চিরসময়ের কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর কবিতা এক অদ্ভুত গোধূলি :
হী র ক ব ন্দ্যো পা ধ্যা য়
Wordsworth বলেছিলেন : Emotion recollected in tranquility.
কবিতায় আবেগ সংযত করতে হবে।জীবনানন্দ ও পারেন নি তার রূপসী বাংলার কবিতাগুলি তার প্রকৃষ্ট উদাহরণ।অথচ মজার ব্যাপার হল এই যে ,আলোকসরকার যখন …উতল নির্জন..
প্রকাশের পর জীবনানন্দকে এক কপি দেন তখনও কবি বলেছিলেন আবেগ সংযত করার কথা আলোক সরকারকে।
প্রণবেন্দু অথচ চিরদিন মিতকথনে বিশ্বাসী।কবিতায় নিজেকেই শাসন করা, চুপ করতে বলা।
পঞ্চাশের দশকে যে সব কবি তাদের লেখায় নিজস্ব ভাষা খুঁজে পেয়েছিলেন তাদের মধ্যে
শঙ্খ অলোকরঞ্জন উৎপলকুমার বিনয় আলোক এবং অবশ্যই প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত।অন্যদিকে জনপ্রিয়তার শীর্ষে তখন সুনীল শক্তি তারাপদ শরৎকুমার রা।
বুদ্ধদেব বসু অবশ্য প্রণবেন্দুর লেখা সম্পর্কে বলেছেন স্থিতধী এবং ধীমান।
প্রণবেন্দু যখন লিখতে এলেন, স্বাধীনতা পরবর্তী দেশকালের পরিস্থিতি জটিল, রাজনৈতিক স্থিতিশীলতা বিনষ্ট এবং বৃহৎ ভাঙনের সূচনাপর্বে টালমাটাল অবস্থা।
বাংলা তথা ভারতের রাজনৈতিক এবং সমাজনৈতিক আঙিনায় নানান খন্ডতা,সমগ্রের
দিকে যাওয়ার বাধা সেই সঙ্গে ব্যক্তিকেন্দ্রিক অস্তিত্ব সম্পর্কে সংশয়।দিগন্তপ্রসারি প্রশ্নমনস্কতাএবং সমস্যার স্বরূপ উদ্ঘাটন, সত্তার যন্ত্রণা সম্পর্কিত অনুভূতি প্রবণতা, আত্মবিলোপ নয় অভিজ্ঞতার ভিন্নমুখিনতা
প্রণবেন্দুর কবিতায় বারবার ফুটে উঠেছে অথচ তা কখনোই কষ্টকল্পিত হয়ে ওঠে নি।
…বাড়ির বিষয়ে/আমি খুব কম জানি/বন্ধুরা খুব বড়লোক নয়,/তারা পায়রার খোপের মতো/সাময়িক রন্ধ্রে বাস করে।/আমাদের দেখা হয় /সমবায় শখের চাতালে/…/বাড়ির বিষয়ে আমি এত কম জানি /যে কোনো বৃষ্টি এলে /আমার স্বদেশ ঝরে, টের পাই/আমি ছত্রহীন কোনো অনিবারনীয় /হাভাতে নেশার ঘোরে/ভিজে সার হ ই/সমস্ত কুকুর ভেজে ,বাড়ি ভেজে/নক্ষত্রবিহীন কোনো চতুষ্কোণ নীরবতা ভেঙে/আমার শরীর ছেড়ে হৃদয় আদুল হয়ে,/বাদল
পোহায়…।
(বাড়ি বিষয়ে#অংশ#সদর স্ট্রিটের বারান্দা#প্রণবেন্দু দাশগুপ্ত)
আসলে লজিক্যাল ভ্যালিডিটিতে বিশ্বাস করতেন কবি।বিষ্ণু দে র কবিতায় যা বিশেষ করে দেখা যায়।ইনটেলেকচুয়াল।সম্পূর্ণতার দিকে তাকিয়ে থাকা।আসলে ঢেউ যখন আসে তখন মূল স্রোতের ধাক্কা তো সহ্য করেন কবি।
প্রণবেন্দুর ভাষ্যে কোথাও কোনো জ্ঞান দেওয়া নেই।আছে সহজ সরল বিশ্বাসে আপ্লুত বোধ আর আশ্চর্য এক অভিমান।
…খুব বেশিক্ষণ আমি আলো দিতে শিখিনি এখনো/আমার নিজের কিছু অন্ধকার আছে/কিছু দ্বিধা কিছু অসুবিধা…..
(#এইখানে#অংশ#শুধু বিচ্ছিন্নতা নয়)
এটা একটা ঐতিহাসিক ব্যাপার যে প্রণবেন্দুর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ,(এক ঋতু) প্রকাশিত হয় শতভিষা থেকে।সেটা১৯৫৬ সাল। বলাই বাহুল্য
বন্ধুবর আলোক সরকার এবং বিশ্বপথিক অলোকরঞ্জন খুব যত্ন নিয়ে ছেপেছিলেন এই ব ই টি।এরপর যখন কৃত্তিবাস আন্দোলন খুব জোরদার হলো, তখন তার সদর স্ট্রিটের বারান্দা, কাব্যটি প্রকাশিত হয় ১৯৬৩ সালে
সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়ের বিশেষ আগ্রহে।এবং সবচেয়ে মজার ব্যাপার কৃত্তিবাস প্রকাশনা থেকেই।প্রকাশিত হ ওয়া মাত্র তা অত্যন্ত সাড়া ফেলে দেয়।সৌভাগ্য বা দুর্ভাগ্য যাইহোক ব ইটির
পজিটিভ সমালোচনাসঙ্গে সঙ্গে প্রণবেন্দুর কবিতা জনপ্রিয়তার শীর্ষে নিয়ে চলে যায় বিভিন্ন সাময়িক পত্র দ্বারা।
সঞ্জয় ভট্টাচার্য বীরেন্দ্রনাথ চট্টোপাধ্যায় স্বীকার করলেন তিনি একজন কবি বটেন।তবু কেন কবি লিখেছিলেন,..
.. একটা কথা জানতে আমায় হবে/ওরা আমায় পাহাড় থেকে/গড়িয়ে ঠেলে দিল কেন ? /…/ মরে যেতে যেতেও দেখব
,কোনো নদীর জলে এসে/ওদের ছায়া লজ্জা হয়ে কাপে কীনা…
(অপেক্ষা# অংশ# সদর স্ট্রিটের বারান্দা।)
তাহলে কী কোথাও কোনো ঈর্ষাপরায়ণতা বা পরশ্রীকাতরতার আচ সমসাময়িক বন্ধুদের কাছে লক্ষ্য করেছেন কবি।যে সময়ের কথা বলছি, কবিতার তখন বদল চলছে।নির্মাণ বিনির্মাণ চলছে।তিনি নিজেই বলেছেন, জীবনানন্দ দাশ,বিষ্ণু দে,সুধীন্দ্রনাথ দত্ত, অমিয় চক্রবর্তী এমনকি বুদ্ধদেব বসুর লেখাও তার ভালো লাগতো।এমনকি বিষ্ণু দের সাহিত্য পত্রে
তার লেখা ছাপা হয়েছে।বুদ্ধদেব বসুর ,কবিতা পত্রিকায়তো নিয়মিত ছাপা হচ্ছে তার কবিতা।
আলোক সরকার স্বয়ং বলেছেন, সেটা ছিল ১৯৫৩–৫৪ সাল আমি অলোকের, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্তর বাড়ি নিয়মিত যেতাম, সেখানে কবি প্রণবেন্দু দাশগুপ্তর সঙ্গে আমার
প্রথম পরিচয় হয়, আলাপের সঙ্গে সঙ্গে ই
খুব ঘনিষ্ঠতা বাড়ে,বন্ধুত্ব হয়।অলোকরঞ্জনের যৌবন বাউল… এর কবিতা শুনে আমি অবাক হতাম,বুঝতে পারতাম এগুলো অলোকরঞ্জনের নিজস্ব কবিতা হয়ে উঠছে।প্রণবেন্দুর তখন ও কোনো ব ই বেরোয় নি।প্রকাশের আগেই
সদর স্ট্রিটের বারান্দার কবিতা গুলি শুনেছি।
কিন্তু পরবর্তীতে প্রণবেন্দু কেন বন্ধুদের কাছ থেকে বিচ্ছিন্ন হয়ে যাচ্ছেন ক্রমাগত।প্রকৃত অবি কি ভালোবাসে একার সন্ন্যাস।
অথচ কবিতো বন্ধুত্ব চেয়েছেন, ভালোবাসা চেয়েছেন, হীন ঈর্ষা তো তিনি চান নি।
এ প্রসঙ্গে বলাই বাহুল্য কবি সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়
একবার বলেছিলেন,…. আমি পিঠ ফেরাতেই
বন্ধুরা ঢেলেছে বিষ,সেই বিষে আমার স্বাস্থ্য ভালো হয়েছে।…
এ অবশ্য অন্য কথা।
কবি সত্তার গভীরে যে সুর তার সৌন্দর্য ধ্বনি, অনুসন্ধান প্রণবেন্দুর কবিতায় তা বিস্ময়কর,তার সৃষ্টিকে চিহ্নিত করা রীতিমতো দুরূহ ব্যাপার।
…লাল ঘুড়ি বুকের ওপরে ঠেকে যায়।
তুমি কোনদিক থেকে সূতো পাঠিয়েছো?
তোমার রঙিন ঘুড়ি, হে কিশোর,
আমি আজ ফেরত দেব না–
ছাতে গিয়ে ,ওড়াব আকাশে…
(অংশ#রবিবার#প্রণবেন্দু)
যতদিন বেঁচে থাকবে বাংলা কবিতা ততোদিন
পাঠকের একান্ত মননে থাকবেন প্রণবেন্দুর কবিতা।
।।সমাপ্ত।।