শ্রী কানাই লাল দীর্ঘাঙ্গী-র
চন্দ্রকোনার হারিয়ে যাওয়া ছোট ছোট ইতিহাস নিয়ে
মেদিনীপুরের ভুলে যাওয়া ইতিকথা
শালফুল উপন্যাস, টুসুগান ও সাহেব পটে নায়েক বিদ্রোহ, চন্দ্রকোণার ফাঁসি ডাঙ্গা, গণগণির নায়েক শিবির ও মেদিনীপুরেরপুরাতন জেল খানার ফাঁসী দেওয়ার অশ্রু সজল কাহিনী:
শ্রী কানাই লাল দীর্ঘাঙ্গী
পর্ব-১৮
(এই মর্মস্পর্শী গণ-বিদ্রোহের সমসাময়িক সত্য ঘটনা আমরা ‘শালফুল’ নামক ঐতিহাসিক উপন্যাস থেকে জানতে পারি। …
টুসুগান পর্যন্ত আগের অংশে লেখা হয়েছে।)
……. …………………………….
এই পাহাড়ে নেই কোন মধু
ভ্রমর নাই যে খায় চুষে।
পূর্ব্বেই বলা হয়েছে যে সে সময়ে ইতস্তত: বহু লায়কালি গড় ছিল। এ সমস্ত গড় বা দুর্গ থেকে
এতদ্দেশীয় বীরগণ তীর ধনুক, বর্শা, কাঁচা বেল
ইটপাটকেল বা লুঠ করা বন্দুক ও কামান ইত্যাদি
দ্বারা ইংরেজ সৈন্যের সঙ্গে যুদ্ধ করতেন। কখনো
ইংরেজ সৈন্য সুউচ্চ মাটির পাহাড় দিয়ে ঘেরা দুর্গ
-গুলিকে কামান ও বন্দুকের গুলিতে ধ্বংস করে দিত; এর ফলে বহু নায়েক বীর মারা যেতেন।
তাই এমনি একদিন টুসু রানী তার যৌবন পাহাড়কে দেখিয়ে আক্ষেপ করে বলছে, ‘তার
যৌবন পাহাড়ের মধু পান করার মত এখন কোন ভ্রমর নেই’ অর্থাৎ তাঁর স্বামী লায়কালি গড়ে ইংরাজ সৈন্যদের যুদ্ধে মারা গিয়েছেন। আর
এর সাথে সাথে তার যৌবন পাহাড়ের মধুও
শেষ হয়ে গিয়েছে।
টুসুগান
(২)
বিষ্ণুপুরে দেখে এলাম
কাড়া লড়াই লেগেছে
ছোট কাড়ার শিং ভেঙ্গেছে
রক্তেতে বান ছুটেছে।
সিপাই বলে পালাও পালাও
দারোগার পথ ঘিরেছে;
ও দারোগা! পথ ছাড়া
টুসু মা যাবেন পুরুল্যা।
বিষ্ণুপুরেও এই গণ -বিদ্রোহ হয়েছিল। উপরোক্ত
টুসু গানটি ঐখানের ই এক যুদ্ধের; প্রথমতঃ এতদ্দেশীয় কোন বীর আহত হওয়ায় তুমুল সংগ্রাম হয়। এ সময় এঁদের আক্রমণে ইংরেজ
সিপাহীরা ছত্রভঙ্গ হয়ে গিয়েছিল; তখন দারোগা
তাদের পথ ঘিরে পুনশ্চঃ যুদ্ধে প্রনোদিত করেছিলেন। কিন্তু অবশেষে যুদ্ধে হেরে গেলে
টুসু নিরুপায় হয়ে পুরুলিয়ার গভীর জঙ্গলে গিয়ে
আশ্রয় গ্রহণ করতে চেয়েছিল। সেহেতু সেদিন
টুসু রাণী কাতর ভাবে দারোগা বাবুকে পথ ছাড়তে
বলে। কারণ অনেক সময় ইংরেজ সৈন্য কায়দায়
পেয়ে তাদের উপর অত্যাচার করত। এই দেশে জঙ্গলের অধিবাসী, যাদের কাড়ার মত গতর ছিল ও রঙ ছিল কৃষ্ণবর্ণ।
এই রক্তক্ষয়ী সংগ্রামে বিদ্রোহীগণ বিনা কারণে
নিরীহ জনপদবাসীর উপর কখন ও অত্যাচার করতেন না। তবে কেহ বিশ্বাস ঘাতকতা করলে
তাকে তাঁরা ভীষণ ভাবে শাস্তি দিতেন।
বিদ্রোহী হাবল ও রাজেন্দ্রের বিস্তৃত বিবরণ এ পর্যন্ত উদ্ধার হয়নি, তবে ফাগু ও সুবল দুভায়ের
বাড়ী ছিল বর্তমান চন্দ্রকোণা থানা এলাকার
রামগড় গ্রামে। কারণ সুবলের নামে রামগড়ের ‘সুবল বাঁধ’। এঁরা জাতিতে ছিলেন ভূমিজ। আজ ও
লোকে বলে, “বিদ্রোহী সুবল দুর্ধর্ষ প্রকৃতির ছিলেন।
রামগড়ের সদগোপ বংশীয় মহিলাদি’কে তাঁর স্ত্রী কে মাথা বেঁধে দিতে হ’ত। হাবল, রাজেন্দ্র, ফাগু ও
সুবল প্রভৃতি নেতৃস্থানীয় বীরদিগের ফাঁসী এই সময় ফাঁসী ডাঙ্গার ফাঁসী মঞ্চেই হয়েছে”। দুর্ভাগ্যবশত গড়বেতার ” গণগণির ডাঙ্গার” নায়েক শিবির ইংরেজ গণ কর্তৃক ধ্বংস হলে সেনাপতি অচল সিংহ আত্মগোপন করেন। কেহ বলেন তাঁর এক বিশ্বস্ত অনুচরই সরকারের নিস্কর জমি পাবার
লোভে তাকে ধরিয়ে দেয়া। সে যা হোক, পরবর্তীকালে নায়েক বিদ্রোহের সর্বাধিনায়ক সেনাপতি অচল সিংহ ও অন্যান্য বিদ্রোহী ৩০জন
বীরের কোম্পানির বিচারে মেদিনীপুরের পুরাতন জেলখানা (মারাঠা দুর্গ )র সংলগ্ন মাঠে প্রকাশ্যভাবে ফাঁসী হয়। এই ফাঁসী দেওয়ার
রোমাঞ্চকর ঘটনা সম্মন্ধে প্রবোধবাবু তাঁর রচিত
‘শালফুল’ উপন্যাসের চতুর্বিংশ পরিচ্ছেদে লিখেছেন :
ক্রমশঃ…