কা র্তি ক চ ন্দ্র   গ ঙ্গো পা ধ্যা য় “জন্ম জন্মময় বিধিবদ্ধ অদেখা” – সাহিত্যচর্চাঃ বর্ধমান (পর্ব-৩)

পরিচিতিঃ কার্তিকচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়ের জন্ম ৫ ই অগাস্ট, ১৯৪৮. বংশভিটেঃ সিমডাল, বর্ধমান। জন্মস্থান – বিল্বগ্রাম, বড়োবেলগনা, বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ের তুখোর এই ছাত্র ১৯৬০ এর মাঝামাঝি থেকে লেখালিখি শুরু করেন। বর্ধমানের সাহিত্য জগতে তিনি এক মাইলস্টোন। অনুজদের উৎসাহ দিয়ে ও পথনির্দেশ করে সাহিত্যের দিকে তাদের কম্পাসের কাঁটা ঘুরিয়ে দিতে পারতেন। জহুরির চোখ দিয়ে তিনি চিনে নিতে পারতেন কাচ আর দু-চার আনার সোনাদানার সম্ভাবনা। বর্ধমানের “নতুন সংস্কৃতি”র এক অন্যতম সদস্য তিনি। – যে নতুন সংস্কৃতির সভায় একসময় আসতেন আলোক সরকার, অলোকরঞ্জন দাশগুপ্ত প্রমুখ কবিরা। নিয়মিত উপস্থিত থাকা কিশোরকবি সুকান্ত ভট্টাচার্যের অভিন্নহৃদয় বন্ধু কবি অরুনাচল বসুর স্নেহধন্য ছিলেন কার্তিকচন্দ্র গঙ্গোপাধ্যায়। অজস্র কাব্যগ্রন্থ, ছোটগল্প, প্রবন্ধ, অনুবাদ কর্ম রয়েছে তাঁর। পেয়েছেন অজস্র সম্মান ও পুরস্কার। তাঁর কয়েকটি কাব্যগ্রন্থ ঃ কুঁড়ির মতো ফোটে, বিরিয়ানির মাছি, ফুটকম্পাস, ইডিপাসের চুমো, বেহালাও ঘেন্না হয়ে যায় ইত্যাদি। ‘রামকৃষ্ণ ‘, ‘বিদ্যাসাগর’, ‘রবীন্দ্রনাথ ও আজকের প্রজন্ম’, ‘ফাঁকার হিসেবনিকেশ’, ‘কাহিনিচলের তত্ত্বতালাশ’ তাঁর প্রবন্ধ গ্রন্থ। ‘পাঁচ পাবলিক এবং তিনি’, ‘ঝিঁঝিঁর সংসার’ ইত্যাদি তাঁর গল্পগ্রন্থ। আজ তাঁর জন্মদিনে বাইফোকালিজম্-র পক্ষ থেকে তাঁকে শ্রদ্ধা জানানো হলো।

“জন্ম জন্মময় বিধিবদ্ধ অদেখা” – সাহিত্যচর্চাঃ বর্ধমান

 

কা র্তি ক চ ন্দ্র   গ ঙ্গো পা ধ্যা য়

 

★ তিন

বর্ধমানের সাহিত্য জগতে প্রাবন্ধিক ও অনুবাদক হিসাবে প্রথমেই মনে আসে প্রয়াত অবন্তী সান্যালের নাম। তিনি রম্যাঁ রলাঁর ভারতবর্ষ ও মস্কোর দিনলিপি অনুবাদ করেন। এছাড়া হাওয়ার্ড ফাস্টের শেষ সীমান্ত, সলোকভের ধীর প্রাবাহিনী ডন, নাম কাওএর ভিয়েতনামের স্পন্দন, হো-চি-মিনের জেলখানার কড়চা প্রভৃতি তিনি অনুবাদ করেন।রবীন্দ্রনাথের গদ্যরীতি, প্রাচীন নাট্যপ্রসঙ্গ, ফরাসী বিপ্লব, ভারতীয় কাব্যতত্ত্ব প্রভৃতি গবেষনামূলক গ্রন্থগুলি তাঁর গভীর মননচর্চা ও অভিনব সব ভাবভাবনাকে তুলে ধরে।তাঁর সম্পাদিত হাজার বছরের প্রেমের কবিতা বাংলা সাহিত্যের এক অত্যুৎকৃষ্ট সংকলন। অধ্যাপনা সূত্রে সুমিতা চক্রবর্তীর বাললা কবিতা সম্পর্কে মূল্যবান গবেষনাধর্মী লেখাগুলি আমাদের ভাবভাবনাকে অনেক সমৃদ্ধ করে।সমাজ সংস্কৃতির বিভিন্ন বিষয় নিয়ে জ্যোতির্ময় ভট্টাচার্য, অরিন্দম কোনার, হরিহর ভট্টাচার্য, উদয় দাস, সুভাষ ঘোষ, কল্যাণ ভট্টাচার্য প্রভৃতির নানা লেখা আমাদের তথ্য ও তত্ত্বজিজ্ঞাসার তৃষ্ণা অনেকটাই নিবারিত করে। মিহির কামিল্যা চৌধুরী, নীরদবরন সরকার, সুধীর দাঁ প্রভৃতির লেখায় আমাদের অতীত সংস্কৃতির অনেকটাই পরিজ্ঞাত হয়। প্রণব চক্রবর্তী, কল্যানী ভট্টাচার্য, ঝর্না বর্মন, চিন্ময়ী ভট্টাচার্য প্রভৃতির সাহিত্য সংস্কৃতির অনেক দিকমুখ আমাদের চোখে ধরা পড়ে। গোপীকান্ত কোনার, ভব রায়, রত্না রশীদ ব্যানার্জী প্রভৃতির লোকসাহিত্যে চর্চার উপস্থাপিত প্রবন্ধগুলিও লোকায়ত জীবন সম্পর্কে আমাদের মর্যাদা আদায় করে।লোলিত কোনারের নাট্যবীক্ষণ বইটি নাটকের তাত্ত্বিক ও প্রায়োগিক দিক সম্পর্কে আমাদের অনেকটাই প্রশিক্ষিত করে।ভূপর্য্যটক অজিত হালদারের ভ্রমণগ্রন্থগুলি যেমন আমাদের ভ্রমণপিপাসা মেটায় তেমনি নানা দেশের বিভিন্ন জ্ঞাতব্য বিষয় নিয়ে আমাদের সুশিক্ষিত করে। নাট্যগ্রন্থ ও নাটক সম্পর্কিত প্রবন্ধ রচনার ক্ষেত্রে শম্ভু বাগ, অমল বন্দ্যোপাধ্যায়, মৃদুল সেন ও অলোক সামন্তর নাম উল্লেখযোগ্য। এ ব্যাপারে আলোচনায় ছেদ টানার আগে স্বরূপ দত্তের প্রথম উপন্যাস ‘মাছমাস্টার’এর কথা এসে পড়ে।এ উপন্যাস সম্প্রতি বাংলা অ্যাকাডেমির পুরস্কার পেয়েছে।বইটি বাংলা সাহিত্যে এক বিরল সংযোজন। আখ্যান এখানে প্রেক্ষাপট, অন্তরালের ধূসর করোজ্জ্বল, নিরন্ন ছায়াবিদ্যুৎকে অমোঘ তুলে আনার এক নান্দনিক বঁড়শি।জন্ম বিতর্কিত, অবস্থান ধ্বস্তপ্রায় অথচ লোকায়ত এক জলবাউল নেউল, আর তার ডামা হিলহলে পুনিকে নিয়েই এ উপন্যাস ঘোরাফেরা করে গাঁবাংলার বিষ আর অমৃত মন্থনে।আসলে এ উপন্যাসের মূল ভূমিকা জলের। বিলপুকুরের টোকাতেই এখানে খিল খুলে যায় ধুলোবাংলার অন্দরমহলের।লেখকের আরও দুটি উপন্যাস প্রকাশিত।

কয়েকটা কথা।এখানকার অধিকাংশ গল্প উপন্যাস জৈব প্রকৃতির গেরস্থালী আর বাউন্ডুলে – দুটো ভূমিকাতেই যথেষ্ট দেখা যায়। এছাড়া গরীব ও মধ্যবিত্ত মানুষের আনাগোনাই এসব লেখাতে বেশ করে পাওয়া যায়।বিসর্পিলতা এখানকার বেশ কিছু লেখাতে পাওয়া গেলেও সেসব আঁকবাঁক তেমন চোস্ত নাগরিক হয়ে উঠতে পারেনি। অনেক লেখায় এখানকার আঞ্চলিক নানা ভাষাটুকরো ও কথাচল উঠে আসে।যাই হোক, স্নেহ মমতার কারণ এখানকার লেখায় যতটা বেশি, বিষমন্থনে ততটা পারঙ্গম নয় বলে সাধারন পাঠক হিসাবে আমার মনে হয়েছে।।

★ চার

বর্ধমানের বর্তমান সাহিত্য চর্চা সম্বন্ধে দু-একটা কথা না বললে নয়। সামগ্রিকভাবে বর্তমান সাহিত্যচর্চার যে ধারাটি আমাদের চোখের সামনে আসছে সে ধারায় সাধনার নিষ্ঠতা আগের তুলনায় কমে আসছে।সম্ভবত যথাযথ নান্দনিক সমালোচনার ঘাটতি ও কথাছবির দৌরাত্ম্য এর জন্য অনেকটা দায়ী। সাহিত্য সভাগুলিতেও অনেক ক্ষেত্রে শুধুমাত্র মামুলি সাহিত্যপাঠ ছাড়া আর কিছু পাওয়া যায় না।আগে কিন্তু পঠিত লেখাগুলির সমালোচনা ও প্রতিসমালোচনার ভেতর দিয়ে উপস্তিত সকলেই কমবেশি সক্রিয় ও শিক্ষিত হতো। দ্বিতীয়তঃ কিছু কিছু সাহিত্য পত্রিকা অনেক বাধা বিপত্তির ভেতর দিয়ে এখনও নিয়মিতভাবে বের হয়। কিন্তু আগের অনেক সাহিত্য পত্রিকা এখন হয় বন্ধ অথবা মাঝেমধ্যে হঠাৎ হঠাৎ বের হয়। তৃতীয়তঃ আনকোরা নতুন প্রজন্মের দু-চারজন ছাড়া গুরুত্ব সহকারে সাহিত্যচর্চা অন্যরা করছে বলে আমার অন্তত জানা নেই। অথচ অনেক প্রতিশ্রুতির সাক্ষর এই নতুন প্রজন্মের অনেকের কাছে পাওয়া গিয়েছিল। চতুর্থতঃ এখন লেখকদের অনেকের মধ্যে অন্যদের লেখা পড়ার সক্রিয়তা অনেক কমে গেছে।যাই হোক আমার দেখার বাইরের সাহিত্যচর্চা যদি আমার এ ধারণাগুলোকে ভুল বলে প্রতিপন্ন করে তবে আমি কম খুশী হ’ব না। পরিশেষে বলি, বর্ধমানের সাহিত্যচর্চা সম্পর্কে আমার আলোচনা প্রকৃতপক্ষে এক খন্ডিত আলোচনা।অনেক সমর্থ লেখক লেখিকা আমার হয়তো আলোচনার বাইরে রয়ে গেছেন। জানা ও অজানা সেসব লেখকের কাছে আমি ক্ষমাপ্রার্থী।

*শিরোনামের কবিতার কবি শান্তনু বসু।

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন

কা র্তি ক চ ন্দ্র   গ ঙ্গো পা ধ্যা য় লিখছেন– “জন্ম জন্মময় বিধিবদ্ধ অদেখা” – সাহিত্যচর্চাঃ বর্ধমান(২য় পর্ব)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *