ছোটগল্পঃ সরকার, সহজ হিসেব — প্র দী প   ভ ট্টা চা র্য্য

প্রদীপ ভট্টাচার্যে-র জন্ম ১৯৫২ সালে কোচবিহার জেলার দিনহাটায় ।দিনহাটায় স্কুল জীবন শেষ করে শিলিগুড়িতে কলেজ জীবন শুরু।বর্তমান বাসস্থান শিলিগুড়ি পুরসভার 31নং ওয়ার্ডে সুকান্তপল্লীতে । ৭০ এর দশকের শুরু থেকেই নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। পরবর্তী কালে গল্প , কবিতা ও প্রবন্ধ উত্তরের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই করোণা আবহে ঘরে বন্দি । ছোটবেলার বিভিন্ন স্মৃতি বিশেষ করে এবারের পূজোর পরিমণ্ডলে নিজের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।বাইফোকালিজম-র পাতায় প্রতি বুধবার থাকছে তারই নস্টালজিয়ার খসড়া।

সরকার, সহজ হিসেব

প্র দী প   ভ ট্টা চা র্য্য

বােগাস ব্যাকডেটেড, ওল্ড সেন্টিমেন্ট, ওল্ড ভ্যালুস যত্তসব। এই জন্যই তাে দেশটার এই অবস্থা। অন্য কোন দেশ এরকম “নিজের ষাট-সত্তর বছরের পুরােনাে ব্যাপার নিয়ে পাগলামি করে না।করবে কেন? ওরা অলওয়েজ দেশকে আপ-ডেট করে চলেছে।”- মনে মনে গজ্ গজ্ করতে করতে বলে চলে, জয়ন্ত। জয়ন্ত দিন সাতেকের জন্য দেশে এসেছে। এবার জয়ন্ত বৌ মেয়েকে নিয়ে আসেনি। বােনের সাথে পৈতৃক সম্পত্তি ভাগ-বাটোয়ারার ফয়সালা করেই চলে যাবে। পরে এক সময় এসে দালাল লাগিয়ে বিক্রি করার ব্যবস্থা করবে বলে ঠিক করেছে।সম্পত্তির পরিমান কম তো না! জয়ন্তর মা সরমাদেবী বারান্দায় বসে তরকারি কাটছেন। ছেলে মাত্র সাতদিনের জন্য এসেছে। ছেলের পছন্দের খাবার যতটা সম্ভব তৈরি করবে ভেবে রেখেছেন। বয়স হয়েছে। চোখে একটু কম দেখেন। ইদানিং কানেও একটু কম শুনছেন। জয়ন্তর কথাগুলাে ভাল শুনতে পাচ্ছিলেন না তাই গলা উচিয়ে জিজ্ঞেস করেন খােকা কিছু বলছিস? “না তােমাকে না”-বলতে বলতে জয়ন্ত বারান্দায় এসে দাঁড়ায়। “কেন, আমাকে বলা যায় না?” সরমা জানতে চান। না তোমাকে বলে কোন লাভ নেই। তুমি তো সম্পত্তির কিছু জান না বােঝও না, এগুলাের একটা ব্যবস্থা তো করতে হবে। সে ব্যাপারেই বাবার সাথে কথা বলবাে বলেই অনেক চেষ্টা করে দশদিনের ছুটি নিয়ে এলাম, কিন্তু দুদিন হয়ে গেল বাবার সাথে একটু বসে কথা বলবাে সে সুযােগই তাে পাচ্ছিনা। ছেলের কথা শুনে সরমাদেবী বলেন ” তোর বাবা ১৯শে মে-র অনুষ্ঠান নিয়ে একটু ব্যস্ত।

সত্যি ভাবা যায় না। জয়ন্ত আরাে কিছু বলতে যাচ্ছিল কিন্তু তার আগেই পিছন থেকে দিলীপবাবু অর্থাৎ জয়ন্তর বাবা বলে ওঠেন ‘কেন, সুযােগ নেই? এই তো এখন বল।”জয়ন্ত পিছন ফিরে দেখে একটা বাঁধানাে ফটো নিয়ে বাবা এসে দাঁড়িয়ে আছে। জয়ন্ত টের পায়নি জয়ন্তকে চুপ করে থাকতে দেখে দিলীপবাবু স্ত্রীর পাশে বারান্দায় বসে বলেন “তােমাকে কয়েকদিন আগে বলেছিলাম। আজ পাকাপাকি ভাবে ভাষা শহীদ স্মৃতিরক্ষা কমিটিকে সম্মতি দিয়ে এলাম। সরমাদেবী স্বামীর দিকে তাকিয়ে কিসের সম্মতি জানতে চান। কিছুটা অবাক হয়ে দিলীপবাবু বলেন-তােমার মনে নেই! কদিন আগেই তো বললাম যে রাস্তার ও পাশের এক বিঘার জমিটা “ভাষা শহীদ স্মৃতি রক্ষা কমিটিকে দান করব। রথীনবাবুর ১৯শে মে-র স্মরণে শহীদ স্মৃতি স্তম্ভ নির্মাণ করে দেবেন। বাকিরা সবাই মিলে ফুলের বাগানসহ সৌন্দর্যায়ন করবেন। দারুণ হবে তাই না? দেখবে একদিন করিমগঞ্জের গর্ব হয়ে উঠবে। জয়ন্ত বাবার কথা শুনে চুপ করে থাকতে পারে না বলে ওঠে বাবা তুমি রাস্তার ও পাশের এক বিঘার প্লটটা দান করে দিলে। জয়ন্তর কথা শুনে দিলীপবাবু বললেন হ্যাঁ কুমুদ কাকাদের নামে ওখানে শহীদ স্মারক তৈরী হবে। কি যে বল না! তোমার কোন পাড়াতুতো কাকা আর ষাট বছর আগের ভাষা-আন্দোলনের শহীদ যত্তসব ওল্ড ভ্যালুজ। আর তার জন্য শহরের মাঝখানে একেবারে ক্রিম পজিশনের একবিঘা জমি তুমি দান করে দিলে। একবার ভেবেছো জামিটার দাম কত? একবার পরামর্শও করলে না!

দিলীপবাবু ছেলের মুখের দিকে কিছুক্ষণ তাকিয়ে বললেন— জমির দামের হিসেব তাে করিনি, শুধু জানি যাঁদের আত্মত্যাগের বিনিময়ে আমার মাতৃভাষা মর্যাদা পেয়েছিল তাদের জীবনের দাম আমার জমির থেকে অনেক বেশী। এবার জয়ন্ত একটু রেগে বলে ওঠে – তােমাদের ঐ এক কথা-ভাষা-ভাষা। কি হবে ভাষা দিয়ে? কই আমি তো আমেরিকায় একটাও বাংলায় কথা বলি না। তোমার বৌমাও এখন ইংরেজীতেই বেশী স্বচ্ছন্দ্য। মেয়ে তো বাংলা বােঝেও না বলেও না। কই আমাদের কোন অসুবিধা হচ্ছে না বরং ইংরেজী ভাষা অনেক বেশী-স্মার্ট। ভাষা ধুয়ে জল খেলে তাে আর পেট ভরবে না। একটা ঠুনকো সেন্টিমেন্টের জন্য অত দামি জমিটা… না,কিছুই বলার নেই! দিলীপবাবু ছেলের কথা শুনে কি যেন ভাবেন। পরে আস্তে আস্তে অথচ বলিষ্ঠ স্বরে বললেন, “তুমি আই, বি. এমে অনেক টাকা মাইনের চাকুরে তুমিতাে আই.বি.এম সহ আরাে অনেক মাল্টিন্যাশনাল কোম্পানির মতাে ভাষার সাম্রাজ্যবাদী আগ্রাসন সমর্থন করাে। সমগ্র পৃথিবী যদি একটি মাত্র ভাষায় কথা বলে তাহলে কত সুবিধা বলাে নানা ভাষায় পণ্যের বিজ্ঞাপন দিতে হবেনা? নানা দেশের নানা ভাষার জন্য আলাদা আলাদা সেলসম্যান রাখতে হবেনা? কোম্পানির খরচ কমবে লাভের অঙ্ক বাড়বে। লাভ বাড়লে তােমরা উচ্চপদস্থ কর্মচারী তোমাদের মাইনেও নিশ্চয়ই বাড়বে। দিলীপবাবু আরও কিছু বলতে যাচ্ছিলেন সরমা তাকে থামিয়ে দিয়ে জয়ন্তর দিকে তাকিয়ে বললেন, “খােকা আমি বলি কি, আমাদের অবর্তমানে একবার এসে বােনের সাথে পরামর্শ করে যা করার করিস। মাঝে শুধু শুধু এসে টাকা এবং সময় নষ্ট করে লাভ কি!যা কোথায় যাবি বলছিলি সেখান থেকে ঘুরে আয়।

লেখা পাঠাতে পারেন

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *