ধারাবাহিক গদ্য পরম হংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা। পূর্বে প্রকাশিতের পর(একুশতম পর্ব)
অমৃতকথা-আনন্দকথা
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
আজকের কথা অমৃত কথা। এই কথা শুনলে বা
পাঠ করলে মানুষের “অক্ষয় পূন্যলাভ”হয়। সব কিছু শুভ হয়, জীবের কল্যান হয়, মঙ্গল হয়, মনে শান্তি আসে। আর মন আনন্দে ভরে ওঠে। কিছু কিছু সময়ের প্রভাব থাকে এই পৃথিবীতে। দিন, ক্ষণ, তিথি,নক্ষত্র অনুযায়ী এদের প্রভাব জড়িয়ে থাকে এই নির্দিষ্ট সময়কালে। কোজাগরী পূর্ণিমা থেকে রাসপূর্ণিমা পর্যন্ত সময়কে “দামোদর” মাস বলে। ভগবান শ্রীকৃষ্ণই শ্রীদামোদর। তাঁরই বালক বয়সের ” গোপাল ” রূপ। মা যশোদা পরমেশ্বর শ্রীকৃষ্ণকে তাঁর দুষ্টুমির জন্য তাঁকে রসি ( দড়ি) দিয়ে বেঁধে রেখেছিলেন। বেঁধেছিলেন একটা উদখলে। এই চিত্রটি প্রায়শই দেখা যায়।ছবিতে, ক্যালেন্ডারে। এই একমাস নিষ্ঠার সঙ্গে, নিয়ম মেনে হরির নাম গুণকীর্তন করলে, শুদ্ধাচারে থাকলে,ভক্তসেবা, ভগবান সেবায় কাটালে, এবং এই একমাস সন্ধ্যায় – গৃহে, অথবা দেবালয়ে, অথবা তুলসীমঞ্চে দীপদান করলে ” অক্ষয় পূন্যলাভ” হয়। যে পূন্যের কোনো ক্ষয় হয় না।
আবার ভাতৃদ্বিতীয়ার পর, চতুর্থী থেকে সংক্রান্তি
পর্যন্ত সময়কালে শ্রীবিষ্ণু মর্ত্যের আবহে পদচারণা
করেন। মর্ত্যবাসীর গণ্ডী ও সীমানায় প্রবেশ করেন।
এই সময়কাল ও অত্যন্ত শুভ। এই সংক্রান্তি কে
” বিষ্ণুপদ সংক্রান্তি ” বলে। এই সময়, সন্ধ্যায়,
ঈশ্বর প্রসঙ্গে থাকলে, শ্রীহরির নাম গান করলে,
দেব- দেবীর স্মরণ- মনন অনুষ্ঠিত হলে, আমাদের
মত গৃহবাসীদের “অক্ষয় পূন্যলাভ” হয়। এই সময় শ্রীবিষ্ণুর সঙ্গে একত্রে বিরাজমান থাকেন মাতা মহালক্ষ্মী। তিনি শ্রীবিষ্ণুর পদসেবায় রত। এই চিত্রও সময় সময় দেখা যায়। তিনি ধনধান্যের দেবী। তাঁর মহিমা ও গুণকীর্তন করলে, ধন বৈভব এবং সম্পন্নতা প্রাপ্ত হয়। সংসারে ও জীবনে গৃহীর শ্রীবৃদ্ধি ঘটে। তিনি চান শুচিতা ও শুদ্ধতা। গীতিকাব্যে আছে –
‘স্বচ্ছ ও সৎ মন।।
করহ শ্রীলক্ষীর আরাধন।।’
তিনি শস্য, প্রাচুর্য এবং সমৃদ্ধির দেবী। লক্ষ্মী –
নারায়ন ও যা, শ্রীবিষ্ণু এবং মহালক্ষ্মী ও তাই।
এক, অভিন্ন ও অভেদ। মা লক্ষ্মীর এক হাতে থাকে অমৃতকলস। এবং অন্যহাতে থাকে প্রস্ফুটিত পদ্ম। সেই অমৃত কলসে তিনি আমাদের জন্য কী কিছু আনেন? হ্যাঁ।অবশ্যই আনেন। আনেন শুভবুদ্ধি, উন্নত বিবেক, স্বচ্ছ মন, শুভ চিন্তা, শুভ বোধ আর প্রীতিপূর্ণ ভালোবাসা। আর তাঁরা উভয়েই অত্যন্ত দয়ালু। অল্পতেই তাঁদের সন্তুষ্টি। যে ব্যাকুল হয়ে তাঁদের কৃপা চায় তাকে তাঁরা দয়া দান করেন, পূর্ণতা দান করেন, ভক্তি দান করেন, মোক্ষ দান করেন। আড়ম্বরহীন ঘরোয়া পদ্ধতির সাদাসিধে পূজা অর্চনাই তাঁদের অত্যন্ত পছন্দের।
সব ধর্ম সেই এক ব্রহ্মে গিয়ে মিশেছে। মানুষের
ধর্ম আলাদা আলাদা হতেই পারে, কিন্তু ঈশ্বর
সেই এক। এবং অদ্বিতীয়। ধর্ম তো আর ঈশ্বর
নয়। ধর্ম হচ্ছে একটা কিছু ধরবার মাধ্যম। যেটা
ধরে তোমাকে উঠতে হবে। পৌঁছাতে হবে। কোথায়? — সেই আনন্দনিকেতনে। যেখানে কোনো বিধি নিষেধ নেই। জাত পাত নেই। ছোট
বড় নেই। তুচ্ছ উচ্চ নেই। তুমি আমি নেই।
সংস্কার সংকীর্ণতা নেই। সব এক। সব একাকার।
এর জন্য কী চাই? চাই শুধু ভক্তি। চাই শুধু বিশ্বাস। চাই শুধু ভালোবাসা। আর ব্যাকুলতা।
টাকাপয়সা, ধন দৌলত, অর্থ বিলাসিতা, প্রাচুর্য,
ব্যাঙ্ক ব্যালেন্স, এর মধ্যে আসে না। দূর্যোধনের কত সম্পত্তি, সোনার সাম্রাজ্য। কত ঐশ্বর্য্য। লোকবল, অর্থবল। কিন্তু তার রাজ-প্রাসাদে গেলেন না শ্রীকৃষ্ণ। কোথায় গেলেন? গেলেন বিদুরের বাড়িতে। সে গরীব। ভগ্ন তার দালান। জৌলুসহীন তার আসবাবপত্র। গেলেন সেখানে। সে রাজপুত্র নয়। সে দাসীপুত্র। তার কিছু নাই। কিন্তু তার আছে এক গলা ভক্তি। একমন বিশ্বাস। একবুক ভালবাসা ঈশ্বরের ওপর। সেই সত্যিকারের ভক্ত। সে বীরভক্ত। গেলেন এবং আহার ও করলেন সেখানে, শ্রীকৃষ্ণ। চাই না রাজভোগ। চাই না আরাম শয্যা। চাই না রাজকীয় আতিথেয়তা। বিদুরের খুদই আমার আনন্দের ব্যান্জন। তার দেওয়া শাকান্নই আমার পরিতোষ বর্ধন করে। এখানেই আমি খুসি। শ্রীকৃষ্ণ বোঝালেন দীন দরিদ্র সততা আর আকুলতা ঈশ্বরের পছন্দের তালিকায় থাকে। এই শিক্ষা দিলেন তিনি। পরবর্তী কালে শ্রীকৃষ্ণ নিজ মুখে বলেছেন গীতায়ঃ ” আমি ঐশ্বর্য্য নয়, অহংকার নয়, জাঁকজমক নয়, যে আমাকে সামান্য একটি ফল, একটি তুলসিপত্র, আর এক গন্ডুস গঙ্গার পবিত্র জল দিয়ে সেবা করে আমি তাকেই পরম ভক্ত ও বান্ধব বলে মনে করি।”
এ যুগের অবতার বরিষ্ঠ, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কী
বলছেন? বলছেন,” সর্বদা ঈশ্বরের সঙ্গে যুক্ত হয়ে থাক।আর তাঁকে মনপ্রাণ দিয়ে ডাকো। সেই ডাকের মধ্যে যেন ব্যাকুলতা থাকে। নিজের হৃদয়ের মধ্যেই ঈশ্বরের জন্য আসন পাতো। অন্তরে অনুভব করো তাঁর উপস্থিতি। তাঁকে জাগাও। তিনি ঠিক পথ দেখাবেন। তিনি তো তোমার পর নন, তিনিই একমাত্র আপন। যেভাবেই ডাকো তাঁর অনুভব, তাঁর উপলব্ধি হবেই হবে। সব পথ – তাঁর পথ। সব রাস্তাই – তাঁর রাস্তা।
“যত মত তত পথ।”
“মনে কর সূর্য আর দশটি জলপূর্ণ ঘট রয়েছে।
প্রত্যেক ঘটে সূর্যের প্রতিবিম্ব দেখা যাচ্ছে। প্রথমে দেখা যাচ্ছে একটি সূর্য ও দশটি প্রতিবিম্ব সূর্য। যদি ৯টি ঘট ভেঙে দেওয়া হয়, তাহলে বাকি থাকে ১ টি সূর্য ও ১টি প্রতিবিম্ব সূর্য। এক-একটি ঘট যেন এক- একটি জীব। প্রতিবিম্ব সূর্য ধরে ধরে সত্য সূর্যের কাছে যাওয়া যায়। জীবাত্মা থেকে পরমাত্মায় পৌঁছানো যায়। জীব(জীবাত্মা) যদি সাধন ভজন করে তাহলে পরমাত্মা দর্শন করতে পারে। শেষের ঘটটি ভেঙে দিলে কি আছে মুখে বলা যায় না। “
(কথামৃত।। ২য় খন্ড।। পৃষ্ঠা ৬৫৪)
।। ওঁ নমঃ ভগবতে বাসুদেবায়।।
চলবে…