ধারাবাহিকের পরবর্তী অংশ
নিমাই বন্দোপাধ্যায়
দিব্যত্রয়ী(এক)
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
আজকের পর্বের শিরোনাম ” দিব্যত্রয়ী “। অর্থাৎ
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ দেব, জগজ্জননী মা সারদা, আর বীর সন্ন্যাসী স্বামী বিবেকানন্দ মহারাজ আমাদের আজকের আলোচিত, সেই তিন মহান দিগন্ত বিস্তারী দিব্য চরিত্র।
এই জগত সংসারকে যাঁরা শুনিয়ে গেছেন তাঁদের
প্রত্যেকের আলাদা আলাদা অমৃতময় বানী যে,
” মানুষই অমৃতের সন্তান। ” তিন জনেই একই কথা বলেছেন তবে আলাদা আলাদা প্রেক্ষিতে।
স্বামীজী বলেছেন, ” মানুষই ঈশ্বরের পুত্র- কন্যা।তাদের মধ্যেই অনন্ত শক্তির ভান্ডার মজুত
আছে। দরকার তার সঠিক বিকাশ ঘটানো। তাই
তিনি বারবার বলে গেছেন ” ওঠো, জাগো, তোমার অন্তরের অফুরান শক্তির বিচ্ছুরণ ঘটাও।”
★★
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ ” মানুষ কী কম গা!
মাটি, পাথর, কাঠের, বাঁশের, খড়ের মূর্তিতে পূজা
হতে পারে, প্রার্থনা হতে পারে, উপাসনা হতে পারে, ভজনা হতে পারে আর রক্ত- মাংস- মজ্জার
জলজ্যান্ত মানুষের পূজা হবে না? ” বলেছেন, “জীবই শিব। শিব জ্ঞানে জীব সেবা। দয়া নয় কিন্ত। বলেছেন ” দয়া ” শব্দটিতে অহং মিশে আছে। অর্থাৎ অহংকার। আমি কাউকে দয়া করছি,সুতরাং আমি একটু ওপরের স্তরের মানুষ।
আর যাকে দয়া করছি, যে আমার উপকার নিচ্ছে
সে আমার চেয়ে নিচের ধাপের লোক। তাই দয়া
নয়। প্রেম। প্রেম- পূর্বক অন্তরের সেবা। ★ ঠাকুরের
ছিল অহৈতুকী স্নেহময় ভালবাসা। যদি কেউ
বলেছে “ঈশ্বর কী আছেন? ঐ যে ঘরের মধ্যে যিনি
সিংহাসনে বসে আছেন তাঁকে ডাকলে সাড়া পাওয়া যাবে? আমার বিশ্বাস হয় না। ” তাকে
ঠাকুর বলেছেন, উপদেশ দিয়েছেন দেখ “,তুই
এইভাবে প্রার্থনা করবি, হে ঠাকুর, তুমি ওই ঘরে
আছ কি নাই আমি জানিনা, তবু ” যদি ” থাকো,
তাহলে আমার কথা শোনো।”
কখনও কাউকে বলেননি যা, তোর যখন বিশ্বাসই
নেই, তুই একটা নাস্তিক, তুই যা মন্দির থেকে।
কখনো না। কাউকে না। গিরিশ ঘোষ কে বলেছেন, ” সারাদিনে একবার বসবি ঠাকুরের কাছে। ” গিরিশ মুখের ওপর বলে দিয়েছে পারব না।– সে কি রে? তাহলে সকালে উঠে তো একটু
সময় পাবি! না, না, সকাল কখন হয় কোথায় হয়
তারই ঠিক নেই! তাহলে? ঠাকুর চিন্তায় পড়ে
গেলেন। গিরিশের জন্যে। “তাহলে এক কাজ কর
তোর হয়ে আমি ঠাকুরকে ডাকব। তুই আমায় ব- কলমা দে। ”
কত মানব দরদী! কত ঈশ্বর- প্রেম! কত মানুষের
ওপর ভালবাসা। এই হলেন ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ।
আর মা সারদা কী বলে গেছেন? একই কথা।
তিন জনেই নিজের নিজের ভাবার্থে, নিজের নিজের দৃষ্টিতে, নিজের নিজের অভিধায় একই
“মানুষের” কথাই উল্লেখ করে গেছেন। মা সারদা
বলে গেছেন, ” আমি সত্যি কারের মা,কোনো
পাতানো মা নই, কথার কথা মা নই, সত্য জননী। ” আমিই তোমাদের মত সংসারী মানুষের একমাত্র
আপনজন। বলেছেন আমার সন্তানদের ক্ষতি করা, বিধির ও ক্ষমতা নেই। অর্থাৎ মা ‘ ই মানুষের
একান্ত আপন। গর্ভে ধরেন, জন্ম দেন, প্রথম আহার মুখে তুলে দেন, বলতে শেখান, চলতে
শেখান, জীবনের পথে প্রথম বন্ধু তিনিই। সঠিক
পথটা ও চিনিয়ে দেন। সব সময় মংগল কামনা
তিনিই করেন। সন্তানের মাথায় আশীর্বাদের শুভ-
ময় হাতটা ছুঁইয়ে দেন তিনিই। তাই মা সারদা
নিজেই ঘোষণা করছেন, ” সব সময় জানবে
আর কেউ না থাক, তোমার একজন ‘ মা’ আছেন।
★
আরও বলেছেন, ” মনের স্বভাবই নিচের দিকে
যাওয়া। উদাহরণ দিয়ে বলেছেন যেমন জল।
কিন্তু সূর্যদেবের তীব্র কিরন তাকে টেনে ওপরে
নিয়ে যায়। তেমনই মানুষকেও ঈশ্বরের পথে টেনে
নিতে হবে। আলোচনা সমালোচনা সবাই করতে
পারে, তাকে সঠিক পথ দেখাতে পারে ক’ জনে?
আমার ছেলে যদি ধুলোকাদা মাখে আমাকেই তো
ধুলো ঝেড়ে কোলে নিতে হবে! “
কী অসামান্য বানী শোনালেন সংসার- তাপিত
“মানুষদের।” তাঁরা প্রত্যেকেই মানুষের কথাই
ভেবেছেন। সমান ভাবে। ছোট বড় নেই। বড়
লোক বাড়ির গৃহিণী মায়ের কাছে যতটা কাছের,
একজন সমাজের পিছিয়ে পরা গরীব ঘরের মেয়েও মা সারদার কাছে সমান আদরের। তিনি
” সমদর্শী “। ” অমৃতদাত্রী “।
★★
তিনি নিজেই ছিলেন এক অনন্ত শক্তির আধার।
ঠাকুরের পার্ষদরা বলতেন, ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে
বুঝতে গেলে আগে স্বামীজীকে বুঝতে হবে।
আবার শ্রীমা সারদা দেবীকে জানতে গেলেও সেই
স্বামীজী মহারাজের দৃষ্টিকেই আমাদের অনুসরণ
করতে হবে। কেননা, স্বামীজীই একমাত্র ব্যাক্তি
যিনি ছিলেন ঠাকুরের এবং মায়ের মধ্যেকার
সেতুবন্ধ। এঁরা তিনে এক, আবার একে তিন।
এই মজবুত সেতুই সংসার- তাপিত মানুষদের
পূর্ণের অভিযাত্রায় পথ দেখাবে, বেঁধে দেবে,
আবার মিলিয়েও দেবে, এই সংসারের জটিল
আবর্তে। এই যাত্রার শেষ নাই। বস্তুত তাঁদের তিন
জনের কথা শুরু করলে আর শেষ হতে চায় না।
★★
মায়ের বাড়িতে, জয়রামবাটীতে, একদিন, একজন মুসলমান এসেছে পাশের গ্রাম থেকে। সে
আবার চুরি ডাকাতিও করে মাঝেসাঝে। সে
একছড়া পাকা কলা নিয়ে মা’ র কাছে এসেছে।
এসে বলছে, ” মা, মা গো, ঠাকুরের পূজোর জন্যে কটা পাকাকলা এনেছি, আমার গাছের।
নেবেন কী?”
ঘটনাটি আজ থেকে প্রায় দেড়শো বছর আগের। প্রিয় পাঠক, একটু ভেবে দেখুন – তখনকার সেই
সময় জাতপাতের এবং কুসংস্কারের কী ভীষন
প্রভাব ছিলো পল্লীগ্রামে। একদিকে দান গ্রহণ
করছেন কে? একজন ব্রাহ্মণ ঘরের বিধবা। আর
সেই দান করছেন একজন বিধর্মী এবং তার সঙ্গে
একজন চুরি ডাকাতি পেশার নিরক্ষর দরিদ্র মানুষ।
মা সারদা হাসিমুখে বলছেন, ” নেব বাবা, নেব
বইকী! ঠাকুরের সেবা’র জন্য এনেছ,তোমার
গাছের ফল। কেন নেব না? “
এ এক অচিন্তনীয় ও অভাবনীয় ঘটনা। এ এক
মহা বিপ্লব। জাতি ধর্ম বর্ন পেশা সব কিছুকে
সরিয়ে মা সারদা দেখিয়ে গেছেন ভালবাসার
থেকে মহার্ঘ্য আর কিছু নাই।জাতপাত সব নগন্য।
লোকটির হাত থেকে মা কলা’ কটি নিয়ে ঘরে
তুলে রেখে বললেন, ” চলে যেও না বাবা,দুটি
কিছু খেয়ে দাও। ” — বলে ঘরে গিয়ে কিছু মুড়ি
গুড় এনে তার গামছায় ঢেলে দিলেন। লোকটিও
পরম তৃপ্তিতে, আনন্দে ফিরে গেল নিজের গ্রামের
পথে।
আমাদের এই সমাজে এবং এই সংসারে
নিন্দুকের অভাব তখনও ছিলো না, আজ ও তার
অভাব নেই। এক অন্য মহিলা সেদিন সেই সময়
মা’য়ের কাছে উপস্থিত ছিলেন। মা সারদার একটা
সাংসারিক ” ভুল ” তিনি ধরে ফেলেছেন এই ভাবে
বলে উঠলেন, ” ওদের জিনিস ঠাকুরকে দিও না।
তাছাড়া ওরা চোর। মুসলমান। ওরা মন্দ বই ভাল
নয়। ওর ছোঁয়া কলা ঠাকুরকে দিও না।”
মা সারদা বললেন, ” জন্মেই কেউ মন্দ হয় না।
এই সংসারই তাকে মন্দ করে। দোষ তো মানুষের
লেগেই আছে। কী করে তাকে ভালো করতে হবে,
তা ক’ জন জানে ? জলের স্বভাবই তো নিচু
দিকে যাওয়া। সেই জলকে সূর্যকিরণ টেনে আকাশে তোলে। তেমনই ঠাকুরই ওর পরিবর্তন
ঘটাবেন। ”
কী অসামান্য দৃষ্টি! কী অপূর্ব কথা!
আর কী জগতবীক্ষার অনন্য দৃষ্টান্ত মা সারদা
রেখে গেলেন আমাদের সামনে! প্রভু যীশুর মত
তিনিও বলে গেলেন, ” আমি ধ্বংস করতে আসিনি, আমি পূর্ণ করতে এসেছি। আমি সৃষ্টি করতে এসেছি। আমি প্রেম বিলাতে এসেছি।
আমি সকল কে আপন করতে এসেছি। এ জগতে
কেউ পর নয় মা,সবাই তোমার আপনজন। আর জগতটাও তোমার আপন। “
চলবে…