“গরীবের ঘোরা রোগ”-এ রুমকি রায় দত্ত-র মণিপুর ভ্রমণ(৪র্থ পর্ব)

পরিচিতিঃ জন্ম ও বড়ো হওয়া মুর্শিদাবাদ জেলার ফরাক্কায়। সেরিকালচার ও বাংলা বিষয়ে স্নাতক। বাংলায় স্নাতকোত্তরের পরই লেখার জগতে প্রবেশ ছোটো গল্প, উপন্যাস, ভ্রমণ সাহিত্যের হাত ধরে। বিভিন্ন পত্র-পত্রিকার পাশাপাশি প্রকাশিত বই দুটি- ছোটো গল্প ‘যাপ্যযাত্রা’ (শ্রেষ্ঠ গ্রন্থ ২০১৮ হিসাবে ডা: ব্রজগোবিন্দ সাহা পুরস্কারে ভূষিত) ও নভেলা গ্রন্থ ‘আমি বৃক্ষপুরুষের প্রেমিকা’।

 

গরীবের ঘোরা রোগ-এ রুমকি রায় দত্ত-র মণিপুর ভ্রমণ

 

মণিপুরের পথে পথে

৪র্থ পর্ব

লোকটাকের মতো এত স্থির জলরাশি জীবনে কখনও দেখিনি। যেন স্থির একপাত্র জলে নীল বর্ণ গুলে সাজিয়ে দিয়েছে প্রকৃতিকে। নৌকা জল কেটে এগিয়ে যাচ্ছে, অথচ হ্রদের বুকে কোনো হিল্লোল নেই। দূরে একটা ডিঙি নৌকাউ কালো পোশাকের একটি মানুষ জলে ছিপ ফেলে বসে আছে। স্থির! নৌকা ভাসছে,কিন্তু চলছে নয়া। যেন পটে আঁকা স্থির চিত্র। ক্যামেরায় বন্দি করলাম। প্রায় মাঝ বরাবর এসে আমাদের নৌকে থেকে দেখতে পেলাম গোটা লেকের জলে ভাসমান ঘাসের বোঝা। সবুজ ঘাস, গোল গোল হয়ে স্থির ভেসে আছে। অথচ এদের চলন আছে, সে চলন অদৃশ্য। বিভিন্ন উদ্ভিদ, মাটি ও জৈব অবশেষের পচনশীল অবস্থার মিশ্রণ এই দ্বীপ, জলে এভেবেই ভাসমান থেকে এক জায়গা থেকে অন্য জায়গায় যায়। এগুলিকে বলে ফুমদিস( phumdis). এই দ্বীপগুলি ২ মিটার পর্যন্ত পুরু হয়। জলের উপরে এই দ্বীপের ২০% নজরে আসে। গ্রীষ্মের সময় লেকের জলের স্তর কিছুটা কমলে,এই দ্বীপের ভাসমান ঘাসের শিকড় লেকের তলার মাটির কাছে পৌঁছে পুষ্টি সংগ্রহ করে। এমন প্রায় ১০০০ বা তার বেশি সংখ্যক ভাসমান দ্বীপ আছে। অবাক হয়ে দেখলাম, এই টুকরো টুকরো ভাসমান বিচ্ছিন্ন দ্বীপের উপর ঘর বেঁধেছে মনিপুরের মৎসজীবী এক বিশেষ সম্প্রদায়ের মানুষ। প্লাস্টিকের আচ্ছাদনের ঘরে ছেলে পুলে নিয়েই এই জনজাতির সংসার। ভাসমান দ্বীপেই বাচ্চাদের স্কুল।


আমাদের নৌকা লেকের নীল জলে ভাসতে ভাসতে এসে পৌঁছাল এমনই এক দ্বীপের কাছে। একজন মৎসজীবী ঘরের দরজার সামনে ঘাসের উপর বসে আছে। খুব ইচ্ছে হল নেমে ঐ দ্বীপের বুকে হাঁটি। ইচ্ছে পূরণও হল। নৌকার নীচ থেকে ঘাসের বিছানা শুরু। চারটে বাঁশ ঐ ভাসমান ঘাসের উপর ফেলা। খুব ধীরে পা রাখলাম ঐ বাঁশের উপরে। ভাসমান ঘাসের জমি পায়ের চাপে স্পঞ্জের মতো কিছুটা নেমে গেল। অনভ্যস্ত আমরা ঐরকম দোদুল্যমান বাঁশের উপর পা রেখে ভারসাম্য ঠিক রাখাই মুশকিল হয়ে উঠল। ভাসমান বাড়ির সামনে দাঁড়ালাম। ভিতরে আধো-অন্ধকার। সবুজ প্লাস্টিকের দেওয়াল ভেদ করে একটা সবজে আলো ঘরের ভিতরে। সামান্য কয়েকটি গৃহস্থালির জিনিস। ঘরের মালিক তখন সামনে ঘাসের বেডের উপরে বসে। আমাদের দেখে তাকিয়ে আছে। ঘরের সামনেই ভাসছে একটা কাঠের তৈরি ডিঙি বা গলুই নৌকা। লোকটির ভাষা আমরা বুঝতে পারলাম না। তবে ঐ ডিঙি তে চাপার ইচ্ছা প্রকাশ করাতে এক কথায় রাজি হয়ে গেল। সে ডিঙির সামনের দিকে চলে গেল দাঁড় ধরে বসে রইল।পিছনে আমি আর আমার ছেলে চেপে বসলাম। আসতে আসতে ভেসে পড়লাম লোকটাকের ইন্ডিগো নীল জলে। জল অনেক গভীর বোঝা যাচ্ছে। ছোটো ডিঙি, নৌকার মতো স্থির ভারসাম্য বজায় রাখে স্নিগ্ধ চলনে এগিয়ে চলল। মানুষটি দাঁড় ধরে বসেই রইল প্রায়। মাঝে মাঝে জলে দাঁড় টানার শব্দ। দিক পরিবর্তনেই একমাত্র দেখলাম দাঁড়টানার দরকার। কী যে অপূর্ব অনুভব! সাধারণ নৌকায় জলের থেকে অনেকটা উঁচুতে ভাসতে হয়। এ ডিঙাতে জলের সাথে কথা বলা যায়। এত কাছে এমন এত নীল জল! স্বপ্ন মনে হয়। মনের ভিতরে তখন এক অদ্ভুত রোমাঞ্চ ছুটে বেড়াচ্ছে।

একটা অভিযানের রোমাঞ্চ! এই অনুভূতি কি এভাবে লিখে বোঝানো যায়? তবু চেষ্টা করলাম। দু-পাশে পানা ঝোপ ঠেলে স্থির জলে ভাসমান আমরাও স্থির! সামনে যা দেখি, পিছনে যা দেখি। আকাশ পানে চাইলে তাও সব স্থির ছবির মতো সুন্দর এই প্রকৃতি। এও অনবদ্য, অব্যক্ত অনুভূতি! কিছুটা সময় পর ফিরে এলাম আবার ঐ ঘরে। মানুষটির অস্পষ্ট ভাষা বুঝতে অসুবিধা হলেও, প্রশ্নের উত্তরে জানমাল,এই হ্রদই এদের জীবনধারণের একমাত্র উপায়। এই হ্রদে মাছ ধরে জীবিকা নির্বাহ করে। নৌকা ভ্রমণের জন্য ১০০টাকা হাতে দিলাম। তাদের অতিরিক্ত উপার্জনের এটাও একটা পথ। তবে তাঁরা চায় না। কোনও রকম আশাও রাখে না।কেউ নয়া দিলেও কিছু নয়, তবু কাজ করালে মূল্য দিতে হয়। আমাদের ক্ষণিকের ভ্রমণে যে অনাস্বাদিত দুর্লভ অনুভূতি তিনি দিলেন, তা হয়তো ঐ ১০০ টাকায় পূরণ হয় না।


প্রায় পৌনে তিনটে বাজে। এর বেশি দেরি করলে এন আই এ মিউজিয়াম বন্ধ হয়ে যাবে। ওদিকে আধঘন্টার ভ্রমণ একঘন্টা হয়ে গিয়েছে। পাড়ে এসেই বাকিটাকা জমা দিয়ে পাড়ি দিলাম মিউওজিয়ামের পথে।মিউজিয়ামের বিস্তারিত তথ্যে আর গেলাম না। সবাই অনুভব করতে পারবেন, ‘নেতাজী’ স্মৃতিবিজড়িত সেই স্থানের মাহাত্য। তবে মনিপুর এলে অবশ্যই দেখতে ভুলবেন না এই মিউজিয়াম। পুরো মিউওজিয়াম ঘুরে দেখতে অনেকটা সময় চলে গেল। প্রায় সন্ধের মুখে। ফিরতি পথে চলেছি আমরা। হঠাৎ বাজনার আওয়াজে ঘুরে দেখলাম, আমাদের সামনেই পরপর অনেকগুলো গাড়ি। কিছু মানুষ মাঝে হেঁটে যাচ্ছে। গাড়িগুলির গায়ে লেখা “বরের গাড়ি”, বরের মামার গাড়ি”…। ওদের পেরিয়ে কিছুটা এসে হঠাৎ এক জায়গায় গাড়ি দাঁড়িয়ে গেল। ড্রাইভার জানালেন এটা ‘ইস্কনের মন্দির’। একটু অবাক হলাম এর গঠনশৈলী দেখে। আমাদের এখানকার ইস্কনের মন্দিরের মতো নয়। অপূর্ব কাঠের কারুকাজ মন্দিরের ভিতরের অংশে । সারাদিন ঘুরে বেশ ক্লান্ত ছিলাম। বেশিক্ষণ আর শরীর চলবে না বুঝতেই পারছিলাম। মন্দির দেখে আবার উঠে বসলআম গাড়িতে। পরেরদিন চলে যাব। এখনাকার একটি বিশেষ আকর্ষণ “ইমা মার্কেট” আজ না দেখলে আর দেখা হবে না। ওদিকে সাতটা বাজলেই সব দোকান বন্ধ হতে শুরু করবে। কাজেই তড়িঘড়ি একবার চোখের দেখা দেখতে প্রবেশ করলাম বাজারে। মাঝে মাঝে কপালে ভালো ড্রাইভার জুটে যায়। তার স্ময় কিন্তু পেরিয়ে গিয়েছে, তবু সে আমাদের ইচ্ছা পূরণে সঙ্গ দিল। ইমা মার্কেটের একটু আগে আমাদের নামিয়ে দিল। আমারা দু’পা হেঁটে এসে পৌঁছালাম মনিপুরের বিশেষ আকর্ষণ মহিলা পরিচালিত এই “ইমা মার্কেট”। মাছের বা সবজির মণ্ডির মতো ভাগ করা আছে পসরা নিয়ে বসার জায়গা।

কত কী আছে সে বাজারে। ওখানে বিশেষ একপ্রকারের ঘাসের তৈরি হাতের জিনিস সবার প্রথম দৃষ্টি আকর্ষণ করবে। খুব দ্রুততার সাথে কয়েকটি পছন্দের জিনিস কিনে নিলাম। কিন্তু এখানকার ট্রাডিশন্যাল পোশাক কেনা হল না। ইমা মার্কেটের থেকে একটু এগিয়ে একটা হাট বসে। ট্রাডিশন্যাল পোশাকের। সেটি বন্ধ হয়ে গিয়েছে। এবার ফিরতে হবে হোটেলে। খুব ক্লান্ত সকলেই। পরেরদিন সকাল সকাল বেরিয়ে পড়ব নাগাল্যান্ডের পথে। গাড়ি বুকিং আছে। রুটের গাড়িই বুক করা হয়েছে। দুটো ফুল সিট, মানে আটটা সিট। কিন্তু মানুষ ভাবে এক, আর হয় আরেক। কী হবে আগামীকাল?

ক্রমশ…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে

“গরীবের ঘোরা রোগ”-এ রুমকি রায় দত্ত-র মণিপুর ভ্রমণ(৩য় পর্ব)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *