“৯ এর গেরো!” কলমেঃ অ রি ন্দ ম রা য়

অরিন্দম রায়, বর্তমানে সুইস ফেডারেল ইনস্টিটিউট অফ টেকনোলজি তে জলবায়ু পরিবর্তন এবং বায়ুদূষণ নিয়ে গবেষণারত। তাঁর গবেষণার বিষয় সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে তাঁর নিজস্ব ওয়েবসাইট ফলো করুন। www.sobujprithibi.in অরিন্দমের লেখা নিয়ে সেজে উঠল আজকের বাইফোকালিজম্-র পাতা।

৯ এর গেরো!

অ রি ন্দ ম   রা য়

 

 

খনও খেয়াল করেছেন কি যে শপিংমলগুলোতে বা আপনার পাড়ার সিংহিবাবুর শাড়ির দোকানে জিনিষের দাম ৯ দিয়ে শেষ হয় কেন? টিশার্ট ২৯৯, জিন্‌স ৫৯৯ এমনকি অনলাইন থেকে কেনা মোবাইল ফোনটার ও দাম ৪৯৯৯! কি আজব ব্যাপার বলুনতো! কেন, ৩০০, ৬০০ বা ৫০০০ রাখলে কি এমন মহাভারত অশুদ্ধ হচ্ছিল? এই তহ সেদিন এক বহুজাতিক পন্যের দোকানে দেখি বাঁধাকপি!! হ্যাঁ মশাই তাহলে আর বলছি কি, আমাদের নিরীহ গোবেচা্রা গোলগাল সবজি (আবার সবুজ ও বটে), যার ফলন নিয়ে কারো কোন মাথা ব্যাথা নেই (শুধু শীতকাল এলে একটু ষাঁড়গুলো দল বেঁধে ফুটবল খেলে)দেখি লেখা ৪৯ টাকা জোড়া!!


সময়টা ১৮৭০ এর মাঝামাঝি। বছর ত্রিশ এর এক তরুনের, যার বাবা আবার প্রটেস্টান্ট চার্চ এর উচ্চ পদাধিকারী, ঝোঁক চাপলো সাংবাদিক হবেন। প্রতিষ্ঠা করে বসলেন শিকাগো ডেইলি মেল। কিন্তু বিক্রিবাটা একদমই ভালো না। কি করা যায়? ভেবেচিন্তে বার করলেন এক উপায়। এক ডলার এর পরিবর্তে ৯৯ সেন্ট এ বিক্রি করবেন টার সংবাদপত্র। বলা ভালো তখনকার প্রতিদ্বন্দ্বী সংবাদপত্রের মুল্য ছিল এক ডলার। স্থানীয় বিক্রেতাদের খুচরো সমস্যা মেটানর জন্য টাঁকশাল থেকে পিপেতে করে আনালেন সেন্ট। বাকিটা ইতিহাস! হুহু করে বাড়তে লাগল তার খবরের কাগজ। বলা হয় তিনিই নাকি এই ৯ এর গেরোতে আমাদের প্রথম ফেলেন।
ব্যাপারটা তাহলে একটু খুলে বলা যাক। ধরুন আপনি সাধারন মধ্যবিত্ত। গিন্নির গুঁতোয় বেড়াতে যাবেন বলে ট্রাভেল এজেন্টকে ধরলেন। সে সব শুনে বলল আপনার বাজেট যা তাতে ডুয়ার্স বা পুরী যেতে পারেন। এবার সমস্যা হল আপনি মধ্যবিত্ত। শিবুর চায়ের দোকানে বা আপনার অফিস এর সহকর্মীদের কথা শুনে আপনি মহা দোটানায়। কেউ বলছে ডুয়ার্স দারুন জায়গা দাদা! গণ্ডার লেজ গুটিয়ে জল খেতে আসবে হোটেলের সামনে। আবার কেউ বলছে কি দরকার দাদা অন্য কোথাও! পুরীর সমুদ্র দশবার গেলেও পুরনো হয় না! আপনাকে এই সময় যদি জিজ্ঞেস করা হয়, ছয় বার এর মধ্যে আপনি তিনবার পুরী যাবেন বলবেন আর তিনবার ডুয়ার্স! এখন ট্রাভেল এজেন্ট আপনাকে ফোন করে বলল দাদা দিঘা যাবেন? ওখানে ব্রেকফাস্টটা ফ্রীতে করে দেব। এবারে আপনি দশবার এর মধ্যে নয়বার গিন্নিকে বলবেন চলো দিঘা ঘুরে আসি গিন্নী!
আমাদের ৯ এর গেরোটাও খানিকটা একই রকম। শিকাগো বিশ্ববিদ্যালয় আর ম্যাসাচুয়েটস ইন্সিটিউট অফ টেকনোলজি এর দুই গবেষক একই পোশাকের দাম এর সামান্য কম বেশি করে আশ্চর্য ফল পেয়েছেন। একই সাথে রাখা একই পোশাক তিনরকম দামে বিক্রি করার সময় তারা দেখলেন ৩৯ ডলারের পোশাকের কাটতি সবথেকে বেশি।শুধু তাই নয় ৩৯ ডলারের পোশাক ৩৪ ডলারে পেলেও লোকে তা কিনছে না।
এবারে তারা একই পরীক্ষা করলেন শুধু আগের বছরের বেঁচে যাওয়া কাপড় নিয়ে। দেখলেন এবার কিন্তু কাটতি অতটা না। কিন্তু এরা ৯ এর গেরোর কারন সম্পর্কে কোন আলোকপাত করতে পারলেন না। যাই হোক এরপর এদের কাজ এর সুত্র ধরে নিউইয়র্ক বিশ্ববিদ্যালয়ের এক ছাত্র মনোজ থমাস খানিকটা আলাদা রকমের পরীক্ষা নিরীক্ষা চালালেন। ৩.৬০ ডলারের পেন আর ৩.৫৯ ডলারের একই পেন বাছতে দিলেন বিশ্ববিদ্যালয়ের ছাত্রছাত্রিদের। কিন্তু অদ্ভুত ভাবে এবারে কিন্তু বিক্রির কোন তারতম্য দেখা গেলনা। কি হল তাহলে? ৯ এর গেরো কি ফস্কে গেল?
আসলে না। আরও কিছু পরীক্ষা নিরীক্ষা করে মনোজ বললেন ৯ এর গেরো তখনই কাজ করবে যখন কিনা সবথেকে বামদিকের সংখ্যাটির তারতম্য হবে। অর্থাৎ কিনা ২.৯৯ ডলারের পেন লোকে ৩.০০ ডলারের থেকে বেশি কিনতে পছন্দ করছে কিন্তু ২.৬০ ডলারের পেন ২.৫৯ ডলারের পেন পছন্দ করছে না। এই প্রসঙ্গে এক ব্যাক্তিগত অভিজ্ঞতা বলি। সদ্য পুজোর বাজার থেকে ফেরা এক বন্ধুকে জিজ্ঞেস করলাম ‘ কি রে এই জিন্‌স টা কত পড়ল?’ সে বলল ‘৯০০ টাকা, সস্তা হয়েছে না!’ প্রাইস ট্যাগ এ দেখি লেখা আছে ৯৯৯ টাকা! সেটা দেখাতে বন্ধুটি বলল ‘ ওই হল আর কি’।
একটু ভেবে বলুন তো, এই ৯ এর গেরোর কোন জিনিষ কিনতে গিয়ে বাকি ১ টাকা ফেরত চেয়েছেন কি? আসলে ৯৯৯ টাকা দিয়ে একটা জিন্‌স কেনার পর আমরা বেশিরভাগ সময়ই হাজার টাকার নোট দিয়ে বিল নিয়ে বেরিয়ে চলে আসি। কখনও বা কেউ (আমার এক জেঠু যিনি পিঁপড়ে চিনির দানা খেয়ে নিয়েছিল বলে তাকে চায়ে ডুবিয়ে খেয়েছিলেন, তিনি ও এই গোত্রে পড়েন) সেই একটাকা ফেরত চাইলে মিষ্টি হেসে লিপস্টিক সজ্জিত মধ্যবয়সী মহিলা বলেন ‘স্যার, খুচরো নেই’। এবার ভাবুন কোন এক শপিং মল এ প্রতিদিন অন্তত ১০০০ জন এই ৯ এর গেরোতে পড়েন। মানে গোটা বছরে তিন লক্ষ্য পঁয়ষট্টি হাজার টাকা। আর সেই বহুজাতিক মল এর ভারতীয় শাখা যদি ১৫০০ টাও হয় প্রায় ৫৪ কোটি টাকা! সমস্যাটা হল এই পুরো টাকাটাই করমুক্ত কারন আপনার বিলটিতে দাম কিন্তু ১০০০ নয় ৯৯৯ লেখা আছে!


রটজার বিশ্ববিদ্যালয়ের ডঃ শিন্ডলার দীর্ঘদিন যাবদ এই ৯ এর গেরো নিয়ে গবেষণা করছেন। তিনি সরাসরি সেই গ্রাহকদের সাথে কথা বলেছেন যারা কিনা এই ৯ এর গেরোতে পরেছেন। এক বিশাল সংখ্যক গ্রাহকের সাথে কথা বলে তিনি এক চমৎকার সিধান্তে পৌঁছেছেন। ক্রেতাদের বেশিরভাগেরই ধারনা বিক্রয়মুল্যের শেষে ৯ বা ৯৯ থাকা মানেই সেল চলছে সেই জিনিষের! প্রায় দুহাজারের কাছাকাছি পন্যের ওপর সমীক্ষা চালিয়ে তিনি দেখেছেন ৯ এর গেরো এবং ‘বোধহয় ছাড় দেওয়া হচ্ছে’ এই মানসিকতার পরিস্কার সম্পরক রয়েছে। আর শুধু বাঙ্গালীকে দোষ দিয়ে লাভ নেই, ছাড় দেওয়া হচ্ছে শুনলে সব দেশের বেশিরভাগ মানুষেরই মাথা ঘুরে যায়!
কাজেই বোঝাই যাচ্ছে যে নয় নয় করে অনেকেই না জেনে নয় এর গেরোতে পড়ে। কিন্তু এর কারণতা কি? বিখ্যাত সংবাদপত্র ‘দ্য গার্জিয়ান’ এর করা সমীক্ষাতে ৯ কে অনেক পেছনে ফেলে ৭ বেশিরভাগ মানুষের পছন্দের সংখ্যা বলে প্রমানিত। তাহলে ৭ এর গেরোতে না পড়ে আমরা ৯ এর গেরোতে পড়ি কেন? সংখ্যাতত্ত্বের মনস্তত্ত্ব নিয়ে গবেষণা করা বিখ্যাত গবেষক প্রোফেসর দেহেনের মতে ৯৯৯ কে ৯০০ ভাবা বা ৫৯৯ কে ৫০০ ভাবার সময়টা ভীষণই ক্ষুদ্র। অর্থাৎ মুহূর্তের ১০০ ভাগেরও কম সময়ে আমরা মনের মধ্যে এই ৯৯৯ কে ৯০০ ভেবে ফেলি। এবারে যেহেতু আমরা বা্মদিক থেকে ডানদিকে পরতে অভ্যস্ত সেহেতু সবথেকে বামদিকে থাকা সংখ্যাটাই আমাদের মনের গভীরে ঢুকে যায়। অবচেতন মনে আমরা ডানদিকের থাকা বাকি সংখ্যাগুলি বাদ দিয়ে ফেলি।
কিন্তু ৯ এর গেরোও মাঝে মাঝে ঢিলে যায়। যেসব জিনিষের দাম অনেক বেশি। মানে ধরুন আপনি গাড়ি কিনতে গেছেন বা একটা পুরনো পেইন্টিং সেক্ষেত্রে কিন্তু এই নয় এর গেরো খাটবে না। তখন যেহেতু মান এর সাথে সমঝোতা করছেন না তাই আপনি খুব সহজে নয় এর গেরোতে পরবেন না। কাজেই দৈনন্দিন জীবনে কেনাকাটির সময় ৯ এর গেরো থেকে সাবধান!

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *