ভানদেশ, ভূরিশ্রেষ্ঠ, মহারানী,ভবশঙ্করী ও
প্রসিদ্ধ কবি ভারতচন্দ্র রায় -গুনাকর
দু র্গা শ ঙ্ক র দী র্ঘা ঙ্গী
একঃ
আমরা ‘দেশাবলি বিবৃতি’র শেষাংশের অর্থ করলে
জানতে পারি এই সব অঞ্চলে পাটের চাষ খুব উন্নত মানের, তার সাথে কলাগাছেরও চাষ হোত।
সম্ভবতঃ কলা গাছের ছাল থেকেও সুতা তৈরী হোত। “কদলীপট্টসূত্রানামকরো হি স্থলে স্থলে
পট্টসূত্রস্য জননাৎ ক্ষৌম্যভূমিশ্চ বিশ্রুতা”
আবার ” ধীবরানাঞ্চ নিবাসোবর্ত্ত তে যত্র ভুরিশঃ “
এই সব অঞ্চলে নদ নদী, খাল বিল, জলাভূমি
অধিক থাকার জন্য মৎস্যজীবী জেলেদের বসবাস অধিক ছিল। তারা নৌকাও চালাত।
” মধ্যদেশী ব্রাহ্মণানাং বসতি বৈ পুরাকৃতা “
এইসব জায়গায় মধ্য দেশীয় ব্রাহ্মণদের বসবাস
ছিল। তবে মধ্যশ্রেণী ব্রাহ্মণ ও মধ্য শ্রেণী
বাংলার মধ্যে একমাত্র মেদিনীপুর জেলায় দেখা যায়। “১৯১৭ খৃষ্টাব্দে মেদিনীপুর সাহিত্য সম্মেলনের চতুর্থ অধিবেশনে, পণ্ডিত হরপ্রসাদ
শাস্ত্রী তাঁর সভাপতির অভিভাষণ বলেছিলেন-
” রাঢ়ী, বারেন্দ্র, বৈদিক ভিন্ন অনেক ব্রাহ্মণ বল্লাল
সেনের পূর্ব্বেও মধ্যদেশ হইতে আসিয়া দক্ষিণ রাঢ়
ও উড়িষ্যায় বাস করিয়াছিলেন। ইহারা আমাদের
মধ্যশ্রেণীর ব্রাহ্মণ। মধ্যশ্রেণীর ব্রাহ্মণের আদি বৃত্তান্ত লইয়া অনেক জল্পনা-কল্পনা শুনা যায়।
সে সব ঠিক নয়। রাঢ়ী শ্রেণীদের সঙ্গে ইহাদের কোন সম্পর্ক নাই। রাঢ়ে ও বরেন্দ্র পঞ্চ ব্রাহ্মণের
সন্তানেরা বসতি করার পর মধ্যদেশ হইতে আসিয়া
যে সকল ব্রাহ্মণ এদেশে আসিয়া বাস করেন, তাম্রপট ও শিলালিপিতে উহাদিগকে ‘মধ্যদেশ
বিনির্গত’ বলিয়া লেখা আছে। “
আমরা পণ্ডিত জগমোহন রচিত গ্রন্থে “দেশাবলি
বিবৃতি”তে যা পাই” মধ্যদেশী ব্রাহ্মণানাং বসতি
বৈ পুরাকৃতা। বল্লালসেনেন ভুপাল রাজাদিশূর সুনুনা। অকুলীন কুলীনত্ব ব্রাহ্মণানাং
বিভাগশঃ। স্থানং ত্রিসু হি দেশেষ্য কৃতং বৈ
নৃপসুনুনা।। “
অষ্টাদশ শতাব্দীর শুরুতে ভূরসুট স্বাধীন রাজ্য ছিল। বর্ধমান মহারাজা ‘কীর্তিচন্দ্র রায়’ ভূরসুট
রাজ্য অধিকার করে এই স্থান মুসলমান রাজ্যের
অন্তর্ভুক্ত করেন। সেই সময় রাজা নরেন্দ্রনারায়ণ
রায় ভূরসুটের শাসনকর্তা ছিলেন; বর্ধমান রাজার
সহিত সম্পর্কের অবনতি হওয়ায়, মহারাজা
কীর্ত্তিচন্দ্র ভূরসুট দুর্গ আক্রমণ ও লুণ্ঠন করে
এই রাজ্য কে মুসলমানদের হস্তে তুলে দেন।
নরেন্দ্রনারায়ণের পুত্র বঙ্গের প্রসিদ্ধ কবি ভারতচন্দ্র
রায়-গুনাকর এই স্থানে ১৬৩৪ শকাব্দে জন্মগ্রহণ
করেন। তিনি ‘ অন্নদামঙ্গলে’ এই ভাবে পিতৃপরিচয়
দিয়েছেন :
“ভূরসুট পরগণায় নৃপতি নরেন্দ্র রায়
মুখটি বিখ্যাত দেশে দেশে।
ভারত তনয় তাঁর অন্নদা মঙ্গল সার
কহে কৃষ্ণচন্দ্রের আদেশে।। “
ভারত চন্দ্র রায় তাঁর পিতৃ সম্পত্তি বাজেয়াপ্ত
হলে, মাতুলালয়ে গমণ করেন এবং সেখানেই
বিদ্যাভ্যাস করেন। মাত্র ১৪ বৎসর বয়সে তাঁর
বিবাহ হয়। হুগলি জেলার দেবানন্দপুর গ্রামে
জমিদার রামরাম দত্ত মুন্সী মহাশয়ের আশ্রয়ে
থেকে পারসী অধ্যয়ন করেন। তিনি “সত্যপীরের
কথা” নামক পাঁচালী কবিতায় এই রূপ লিখেছেন।
” দেবের আনন্দ ধাম, দেবানন্দপুর গ্রাম
কহে অধিকার রাম-রাম দত্ত মুন্সী।
ভারতে নরেন্দ্র রায় দেশে যার যশ গায়,
হয়ে মোরে কৃপাদায়, পড়াইল পারসী।।
দুইঃ
বর্ধমানরাজ কর্তৃক ভূরসুট পরগনা বাজেয়াপ্ত করা হয়। এই বিষয়ে ঐতিহাসিক হান্টার সাহেবের যা
লিখেছেন তা হ’ল:-
“Kirtti Chanda Rai inhereted the ancestral Zamindari and added to it the Paragana of Chetwa, Bhursut, Barda and Monohar Sahi.
He was bold and adventurous and fought
with the Rajas and Dispossessed them
of their petty kingdoms. “
ভূরশুট রাজ্যের অধিপতি কায়স্থ রাজা পাণ্ডুদাস
শ্রী ধর আচার্যের প্রধান পৃষ্ঠপোষক ছিলেন।
তাঁর পূর্বে একজন ধীবর রাজা এই স্থানের শাসন-কর্তা ছিলেন বলে জানা যায়। রাজা
পাণ্ডুদাস এর পর নবাব হুসেন শাহের রাজত্বকালে
চতুরানন নিয়োগী নামে একজন রাঢ়ীয় ব্রাহ্মণ
রাজবংশের প্রতিষ্ঠা করেন। চতুরানন এর দৌহিত্র
ফুলিয়ার মুকুটিবংশীয় কৃষ্ণ রায় ভূরশুটের প্রথম
ব্রাহ্মণ রাজা। তিনি সম্রাট আকবরের রাজত্বকালে
১৫৮৩-৮৪ খৃষ্টাব্দে ভূরশুটে রাজত্ব করতেন। এই
রাজ বংশের কৃষ্ণ রায়ের বংশধর রাজা
প্রতাপনারায়ণ (নাতি) ছিলেন কীর্ত্তিনাথ পুরুষ।
তাঁর পিতার নাম রুদ্রনারায়ণ আর মাতার নাম
ভবশঙ্করী। রুদ্রনারায়ণ কম বয়সে মারা যান।
এই সময়কালে, যখন পুত্র নাবালক, রাণী
ভবশঙ্করী এই রাজ্য শাসন করেছেন । রাজনীতি, সমাজ, দর্শন, আধ্যাত্বিক বিষয়ে তাঁর জ্ঞান ছিল।তিনি ছিলেনযুদ্ধে পারদর্শী, হাতির পিঠে চেপে কামান নিয়ে যুদ্ধ করতে পারতেন। পাঠান সৈন্যদের হারিয়েছিলেন। ভয়ে পাঠান সর্দার ওসমান খান উড়িষ্যা পালিয়ে গেছলোh। হিন্দু রাজ্য প্রতিষ্ঠা পেল।
মুঘল সম্রাট আকবর পাঠানদের বাংলায় আক্রমণ মেনে নিতে পারেন নি। রানী ভবশঙ্করীর এই যুদ্ধে
( Battle of Kastasangrah) জয়ের খবর তিনি
পেয়েছিলেন। তৎকালীন বাংলার গভর্নর মানসিংহ
কে পাঠিছিলেন রাণী ভবশঙ্করীকে পুরস্কৃত ও স্বীকৃতি দেবার জন্য। ভূরিশ্রেষ্ঠ রাজ্যের স্বাধীনতা
ও সম্মানীয় স্বীকৃতি দেওয়া হয়েছিল এক অনুষ্ঠানের মাধ্যমে। রানীকে দেওয়া হয়েছিল
একটি স্বর্ণ মুদ্রা, একটি ছাগল ও একটি কম্বল।
একটি সীলমোহর যুক্ত মানপত্র অর্পন করেন
এই ভাবে ” মহারাণী ভবশঙ্করীকে রায়বাঘিনী
আখ্যা দেওয়া হইল। মুঘল সম্রাটরা কোনদিন
ভূরশুট রাজ্যের ব্যাপারে কোনরূপ হস্তক্ষেপ করবে না।
এই বংশের সুযোগ্য পুত্র রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র
অনেক কষ্টের মধ্যে দিন কাটাতে হয় যখন
বর্ধমানের মহারাজা নরেন্দ্রনারায়ণকে সিংহাসন-চ্যুত করলেন এবং রাজ্যকে বাজায়প্ত করলেন।
আগের ঘটনা ঃ –বরদার রাজা শোভা সিংহের হাতে বর্ধমানেররাজা কৃষ্ণরাম রায় নিহত হন। তাঁর পুত্র জগৎরাম বর্ধমানের শাসনভার গ্রহণ করেন। ১৭৩২ খৃষ্টাব্দে তিনি মারা গেলে তাঁর পুত্র
কীর্তি চন্দ্র রায় বর্ধমানের শাসন গ্রহণ করেন।
মুসলমান রাজত্ব কালে বঙ্গদেশে ক্ষুদ্র ক্ষুদ্র রাজ্য
হিন্দুদের দ্বারা শাসন হ’ত। কীর্তি চন্দ্র হিন্দু
রাজাদের সাতন্ত্র্য লুপ্ত করে মুসলমানদের
হাতে তুলে দেন। অনেক জমিদারি নিজের জমিদারী ভুক্ত করেন।
তিনঃ
ভূরশুট রাজ্যের তিনটি দুর্গ ছিল ১) গড় ভবানী পুর ২) পাণ্ডুয়া(পেড়ো বসন্তপুর) ৩) রাজবলহাট
এখন দুর্গের অস্তিত্ব নেই। হাওড়া জেলার ডিহি
ভূরশুটে পুরানো রাজধানী ছিল রাজবলহাটে।চণ্ডী মাতার আর এক রূপ রাজবল্লভী এই বংশের কূল দেবী, অষ্টধাতুর মূর্তি। হাওড়া জেলাতে ডিহি ভূরশুট,দামোদরের ঐ পাড়ে। ইং ২০১২ সালের ফেব্রুয়ারি মাসে বাৎসরিক রায়বাঘিনী রাণী ভবশঙ্করী স্মৃতি মেলা শুরু হয়। রাণীর যুদ্ধ জয়, সাহসিকতার বীরত্বের কাহিনী আজও শোনা যায়।
ভারতচন্দ্র রায়-গুনাকর ২০ বৎসর বয়সে ভূরশুটে যান পিতৃ সম্পত্তি উদ্ধার করার জন্য। এই সম্পত্তি
ছিল ভূরশুটেরশাসন কর্তা রাজা নরেন্দ্রনারায়ণের।
ভূরশুটে তিনি বর্ধমানের রাজা কর্তৃক কারারুদ্ধ হন। বেশ কিছুদিন পরে কারাগার হ’তে পালিয়ে কটকে যান, আশ্রয় নেন তথায় মহারাষ্ট্রীয়দের কাছে।
এরপরে তিনি ফরাসীদের অধিকৃত চন্দননগরের দেওয়ান ইন্দ্রচন্দ্রের কাছে আশ্রয় লাভ করেন।
ভারত চন্দ্রের প্রতিভার কথা শুনেছিলেন মহারাজা
কৃষ্ণচন্দ্র, এই স্থান থেকে ভারতচন্দ্রকে নিজের
রাজসভায় নিয়ে যান। ভারতচন্দ্রকে মাসিক চল্লিশ
টাকা বৃত্তি দিতেন। রাজসভায় তিনি মহারাজাকে
‘অন্নদামঙ্গল’ ও ‘বিদ্যাসুন্দর’ পাঠ করে শুনান।
মহারাজা কৃষ্ণচন্দ্র পাঠ শুনে মুগ্ধ হন, প্রীতি হয়ে
‘রায়গুণাকর’ উপাধি দেন এবং মূলাজোড়ে বহু
নিস্ক্রিয় সম্পত্তি ভারতচন্দ্রকে প্রদান করেন।
ভারতচন্দ্র ‘রসমঞ্জরী’ নামক আর একখানি গ্রন্থ
প্রণয়ন করেছিলেন। মাত্র ৪৮ বৎসর বয়সে ১৬৮২
শকাব্দে তিনি ইহধাম ত্যাগ করেন।
কৃষ্ণনগর-কোতয়ালী থানার অন্তর্গত এই
গ্রামটিরপ্রাচীন নাম ছিল দীর্ঘিকানগর। কৃষ্ণনগর-রাজবংশের প্রতিষ্ঠাতা ভবানন্দ মজুমদারের পৌত্র রাজা রাঘব দীঘি খনন, রাস্তাঘাট অন্যান্য উন্নতির সঙ্গে দীঘির পূর্ব
-দিকেএকটি সুন্দর অট্টালিকা তৈরি করেন
এবং পাশাপাশি দুটি মন্দির নির্মাণ করে প্রতিষ্ঠা
করেছিলেন। মন্দিরটির একটিতে রাঘবেশ্বর পূজিত হন। রাঘবেশ্বর মন্দিরে উক্ত লিপিতে
রাঘব প্রতিষ্ঠিত একটিমাত্র মন্দিরেরই উল্লেখ আছে। মহাকবি ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলে’
রাঘব কর্তৃক দীঘি খনন ও শিব প্রতিষ্ঠার কথা
উল্লেখ আছে। আরও লিখেছেন যে,তিনি
দেগাঁয়েরকুমার দেপালের রাজ্য ও ধনসম্পদ
লাভ করেছিলেন।
রানাঘাট থানাতে দেবগ্রামে দেবপাল নামক
কুম্ভকার জাতীয় এক রাজার সুবিখ্যাত গড় ছিল।
ভারতচন্দ্রের ‘অন্নদামঙ্গলে’ বলা হয়েছে যে, দেবী
অন্নপূর্ণার রোষে দেবপালের পতন হয়এবং তাঁর
রাজ্য ভবানন্দ পৌত্র রাজা রাঘবেশ্বরের হস্তগত হয়।
মহাকবি রায়গুণাকর ভারতচন্দ্র রায়ের ‘আট হাট
সোরগোল বত্রিশ বাজার’-এর অন্যতম বর্ধমানের
নবাবহাট বর্ধমান শহরের শেষপ্রান্তে পশ্চিমে অবস্থিত। নবাব হাটে ১০৯ টি শিবমন্দির ১১৯৫ বঙ্গাব্দে(১১৯৫ খ্রিস্টাব্দে) মহারাজা তেজশচন্দ্রের
মাতা বিষণকুমারী ইংরেজদের সঙ্গে বিরোধে জয়ী
হয়ে এই ১০৯ টি শিবমন্দির তৈরি করান।
★★★
তথ্যসূত্রঃ
১) হুগলী জেলার ইতিহাস
সুধীরকুমার মিত্র বিদ্যাবিনোদ
২) বাংলার মন্দির স্থাপত্য ও ভাস্কর্য
ডঃ(অধ্যাপক) প্রণব রায়