“পুরোনো সব দিনের কথা”(২য় পর্ব)– কলমেঃ সুকন্যা দত্ত

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

আদরের চাদরে আঁকা স্মৃতিগুলো(২য় পর্ব)

কলমেঃ  সু ক ন্যা   দ ত্ত

বরিশালের_কথাঃ

রেডিওতে বাজছিলো,
“এই দেশ এই দেশ আমার এই দেশ,
এই মাটিতে জন্মেছি মা
জীবন মরণ তোমার স্মরণ
তোমার চরণধূলি দাও মা।”
বাইরে তখন অঝোর ধারায় বৃষ্টি পড়ছে। মাটির বুকে ঝাঁপিয়ে পড়া জলধারা দেখা যায় কিন্তু মনের ভিতর ঝমঝমিয়ে বৃষ্টির শব্দ পাওয়া যায় না। চোখের অগোচরে  ঝরে পড়া ফোটা
ফোটা বারিধারা মন চঞ্চল করে দেয়। আমি সেই রাতে আমার বাবার চোখে জল দেখিনি তবে কথা বলতে গিয়ে বাবার   গলা যখন ধরে   আসছিলো, থিরথির করে ঠোঁট কাঁপছিলো তখন বেশ বুঝতে পারছিলাম  জন্মভূমির  গন্ধ মায়ের গায়ের গন্ধের মতো। দূর থেকেই মিষ্ট আঘ্রাণ পাওয়া যায়।  দেশ ভাগ হলে ওপার বাংলার স্বচ্ছ্বল জীবনের আধ পেটা খাওয়ার পূর্নবাসন হয় এপার বাংলায়। বসত বাড়ী ছেড়ে নতুন জীবন গড়ার নতুন লড়াইয়ে ছিন্নমূল মানুষগুলোর কাছে ওদেশ হয়ে যায় ইতিহাস। পাঁজরে পাঁজরে দেশ ছাড়ার ব্যথা গুমরে মরে।

আমার বাবার জন্ম ওপার বাংলায়। বাংলাদেশের বরিশালের মাটিতে যেদিন তিনি জন্মেছিলেন সেদিন  হয়তো নিজে ও জানতেন না একদিন পদ্মার দেশের সব কিছু ছেড়ে চলে আসতে হবে গঙ্গার দেশে। আমাদের ভাবনার বাইরে ও একটা জগৎ থাকে যে  জগত ভবিতব্যের ধার ধারে না।

আসি স্মৃতিচারণের কথায়। সংস্কৃতে একটা শ্লোক আছে,
” জননী জন্মভূমিশ্চ স্বর্গাদপী গরীয়সী। “
আমার বাবা ও আজ ও সেই জন্মভূমিকে সেচন করে বাঁচেন। বাবা কাকা পিসির থেকে দেশের যতটুকু ইতিহাস জেনেছি, তাই আজ লিখতে বসলাম। এক অজানার হাতছানি পাই ওপারের পদ্মা থেকে। কল্পনায় মেঘনার পাড়ে ঘর বাঁধি। একেই কী মাটির টান বলে?যে দেশকে কখন ও দেখিনি তার জন্য এত টান কেন? কাঁটা তার দেশ টুকরো করলে ও মায়ায় ছুরি বসাতে পারে না।

বাবার মুখে বরিশালের কথা শুনতে শুনতে অভিজ্ঞতার ফুল কুঁড়োই। ফুলগুলোকে কোঁচড়ে বেঁধে ঘরে এনে তার ঘ্রাণে বুঁদ হই। তারপর বহু সঞ্চয়ের পর আজ আঁখরের মালা গাঁথতে বসি।
কথায় আছে, 
‘ধান- নদী -খাল এই তিনে বরিশাল’। 
সায়র, নদী, খালের গল্প রোজ লেখা হয় বরিশালে। জলের মাঝে স্টীমারের চলাচল, দূর থেকে কানে আসা ভোঁ এর সুরে নদী স্বরলিপি লিখে যেত। দক্ষিণ-পূর্ব বাংলায় মুসলিম আধিপত্যের  বিস্তার কালে রাজা দনুজমর্দন কর্তৃক ‘চন্দ্রদ্বীপ’ নামে এই স্বাধীন রাজ্যটি প্রতিষ্ঠিত হয়। চতুর্দশ শতাব্দী পর্যন্ত এ অঞ্চল চন্দ্রদ্বীপ নামে প্রসিদ্ধি ছিলো। এই  রাজ্য প্রতিষ্ঠার পূর্বে এ অঞ্চল ‘বাকলা’ নামে পরিচিত ছিল। ‘বাকলা’ শব্দটি আরবী শব্দ, যার  অর্থ শস্য ব্যবসায়ী। জনৈক ড. কানুনগো নামীয় এক ব্যক্তি বাকলা বন্দর নির্মাণ করেছিলেন। এ সামুদ্রিক বন্দরে আরব ও পারস্যের বণিকরা বাণিজ্য করতে আসতেন। অতি প্রাচীন বৈদেশিক মানচিত্রে বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নাম বড় অক্ষরে অঙ্কিত দেখা যায়। ১৭৯৬ খ্রিস্টাব্দ পর্যন্ত এ জেলা বাকলা-চন্দ্রদ্বীপ নামে পরিচিত ছিল। ১৭৯৭ খ্রিস্টাব্দে ঢাকা জেলার দক্ষিণাঞ্চল নিয়ে বাকেরগঞ্জ জেলা প্রতিষ্ঠিত হয়। ১৮০১ সালে জেলার সদর দপ্তর বাকেরগঞ্জ জেলাকে বরিশালে (গিরদে বন্দর) স্থানান্তরিত করা হয়।

বরিশালের নামকরণ নিয়ে নানামুণির নানা মত। কেউ বলেন  বড় বড় শালগাছের কারণে (বড়+শাল)= বরিশাল আবার কার ও মতে পর্তুগীজ বেরী ও শেলীর প্রেম কাহিনীর জন্য বরিশাল। কেউ বলেন  বড় বড় লবণের গোলার জন্য বরিশাল নাম হয়েছে। সেই সময়  গিরদে বন্দরে (গ্রেট বন্দর) ঢাকার নবাবদের বড় বড় লবণের চৌকি ছিল। এ জেলার লবণের বড় বড় চৌকি ও লবণের বড় বড় দানার জন্য ইংরেজ ও পর্তুগীজ বণিকরা এ অঞ্চলকে ‘বরিসল্ট’ বলত। এ বরিসল্ট পরিবর্তিত হয়ে বরিশাল হয়েছে বলে অনেকের মত।
সে যাই হোক  এবার সকলের স্মৃতির সরণী বেয়ে কলম ধরার পালা।

সময়টা ১৯৩০ সালের অবিভক্ত বাংলাদেশ। আমার বাবার বরিশালের দেশের কলসকাঠিতে হলে ও আলেকান্দার মিশন রোডে বাবার দাদামশাই শ্রদ্ধেয় যদুনাথ দত্ত বাড়ী তৈরি করেছিলেন । তিনি ঢাকা স্বাধীনতা পূর্ববর্তী   বাংলার কলিকাতার ভূতপূর্ব কারমাইকেল মেডিকেল কলেজে চিকিৎসা শাস্ত্র নিয়ে পড়াশোনা করেছিলেন। অধুনা যেটি আর জি কর মেডিকেল কলেজ নামে পরিচিত। সেখান থেকে ডাক্তারী পাশ করে তিনি বরিশালে ফিরে এসেছিলেন। তিনি ছিলেন, ভারতরত্ন, বিখ্যাত  ডঃ বিধান চন্দ্র রায়ের একজন কৃতী ছাত্র।সেখান থেকে তিনি Mid Wifery বা ধাত্রী বিদ্যা বর্তমানে যা Gynecology নামে পরিচিত, সে বিষয়ে পাশ করে স্বর্ণ পদক পান। সেই সময়ে ওনার রোগী দেখার ঘরে  সাতাশিটা ওষুধের আলমারি আর চারজন কম্পাউন্ডার ছিলো, যারা ওনার অধীনে থেকে রোগীদের চিকিৎসা করতেন। ডঃ যদুনাথ দত্তের রোগী দেখার জায়গা আর ওষুধের দোকান  ছিলো বরিশালের বানিজ্যিক এলাকায়। দোকানের নাম ছিলো রাসমোহন মেডিকেল হল।

বাবার দাদু শ্রী  যদুনাথ দত্তের তিন মেয়ে ছিলো।  মালতী, ইন্দিরা ও দীপালী। বরিশালে  বাবার  পিসিরা ওনাদের যুবতী কালে ধূসর রঙের বড়  ঘোড়ার গাড়ী তে করে স্কুল যেতেন। কেবল পড়া লেখা নয়, বিনোদনের জন্য মাঝে মাঝে ছায়াছবি দেখতে গেলে এই ঘোড়া গাড়ীই ছিলো সম্বল। শ্রী যদুনাথ দত্ত তার তিন মেয়েদের   বাড়ীতে দর্জি রেখে সেলাই শেখাতেন। সর্ব গুণে সুসম্পন্না করার জন্য গানের শিক্ষক রেখে গান, বাবুর্চি রেখে রান্না শিখিয়েছিলেন। 
আর মাছ, তেল কই, শোলের ঝোল, মুসুরির ডাল, চাকা চাকা আলু ভাজা,   শিলে বাটা মান কচুর সাথে নারকেল বাটা আর কাঁচা সরষের তেল দিয়ে সকলের দুপুরের খাবার পাত পরিপূর্ণ হয়ে থাকতো।
রাতে সকলে খেতেন দুধ, ভাত, কলা আর বাতাসা। কাঁসার ঘটিতে জল খেতেন যদুনাথ দত্ত।

আমার বাবার ঠাকুমা কিরণ বালা দেবী। তিনি   ছিলেন  বারো ভুঁইয়াদের মধ্যে অন্যতম যশোরের প্রতাদিত্য রায়ের বংশের। ওনার হাতের রান্নার ছিলো অসাধারণ। 
কিরণ বালা দত্তের একটি বইয়ের ট্রাঙক ছিলো। সেখানে শরৎ চন্দ্র চট্টোপাধ্যায়ের “পরিনীতা”, ” দেবদাস”,” গৃহদাহ “ছাড়া ও কৃত্তিবাসী রামায়ণ ও কাশীদাসী মহাভারত সহ নানান রকমের বই ছিলো। সেই সময়ের ডাক্তারের গিন্নী কিরণ বালা দত্তের গায়ের রঙ শ্যামলা হলে ও চোখ নাক মুখ ছিলো নিখুঁত।

বরিশালের পটুয়াখালীর তৎকালীন জমিদার রাজেশ্বর রায় চৌধুরীর এক ছেলের একবার বসন্ত হয়েছিলো।গলিত বসন্তে তার শরীর বিকৃত হতে শুরু করে। সে সময় আমার বাবার দাদু ওনার বরিশালের বাড়ীতে রেখে তার চিকিৎসা করেছিলো। কলা পাতায় ঘি মাখিয়ে ওষুধের সাহায্যে তাকে সারিয়ে তোলা হয়েছিলো।  ছেলের পূর্ণজন্ম রাজেশ্বর রায়ের কাছে স্বর্গ প্রাপ্তি তুল্য। জমিদার ডঃ যদুনাথ দত্তের প্রতি কৃতজ্ঞতায় উপঢৌকনে   ওনাকে রূপোর থালা, বাটি, গ্লাস সহ আর ও নানান রকম উপহার দিয়েছিলেন। বাবার মুখে শুনেছি, সেদিন জমিদার সামনে আনন্দে চোখের জল ধরে রাখতে পারেনি। পিতৃত্বের কাছে রাজকীয়তা, আভিজাত্য তুচ্ছ হয়ে যায়। বাঙালি পিতার,  সন্তানদের  ” দুধে ভাতে ” রাখার আকাঙ্খা সদ হৃদয়ে বিরাজমান। 
যদুনাথ দত্তের প্রথম সন্তান অর্থাৎ  আমার দাদু মকুন্দলাল দত্তের বিবাহ হয় পারুল রানী  দত্তের সাথে। বরিশালের পারুল রাণী দত্তর বয়স তখন মাত্র নয় বছর। শ্যামবর্ণা ছোটো খাটো সেই মেয়ের বিয়ের পর শ্বশুর বাড়ী আনার পথে মহা সমারোহে  নানান বাজনা বাজিয়ে পালকী করে বরিশাল শহর ঘোরানো হয়েছিলো। পালকীর ভিতর সেই সময় আমার ঠাকুরমা র কোলে বসেছিলেন ওনার দেওর রণেন্দ্র লাল দত্ত,আমরা যাকে বলতাম রাঙা দাদু। চাঁদপানা সেই মুখ ঘোমটার আড়াল থেকে বরিশালের ঐ বড়ো বাড়ীটা দেখে সেদিন জুলজুল করে তাকিয়ে ছিলো। সাদা কাপড়ে দুধ আলতার পায়ের ছাপ দিয়ে পারুল রাণীর প্রথম গৃহ প্রবেশ। পুতুলের বয়সী বাড়ীর বড়ো বউ পারুল রাণীর সব সময়ের সঙ্গী চার দেওর আর তিন ননদ। 
বাড়ীর ভিতর তুলসী মঞ্চ ঘিরে দোতলা দালানবাড়ি।  খড়খড়ি জানলার ওপারে মেয়েদের অন্দর মহলে। নীচতলায় ছিলো চাকর মহল  আর ডঃ যদুনাথ দত্তের রোগী দেখার জায়গা। কত দূর থেকে রোগীরা আমার বাবার দাদুর কাছে আসতেন। দোতলায় ছিলো শোয়ার ঘর, বৈঠকখানা, ঠাকুর ঘর আর রান্নার ঘর। 

বরিশালের বাড়ীতে যোগেশ ও  সুরেশ  নামের দুই ঠাকুর চাকর ছিলো। যোগেশ  বাড়ীর নানান কাজ করতো আর সুরেশের কাজ ছিলো রান্না করা।  ডঃ যদুনাথ দত্তের বাড়ীতে যে রোগীরা দূর থেকে আসতো তাদের জন্য দুপুরে  রান্নার ব্যবস্থা হতো। শোনা যায়, রোজ সে বাড়ীতে  প্রায় চল্লিশ  থেকে পয়তাল্লিশ  জন লোক খাওয়া দাওয়া করতো। সরু চালের ধোঁয়া ওঠা গরম ভাত, চাকা বেগুণ ভাজা, রুই মাছের ঝোল আর আমের চাটনি রোগীরা চেটেপুটে খেতো। দু হাত তুলে সবাই আর্শীবাদ করে যেতো গৃহকর্তা কে। যদুনাথ দত্ত ছিলেন এক ভাই,এক বোন। ওনার বোন নকুলেশ্বরী দেবী সেই সময়ের অসম্ভব শিক্ষিত ছিলেন। উনি  নিজের নাম নিয়ে  ছত্রিশ লাইনের একটি কবিতা লিখেছিলেন।

দত্ত বাড়ীর দালানকোঠার পিছনদিকে একটা মস্ত পুকুর ছিলো। নেয়ামত আর আবদুল জাল দিয়ে মাছ ধরতে আসতো। ঘাট বাঁধানো পুকুরে মাছ ধরার সময় বহু মানুষের সমাগম হতো। বিরাট বিরাট রুই,কাতলা, মাগুর, শিঙি মাছ জালে খাবি খেতে থাকলে সবাই চারিদিক থেকে হইহই করে উঠতো। পুকুরের স্বচ্ছ্ব জলে মাছেরা লাফিয়ে পালানোর ফিকির খুঁজলে নেয়ামত বলতো,
” পালাবি কই? তোরে আজ ছাড়ুম না।”
মাছ ধরা শেষে ঘাটে বসে জাল গোটাতে গোটাতে আবদুল বলতো,
” ও গিন্নি মা, দুইটা মুড়ি বাতাসা দেন দেখি, বড়ো ক্ষুধা লাগছে।”
কিরণ বালা দেবী তখন বাড়ীর কর্ত্রী। নিজের হাতে মুড়ি, বাতাসা, রসগোল্লা আর জল দিয়ে নেয়ামত আর আবদুল কে বলতেন,
” এখন এগুলো খেয়ে নাইতে যা। দুপুরে চাট্টি ভাত খেয়ে যাবি। সুরেশকে বলেছি,হাঁড়িতে তোদের জন্য চাল দিতে।”
কিরণ বালা দেবীর এই মায়ায়, আন্তরিকতার কাছে সকলে আত্মসমর্পণ করেছিলো। পুকুরের দু দিক জুড়ে বাগান। আম, জাম, কাঁঠাল, সুপারি, বাতাবি লেবু গাছের সারি বাগানকে আগলে রেখেছিলো। সকালের এই জলময় স্থান রাতের আঁধারে বড়ো রহস্যময় লাগতো। বাঁশ বাগানে জোনাক পোকার আলো মিটমিট করতো। গরম কালে বাতাসে ভেসে আসতো আমের মুকুলের গন্ধ।  দোতলার জানলা থেকে রাতের পুকুর ঘাটের দিকে চেয়ে আমার ঠাকুমা পারুল রাণী বলতেন,
” ঝিঁঝি পোকা আর জোনাকিপোকারা কাউকে ভয় করে না। রাতের আঁধারে কেমন হেসে খেলে বেড়ায়।”

আমার বাবার ঠাকুমা কিরণবালা দেবীর একশো  ভরি সোনার গয়না ছিলো। ওনার বড়ো মেয়ের বিয়ের সময় সিন্দুক খুলে  বড়ো মেয়ে মালতীর জন্য দুটো কঙ্কন, মটর হার,  আর কান পাশা বের করেছিলেন। আমার দাদু মুকুন্দ লাল দত্ত এবং ওনার ভাই বোনদের জন্য একজন  মাষ্টার মশাই ছিলেন। মাস্টার মশাই ওই বাড়ীর একতলায় থাকতেন।  ডঃ যদুনাথ দত্তের কম্পাউন্ডার মাসে  ৫০ টাকা বেতন  পেতেন। সেই টাকায় ওই সময়ে সংসার চালিয়ে ওনার মেয়েকে ডাক্তারী পড়িয়েছিলেন।

ডঃ যদুনাথ দত্ত ওনার মেয়েদের ধূমধাম করে বিয়ে দেন।  তিন মেয়ের বিয়েতে একমাসের বাজার  সদয়, কাপড় চোপড়, ঘড়ি, কাঁসার বাসনপত্র, নানান গয়নায় সাজিয়ে কন্যাদান করেন।
সে সময়ের অর্থের মূল্য বোঝাতে একটি কবিতা তুলে ধরলাম….

“এক পয়সার তৈল,
কিসে খরচ হৈল,
তোমার দাড়ি আমার পায়,
আরও দিলাম ছেলের গায়,
ছেলেমেয়ের বিয়ে হল,
সাতরাত গান হল,
কোনও অভাগী ঘরে গেল,
বাকি তেলটুক নিয়ে গেল।”

আমার দাদু মুকুন্দলাল দত্ত বছরে চার বার কলকাতায় ওষুধ, চিকিৎসার সামগ্রী কিনতে আসতেন। প্রথমে বরিশাল থেকে স্টীমারে আসতেন পার্বতীপুর(,রঙপুর ডিভিশন), সেখান থেকে East Bengal  Mail  ট্রেনে শিয়ালদহ।  বরিশাল হলো নদ নদীর জায়গা। জালের মতো বিস্তারিত নানান নদী,খালের পলি সঞ্চয়ে বরিশাল ভূখন্ড গড়ে উঠেছে । মেঘনা, তেঁতুলিয়া, আড়িয়ার খাঁ ,কীর্তনখোলা,ইলিশা,হিজলা,বাকেরগঞ্জ, কালিজিরা, সন্ধ্যা নদী নানান নদী যেনো বরিশাল কে জড়িয়ে ধরে আছে। বাবার দাদামশাই   যদুনাথ দত্ত গাড়ী করে বাজার থেকে ইলিশ মাছ কিনে নিয়ে আসতেন৷ আর ওনার স্ত্রী রান্না করতেন নিজ হাতে। রূপোলী শস্যের গন্ধে সারা বাড়ী ভরে যেতো। মেঝেতে পিঁড়ি পেতে সামনে কাঁসার থালায় ইলিশের নানা পদে সেই দিনটা জমজমাট হয়ে উঠতো। ইলিশ মাছ ভাজার তেল কাঁচা লঙ্কা আর লবণ দিয়ে গরম ভাত খাওয়ার পর সাথে থাকতো ইলিশ মাছের বড়া, ইলিশ মাছ ভাজা, কালো জিরা বেগুণ দিয়ে ইলিশ মাছের ঝোল, নারকেল বাটা- সরষে বাটা দিয়ে ভাপা ইলিশ। খাওয়ার পর ও সকলে হাতে মাছের গন্ধ শুকতেন।
নারিকেলের দুধের সাথে কালো জিরে,আদা বাটা, সরিষার তেল,কাঁচা লঙকা দিয়ে ইলিশ রান্না বরিশালের একটি বিখ্যাত পদ রাঁধতেন। এছাড়া নারিকেলি মিষ্টি ভাত, নারকেল দুধে আমড়া,ইলিশ  পোলাও,চিংড়ি পিঠে বরিশালের বিখ্যাত সব রান্না। 
রসগোল্লার পায়েস ছিলো কিরণ বালা দত্তের রান্না অন্যতম সেরা একটি পদ।

দত্ত বাড়ীতে একজন ডাকবাহক আসতেন চিঠি নিয়ে। উনি খুবই সত একজন মানুষ ছিলেন। 
বাবার কাছে শুনেছি, একবার, তিনি চিঠি আনলে খুশী হয়ে আমার বাবার ঠাকুরমা দুটো টাকা দিতে চাইলে উনি বলেছিলেন, 
“আমি টাকা নিতে পারবো না, আমায় একটু মিষ্টি খাইয়ে দিন”। 
সেই সময় দু টাকায় চারটি রাজভোগ পাওয়া যেতো। সেই মিষ্টি খাইয়ে আপ্যায়ন করেছিলেন সেই ডাক হরকরা কে।
বরিশালের বাড়ীতে ধূমধাম করে লক্ষ্মী পুজোর প্রচলন ছিলো। মাটির প্রতিমা নয়, কলা গাছ কে বউ সাজিয়ে কলা বউয়ের পুজোর প্রচলন ছিলো।
বাবার  ঠাকুমার কড়া নির্দেশ ছিল, কলা-বউ বা নৌকা বানানো বংশের ‘পোলা’-দেরকেই করতে হবে।
সকাল সকাল সমূল কলা গাছ এবং অন্যান্য আটটি গাছের চারা সংগ্রহ করে শুরু হতো কলা বউ ও নৌকা বানানোর কাজ। কলা গাছকে স্নান করিয়ে লম্বা পাতাগুলো মুড়ে ‘ছিলা’ দিয়ে বেঁধে এমন করা হ’ল যাতে কাপড় পরালে মনে হবে, যেন ঘাড় নীচু করা বউ। এবার এই কলা গাছের গোড়ায় ঢোঙ্গল দিয়ে জড়িয়ে আট রকম গাছের চারা অপরাজিতা লতার সাহায্যে বেঁধে দেওয়া হবে। কলাবউয়ের হাত বানানো হতো এক বা দেড় ফুট আঁখের টুকরো দিয়ে। গাছটির বুক বরাবর আঁখের টুকরোটি কলার ‘ছিলা’ দিয়ে হাতের অনুকরণে বেঁধে দিতো এবং সেই সঙ্গে বেঁধে দিতো একই বৃন্তের একজোড়া কাঁচা সুপারি — যা কিনা কলাবউ-এর কল্পিত স্তন।
এবার কলাবউকে লাল পেড়ে শাড়ী পরিয়ে, ঘোমটার মাথায় দুটি শোলার কদম ফুল বেঁধে দিয়ে, গলায় ফুলের মালা পরিয়ে শঙ্খ, কাঁসর-ঘন্টা বাজিয়ে বসিয়ে দেওয়া হতো আলপনা আঁকা বেদী বা পিঁড়িতে। শুধু তাই নয়, দেবীর সঙ্গে পঞ্চ শস্য ও সোনা, রূপো ইত্যাদি রত্ন নিয়ে ঢুকতো কলা গাছের ঢোঙ্গল-এ তৈরী দেড় বা দুই ফুটের একটা ‘ছোই’ দেওয়া নৌকো।
কোজাগরী পুর্ণিমার অপূর্ব স্নিগ্ধ জ্যোৎস্না রাতে বাংলার ঘরে ঘরে পূজিত হন দেবী লক্ষ্মী। ঘরের সকলের একটাই। মা লক্ষ্মী পুজোর রাতে তাদের ঘরে ঢুকবেন, শস্য-রত্নের ঝাঁপি উজাড় করে ঢেলে দিবেন এবং তারা ধনে-জনে সমৃদ্ধশালী হবে।
লক্ষ্মী পুজোতে কিন্তু বাজি-পটকা তো দূরের কথা, ঢাক-ঢোলও বাজানো হয়না। মনে করা হয়, দেবী খুবই চঞ্চলা, শব্দের তিনি গৃহে ধন-সম্পদ নিয়ে নাও আসতে পারেন। তাই সবাই নিঃশব্দে সারা রাত অপেক্ষা করতে থাকে লক্ষ্মী দেবীর আগমনের জন্য।
বাবার  ঠাকুমা বলতেন,
”কোজাগরীর রাইতে ঠাকুর আইসা জিগাইবে—কে জাগে? তখন উত্তর না পাইলে ঠাকুর চইলা যাবে।”
বাড়ীর মেয়েরা গয়না পড়ে,লাল পেড়ে সাদা শাড়ীতে সেজে,পায়ে আলতা রাঙিয়ে, মাথায় সিঁদুর টেনে নাড়ু,লুচি,সুজি বানাতে বসতেন। কেউ আবার চালের গুড়ো ও খড়ি মাটি মিশিয়ে আলপনা আঁকতেন। জল চৌকিতে আয়না, চিরুনি,  লক্ষ্মীর ঝাঁপি, লক্ষ্মী পেঁচা,ধানের শীষ,লক্ষ্মীর পায়ের ছাপ এঁকে তার উপর কলা বউ কে লাল পাড় শাড়ী পড়িয়ে পুজার জন্য স্থাপন করা হতো। তবে সব আয়োজন দিনের বেলা শেষ হলে ও পূজা হতো গোধূলি লগ্নে ।  প্রদীপ,ধূপ,ধুনো সাজিয়ে শুরু হতো পাঁচালির ব্রত কথা। কিরণ বালা দত্ত গরদের লাল পেড়ে শাড়ীর আঁচল গলায় জড়িয়ে পুজোয় বসতেন। গোধূলির পেতলের প্রদীপ জ্বালিয়ে, শঙ্খ বাজিয়ে, উলু ধ্বনি দিয়ে সুর করে পড়তেন,
” দোল পূর্ণিমা নিশি নির্মল আকাশ,
ধীরে ধীরে বহিতেছ মলয় বাতাস।”
ওনাকে ঘিরে বাড়ীর সকল মেয়েরা হাত জোড় করে বসে থাকতেন। বাড়ীর ছেলেরা তখন অতিথি আপ্যায়নের কাজে ব্যস্ত থাকতো। বাড়ীর বাগানে চাঁদোয়া সাজিয়ে বড় বড় লোহার কালো কড়াইয়ে একের পর এক রান্না করতো বামুন ঠাকুর।
পুজো শেষে শয়ে শয়ে গ্রামের লোক খেতে আসতো৷ বাড়ীর দাওয়ায় লম্বা সারিতে বসিয়ে পাত পেড়ে খাওয়ানো হত। কলাপাতায় পুজোর ফল প্রসাদ, নাড়ু, লুচি, সুজি, খিচুড়ি, লাবড়ার তরকারী, আলুরদম, চাটনী, রসগোল্লা খাওয়ানো হত। দত্ত বাড়ীতে সকল ধর্মের মানুষ সে পুজোয় অংশ নিতো আর পেট ভরে খেয়ে যেতো। ইংরেজদের ডিভাইড এন্ড রুল পলিসি বাংলাদেশের এই মানুষদের স্পর্শ করতে পারেনি।

ভোরের শিশিরে সূর্যের প্রথম আলো যেমন হীরককণার মতো চকচক করে,তেমন দেশভাগের পর ও ওপার বাংলার স্মৃতিকথা বলতে গিয়ে চোখের ভাষা জীবন্ত হয়ে উঠছে।বাংলাদেশের মাটি আজ ও পা দিতে পারিনি তবে ওপারে বৃষ্টি এলে এপারে আমি সেই ঝমঝম শব্দ শুনতে পাই।  তানপুরার তারে যেমন সুরের ঝর্ণা বয়ে যায়, আমার বাবার দেশ বরিশাল, তার স্মৃতিকথা ও তেমন ধ্বনিত করে আমার মন প্রাণ।

বরিশালের কলসকাঠির দেশের বাড়ীতে মহা ধূমধাম করে দুর্গাপুজা হতো। পুজোর দুদিন আগে বরিশাল থেকে কলসকাঠি গ্রামের বাড়ীতে সবাই সমবেত হতেন।  বাবার ঠাকুমা কিরণ বালা দেবী সালংকার ভূষিতা হয়ে মিশন রোডের বাড়ী থেকে গ্রামের বাড়ীতে যেতেন।ষষ্ঠী থেকে দশমী অবধি শ য়ে শ য়ে লোক খেতে আসতো। কোনোদিন রান্না হতো খিচুড়ি,বেগুনি, আলুর দম আবার কোনোদিন পোলাও, মাংস। বামুন ঠাকুর রান্না করতো, ভোলা ময়রা মিষ্টি তৈরী করতো। অষ্টমীতে পাঁঠা বলি দিতে আসতো বিশু কসাই। বিজয়া দশমীর আগের দিন বাড়ীর সব মেয়েরা রান্না ঘরে ময়দা, নারকেল, গুঁড় নিয়ে বসতেন। চিনির নারকেলের নাড়ু, গুড়ের নাড়ু, নিমকী বানিয়ে পরদিনের অতিথি সমাদরের ব্যবস্থা হতো। কিরণ বালা দত্ত এ বাড়ী এলে সকলে বলতেন, সাক্ষাৎ দুর্গা প্রতিমার আগমন ঘটেছে।আবার বিজয়া দশমী শেষে তিনি ফিরে যাওয়ার সময় সকলে ওনাকে বলতেন, 
“বিসর্জনের পর মা কৈলাশে যাচ্ছেন”।
আমার দাদু,মুকুন্দ লাল দত্ত,মিটফোর্ড হাসপাতালের মেডিকেল  কলেজে ডাক্তারী পড়া শুরু করলে ও পরে এল আই সি র চাকরী পেলে পড়া স্থগিত রাখেন। বিয়ের পর একটা বড়ো সংসার। সে সংসার এখন আর বরিশালের বাড়ীর আঁচ পায় না। নারকেল,সুপারির ছায়া হাত বুলায় না, একফালি বারান্দার কোণে। তারপর আমার দাদুরা পরিবার নিয়ে হন কলকাতাবাসী। এখানে এসে দাদু সুরেশকে আর বলতে পারেন না,
” বাগানের লেবু গাছ থেকে দুটো কাগজি লেবু পেরে আনতো সুরেশ।”
এখানে ট্রামের চাকার শব্দে মুছে যায় ওদেশের সন্ধ্যা আরতির সুর। দেশ ভাঙন পুজোর আয়োজনে ও ভাগ বসিয়েছে। এইদেশেনপাত পেড়ে খেয়ে আর্শীবাদের দুহাত আকাশ ছোঁয় না। শীতের নলেন গুড়ের পায়সের ঘ্রাণ শুঁকে পাশের বাড়ী থেকে আলমের মা ছুটে আসে না। এ বাড়ীতে রোগীর ভিড় নেই, ঘোড়ার গাড়ী নেই। মৌসুমী জলবায়ু দুদেশের মাটিকে এক সময়ে স্নান করায়। তবু ও মন চাইলেই ওদেশের হাতটা ধরা যায় না। আইনের বিধিনিষেধ কোথাও একটা দূরত্ব তৈরি করে রাখে। ওপার বাংলার মানুষ আজ ও চোখের জল ফেলে বাস্তুহারা হওয়ার শোকে। তারপর কত কিছুই আসে যায়। বিশ্বযুদ্ধের দাপট, মহামারী তবে দেশহারানোর যন্ত্রনাকে চিরবিদায় দেওয়া যায় না।

আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকটিতে

পুরানো সেই দিনের কথাঃ কলমে- সু ক ন্যা দ ত্ত

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *