জলছাপে ইতিহাস ও ঐতিহ্যের পুজো

পরিচিতি দুর্গাশঙ্কর দীর্ঘাঙ্গী দীর্ঘদিন ধরে ইতিহাস নিয়ে লেখালিখি করছেন।লেখক চন্দ্রকোনার বাসিন্দা।স্বর্গীয় কানাইলাল দীর্ঘাঙ্গীর সুযোগ্য পুত্র।মূলত মেদিনীপুর তথা চন্দ্রকোনার ইতিহাস চর্চার সাথে নিজেকে জড়িয়ে রেখেছেন।নিজের প্রচেষ্টায় তৈরি করেছেন একটি স্বয়ংকৃত মেদিনীপুরের ইতিহাস সংরক্ষনাগার।

 

গ্রাম বাংলার ৩২৪ বৎসরের প্রাচীন দুর্গাপূজা পশ্চিম মেদিনীপুরের জগন্নাথপুর গ্রামে

শ্রী দু র্গা শ ঙ্ক র   দী র্ঘা ঙ্গী

গ্রামবাংলার একটা বৃহৎ অংশের মানুষের কাছে দুর্গাপুজো মানে শুধুই পুজো বা উৎসব নয়, পুজো মানে একটা চাপা আবেগের বহিঃপ্রকাশ।এই পুজোর বনেদিআনার জগতে লুকিয়ে আছে বহু খোয়া যাওয়া ইতিহাসের ঐতিহ্য। যা সারা বাংলার সিগনেচার। তারই ইতিহাস ঐতিহ্যের খোঁজ করতে গিয়ে পেয়ে যাওয়া যায় বহু মূল্যবান সংস্কৃতি ও তথ্যের খোঁজ। জগন্নাথ পুরের ভট্টাচার্য্য বাড়ির পুজো নিয়ে লিখতে গিয়ে এরকম বহু স্মৃতি সংস্কৃতি, ইতিহাস ও ঐতিহ্যের আকর উঠে এলো।
এই গ্রামে ভট্টাচার্য্য পরিবারের দূর্গাপূজা তথা বাংলার প্রাচীনপূজাগুলির মধ্যে অন্যতম। আজ থেকে ৩২৪ বছর আগে ১৬৯৬ খ্রিস্টাব্দে দূর্গাপূজা প্রথম প্রবর্তন করেন৺রাম রাম তর্কালঙ্কারের দ্বিতীয় পুরুষ৺বেচারাম ন্যায়ভূষণ মহাশয় পাইক মাজিটা গ্রামে। ভট্টাচার্য্য পরিবারের  কূলদেবতা ৺শ্রী ধর জীউ এই গ্রামের বাড়িতে অধিষ্ঠিত আছেন। এই গ্রামের পূজো চিরাচরিত চলে আসছে

জগন্নাথপুর গ্রামের চাষ বাড়িতে দূর্গাপূজার পত্তন করেন ৺বেচারাম ন্যায়ভূষণের পুত্র ৺তারকনাথ ভট্টাচার্ষ্য মহাশয়। এইখানে ৺দামোদর জীউ অধিষ্ঠিত আছেন। এইখানে দেবীর মূর্ত্তি আগের মতন তৈরি হয়। মা এখানে কন্যারূপে পূজো পান। আচার অনুষ্ঠান, ভোগ দর্শন, আগের পদ্ধতি মেনে করা হয়। বৈষ্ণব মতে পূজো করা হয়। চিরাচরিত গ্রামবাসীদের সবাই সোৎসাহে অনুষ্ঠানে অংশগ্রহণ করে।  সপ্তমী, অষ্টমী, নবমীর দিনগুলিতে ভোগ দর্শনে খিচুড়ি, তরকারির বিভিন্ন পদ, পায়েস, বিভিন্ন ধরনেরহাতে তৈরি নারকেল নাড়ু, তিল নাড়ু, মুড়কি,নানা ফলমূল দেওয়া হয়। এই পুজো উপলক্ষে গ্রামবাসীরা সবাই আমন্ত্রিত হন। খিচুড়ি ভোগ , প্রসাদ সবাই কে দেওয়া হয়। মন্দিরের দুই পাশে দুটি বড় পুস্কারিনী আছে। একটিতে ঘট ডোবানো হয় আর একটিতে ঠাকুর  বিসর্জন দেওয়া হয়। 
বংশ পরম্পরায় এই পূজো প্রতি বছর পালন হয়। ৺তারকনাথ ভট্টাচার্য্যের দুই সন্তান ৺চারু ভট্টাচার্য্য ও ৺অখিল ভট্টাচার্য্যের হাত ধরে এই পরিবারের পুত্র, নাতি, নাতনী, পুত্রদের বংশধরগণ আজও পুজা করে আসছেন। 


জমিদারি আর নেই। দূর্গা পূজো বংশ পরম্পরা চলে আসছে। এই পূজো অনুষ্ঠানের যাবতীয় খরচ বর্তমান প্রজন্মরা  করে থাকেন। এই সমস্ত ঘটনা বলছিলেন  এই বংশের এক ব্যক্তি শ্রী দিলীপ ভট্টাচার্য্য মহাশয়। রথযাত্রার প্রথমদিনে ঠাকুরের কাঠামোতে গঙ্গামাটি লেপন করে দেবীকে ধ্যান করে আহ্বান করা হয়। তারপরে কাঠামোর পূজো করা হয়। তারপরে মূর্ত্তি গড়া হয়। এই পূজো অনুষ্ঠিত হয় টিনের দালান মন্দিরে। 
এই বংশের পুত্রবধূ আরতি ভট্টাচার্য্য জানালেন নবপত্রিকা তুলে এনে পূজোর কাজ শুরু হয়। এই সময় বাড়ির, ছেলে, মেয়ে, পুত্রবধূ, নাতি নাতনীরা সবাই বাড়ির অনুষ্ঠান উপভোগ করার জন্য কর্মস্থল থেকে দেশের বাড়িতে আসেন। শরৎকালের পূজোতে আসা, সবুজায়ন দেখা, খোলা তাজা হাওয়ার অনুভূতি  সবার ভালো লাগে। এই বছর পূজোতে দর্শনার্থীদের জন্য স্যানিটাইসার, মাস্ক অবশ্যই থাকবে। সরকারি নিয়ম বিধি পালন করা হবে। হাইকোর্টের নির্দেশ মেনে পূজো হবে। যেহেতু মন্দির খোলমেলা স্থানে তাতে পূজার কোন প্রতিবন্ধকতা হবে না। জানালেন সৌমাল্য ভট্টাচার্য্য ও তার ভাই বোনেরা। এই বংশের প্রধান পুরুষ রাঢ়ী ব্রাহ্মণ পণ্ডিত ৺রঘুনাথ শিরোমণি। বর্ধমান মহারাজা তাঁকে নিষ্কর ২৫ বিঘা জমি ও দুটি সায়র দান করেন এবং টোলের বৃত্তির চিরস্থায়ী বন্দোবস্ত করেন। আরো কয়েকটি গুরুত্বপূর্ণ খবর পাওয়া গেল এই বংশের একজন পণ্ডিত ৺রাজেন্দ্র নাথ স্মৃতি তীর্থ (আদি  থেকে নবম পুরুষ) জয়রাম বাটীতে শ্রীশ্রী মা সারদা দেবীর জনক -জননী রামচন্দ্র মুখোপাধ্যায় ও শ্যামা সুন্দরী দেবীকে মন্ত্র দীক্ষা দিয়েছিলেন। সেই সূত্রে  ভট্টাচার্য্য বংশকে “গুরু বংশ” বলে স্বীকৃত হয়ে আসছে। এই জগন্নাথপুর গ্রামে ঠাকুরদাস বন্দোপাধ্যায় মহাশয় বিদ্যাসাগর মহাশয়ের জন্য পাত্রী দেখতে গিয়েছিলেন। আর একটি বিশেষ ঐতিহাসিক ঘটনা হল। ডিহিদার মামুদ কর্তৃক বর্ধমানের দামুন্যা গ্রামের কবি কঙ্কন মুকুন্দরাম অত্যাচারিত হয়ে জমি জায়গা ছেড়ে সস্ত্রীক সন্তানদের নিয়ে মেদিনীপুর জেলার জগন্নাথপুর গ্রামের আগে ঘুচুড়া গ্রামে আসেন। স্বপ্নাদেশে মাতা চণ্ডী কে পান। সায়রে স্নান করে শালুক ফুল তুলে মাচণ্ডীর আরাধনা করেন। পরে এই জনপথ ধরে ব্রাহ্মণ ভূমের রাজা বাঁকুড়া রায়ের আঢ়ঢ়া গ্রামে আসেন। এই গ্রামটি মেদিনীপুর জেলার নেড়াদেউলের সন্নিকটে। রাজা আশ্রয় দেন। জমি জায়গা, থাকার ঘর দেন। পরবর্তী সময়ে রঘুনাথ রায়ের আমলে কবিকঙ্কণ বিখ্যাত চণ্ডী মঙ্গল কাব্য রচনা করেন। জগন্নাথপুর গ্রাম তাই ইতিহাসে বিশেষ স্থান নিয়ে আছে। 

তথ্য ঋণ: শ্রী দিলীপ ভট্টাচার্য্য
             শ্রীমতি আরতি ভট্টাচার্য্য

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *