মেছাে ভূত
প্র দী প ভ ট্টা চা র্য্য
ভূতের ভয় পায়না এমন মানুষ নেই তা নয় তবে সে সংখ্যা খুবই কম। ভুতের ভয়ের বিষয়টা কি গ্রাম কি শহর প্রায় একই এরকম। তবে গ্রামগঞ্জে গাছপালা বেশী থাকায় সেই সাথে জনবসতি কম হওয়ার কারণে গ্রামের মানুষের কাছে ভূত, পেত্নীর আনাগােনা একটু বেশী। ভূতের বাহার কি কম? সাধারণ ভূত, পেত্নী,শাকচুন্নী, ব্রহ্মদৈত্য, গেছাে ভূত, মামদো ভূত, মেছাে ভুত আরাে কত আছে কে জানে। সাধারণত ভুতেরা তেঁতুল গাছে আর শেওড়া গাছে বাসা বাঁধে। এই গাছগুলাে শহরে খুব বেশী দেখা যায় না। শহরের লােকেরা শেওড়া গাছের নাম শুনেছে কিনা আমার তাে সেটাই সন্দেহ। আমাদের অবশ্য ভূতের ভয় খুব একটা ছিলনা। কারণ আমাদের বাড়িটা জঙ্গলাকীর্ণ পরিত্যক্ত কবরখানা। সামান্য একটু মাটি কোদাল দিয়ে কোপালেই দু-একটা মানুষের খুলি বা হাত-পায়ের হাড় উঠে আসত। তখন গােসানিমারির দিকে একটা হাড় গুঁড়াে করার মিল ছিল। তখন সবে চাষের জমিতে হাড়ের গুঁড়াে দেবার চল শুরু হয়েছে। অনেক চাষী-ই অবশ্য জমিতে হাড়ের গুঁড়াে দিতে চাইতাে না। যাই হােক, তখন মিলের প্রয়ােজনে ভার নিয়ে লােক ঘুরে বেড়াত হাড়ের খোঁজে। আমরা হাড়গুলাে একখানে জমিয়ে রাখতাম ভারওয়ালা এসেনিয়ে যেত। তবুও সন্ধ্যের পর গা ছমছম করতােআমাদের বাড়ির তিন চারশো গজের মধ্যে কোন বাড়ি ছিলনা।পাশেই ছিল বাঁশবন, ছড়ার পারেই ছিল শেওড়াবন সব মিলিয়ে তেনাদের উত্তম বিচরণ ক্ষেত্র। অশরীরী, বাঁশবনের পাশ দিয়ে সমস্ত বাঁশঝাড়ের পাতাগুলাে একসাথে কেঁপে ওঠা অথবা তেঁতুল গাছের নীচ দিয়ে যাওয়ার সময় নাকি সুরে ব্রহ্মপত্য আর শাকচুন্নীর নাকি সুরের ফিসফিস করে কথা অনেকেই নাকি শুনেছে। আমার অবশ্য সে সব শােনার সৌভাগ্য হয়নি। তবে এখনও একটা অবাস্তব ঘটনার কথা খুব মনে পড়ছে। এখন এই প্রৌঢ় বয়সে এসেও সেদিনের ঘটনার কোন যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা পাইনি। ছােটো-খাটো ভূত-প্রেতের কথা পরে বলা যাবে। আগে যুক্তিগ্রাহ্য ব্যাখ্যা না পাওয়ার ঘটনাটাই বলি। আমাদের বাড়ি থেকে (দিনহাটা কলেজপাড়া) কোচবিহার যাবার রাস্তায় চার কিলােমিটার গেলেই ঠিক ভেটাগুড়ির আগেমাসানকূড়া বলে একটা জায়গা ছিল।কড়া মানে ছােট অথচ গভীর জলাশয়। মাসার কালীর জলাশয়। কোচবিহার থেকে দিনহাটায় আসার রেলপথটা মাসানকুঁড়ার কাছে এসে বেঁকে কুঁড়াতে পাশ কাটিয়ে আবার সােজা চলে গেছে। ছােটবেলায় শুনেছি ব্রিটিশরা এই কুঁড়ার উপর দিয়ে সেতু নির্মান করতে গিয়ে বার বার বাধাপ্রাপ্ত হয়ে শেষে রেলপথ ঘুরিয়ে নেয়। এহেন মাসানকুড়ায় সারাবছর প্রচুর জল থাকার কারনে প্রচুর মাছ থাকত। তখন অবশ্য খেতে রাসায়নিক সারের ব্যবহার শুরু হয়নি ফলে খালে বিলে প্রচুর মাছ পাওয়া যেতাে। স্বভাবতঃই মাসানকুড়াতেও প্রচুর মাছ হিল সিঙ্গি, কই, মাগুরতাে ছিলই প্রচুর বােয়াল, শোল মাছও পাওয়া যেত। আমরা প্রতিদিন ভােরবেলায় বেড়াতে যেতাম মাসানকড়া পর্যন্ত হাঁটতে হাঁটতে যেতাম। যাওয়ার সময় দেখতাম বেশ কয়েকজন সাইকেলের পিছনের ক্যারিয়ারে দড়ি দিয়ে হাঁড়ি বেঁধে ছিলো সাইকেলের সাথে বেঁধে প্রতিদিন নিয়ে যেতাে। তাদের সবারই বয়স ৫০-৫৫-র মধ্যে। কোন একদিন একটা ঘটনায় উনাদের সাথে কথা হয়েছিল। আমরা তখন খুবই ছোট। একজন ছিলেন নিবারণ কাকা। আমার স্পষ্ট মনে আছে চার-পাঁচদিন মাছ মারার দলটা দেখছিলাম না। তারপর একদিন হঠাৎ দেখি নিবারণ কাকা সাইকেলের হ্যান্ডেলে একটা বড় বােয়াল মাছ ঝুলিয়ে সাইকেল চালিয়ে আসছে। সঙ্গে নিবারণ কাকার দলের কেউ নেই। নিবারণ কাকাও কোন দিকে না তাকিয়ে সামনে চিত্তদার দোকানে গিয়ে সাইকেল থেকে নামলাে। আমরা একটু অবাক হলাম। প্রতিদিন যাবার সময় আমাদের সাথে দু-একটা কথা বলতে বলতে যায়। আজ একবার তাকালও না। আমরা বেড়ানাে শেষ করে বাড়ি ফিরে এলাম। হঠাৎ আমি স্কুলে যাবার আগে শুনলাম চিত্তদা ঘন ঘন অজ্ঞান হচ্ছে তাই চিত্তদাকে হাসপাতালে ভর্তি করা হয়েছে। আমি তো শুনে অবাক হলাম। চিত্তদার বয়স তখন আনুমানিক ৩০ বছর হবে। বাবা কাঠমিস্ত্রী। চিত্তদা বেশী লেখাপড়া করেনি।রাস্তার ধারেই বাড়ি। বাড়ির সামনে পান-সিগারেটের দোকান দিয়েছে। বেশ ভালো চলে। সকালেই চিন্তদাকে সুস্থ-সবল দেখেছি। ভােরবেলায় যারা বেড়াতে যায় তারা অনেকেই চিত্তদার দোকানে চা খায়। চিত্তদা তাই দোকান খুব ভােরে খুলতে। সেদিন সকালে নিবারণ কাকুকে চিত্তদার দোকানের সামনে সাইকেল থেকে নামতে দেখেছিলাম। হয়তো চা খেতে নেমেছিলেন। চিত্তদা বেশ ডাকা-বুকো স্বভাবের ছিলেন। দিনহাটায় পাইওনিয়ার ক্লাবের ব্যবস্থাপনায় প্রতি বছর ১লা জানুয়ারী এক বিরাট খেলাধুলার আয়ােজন করা হত। বিশাল হলের মাঠে সেই খেলায় উত্তরবঙ্গের সব জেলা থেকে নামি দামি খেলােয়াররা অংশগ্রহণ করত। চিত্তদা বেশ কয়েকবার ওয়েট লিফটিং-এ চ্যাম্পিয়ন হয়েছিল। এহেনাে চিত্তদা ঘন ঘন অজ্ঞান হচ্ছে শুনে সবাই খুব অস্থির হয়ে পরে। পাড়ার বাসিন্দা সবাই সবাইকে চেনে। প্রত্যেকের সাথে সাথে প্রত্যেকের একটা আত্মিক সম্পর্ক ছিল। প্রতােকেই একে অপরের বিপদে এগিয়ে আসতে। কিছুক্ষণের মধ্যে চিত্তদার দোকানে কাজ করত নরেশ আমাদের বাড়িতে এসে যা বলেছিল তাতে আমারই বমি পেতে শুরু করে। ছােটবেলা থেকেই আমার এই এক সমস্যা সামানা শরীর খারাপ বা অস্থির লাগলে আমার বমি পেতে শুরু করে। নরেশদা সেদিন বলেছিল, “বুঝলে কাকিমা সকালবেলায় নিবারণ কাকু একটা বােয়াল মাছ চিত্তদাকে দিয়ে নিবারণ কাকুর বাড়িতে পৌঁছে দিতে বলে।” মা কারণ জানতে চাইলে নরেশদা বলে, মেয়ের অসুখের খবর পেয়ে তখনই মাথাভাঙ্গার বাস ধরবে বলে, কিন্তু জানাে কাকিমা চিত্তদা নিগমনগর রােডে নিবারণদার বাড়িতে গিয়ে শােনে। নিবারণদার মেয়ের বাড়ি গিয়ে হঠাৎ বুকের ব্যাথা কিছুক্ষনের মধ্যেই সব শেষ।মানে নিবারণ কাকু চারদিন আগেই মারা গেছেন -কথাটা শােনার পর আমার মনের অবস্থা বলার ছিলনা। আমার সঙ্গে আরাে যে তিন বন্ধু সকালে বেড়াতে গিয়েছিল তাদের সকলের অবস্থাই আমার মতো হয়েছিল। অপুর বাবা তাে ওঝা ডেকে অপুকে ঝাড়ফুঁক পর্যন্ত করিয়েছিল। ঝাড়ফুঁকের কথায় আর একটা ঘটনা মনে পরে গেলাে। পরে সেই ভুতের কথা বলবে। কিন্তু আমি আজও ভাবি সেদিনের সেই বােয়ালমাছ নিয়ে নিবারণদা মৃত্যুর চারদিন পরে কি করে এলাে।