“মাথুর দিবস”- লিখলেনঃ কৃষ্ণা মালিক

পরিচিতিঃ পূর্ব বর্ধমানের প্রত্যন্ত গাঁয়ের ধুলোমাটিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর। পায়ের তলার সরষেকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে জোর করে পিষে ফেলে ঘরে আটকে থাকা। কলমের কাছে মুক্তি চেয়ে নিয়েছিলেন। প্রকাশিত কবিতার বই কয়েকটি। একটি গদ্যের। এখন গদ্য দ্বিতীয় প্রেম।

মাথুর দিবস

কৃ ষ্ণা   মা লি ক

রোদের আজ মাথুর দিবস। মনমরা হয়ে ঝিমিয়ে আসছিলো। ছোঁয়াচ লেগে আকাশে ছিটেফোঁটা ধূসর রঙ সামান্য গুড়গুড়ুনির সঙ্গে ভেসে যাচ্ছিলো যায় যাক দিন যাক করে। আর মাঝে মাঝে রোদের বিরহ-জ্বরের লাল চোখ। এ যে বর্ষামাস, কে বলবে? মাঠে ধানের ভ্রূণ গর্ভপাতে নষ্টস্বপ্ন। কত রকম বুলবুলি চাষীঘরে সিঁদ কাটে!
অনেকক্ষণ পর ব্যথা উঠলো বুঝি! সাহস পেলো যেন। কালো-ধূসরে সাজ, ফালা ফালা শিহরণ-বিদ্যুৎ তাকে জাঁকালো করলো আর একটু। যেন জিরেন খাওয়া ব্যথা। তারপর গর্ভ থেকে মুক্তি। তবে অপুষ্ট সে। ঝিরঝির করে সামান্য। থেমে গেলো একটু পর। বাসগুলো বহুদিনের ইচ্ছে পুরিয়ে হুসহুস করে চলে যাচ্ছে মেঘলা গন্তব্যে। আর মেঘরঙা ট্রেনগুলো ছায়া ঘনিয়ে-পাহাড়ি মেঘলা দেশের গন্ধ ছড়িয়ে লম্বা হুইসেলে পা নাচিয়ে দিয়ে চলে গেলো। অমনি নীলচে মেঘ-কুয়াশায় ভেজা শীত-শীত পর্বতমালা চোখের সামনে পেখম মেললো। কিশোরী ক’জন খুব কাতর হয়ে সদ্য বয়ঃপ্রাপ্ত মাদী পায়রার মতো বকবকম, ‘এমা! এইটুকু হয়েই থেমে গেলো! কেমন ভিজতে ভিজতে স্কার্টের কিনার উপচে, চুলের ডগা বেয়ে বিষ্টি নিয়ে বাড়ি ফিরতাম -!’ আহা! আমিও বুঝি ভাবছি না! একটু আগেই মনে হচ্ছিলো, কালো মেঘ দামোদরের ওপারের গাঁ-গুলোর উপর দিয়ে ‘কই দেখি – দেখি’ করে এসে পড়বে আর আঁচলের গিঁট খুলে ঝরিয়ে দেবে পুরো এক টাকার কয়েন। অমনি কেমন একটা ছটফটানি – আকুলিবিকুলি নিয়ে ব্যথার তারসে সুখ আনবে! ব্যথারও সুখ আছে তো! কোথায় কোন্ বিন্দাস নগরে আষাঢ় মাটির সোঁদা গন্ধ আর রক্তে মরফিন ঢেলে দেয় সে কেউ জানবে কেন?
দু-ফোঁটা গায়ে পড়তেই মনের আদেখলাপনা , আষাঢ় কোথা থেকে আজ পেলে ছাড়া…
আমাদের ছোটোবড়ো বিচ্যুতিই সজল মেঘ আর ঘনায়মান আষাঢ়ের দৃশ্য ভুলিয়ে দিয়েছে। ওই কিশোরীকুল জানে, চাতক কতটা বৃষ্টিকাঙাল। তবু স্মৃতির চাতালে ভেজে কচি ধান গাছ, শিরিষ গাছ, কচুবন, আহ্লাদী পদ্মপাতা। নটরাজ সার্কাসের তাঁবু ভেজে, হাসির খোরাক জোগানো ছোট্ট মানুষটাও, মানুষকে হাসানোর সময়েও যে মুখে মাখা রঙের ভেতর অনবরত নোনাপানিতে ভিজতেই থাকে। ভেজে ট্রামডিপো, বর্ধমান লোকাল। বাসের একলা জানলা ভেজে।

ভিজতে ভিজতে বলি, এসো বৃষ্টি, তাপিত এই দগ্ধ দিনে। আমার উন্মুখ মুখে স্পর্শসুখ দাও। শরীর জুড়ে দাও তৃষ্ণানিবৃত্তি। আর মনে দাও ব্যথার সুখ। ট্যাঁপারি ফুলের মতো সড়কে পড়ে ফেটে পড়ুক বৃষ্টির ফোঁটা। চাকায় জল ছিটিয়ে ভেজা বাসের পিছনে পিছনে চলে যাই পৃথিবীর অন্য নটিক্যালে। যেখানে হয়তো এই সময়েই ঘনঘোরে ভেঙে পড়ছে বিপুল দাদুরিমত্ত উপুড়ঝুপুর ধানের সবুজ মাঠ।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *