সহজ মানুষ-সহজপাঠ (আজ ছত্রিশতম পর্ব)– লিখছেনঃ নিমাই বন্দোপাধ্যায়

ধারাবাহিক গদ্য পরম হংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা

 

আগের পর্বের শেষ টুকু

মহাভারতের গল্প ( দুই)

 

নি মা ই   ব ন্দো পা ধ্যা য় 

(তখন যক্ষরাজ বললে, সব প্রশ্নের
সঠিক উত্তর দিতে পারো যদি, তাহলে তোমার
ভাইদের প্রানও ফিরিয়ে দেব আমি। সুতরাং আর
ক্রোধ নয়।শুনেছি তুমি বীর। এবার আমার প্রশ্নের
উত্তরের জন্য প্রস্তুত হও।”)
★★★★★★★★★★★

ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির মূহুর্তের মধ্যে নিজেকে প্রস্তুত
করে নিলেন। তিনি শুধু ন্যায়নিষ্ঠ আর সত্যবাদীই
নন, তিনি যথেষ্ঠ বিচক্ষণ ও বটে। পরিস্থিতির
গুরুত্ব বিবেচনা করে তিনি প্রশ্নোত্তর পর্বে যক্ষরাজের আহ্বান স্বীকার করলেন।মনে মনে
সংকল্প নিলেন যেমন করে হোক যক্ষের চাতুরীর
হাত থেকে নিজেকে বাঁচাতে হবে।আর সেই সঙ্গে
ভীম,অর্জুন, নকুল আর সহদেবের প্রানও ফেরাতে
হবে। এমন ভয়ানক মৃত্যু এদের হতে পারে না।
এরা শুধু আমার আপন বংশধর নয় ; কেউ সহোদর আবার কেউ বৈমাত্রেয় ভাই। এরা প্রত্যেকে জগদ্বিখ্যাত বীরযোদ্ধা। আমি ধর্মরাজ
যুধিষ্ঠির, আমি যদি এদের জীবিত ফেরাতে না
পারি, তাহলে আগামী দিনের ইতিহাস আমায় ক্ষমা করবে না।

যুধিষ্ঠির উচ্চস্বরে বললেন, ” আমি প্রস্তুত। কিন্তু
তুমি রাজা হয়ে আড়ালে কেন? এ তো কোনো
রাজার মর্যাদায় শোভা বর্ধন করে না? তুমি আমার
সামনে প্রকট হও, তবেই শুরু হবে এই প্রশ্নোত্তরের আসর। ”
উত্তরে যক্ষরাজ জবাব দিল, “আমি বধির নই। বিধি ভঙ্গ করব না। বিধাতাপুরুষের এই বিধান।
ধর্মরাজকে আমার আভূমি প্রনাম জানাই।আমার
প্রশ্নমালার সঠিক উত্তরের ওপরই আপনার
মনোবাসনা লুকিয়ে আছে।”
—” বেশ, তবে শোনো, বিধির বিধান, লঙ্ঘিত
হোক তা আমারও কাম্য নয়। তুমি প্রশ্ন শুরু করো। আমি সাধ্যমত উত্তর দেবো।” বললেন
যুধিষ্ঠির। যক্ষরাজ শুরু করলেন :—
আমার প্রথম প্রশ্ন। (১) কোন্ ধর্ম, সাধু ধর্ম?
—- তপস্যা। জীব- সেবা। আর শরণাগতকে আশ্রয় দান। এগুলিই সাধু ধর্ম।
— বেশ । এবার দ্বিতীয় প্রশ্ন।(২) ধর্ম কী?
— যা ন্যায়কে ধারণ করে আছে, সত্যে
প্রতিষ্ঠিত এবং পরের উপকারে আসে, তাই ধর্ম।
— বেশ। এবার তৃতীয় প্রশ্ন। (৩) পৃথিবীর চেয়েও
বড় কে?
— মাতা। তিনি পৃথিবীর অধিক।
— বেশ। এবার চতুর্থ প্রশ্ন। (৪) আকাশের চেয়েও
উঁচু কে?
— পিতা। জীবনে তাঁর উচ্চতা মাপা যায় না।


★★★
এই ধর্মরাজ আর যক্ষরাজের প্রশ্নোত্তরের গল্পটি
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কে শোনাচ্ছিলেন এক ভক্ত ।
দক্ষিণেশ্বরে। ঠাকুর তাঁর সেই ছোট্ট তক্তাপোশটিতে বসে শুনছিলেন শিশুর সরলতা নিয়ে।
শুনতে শুনতে ঠাকুর তন্ময়।বললেন,” দ্যাখ,অমন
আকাশের মতো বিশাল যে বাবা, তিনিই তো
আমার সাত বছর বয়সে আমাদের ছেড়ে চলে
গেলেন। ধর্মরাজ যুধিষ্ঠির ঠিকই বলেছিলেন।
তাঁর নাগাল পাওয়া যায় না। আমিও তখন তাঁকে
হারিয়ে চোখে সর্ষেফুল দেখতুম।সবদিকেই শুধু
অন্ধকার।
গেছিলেন আমার পিসির বাড়ি, ছিলিমপুরে।
দুর্গোৎসব দেখতে। ভাগনে নিয়ে গেলেন মামাকে।
আমি জানতেও পারলুম না। আকাশের মত উঁচু
পিতাকে খুঁজতে কত জায়গায় গেছি। “
— ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একাত্ম, ধর্মরাজ যুধিষ্ঠিরের
সঙ্গে।যেন কেউ ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ কে’ ই এই
প্রশ্নগুলি করছে। বললেন,” তবু কিছুদিন পৃথিবীর
চেয়েও বড় যে মা, তাঁকে দুবেলা প্রনাম করার
সুযোগ পেয়েছিলুম। পান দোক্তারও অভাব বুঝতে
দিইনি।
তোরাও মা- বাবাকে আদর যত্নে রাখবি বুঝলি?
তাঁরাই তো আসল গুরু রে! কানে মন্তর দেন না
ঠিকই ; তবে তাঁরাই শেখান চলতে, বলতে,জীবনের পথে হাতে ধরে শেখান সবকিছুই।
এগুলো ই তো জীবনের আসল মন্তর রে! তাঁদের
অযত্ন করলে ভগবানও ক্ষমা করেন না। ”
— ঠাকুর বললেন, ” বল,যক্ষরাজের পরের প্রশ্ন
কী ছিলো। “প্রশ্ন শোনার আগেই বললেন, “বলছিলি না —
ধর্ম কী? — আমি হলে বলতাম,সত্যই ধর্ম।সত্যে
আঁট থাকলেই ধর্মে টিকে থাকা যায়। আরও
বলতাম৷ সব ধর্মই সমান। সেখানে যাবার পথ
আলাদা আলাদা হতে পারে। যেমন, সব
পুষ্করিণীতেই সেই এক জল। পুবে,পশ্চিমে উত্তরে
দখিনে আলাদা আলাদা ঘাট থাকতে পারে।
কিন্তু সব ঘাটেই সেই একই পুকুরের জল।তেম্নি
সব জীবও ওই এক ব্রহ্মের অধীন। “
★★
যক্ষরাজের পন্চম প্রশ্ন। (৫) বায়ুর চেয়েও দ্রুত কী?
ধর্মরাজ জবাব দিলেন — ” মন “।

শুনে, ঠাকুর খুসিতে ডগমগ। বললেন, ” এটা
ধর্মরাজ মোক্ষম বলেছেন। মন বড্ড জোরে এখানে সেখানে ছোটে, জানিস?
এই মা ভবতারিণীর চরণতলে ফেলে রাখলাম, তো পরক্ষনেই কামারপুকুরে পাইনদের শিব- দালানে। এই এখানে তো ওই ওখানে। বড্ড ছটফটে।
ঠিক যেন গেছো বাঁদর।
পোষ মানে, বশে আসে, বেড়ি পরালে। ধর্মের
শেকল। সেটা কেমন? খুব করে নাম- জপ
কর। সাধু সঙ্গ কর। সৎপথে, সৎপ্রসঙ্গে থাক।
মনকে সব সময় কাজের মধ্যে ফেলে রাখ।
ঠাকুরের মালা গাঁথ, ঠাকুর ঘর উঠান পরিষ্কার
কর। দেখবি যেন আজে বাজে চিন্তায় না বসে
ওই মন বাবাজী।
মাছি ফুলেও বসে, মিষ্টির রসেও বসে আবার
পচা ঘা’ য়েও বসে। মনকে সব সময় ঈশ্বর – রসে
বসিয়ে রাখ। তাহলে আর কামিনীকান্চনে মন
বসবে না।

যক্ষরাজের প্রশ্ন সংখ্যা অনেক। ধর্মরাজ ও প্রস্তুত। এই ধর্মহীন, নৃশংস, হিংসাপরায়ণ দূর্বৃত্তের কাছ থেকে ছিনিয়ে আনতে হবে ভাই দের প্রানভোমরা।
কোনো আর এক পুণ্য – পর্বে আমরা শুনব সেই
প্রশ্নোত্তরের সুন্দর গল্প টি। এখন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে আমরা কিছু প্রশ্ন করবো এবং শুনব ঠাকুরের শ্রীমুখের উচ্চারণ।

প্রথম প্রশ্ন। (১) — দেবতা থেকেও বড় কে?
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণের উত্তর –” মানুষ। সে দেবতা
থেকেও বড়। খড়, দড়ি, বাঁশের তৈরী মাটির
মূর্তিতে পুজো হতে পারে, আর রক্ত-মাংসের মানুষে পুজো হবে না?
মানুষ ই দেবতা। নরদেবতা। আমি বলি “নরনারায়ণ। “

দ্বিতীয় প্রশ্ন। (২) — ঈশ্বর কোথায় থাকেন?
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ হেসে বললেন, ” মানুষের
হৃদয়ে। বা বলতে পারিস ভক্ত -হৃদয়ে। সেই তো
ভাগ্যবান, সে বুকে করে ঈশ্বরকে বয়ে বেড়ায়।
আর তাছাড়া সেই বাহাদুর। সংসারে থাকতে
গেলে কত ঝক্কি বলতো? কামনা বাসনা লোভ
অভাব এইসব সরিয়ে নাড়িয়ে পাশ কাটিয়ে তবে
এগতে হয়। ঈশ্বরকে ভালোবেসে তাঁকে নিয়ে যে
চলতে পারে — সেই বীরভক্ত।

যার আছে অনুরাগ, ভক্তি, আর বিশ্বাস সেই পারে এতবড় বোঝা বইতে। তবে অভ্যেস হয়ে
গেলে আর বোঝা থাকে না। ঈশ্বরই সব ভার
হালকা করে দেন। লাঘব করে দেন।

তখন বোধ হবে আমি শরীর, তুমি আত্মা। আমি
রথ তো তুমি সারথী। আমি পথিক তো তুমি পথ।
আমি যন্ত্র তো তুমি ইঞ্জিনিয়র। আমি ভক্ত তো তুমি ভগবান।

চ ল বে…

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *