাটি গাঁয়ে, আমার সমবয়সী আরও
তো কতো মেয়ে আছে তাদের সংগে আমার তফাত কী? “—এ প্রশ্ন স্বয়ং মায়ের।
“ভক্ত রা সব কোথা কোথা থেকে আসে, গড় হয়ে
প্রনাম করে , আশীর্বাদ চায়, জিজ্ঞেস করলে শুনি, কেউ হাকিম, কেউ জজ, কেউ উকিল।
এরাই বা এমন আসে কেন?” একবার এক ভক্তমহিলা মা’ কে জিজ্ঞেস করলে
“মা, তুমি তো ভগবতী। আমরা জানি। তোমার
মায়ের পেটের ভাই রা ওমন কেন?” মা হেসে
উত্তর দিলেন “মলয়ের হাওয়া সর্বদা বইছে কিন্তু সব গাছে সেই হাওয়া লাগে না। শিমুল,বাঁশ আর
কলা গাছে সেই হাওয়া লাগে না। আমার তিন
ভাই ওই তিন গাছের মত। ওদের গায়ে কোনোদিনও মলয়ের হাওয়া লাগবে না।” তারপর বললেন, —
“সকলেই কী আর সকলকে চিনতে পারে মা? ঘাটে একখান বড় হীরে পড়ে ছিল । সবাই জানত
পাথর। ওই পাথরে পা ঘসত ভাল করে তারপর
স্নান করে উঠে যেত। একদিন এক জহুরী এল
ওই ঘাটে স্নান করতে। সে এসে চিনলে যে, ওটা
পাথর নয়, এক মহামূল্যবান হীরকখণ্ড।”
অর্থাৎ মা সারদা আমাদের বুঝিয়েছেন, তিনি
সামান্য এক পাথরের খন্ড নন, একটি হীরক খন্ড, যা মহা-মূল্যবান। তাঁর চরণযুগলে আভূমি
প্রনতি জানিয়ে এই পর্ব শেষ করছি।
চলবে…
ঋণ স্বীকারঃ জন্ম জন্মান্তরের মা।।
।।যা দেবী সা সারদা।। স্বামী চেতনানন্দ।।পৃ.৩৯.।।
তথ্য সহায়তাঃ ভক্ত প্রবর :মাননীয় শ্রী শান্তি ময় দেব মহাশয়।। শ্রীমৎ স্বামী বীরেশ্বরানন্দজীর দিক্ষীত সন্তান।।