ধারাবাহিক
সময় ও কর্ম
নি মা ই ব ন্দো পা ধ্যা য়
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ বলতেনঃ ” ধপ করে বা লাফিয়ে
ছাতে ওঠা যায় না। ধাপে ধাপে যেতে হয়। একটা –একটা করে, সিঁড়ি পেরতে হয়। নিয়ম মেনে এগোতে হয়,তারপর ছাত”। — তেমনই ঈশ্বরের দিকেও যেতে হয় ধর্মের নিয়ম মেনে। অধৈর্য হলে হবে না। লাফিয়ে ঝাঁপিয়ে কিচ্ছুটি হবার নয়। আর সব কর্মই সময় হলে আপনা থেকেই হয়। তারাহুরোর ফল – বিফল।অর্থাৎ বিফলে যায়। ”
ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ উপমা ও উদাহরনে সিদ্ধ। দৈনন্দিন জীবনচর্চায় আমরা যা দেখি, তিনি তাই তাঁর মত করে এতো সুন্দর কথায় এবং উপমায় বোঝাবেন, যা এক
কথায় ‘ অসাধারণ ‘। উদাহরণ দিয়ে বলেছেন –” কাঁচা ঘায়ের মামড়ি জোর করে তুলতে গেলে রক্তপাত হয়। ঘা শুকিয়ে এলে, সময় হলে, আপনাআপনি খসে যায়। যার ঘা, সে বুঝতেও পারে না “। কী অসামান্য অন্তর্নিহিত দৃষ্টিভঙ্গি ঠাকুরের। কাঁচা ঘায়ের সেরে ওঠা আর সময়ের নিজস্ব শুশ্রূষাকে সমান্তরাল সীমানায় এনে কী নিজস্ব ভঙ্গিতে বুঝিয়েছেন ‘ সময়ের’ গুরুত্ব কতখানি!
তেমনই ” ফল “। কাঁচা অবস্থায় গাছ থেকে পাড়লে- পচে নষ্ট হয়ে যায়। মানুষও খেতে পারে না, পাখিদের
ও ভোগে লাগে না। সময় হলে, পাকলে তারপর গাছ
থেকে পাড়লে সবাই খেতে পারে।
কত সুন্দর উপমায় ঠাকুর আমাদের বুঝিয়েছেন, “সময়” এক কঠিন সত্য।অমৃতময় সত্য। সময়ের আগে
যদি জোর খাটিয়ে কিছু করো, বা করতে যাও, তাহলে
ভোগের চেয়ে ‘ দুর্ভোগ’ হবে বেশি।
ঠাকুর যেমন নানা ঘরোয়া বিষয়ের তুলনা দিয়ে সময়ের গুরুত্ব বুঝিয়েছেন আামাদের মত গৃহবাসী
দের – ঠিক তেমনই, শ্রীকৃষ্ণ গীতাতে বলেছেন,সমগ্র
জগতবাসীকে, তাঁর সেই বিখ্যাত উক্তি ” কর্ম করে
যাও। সৎকর্ম। নিজের মত করে। ফল পাবে। তবে সেটি তোমার হাতে নেই। আছে ঈশ্বরের হাতে। ”
তোমরা যে সংসারে এসেছ, সেটাই ধর্ম পথে ধরে
থাকো। গৃহকে আশ্রম বানাও। আর সধর্মে রক্ষা করো। সংসার পথেই মানুষের সেবা করো। অবলা জীবের মুখে দুটো আহারের ব্যাবস্থা করো। তাহলেই ঈশ্বর খুশি হবেন। একহাতে সংসার করো, অন্যহাতে
ঈশ্বরকে ধরে থাকো। যখন ফুরসত হবে অবসর
পাবে তখন দু’হাতে ভগবানের শ্রীচরণকমলে নিজেকে সমর্পণ করে নির্লিপ্ত হয়ে সংসারে থাকবে।
এখানেও ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ একটি সুন্দর উদাহরণ
দিয়েছেন। বলেছেন – ” কচ্ছপের গল্প। কচ্ছপ ডিম
দেয় নদীর পাড়ে, তার পচ্ছন্দের কোনো গর্তের ভেতর। তারপর সে নিজে আবার জলে চলে যায় আহারের সন্ধানে। কিন্তু বেশি দূর যায় না। আগামী প্রজন্মের সুরক্ষার জন্য ওই জায়গাটির আশেপাশেই সতর্ক হ’য়ে ঘুরে বেড়ায়। ” অর্থাৎ তার মন ফেলে রাখে ডিমের আশেপাশে। অমনি তোমরাও সংসার করো আর মন ফেলে রাখো ঈশ্বরের চরনে। ”
কচ্ছপের ডিম পাহারা দেওয়ার সংগে কি অপূর্ব তুলনা টেনেছেন মানুষের মনকে কেমন করে ঈশ্বরের দিকে ঈশ্বরমুখী করা যায়, তার ইংগিত দিয়েছেন।
আমার ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা থেকে মনে হয় ঠাকুর
সবকিছুই অত্যন্ত গভীরে দেখতেন এক শিল্পীমন
নিয়ে। কবি মন নিয়ে। দার্শনিক মন নিয়ে। তারপর
তার স্বরূপ ব্যাখা করতেন সোজাসাপ্টা গ্রাম্য উপমায় — যা অনবদ্য এক দলিল হয়ে উঠত। তাঁর প্রতিটি ধর্মের কথা, শাস্ত্রের কথা, ধর্মীয় আচার-আচরনের কথা,সব সুন্দর সুন্দর উপমায় প্রাঞ্জল করে আমাদেরকে বুঝিয়ে গেছেন। আর সাহস যুগিয়ে বলেছেন – সময় কারোর জন্য বসে থাকে না। তাই সময় থাকতে লেগে পড়ো। তাঁর কৃপা হলে তিনিই সময় এগিয়ে দেবেন। যদি আন্তরিক হও, তাহলে “সময়” আপনিই এসে যাবে তোমার দুয়ারে। ভগবানই সময় এগিয়ে আনেন। “মা, আমার যখন প্রসব-বেদনা উঠবে, তখন আমাকে ডেকে দিস কিন্তু… এখন আমি ঘুমাতে যাচ্ছি। “মেয়ে শোবার ঘরে চলে গেল। মা বললেন,” যাও বাছা শোওগে, যাও। নিশ্চিন্তে ঘুমাও। তবে – তোমার যখন প্রসব বেদনা উঠবে তখন ওই বেদনাই তোমাকে ঘুৃম থেকে তুলবে,আমাকে ডাকতে হবে না। ”
এই জগত একটা নির্দিষ্ট প্রক্রিয়াতে চলে। সূর্য ওঠে
সকালে, সন্ধ্যায় অস্ত যায়। নদীতে জোয়ার- ভাঁটার
খেলা চলে। মানুষ জন্মায়, কেউ তাকে হাতে ধরে
হাঁটতে শেখায়। তারপর সে নিজেই হাঁটে। প্রয়োজনে
ছুটতেও পারে। কাউকে এসব বলে দিতে হয় না।
অনেকে কানে হাত দিয়ে অদৃশ্য গুরুর উদ্দেশ্যে সম্মান জানিয়ে বলেন, “আমি
অমুক গুরুর কাছে নাড়া বেঁধেছি। ” তেম্নি প্রসববেদনার ” নাড়া” সময় নামক গুরুর কাছে বাঁধা
পড়ে আছে। ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এখানে বুঝিয়েছেন,
যার সময় হয়েছে ঈশ্বরের ‘ বিশ্বরূপ’ দেখার বা জানার
তাকে ঈশ্বর নিজের কৃপাতেই চঞ্চল করে তোলেন। সে তখন পথভোলা মৌমাছির মত ঈশ্বর ঈশ্বর করে
বেড়ায়। তার তখন ঈশ্বর প্রসঙ্গ ভাল লাগে। তীর্থস্থান
ভালো লাগে। দেব দেবীর পূজা দর্শন ভালো লাগে।
যখন কোনো মানুষের হৃদয়ে দৈব- অস্তিত্বের সংকট
উপস্থিত হয়, তখন সেই মানুষটা যে অন্তহীন বিশ্বাসের
অদৃশ্য ‘ প্রতিষ্ঠানের ‘ওপর নির্ভরশীল হয়, সেই শীতল প্রতিষ্ঠানই আমাদের আলোকজ্জল ঈশ্বর। আমাদের আলোচিত ভগবান। জনৈক ভক্ত একবার দক্ষিনেশ্বরে, মা ভবতারিণীর বিগ্রহের সামনে মায়ের প্রতিমার গড়ন সম্পর্কে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণকে বলে ওঠেন” — শুনেছি, দাঁইহাটের বিখ্যাত শিল্পী নবীন ভাস্করের নির্মাণ এই মূর্তিটি।” ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ সংগে সংগে উত্তরে বলেনঃ ” তা তো জানি না বাপু, তবে এটা জানি ইনি চিন্ময়ী।”ভক্তটির কাছে দেবীর পূজা অর্চনা বন্দনা ভজনার চেয়ে মূর্তির উচ্চতা গঠন দেহভঙ্গি এবং কারুকাজ
বেশি প্রাধান্য পেয়েছে। সঙ্গত কারনেই ঠাকুর ক্ষুন্ন
হয়েছেন। এবং জবাবে বলেছেন “তা জানিনা, তবে
এটা জানি, ইনি চিন্ময়ী। ” এর আগেও আমরা ” কথামৃতে” পেয়েছি — কেউ ঠাকুরের কাছে এসেছে, তিনি ঈশ্বর কে নিয়ে নানা কথা বলছেন, কিন্তু সেই ব্যাক্তির মন অন্য কোথাও অন্যখানে পড়ে আছে। তখন ঠাকুর সেই মানুষটিকে বলছেন ঃ যাও, রানী রাসমনির বাগান দেখে এসো। বিল্ডিং দেখে এসো। গংগার দিকে একটু ঘুরে এসো। মন্দিরের কারুকাজ দেখে এসো। অর্থাৎ বোঝালেন তোমার এখনো সময় হয় নি। তোমার অন্তরজগত ফাঁকা, শূন্য। তুমি বহির্জগতের শোভাকে আশ্রয় করেই জীবন সার্থক করো।
দাঁইহাট, পূর্ব বর্ধমান জেলায় অবস্থিত এক বহু
পুরাতন জনপদ। সেখানকার বাসিন্দা নবীন ভাস্কর
সেই আমলের একজন অতি বিখ্যাত ভাস্কর্য- শিল্পী।
দক্ষিনেশ্বরের মা ভবতারিণীর মূর্তি ছাড়াও তিনি
আরও অনেক জাগ্রত দেবী মূর্তির নির্মাণ করেন। তার মধ্যে ওই জেলারই ক্ষীরগ্রামের ” মা যোগাদ্যার” মূর্তি অন্যতম। জনশ্রুতি অনুযায়ী ঃ — শিল্পী নবীন
ভাস্কর বারবার চেষ্টা করেও মা যোগাদ্যার কাঙ্ক্ষিত
মূর্তি তৈরি করতে না পেরে রাতের অন্ধকারে ফিরে
আসছিলেন। সেখানেই এক বড় পুকুরের পাড়ে তিনি দেখেন এক কিশোরী মেয়ে। মেয়েটি বলেন তুমি ফিরে গিয়ে মূর্তি তৈরি করো। কোথায় যাচ্ছ? ভাস্কর শুধান, তুমি কে? এখনো সকাল হয়নি, রাত থাকতে কেন উঠে এসেছ এই পুকুরের ধারে? কিশোরী উত্তরে বলেন “যে ভয়ে পালাও তুমি, সেই মা যোগাদ্যা আমি। ” তারপর শিল্পী মায়ের নির্দেশ মত ফিরে গিয়ে মায়ের মূর্তি তৈরি করেন। আজও সেই দেবী মূর্তির পূজা চলে আসছে…
এখানে একটু উল্লেখ করি — এই দাঁইহাটেই, নবীন
ভাস্করের বাড়ির নিকটেই একই পাড়ায় আমারও
পৈত্রিক ভিটা। আজও সেখানেই আমরা একত্রে থাকি।
চলবে
আগামী সোমবার ” সময় ও কর্ম ” র অন্তিম পর্ব।
শেষ হবে ঠাকুর শ্রীরামকৃষ্ণ এর একটি সুন্দর গল্প দিয়ে।