অজ্ঞানীর ধারাভাষ্য
ছবি গৌতম মাহাতো
লিখছেন নীতা বিশ্বাস
মূলতঃ কবি।তবে গদ্যে তিনি অপ্রতিরোধ্য।লিটল ম্যাগাজিনই তাঁর একমাত্র মুক্তি।দীর্ঘকাল রাজ্যের বাইরে থেকেও বাংলাই তার প্রান ও টান।
আজ সকালে একদল পিপিলিকার কাণ্ডকারখানা দেখিলাম। কাণ্ডরও আবার কারখানা থাকে! থাকে বৈ কি? সেই কারখানায় কাণ্ড প্রস্তুত হয়। চাহিদা মত সাপলাই। সপ্তকান্ড, অষ্টাদশ কান্ড… যে যেমন চায়! আসলে কারখানায় কাণ্ডগুলি আগে কাহারও মস্তিষ্ক হইতে প্রসূত হইয়া কারখানায় ফ্রেম ও স্ট্রাকচার প্রাপ্ত হয়। তারপর সেই অনুসারে ঘটনা ঘটিতে থাকে। আর্ষদৃষ্টির এ এক অপরূপ! অপরূপ শব্দটির অর্থ আমি ঠিক বুঝিতে পারিনা! ‘অপদার্থ’ অর্থ যদি খারাপ পদার্থ হয়, ‘অপমান’ যদি মান-মর্যাদায় আঘাত করা হয়, তবে ‘অপরূপ’ সেই অর্থে রূপের বিকার, এককথায় কুৎসিত হওয়া উচিত! তবু ভবসংসারে সুন্দরের অতি-বিশেষণ হিসাবে ‘অপরূপ’ শব্দটি ব্যবহৃত হয়। যুক্তিবাদকে বাদ দিয়া এইরূপ কত কিছুই যে চলিয়া আসিতেছে! বুঝিনা বলিলে পাণিনি মহাশয় আসিয়া আমায় এক থাপ্পড় মারিয়া বলিবেন যে নিপাতনে সিদ্ধ বলিয়া একটা ব্যপার আছে, জাননা গণ্ডমূর্খ! চড় খাইয়া আমার বোধোদয় হইবে যে আলু কাঁচকলা ছাড়া নিম্ন মধ্যবিত্তের ঝুড়িতে ‘নিপাতন’ নামে কোনো বিশেষ সবজি আছে যাহা সিদ্ধ করিয়া খাওয়া যায়! সে বুঝি কোনো উপাদেয় মহার্ঘ মহামূল্য সবজি হইবে! বস্তুতঃ অনেক কিছুই এইরকম আছে যাহা না গিলাইয়া দিলে আমরা গিলিতেই জানি না। যেমন আমাদের গেলানো হইয়াছে আগে রামায়ণ নামক সপ্তকাণ্ড-সম্বলিত কাহিনী-ছকটি বাল্মীকির কারখানায় প্রস্তুত হইয়াছে। কাহিনী মোতাবেক সব চরিত্রদের জন্ম দেওয়া হইয়াছে। তাহাও আবার ‘চরু’র গুণ ও মান রাখিতে। নিপাতন কি ইহাকেই বলে? হইবেও বা! যজ্ঞের পায়েসান্ন খাইয়া শিশুর জন্ম দেওয়া! ইহাও কি নিপাতনে সিদ্ধ হয়!
যাহাহউক, ছোটমুখে এইসব অবৈজ্ঞানিক কথা লইয়া প্রশ্ন তোলা মানায় না। ভাদুড়ী মহাশয় আসিয়া আমার টুঁটি ধরিয়া বাড়ির বাহিরে বার করিয়া দিতেই পারেন। তিনি আমাকে অর্বাচীন বলিয়া গালি দিলেও তাঁহার ‘কথা অমৃতসমান’ ধারাবাহিক বাড়িতে আমিই সর্বপ্রথমে পড়িয়া লই। ওঃ! কি বলিতে আসিয়া কি বলিতে বসিয়াছি! এই জন্যই প্রসন্নময়ী বলিত আফিম এ্যাডিক্টেড মানুষের কোনো তালজ্ঞান নাই। কেবল বেতালা বকবক। যা বলিতে আসিয়াছে তাহা ভুলিয়া গিয়া…!
বৃদ্ধ মানিয়া আমায় ক্ষমা করিবেন মহাশয় মহাশয়াগন। তো যা বলিতেছিলাম। পিপিলিকার কাহিনী ও কান্ড কারখানার কথা। আফিম একটু লইয়াছিলাম বটে, তবে তাহা এমন কিছু বেশী মাত্রায় নয়। বলিতেছিলাম, আজকাল বৃষ্টি-বাদলায় একপ্রকার পোকার উৎপাৎ বড্ড বাড়িয়া গিয়াছে। পোকাটিকে চিনিলেন কি? চিনেন নাই? ওই যেগুলি পিড়িং করিয়া লাফাইয়া হঠাৎ আপনার ঘাড়ে হাতে অথবা আপনার শরীরের যে কোনো সেন্সিটিভ স্থানে আচমকা বসিয়া কুটকুট করিয়া আপনাকে ব্যতিব্যস্ত করিয়া তোলে, যেন বসিবার আর জায়গা পায় নাই আপনার ঘরে! আপনিও রাগে একটি পিড়িং দিয়া উহাকে ঝাড়িয়া ফেলিয়া নারকোল-ঝাড়ুটি লইয়া পোজ দিয়াছেন, মুহুর্তে দেখিলেন সে তথায় নাই। একটু আড়ালে। আড়াল ভেদ করিয়া দেখিয়া যদিও তাহাকে ফোরফ্রন্টে আনিলেন এবং ঝাঁটাটি দিয়া তাবড় এক বাড়ি মারিলেন, (না না, মর শালা বলেন নাই। যাহাকে তাহাকে কি শালার মর্যাদা দেওয়া যায়), ঝটিতি ঝাঁটার ফাঁক গলিয়া পিড়িং দিয়া সে আপনার বিছানাটিতে আরাম করিয়া বসিল। আ-স্তে ঝাঁটা উঠাইয়া উহার মৃতদেহ খুঁজিতে তৎপর আপনি দেখিলেন শূন্য মেঝেতে মোলায়েম টাইলস গুলি অযথা ঝাঁটার বাড়ি খাইয়া রাগিয়া উঠিইয়াছে। ঝাঁটার ফাঁক ফোকর গলিয়া উচ্চিংড়ে পুঙ্গব আপনার কার্লঅন এর গদির বিছানার ওপর দিব্যি আরামে বসিয়া চোখ মিচকাইয়া হাসিতেছে। দেখিয়া আপনার গা-পিত্তি জ্বলিয়া উঠিয়াছে। উঠিবেই। তবু আপনি দাঁতে দাঁত কষিয়া ‘শা-ল্লা’ বলিতে পারিতেছেন না। আপনি বারংবার পোজ লইয়া টারগেট ঠিক করিতে করিতে হাঁফাইয়া পড়িয়াছেন। সে দয়া করিয়া একটু লুকাইয়া আপনারই খাটের তলায় অপেক্ষারত। শ্রান্ত আপনি তাহাকে না দেখিতে পাইয়া নিশ্চিন্তে আলোটি নিভাইয়া শুইয়া পড়িলেই সে একটি মহাপিড়িং দিয়া আপনার গা-মাথা-চোখ-কান খরখর পদক্ষেপে অতিষ্ঠ করিয়া তুলিবে। সমাজে এইপ্রকার পোকা প্রচুর আছে যাহারা বিনা মতলব নির্দ্বিধায় অন্যকে নিপীড়ন জ্বালাতন করিয়া সুখ পায়। অন্যের শরীরে যৌনাঙ্গে সুচ ফুটাইয়া তৃপ্তি পায়। বস্তুতঃ এইসব ধর্ষকামীতে পৃথিবী ভরিয়া উঠিয়াছে। তাহাদের এই সকল কান্ডকারখানা চ্যানেলে চ্যানেলে বেচিয়া রিপোর্টার জার্নালিস্ট ফ্রিল্যান্সারদের দিব্যি পেট চলে।
তো এইরকম অতিপাজী একটি পোকা, মাত্র দুই কি আড়াই সেন্টিমিটার লম্বা, আমার বাথরুমে কি করিয়া যেন লাশ হইয়া পড়িয়াছিল। উহাকে ঘিরিয়া আমার ঘরের তাবৎ পিপিলিকা কুল জুটিয়াছে দেখিলাম। স্নান ভুলিয়া আমি উহাদের কান্ডকারখানা দেখিতে নিবিষ্ট। এমনিতেই পিপড়া জাতি সবসময় ব্যাস্ত হইয়া চলাফেরায় অভ্যস্থ। তাহাদের এই সদাব্যাস্ততার গুণ যদি সরকারী চাকুরেরা শিখিত! আহা! দেশটি বদলাইয়া যাইতো! তো উহার ডেডবডি ঘিরিয়া একদল গেরুয়া পিপড়া (মনে হয় উহারা মৃতকে আগে দেখিয়া ছিল)মুখ লাগাইয়াছে। উহাদের তো সকল কার্য মুখ দিয়াই! হাত লাগাইতে জানেনা উহারা, জান লাগাইতে জানে। সকলে মুখ দিয়া মৃতদেহ উঠাইয়া লইয়াছে। এইবার হরিবোল ধ্বণি দিয়া যেই উপরে তুলিয়াছে (তুলিবার আগে অবশ্য একটি গুরুত্বপূর্ণ মিটিং সারিয়া লইয়াছে, কোন কোন রাস্তা দিয়া উহারা শোভাযাত্রা করিবে ইত্যাদি অমনি একদল লালপিঁপড়া গন্ডগোল পাকাইল। গেরুয়া গুলা মৃতদেহ লইয়া উহাদের সহিত হাইড এ্যান্ড সিক খেলিতে লাগিলো। লালফৌজও উহাদের সহিত সমভাবে দিক বদলাইতেছে। কেউ কাহাকেও আধা সেন্টিমিটার জায়গা ছাড়িতেছেনা। সে এক দেখিবার মত খেলা বটে! কয়েকটি গেরুয়া কর্মীপিঁপড়া ফিসফিস করিয়া বলিল, এই জন্যেই তো বলেছিলাম হরিধ্বণি দিসনা। চুপচাপ সরিয়ে নিই চল! তা এ বেনোজল গুলো আমাদের মত ভেটরেন দের কথা শুনলে তো! এখন বোঝ্ শালা! ওপাশ হইতে কতকগুলা বেনোজল গেরুয়া বলিল, হরিধ্বণি না দিলে পাবলিক বুঝবে কি’করে যে এটা আমাদের পার্টির লাশ! ফালতু গজগজ কোরোনা দাদা! রাম হরিতে ভক্তি কোন পার্টির আছে, আমরা ছাড়া?
একথা শুনিয়া লাল পিঁপড়ার দল হুল বাগাইয়া ফটাফট পিস্তল বার করিয়া—মানছি না মানবো না/ এ রাজ্যে গেরুয়া জুলুম চলবেনা চলবেনা।
গেরুয়া—তোরা তো কিছুই মানিস না রে! তোদের দলে কেউ যদি ভুলে মন্দিরে গিয়ে জয় মা কালী বলে ফ্যালে তো পলিটব্যুরো তাকে সাসপেন্ড করে। পূরো জবাবদিহি করতে হয়। বেক্তিগত ভক্তির স্থান নেই…
লাল—কথা অন্যদিকে ঘুরাবি না গরু! তোদের দিকে কি তাক করা আছে দ্যাখ! বেশী কপচালে ঢিচক্যাঁও ঢিচক্যাঁও… লাশ পড়ে যাবেরে শালা… মুখ সামলে…
কিইইই! আমাদের গরু বললি? আবার মুখ সামলাতে বলছিস? কেন মুখ সামলাবো! আমরা কি কিছু ভুল কথা বলেছি? মুখ তোরা সামলা।
লাল—তো বলছিসটা কি? তাই বলনা?
গেরুয়া—বলছি, এই লাশ আমাদের। লাশ ছেড়েদে। একদম রোয়াবি দেখাবি না…
লাল—কেন রে! তোদের বাপের লাশ নাকি? কেন ছাড়বো!
গেরুয়া—আমরা আগে দেখেছি, তাই লাশ আমাদের। সাফ কথা।
লাল—এই কেতোওওও। ঝাড় তো কটা পেটো! শালা লাশ নিয়ে জুলুশ বের করবে বলে আমাদের ক্যাডারদের কাছে এস.এম.এস চলে গেছে! বলে কি না লাশ ছাড়! আরে কচ্ছিস কি তোরা! পেটো ঝাড়তে বল্লামনা?
বাজখাঁই আওয়াজে মড়া-আগলানো গেরুয়ারা চমকিয়া উঠিয়া নিজেদের মধ্যে ফিসফিস করিতে লাগিল, –আরে পেটো তো আমরা আনিনি! এখন কি হবে! আরে তখন কি জানতাম লাশ নিয়ে রঙবাজী হবে! চল পালা পালা…।
কীইইই! লাশ ছেড়ে পালাবে? পার্টির কাছে এই শিক্ষা পেয়েচো? শালা আজ তোরই একদিন কি আমারই একদিন!
আরে আরে নিজেদের মধ্যে খেয়োখেয়ি করচিস ক্যানো? বুঝিসনা, এতে পার্টি কত দুর্বল হয়ে পড়ে। তার চে বরং পালা।
দাঁড়া । পালাবার আগে লাশের মুখটা দেখে নিই। মুখ উলটে মরে রয়েচে শালা…
লাল—ইল্লি রে! তোরা একলাই দেখবি? আমরা দেখবো না? কয়েকজন মিলিয়া তাগড়াই লাশ কে চিৎ করিতেই স্পটে শ্মশানের স্তব্ধতা নামিয়া আসিল। মিনিটের মধ্যে দুই দল অকুস্থল ছাড়িয়া দুই উল্টো দিকে দৌড়। পড়িয়া রহিল সেই উচ্চিংড়ার লাশ যাহাকে পুলিশ হন্যে হইয়া খুঁজিতেছে ব্যাঙ্ক-ডাকাতির কেসে।
পালাইতে পালাইতে একজন বলিল, ওই শালা ব্যাঙ্ক ডাকাতটা তো আমাদের পার্টির রে! চিনতে পারলি না! অপরজন বলিল, এই জন্যই তুই কোনোদিন নেতা হতে পারবিনা। বুঝেচিস গোমুখ্যু! চেনাকে কোনো কোনোসময় না চিনতে পারার কোয়ালিটি না থাকলে সে কর্মীই থেকে যায়। নেতা হতে পারেনা কোনোদিনও। তুইও পারবিনা। ঠিক আছে, ঠিক আছে, কিন্তু তুই আমদের পরম পূজ্য গরুকে মুখ্যু বললি? এত বড় পাপ ধম্মে সইবে?
দুজন গেরুয়ার এইপ্রকার কচকচির সময় একটি নতুন রঙের মিছিল এন্ট্রি লইলো। সাদা রঙের এই মিছিল বলিতে লাগিল—চোর ডাকাত, এটিএম ভাঙা, ব্যাঙ্কলুঠেরা, ডায়মন্ডব্যবসায়ী, ধর্মবাবাজী—এরা সকলেই সমাজের পোকা। ইহাদের চিহ্নিত করুন। পোকা হইতে সাবধান। সমাজের পোকা হইতে দূরে থাকুন। উপযুক্ত পেস্টিসাইড ব্যবহার করুন। পোকা ধ্বংস করুন ও পোকামুক্ত জীবন লাভ করুন।
ইহাদের দেখিয়া, কী আশ্চর্য, লাল গেরুয়া সবুজ সব পিঁপড়া অকুস্থলে ফিরিয়া আসিতে লাগিল এবং একত্রে জোট বাঁধিয়া সম্মিলিত পিপিড়া মিছিল মুখে চোঙা লাগাইয়া সদর্পে দেশবাসিকে সাবধান করিতেছে—সমাজের পোকাসম্প্রদায়কে প্রশ্রয় দেবেন না, দেবেন না। পোকাদের বিরুদ্ধে আমাদের সংগ্রাম জারি রহে, জারি রহে।
শ্লোগান শুনিয়া আমার তন্দ্রা চটকাইয়া গেল। দিব্য চক্ষে যাহা দেখিলাম, আহা, সত্যই যদি এইরূপ হইতো! সমাজ ও দেশের কল্যাণের স্বার্থে যদি সব রঙের পিপিলিকা এক হইয়া একটি শুভ্র রঙের জন্ম দিত, তবে দেশটি আমাদের জগৎসভায়—নাঃ কি যে হইতো কিছুই প্রেডিক্ট করিতে পারিনা। দূষণ হজম করিতে করিতে সকলের ইমিউনিটি সিসটেম যেভাবে পোক্ত হইয়া উঠিয়াছে, ডাকাতি-জালিয়াতি-প্রতারণারহিত বাবাজীমুক্ত, ধর্ষণমুক্ত ‘স্বচ্ছ ভারত’এর কনসেপ্ট হজম করা যাইত কি না তাহা একটি গভীর গবেষণা-সাপেক্ষ বিষয়…
★★★