খানা খাজানায়ঃ মোগলাই পরোটার ইতিহাস

সুকন্যা দত্ত বাংলা ভাষায় শিক্ষকতার পাশাপাশি লেখালেখির সাথে যুক্ত। তথ্যমূলক লেখার প্রতি প্রবল আকর্ষণে কলম এ ফুটিয়ে তোলেন অজানাকে। লোক সংস্কৃতি,নানান দেশের খাদ্য,আচার আচরণ ও ভ্রমণমূলক লেখার প্রতি আগ্রত রয়েছে। বিভিন্ন স্থানের ইতিহাসের টানে চলে যান সেই মাটির কাছে। শৈশব থেকেই গান গাইতে ভালোবাসেন। সম্প্রতি বাংলাদেশের একটি নাটকে তিনি রবীন্দ্র সঙ্গীত গেয়েছেন।ইনিও বাইফোকালিজম্-র একজন অন্যতম সদস্যা।

মোগলাই পরোটার ইতিহাস

সু ক ন্যা  দ ত্ত

রসনা তৃপ্তিতে ভোজন বিলাসী মানুষ নতুন নতুন স্বাদ আস্বাদনে প্রস্তুত। রান্নার হাঁড়িতে জাত,পাত, ধর্ম থাবা বসাতে পারেনি। জিভ যে স্বাদ গ্রহণ করতে চেয়েছে,তাকেই হেঁসেলে সানন্দে প্রবেশাধিকার দেওয়া হয়েছে। নতুন দেশ দেখার মতো নতুন খাবার চেখে দেখায় খাদ্য রসিকদের জুরি মেলা ভার।

সৈয়দ মুজতবা আলী লিখে গেছেন,
‘ইংরেজের বাড়ি, হিন্দুর শাড়ি,  মুসলমানের হাঁড়ি।‘
এই মুসলমানদের মধ্যে তুরস্ক,আফগান, পারস্যরা সেরার মুকুটের অধিকারী। তবে খাবারের ইতিহাসে সবচেয়ে বেশি আধিপত্য বিস্তার করে গেছে  মুঘলরা।খাবারের তালিকায় নতুন নতুন ব্যঞ্জন সংযোজন মুঘলদের অবদান। কথায় আছে,
” পড়েছি মোঘলের হাতে,খানা খেতে হবে সাথে”।
মুঘলদের এই ভোজন বিলাসিতার একটি অভিনব সংযোজন হলো মোগলাই পরোটা।যদিও পরোটা মূলত ভারতীয় উপমহাদেশের খাবার। ১৯৬৮ সালে সিং নিজ্জর তার ” Sultan Under The Sultans1000-1526 “বইয়ে পরোটার উল্লেখ করেন। তবে মুঘল আমলে বিশেষ পদ্ধতিতে একধরনের পরোটা তৈরির কথা জানা যায়। এই বিশেষ পরোটা ডিম,মাংসের কিমা  সহযোগে তৈরি হতো।  মুঘল হেঁসেল  কিমা সহযোগে এই পরোটার আতুরঘর হওয়ায় এটি মোগলাই পরোটা নামে প্রসিদ্ধ। ‘পরোটা’ শব্দটি  পরোট ও আটা র মিশ্রিত রূপ যার অর্থ।তবে মোগলাই পরোটার জন্মকাল মুঘল সম্রাট জাহাঙ্গীরের সময়ে(১৫৬৯ -১৬২৭)।
দীর্ঘ সময় ধরে সম্রাট সেই একই পরোটা ও মাংস খেয়ে একঘেয়েমি অনুভব করছিলেন। সেইসময় তিনি  তার বাবুর্চি আদিল হাফিস ওসমান কে  অভিনব পদ রান্নার জন্য দশ দিন সময় দেন।নবম দিনের দিন ওসমান একটি নতুন পদ তৈরি করে আনেন,যার নাম ছিলো ” জাবির ফালা” বা “আন্ডা রোটি”।বর্তমান পশ্চিমবঙ্গের বর্ধমানের বাসিন্দা ওসমানের এই অভিনবত্বে তুষ্ট হয়ে জাহাঙ্গীর তাকে ১০০১ টি স্বর্ণমুদ্রা ও বাংলায় জায়গীর প্রদান করে।


     বর্ধমানের সেই বাবুর্চি ওসমান বহুদিন বংশ পরম্পরায় মোগলাই পরোটার রন্ধন প্রণালীকে সকলের অগোচরে রেখেছিলেন তবে ব্রিটিশ শাসনের সময় ঘরের অন্দর মহল থেকে এই রন্ধন প্রণালী বাইরের আলো দেখে।
ময়দার পাতলা আবরণে ডিম ফেটিয়ে মুড়িয়ে সোজা চালান দেওয়া হয় ফুটন্ত তেলে। মচমচে এই মোগলাই পরোটা কলকাতায় ঐতিহ্য বহন করে চলেছে। বসন্ত কেবিন,অনাদি কেবিন,দিলখুশা  প্রভৃতি দোকান মোগলাই পরোটা কে আজ ও সম্মানের সাথে  বহন করে চলেছে।অষ্টমীর পুজো প্যান্ডেল এ ঠাকুর দেখার ফাঁকে, ইষ্টবেঙ্গল-মোহনবাগানের খেলার শেষে, প্রেমিকার সাথে রাস্তার ধারে কিংবা উত্তম- সুচিত্রা থেকে শাহরুখ -কাজল সিনেমা দেখার পর পেট খিদের অস্তিত্ব জানান দিলে মোগলাই এর নিজের জায়গাতে সে আজও অটল।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *