সহজ মানুষ-সহজপাঠ

 

 

পরম হংস শ্রীরামকৃষ্ণ,স্বামীজি ও মা সারদাময়ী-র মতাদর্শ ও দর্শনের অন্য আলো নিয়ে লিখছেন–নিমাই বন্দোপাধ্যায় “ঈশ্বর প্রসঙ্গে “— বিভিন্ন গ্রন্থে, বিভিন্ন পত্র-পত্রিকায়, -মুনি-ঋষিদের কথায়, বাণীতে,প্রনম্য বহু অবতারদের, লেখক -সাহিত্যকদের লেখায় ও কথায় যা পড়েছি এ যাবৎ– সে গুলিই সহজ সরল ভাবে এখানে একত্র করেছি মাত্র। এর কোনোটিই এ অধমের পূর্ণাঙ্গ সৃষ্টি নয়।বলা যেতে পারে ” ছায়া অবলম্বনে “। আমার মতো একজন অর্বাচীনের এ স্পর্ধা কেন ঘটল ঈশ্বরই জানেন।আমি জানিনা।” ঠাকুর -মা-স্বামীজী মহারাজের শ্রীচরণ স্মরণ করে এ লেখায় উৎসাহিত হয়েছি,একথা স্বীকার করতে আমার কোনো বাধা নেই। আমি নিমাই বন্দোপাধ্যায়, দূর্গাপুর থেকে বাইফোকালিজম্ ওয়েব পত্রিকার সম্পাদকের অনুরোধে এবং উৎসাহে প্রতিদিন কিছু কিছু লেখা নিয়েই – এই তৎপরতা

ধারাবাহিক
পূর্ব প্রকাশিতের পর… 

সত্যরূপে সনাতনী

নি মা ই   ব ন্দো পা ধ্যা য়


সংসারের সার বস্ত হল – ঈশ্বরে অনুরাগ। ভগবানে
বিশ্বাস। তাঁর সম্পর্কে গভীর একটা বোধ। আর
ভক্তি। “ভক্তিতেই মুক্তি। ” ঠাকুর বলতেন”প্রহ্লাদের
মত ভক্তি। আর হনুমানের মত বিশ্বাস।” পিতা চান না পুত্র ঈশ্বরে অনুরক্ত হোক। কিন্তু পুত্র সর্বত্র নারায়ন দেখে। পিতা হিরন্যকশিপু দৈত্যরাজ। তাঁর সন্তান ঈশ্বরভজনা করবে? এখনি ওকে জ্বলন্ত অগ্নিতে নিক্ষেপ করো নতুবা পাগলা হাতির পায়ের তলায় ফেলো যাতে ওকে পিষে মারো।সাত/ আট বছরের প্রহ্লাদ, তখনো সে বালক, সে নতজানু হয়ে পিতাকে অনুরোধে করছে ” তুমিও ঈশ্বরে অনুরাগ
রাখো। তিনিই সর্বশক্তিমান। নারায়ন সর্বত্র। তোমার রাজসিংহাসনের পিছনে ওই যে স্ফটিক স্তম্ভ রয়েছে ওখানেও তিনি বর্তমান। হে নারায়ন, তুমি আমার পিতার ভুল ত্রুটি অহমিকা নৃশংস মনোভাব সব ক্ষমা শান্তি শুদ্ধতা সততায় আর সুন্দরতায় বদলে দাও। তোমার ক্ষমাসুন্দর চোখে। কী ধৈয্য ত্যাগ আর সাহস!কী ঈশ্বীরীয় আবেগ! ওইটুকু ছেলে সে ঈশ্বরের কাছে ভিক্ষা করছে, বলছে হে শঙ্খচক্রগদাপদ্মধারী নারায়ন, তুমি তো জানো আমার পিতা দাম্ভীক ধর্মহীন নৃসংস এবং বিধর্মী। তিনি সর্বদা অধর্মকে আশ্রয় করে আছেন। অন্যায়কে ধরে দিনযাপন করেন। তুমি নিজগুণে
তাঁকে ক্ষমা করে সনাতন পথ দেখাও। ধর্মের পথ
দেখাও। ন্যায়ের পথ দেখাও।


পুত্রের এমন আবেদনে হিরন্যকশিপু
আরও ক্রোধী হয়ে উঠে জল্লাদকে আদেশ দিলেন
এই মুহূর্তে পুত্রের প্রান সংহার করো। প্রথমে তীব্র
কষ্ট দাও, যাতে ও ঈশ্বরের নাম মুখে আনতেও
ভীত হয়। অত্যাচার করো বিভৎস ভাবে। তারপর
ও যদি ওই পথ পরিত্যাগ না করে তাহলে ওকে
হত্যা করো। দৈত্যরাজ জানতেন না ভক্তি, ক্ষমতা দখল করতে পারে কতটা। জানতেন না ভক্তির কাছে কতটা জোর সঞ্চিত থাকতে পারে। একটা বলশালী জল্লাদ একচুল ও নড়াতে পারে না
একটি বালকের দেহ। শুধু ভক্তির জোরে সে অটল। সে অচল। সে নির্লিপ্ত। সে নির্বিকার। সে এতটুকু ও ভীত নয়। জোড়হস্তে সে ঈশ্বরকেই ডেকে চলেছে… এ তো বালক রাজপুত্র নয়! বিস্ময়ে দু পা পিছিয়ে গেল হত্যাকারী। তার হাতের অস্ত্র কাঁপতে শুরু করলে। নির্মম জহ্লাদের মন কার যেন অদৃশ্য সরণি বেয়ে এসে, মমতায় মায়ায় করুনায় তছনছ করে দিচ্ছে। এ আমি কী দেখছি! এতো স্বর্গের শিশু। পারিজাত বনে ফুলের দলে খেলা করছে। সে তার হাতের খড়্গ ছুঁড়ে ফেলে দৌড়ে গিয়ে একমুঠো ফুল এনে দিচ্ছে ওই বালকের চরণে। ওই চরণ তো রাজপুত্রের নয়, ও তো শ্রীকৃষ্ণ স্বয়ং শংখচক্রগদাপদ্মধারী প্রভু শ্রীনারায়ন নিজে।। তাই ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ “ভক্তিতেই মুক্তি। “ভক্তিই সাধককে তার সাধনার সিদ্ধিতে পৌঁছে দিতে পারে। আর চাই” বিশ্বাস”।হনুমানের মত বিশ্বাস। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলেছেনঃ “দেখ, “জয় শ্রীরাম” বলে একলাফে বীর পবনপুত্র দুরন্ত সাগর পার হয়ে গেলো শুধু”ভক্তি” আর “বিশ্বাসের জোরে। আর মজার কথা হলো স্বয়ং রামচন্দ্র, যিনি পূর্ণব্রহ্ম নারায়ণ তাঁকে ওই একই সমুদ্র পেরতে সেতু বাঁধতে হলো। লীলা। একেই বলে লীলা। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এবং মা সারদা দুজনেই বলেছেন ” যার যেমন ভাব তার তেমন লাভ”। “যার যেমন মন তার তেমন ধন”। দুটোই একই অর্থ বহন করে। মানুষ তার প্রারব্ধ ফলাফলের অধীন। সুস্থ সুন্দর এবং সত্যজীবন যাপনে অভ্যস্থ মানুষজন, তাড়াতাড়ি ঈশ্বরাভিমুখী হতে পারেন।”সত্যে” আঁট থাকা চাই। ঠাকুর সারাজীবন এই সত্যকে ধরে সত্যের তপস্যা করে গেছেন।বলেছেন – সত্য কাউকে দেওয়া যায় না কেননা “সত্যই” ভগবান। “এই লও তোমার শুচি।এই লও তোমার অশুচি। আমায় শুদ্ধা ভক্তি দাও। এই লও তোমার ধর্ম, এই লও তোমার অধর্ম, আমায় শুদ্ধা ভক্তি দাও। এই লও তোমার পাপ, এই লও তোমার পুন্য, আমায় শুদ্ধা ভক্তি দাও। এই লও তোমার জ্ঞান, এই লও তোমার অজ্ঞান, আমায় শুদ্ধা ভক্তি দাও।” — ঠাকুর বলছেন জানিস? মা’ কে সব দিলাম। কিন্তু সত্য দিতে পারলাম না। সত্য দেওয়া যায় না। এই যে এত সব দিলাম, মা ভবতারিণীকে, এর মধ্যে “সত্য” না থাকলে সব দেওয়াই যে” মিথ্যে” হয়ে যাবে।

বলছেন ; “দেখ, আমি জ্ঞান পর্যন্ত চাই নাই, মাইরি বলছি, লোকমান্যি ও চাই নাই।” তাহলে কী চেয়েছেন? কিছুই চাননি। শুধু বলেছেন, ” আমাকে রসে – বশে রাখিস মা রে,আমাকে ‘ শুকনো সাধু ‘ করিস নে। তাহলে শুকনো সাধু কারা? যারা কৌপিন পরে, ধুনি জ্বালিয়ে, ছাইভস্ম সিঁদূর তিলক কপাল ভর্তি মেখে,চিমটে গেঁথে, প্যাঁকাটির মতো শরীরে, বসে, মুখে “জয়তারা” বা “ব্যোমভোলা” বলে হুংকার ছাড়ে – তারা। ঠাকুরের কী অসাধারণ বর্ননা। কী অসামান্য দৃষ্টি ভঙ্গি। ঠাকুর জানতেন ওই “শুকনো” সাধুরা সাধন ভজন নয়, শুধু দেখনদারিতে লোক ঠকায়। মানুষকে হাবিজাবি ধর্ম নিয়ে বিভ্রান্ত করে। পুকুর একটাই। কিন্তু ঘাট অনেক। ঈশ্বর এক।তাঁকে ডাকার পথ অনেক। “যত মত তত পথ”। – এটিই তাঁর জগদ্বিখ্যাত উক্তি। ঠাকুরের দর্শন হলো – ভগবানই সত্য। ঈশ্বরই নিত্য। বাকি সব অনিত্য বস্ত। ভগবানই এই ভূধরের আসল কান্ডারী। তাই তিনি – ঈশ্বর। সর্বদা আর সর্বত্র আছেন – তাই তিনি ভবনাথ। সর্ব সংহারক – তাই তিনি শিব। এই জড় জগত শিবময় – তাই তিনি সয়ম্ভূ। পশু ও পাশের রক্ষাকর্তা – তাই তিনি পশুপতি। সমস্ত বিশ্বে পূর্ণ হয়ে আছেন – তাই তিনি পুরুষ। সর্ব নিয়ন্তক – তাই তিনি জগতপিতা। সবার অন্তরে বিচরণ করেন – তাই তিনি অন্তর্যামী। আর ভজনের যোগ্য – তাই তিনি ভগবান।

চ ল বে

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *