জ য় ন্ত   কু মা র   ম ল্লি ক–লিখলেন “ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জলদাপাড়া”

পরিচিতিঃ জন্ম- ১৯৫২, হুগলী শহর শিক্ষাদীক্ষা স্নাতক- কবি, স্নাতকোত্তর- ববি; গবেষণাপত্রঃ উত্তরবঙ্গ উপ-হিমালয়ের বনবস্তির আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা; প্রাক্তনী- বন্যপ্রাণ শাখা, বনবিভাগ (১৯৭৬-২০১২); জীববৈচিত্র্য-বাস্তুসংস্থান বিষয়ে গ্রন্থকার, জার্নাল-পর্যালোচক; দেশবিদেশে প্রকাশনা ১৪০। মুক্তির সন্ধানে সঙ্গীত চর্চা। বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁরই একটি গদ্য। এর আগে বাইফোকালিজম্-র পাতায় তিনি লিখেছেন একটি ধারাবাহিক গদ্য- “অথ নেকড়ে মানব মানবী কথা”

 

ঐতিহাসিক ও সাংস্কৃতিক প্রেক্ষাপটে জলদাপাড়া

জ য় ন্ত   কু মা র   ম ল্লি ক

উত্তরবঙ্গে আলিপুরদুয়ার জেলার টোটোপাড়াতে বিশ্বে টোটো উপজাতির একমাত্র অস্তিত্ব টিকে রয়েছে। রাষ্ট্রসংঘের বিলুপ্তিপ্রায় তালিকাতেও নাম উঠেছে টোটোদের। ভুটান সীমান্ত সংলগ্ন বিখ্যাত জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যানের উত্তর সীমানায়, তোর্সা নদীর পশ্চিম তীরে এবং দক্ষিণে তিতি বনের পাশে অবস্থিত এই গ্রামটির মোট এলাকা ৮.০৮১৪ বর্গ কিমি। একশো বছর আগে জলপাইগুড়ি জেলার সার্ভে রিপোর্টে জে এ মিল্লিগান এই টোটোপাড়ার মোট আয়তন জানিয়েছেন ২০০৩ একর। যার মধ্যে টোটোরা বসবাস ও চাষবাসের জন্য ব্যবহার করতেন ৩০০ একর। এই রিপোর্টে তাদের নিজস্বতা র‌ক্ষায় জমি আদানপ্রদান, কেনাবেচা বা অন্য জনগোষ্ঠীর বসতি করা থেকে বিরত থাকার প্রস্তাব ছিল। এরও আগে উনিশ শতকের শেষ দিকে ডি সান্ডার-এর রিপোর্টে ডুয়ার্সের এই জনজাতির ৩৬টি বাড়ির কথা আছে। মাদারিহাট থেকে ২২ কিমি দূরে অবস্থিত এই গ্রামের টোটো এলাকাগুলি ছয়টি ভাগে বিভক্ত- পঞ্চায়েতগাঁও, মন্ডলগাঁও, সুব্বাগাঁও, মিত্রগাঁও, পূজাগাঁও এবং দুমচিগাঁও। এই পাড়াগুলোকে পাহাড় থেকে নামা লেংপাংতি, নিতিংতি, চুয়াতি, দাতিংতি, পাচো ঝোরা আলাদা করেছে। মাদারিহাট থেকে টোটোপাড়ার যাত্রাপথে বাংরি, তিতি, পূর্ণিখোলা, কালীখোলা, ডয়ামারা নদীর পর হাউড়ি নদী। নুড়ি-বালির এই নদী পেরোলেই টোটো বসতি।
জনশ্রুতি ১৮৬৫ এর ইঙ্গ-ভুটান যুদ্ধে ইংরেজদের হয়ে টোটা বহন করেছিলেন বলেই জনজাতির নাম টোটো। জনশ্রুতি, তারও বহু আগে তিব্বত-ভুটান অঞ্চলে প্রতিদ্বন্দ্বী মঙ্গোলয়েড বংশোদ্ভূত ‘দোয়া’ সম্প্রদায়ের সাথে সাথে লড়াইয়ে পরাজিত হয়েই টোটোরা নেমে আসেন তাদিং আর বাদুর আশ্রয়ে। লোকশ্রুতি অনুযায়ী আজও মেঘে ঘেরা তাদিং এর পাথরে, মাটিতে ভেসে বেড়ায় টোটোদের প্রাচীন পূর্বপুরুষেরা। আগে পাহাড়ের গায়ে ‘ঝুমচাষ করতেন টোটোরা। সে সময়ে ছিল খয়ের গাছের কাঠামোয় নিজস্ব রীতির কুটির। আজ প্রায় সাড়ে তিনশো পরিবারের মধ্যে তা দশটাও নেই।
১৮৬৫ সালের ইন্দো-ভুটান যুদ্ধের পর, কিছু টোটো ভুটানের অভ্যন্তরে স্থানান্তরিত হয় এবং বাকি জনসংখ্যা এখনও টোটোপাড়ায় বসবাস করে। এদের কথ্য ভাষা টোটদি কইপ্রওয়্যা বা টোটোদের ভাষা। এরা নিজেদেরকে হিন্দু বলে, তবে এখানে মূর্তি পূজার অভ্যাস নেই এবং এরা কোনো হিন্দু উৎসবও পালন করে না। টোটোরা প্রকৃতি দেবতাদের পূজা করে। টোটোরা বিশ্বাস করে যে ঈশ্বর ইশপা যিনি ভুটানের বাদু পাহাড়ে থাকেন তিনি অসন্তুষ্ট হলে তারা অসুস্থ হয়ে পড়তে পারে। টোটোরা তাঁকে সন্তুষ্ট করার জন্য শূকর, ছাগল, পায়রার মতো প্রাণী বলি দেয় এবং ‘ইউ’ পান করে। ‘ওমচু’ পুজোর শেষে বর্ষবরণের উৎসবে মেতে ওঠে টোটোপাড়া। ওমচু পুজো মুলত বর্ষা শেষের ইঙ্গিত দেয়। বর্ষায় দুর্যোগের  কারণে আত্মীয়স্বজনদের সঙ্গে যোগাযোগ কিছুটা বিচ্ছিন্ন থাকে। ওমচু পুজোয় তা নতুন করে চালু হয়। ওমচু পুজোর চারদিন মুলত পাহাড়, নদী-নালা, গাছ আর প্রকৃতির বন্দনা করেন টোটোরা। চারদিনের পুজো শেষে শুরু হয় বর্ষবরণের উৎসব। টোটোদের ধর্মীয় স্থান ‘দেমশা’-কে ঘিরে শুরু হয় উৎসব। সেখানে যত্ন করে রাখা দু’টি লম্বা ঢোল (দু’টির একটি পুরুষ, অপরটি নারীশক্তির প্রতীক) সাইঞ্জা ও ঈশপাকে এই সময় বিয়ে দেওয়া হয়। এই দুই ঢোলই টোটোদের দেব ও দেবী। টোটোরা মূর্তি পুজায় বিশ্বাস করে না। এই সময় তাঁদের ঘরে ঘরে বলি দেওয়া হয় মোরগ ও মুরগি। এরপর চলে সেই মাংস ও ভাত আত্মীয়স্বজন ও পড়শিদের বাড়ি বাড়ি বিলি করার পালা। টোটোরা ‘গরম পূজা’ বা পুরো গ্রামের মঙ্গল প্রার্থনা নামে আরেকটি উৎসবের আয়োজন করে। এই পূজার জন্য তারা গ্রামের সীমানা অতিক্রম করে একজন পুরোহিতকে নিয়ে আসে। পূজায় নারীদের উপস্থিতি নিষিদ্ধ। টোটোদের ‘ইউ’ নামক ঐতিহ্যবাহী পানীয় মারুয়া (স্থানীয় বাজরা) এবং চালের গুঁড়ো গাঁজিয়ে তৈরি, যেটি তারা সব উৎসবে সেবন করে।


এলাকায় দুটি প্রাইমারি ও একটি মাধ্যমিক স্কুল রয়েছে। ১৯৭৯-তে চিত্তরঞ্জন টোটো প্রথম মাধ্যমিক পাশ করেছিলেন। মিস রিটা টোটো ২০১০ সালে স্নাতক হওয়া প্রথম মহিলা টোটো। ধনঞ্জয় টোটো উত্তরবঙ্গ বিশ্ববিদ্য়ালয় থেকে লাইব্রেরি সায়েন্সে প্রথম শ্রেণীর স্নাতকোত্তর, টোটো জনজাতির মধ্য়ে একমাত্র। কিন্তু পড়াশোনা করেও টোটোদের চাকরি না হওয়ায় পড়ার আগ্রহ হারিয়ে ফেলছে পরবর্তী প্রজন্ম। অনেকেই মাঝপথে পড়াশোনা ছেড়ে দিচ্ছে।
টোটোরা বাস করে উঁচু বাঁশের মাচায় (উত্থিত প্ল্যাটফর্ম) তৈরি কুঁড়েঘরে। এরা একসময় বিলুপ্তির মুখে ছিল এবং এখন এদের জনসংখ্যা অনুমান করা হয়েছে ১,৬২৯ (২০২১ সালের আদমশুমারি অনুযায়ী)। টোটোরা ১৩টি গোষ্ঠীতে বিভক্ত যার মধ্যে থেকে তারা বিয়ের পাত্রপাত্রী পছন্দ করে। টোটো পরিবার পিতৃতান্ত্রিক। একস্ত্রী বিবাহের একটি সাধারণ রূপ, তবুও বহুবিবাহ নিষিদ্ধ নয়। টোটোরা এখনও পর্যন্ত তাদের স্বতন্ত্র পরিচয় রক্ষা করেছে যদিও ধীরে ধীরে উন্নয়নের মূল স্রোতে ভেসে যাচ্ছে।
টোটোপাড়ার সাপ্তাহিক বাজার মঙ্গলবার হয়। বিক্রেতারা জামাকাপড় এবং ব্যাগ থেকে মুদি এবং স্ন্যাকস সবকিছু বিক্রি করে। ভুটান থেকে আসে দোয়ারা টোটোপাড়ার সাপ্তাহিক বাজারে কেনাকাটা করতে এবং বাণিজ্য করতে সীমান্ত অতিক্রম করে।
এদের প্রথা এবং সংস্কৃতি নৃতাত্ত্বিক আগ্রহের বিষয়বস্তু। এর মধ্যেই নিজভূমে পাল্টে যাচ্ছে জীবনধারণ আর রীতিনীতির নানা দিক। চল্লিশ বছর ধরে চলা সাপ্তাহিক হাটের এক পাশে এখন স্থায়ী বিউটি পার্লার। প্রকৃতি পূজারি এই জনগোষ্ঠীর কেউ খ্রিস্টধর্মে চলে গেছেন, ইংরেজি মাধ্যম মিশন স্কুলও এখানে চলছে বছর কুড়ি। বিয়ে হচ্ছে সাঁওতালি বা নেপালি মেয়ের সঙ্গে; রাজবংশী ও নেপালি ছেলেকে বিয়ে করে সমাজের বাইরেও চলে গেছেন কেউ। নেপালিদের সংখ্যাগরিষ্ঠ হওয়া শুরু স্বাধীনতার পরের দশকেই। এখন টোটোদের জনসংখ্যার প্রায় দ্বিগুণ আছেন নেপালি, বিহারি ও অন্যান্য গোষ্ঠীর মানুষ। জলদাপাড়ার ট্রলিলাইন কার সাফারির সীমানা লংকাপাড়া বিট ছাড়িয়ে এবার ভুটান পাহাড়ের কোলে টোটোপাড়ায় নিয়ে যাওয়ার পরিকল্পনা করেছে জলদাপাড়া জাতীয় উদ্যান কর্তৃপক্ষ। এই পথে তোর্ষা নদীর সৌন্দর্য্য ও জঙ্গল দেখার সুযোগ রয়েছে। মাঝে মধ্যে বন্যপ্রাণের দেখাও মিলে যায়।
নৃতাত্ত্বিক গবেষক প্রয়াত ড. বিমলেন্দু মজুমদার ১৯৭৫ সাল থেকে সরাসরি টোটোপাড়ায় গিয়ে তাঁর ক্ষেত্রগবেষণা শুরু করেন এবং পরবর্তীতে বিভিন্ন সময়ে সেখানে থেকে তাঁর কাজ চালিয়ে যান। সেই টোটোপাড়াতেই এক শীতের সকালে তাঁর সঙ্গে পরিচয় হয় চার উজ্জ্বল কিশোরের সঙ্গে, যাদের অন্যতম ধনীরাম টোটো। সেইসময়ে টোটোদের মধ্যে এই চার কিশোরই কেবলমাত্র বাংলা লিখতে-পড়তে পারত। এই চারজন টোটো কিশোরকে সঙ্গে নিয়ে দ্বিগুণ উৎসাহে তিনি তাঁর গবেষণা চালিয়ে যান। কিছুদিনের মধ্যেই তিনি বুঝতে পারেন এই চার কিশোরের মধ্যে ধনীরাম একটু আলাদা, স্বতন্ত্র। বাইরের জগৎ সম্পর্কে যেমন তাঁর অদম্য কৌতূহল, তেমনই টোটোপাড়ার বনজঙ্গল, পাহাড়নদী, বন্যপ্রাণী ও তার স্বজনস্বজাতি সম্পর্কে রয়েছে তার অদম্য আগ্রহ। সেখানকার মাটি ও মানুষ সমানভাবেই তার আপনজন। সময়কালে কিশোর ধনীরাম যুবক হয়ে ওঠেন, হাতে কলম তুলে নেন। একসময় ধনীরাম নিজেই হয়ে ওঠেন টোটোপাড়ার নিজস্ব ইতিহাস আর ভূগোলের একক প্রতিভূ। ধনীরামের জন্ম ১৯৬৪ সালে এই টোটোপাড়ায়। পিতা আমেপা টোটো ও মাতা লক্ষ্মিণী টোটো। ধনীরাম তাঁদের মধ্যম পুত্র। টোটো জনজাতির নিজস্ব গোষ্ঠী-নির্বাচিত পঞ্চায়েতের শেষ প্রধান ছিলেন আমেপা টোটো। ১৯৭৭ সাল থেকে সরকারি কাঠামো-নির্ধারিত পঞ্চায়েত চালু হওয়ার মধ্য দিয়ে টোটোদের নিজস্ব গোষ্ঠী-নির্বাচিত পঞ্চায়েত লোপ পায়। প্রথাগত প্রাতিষ্ঠানিক শিক্ষাধারায় ধনীরাম মাধ্যমিক পাশ, কিন্তু তাঁর আসল শিক্ষা জনজাতির জীবনে প্রবাহিত লোকজ্ঞানের সম্পদকে আয়ত্ত করে তার ভাণ্ডারী হিসেবে কাজ করার মধ্য দিয়েই হয়েছে। টোটো ভাষা সুষ্ঠুভাবে লেখার জন্য তিনি একটি লিপি (১৮টি ব্যঞ্জনবর্ণ, ১২টি স্বরবর্ণ)। তিনিই প্রথম টোটোজাতির ইতিহাস উপন্যাসের আঙ্গিকে লিপিবদ্ধ করেন। ‘ধানুয়া টোটোর কথামালা’ হল সেই উপন্যাস। টোটো জনজাতির ইতিহাস, পুরাকথা, প্রকৃতিলগ্ন, জীবনসংস্কৃতির বৈচিত্র্য ও তা ক্ষয়ের যন্ত্রণা তাঁর নিজস্ব দৃষ্টিকোণ থেকে উঠে এসেছে এই উপন্যাসে। উপন্যাসটি শুরু হয় ১৯৭২ সালের এক ভোরবেলায় বালক ধানুয়ার ঠাকুমার সঙ্গে টোটোপাড়া থেকে ২৩ কিলোমিটার দূরে মাদারীহাট যাওয়ার ঘটনাটির বর্ণনা দিয়ে। বন-জঙ্গল-নদীখাত-পাহাড় পেরিয়ে সেই প্রথম যাত্রা তার মনে গভীর রেখাপাত করে। সবথেকে বেশি বিস্মিত করে রেলগাড়ি। এক দীর্ঘ সর্পিল লৌহদানবের প্রচণ্ড গর্জনসহ আগমন বালক ধানুয়াকে বিস্ময়াবিষ্ট করে, আর আমাদের তৎক্ষণাৎ মনে পড়ে যায় সত্যজিতের ‘পথের পাঁচালি’ ছবির বালক অপুর কথা। সমগ্র উপন্যাস জুড়ে সাবলীল ভাষায় ফুটিয়ে তোলা হয়েছে টোটো জনজাতির দৈনন্দিন ক্রিয়াকর্ম, আচার, সংস্কৃতিকে। ফুটিয়ে তোলা হয়েছে বনজঙ্গল, পাহাড়, ঝরনা ঘেরা প্রাকৃতিক পরিবেশটিকে। তথাকথিত সভ্য নাগরিকবাবুদের আদি জনজাতিদের প্রতি অশ্রদ্ধা ও অবহেলা, এমনকি স্কুলের শিক্ষক মহাশয়—বাঙালিবাবু—যিনি শহর থেকে আসেন, তিনিও টোটো ছেলেমেয়েদের অবজ্ঞার চোখে দেখেন। আর প্রবীণ টোটোদের নিজেদের ভাষা সংস্কৃতির প্রতি ভালোবাসা, শ্রদ্ধাবোধ, জঙ্গলও জঙ্গলের প্রাণীদের আত্মার আত্মীয় রূপে দেখার প্রবণতা উপন্যাসে অতি সহজ ভাষায় ফুটে উঠেছে।


জলদাপাড়ার পূবভাগে ইতিহাস বুকে নিয়ে জঙ্গলের ঘেরাটোপে নল রাজার গড় আলিপুরদুয়ারের নল রাজার গড় । ইতিহাসেই এই নামেই পরিচিত ধ্বংসপ্রায় দুর্গটি। অনেক ঐতিহাসিকের মতে এই নল রাজার গড় একসময়ে ছিল কামতাপুরের প্রথম রাজধানী । দুর্গটি কবে তৈরি হয়েছে তা নিয়ে রয়েছে বহু মত । তবে রক্ষণাবেক্ষণের অভাবে একবারেই হারিয়ে যেতে বসেছে এই দুর্গটি । লোকমুখে জানা যায় ১৫৫৪ খ্রিস্টাব্দে কোচবিহারের রাজা নরনারায়ন এই দুর্গ নির্মাণ করেন। জানা গেছে ভুটান রাজার হাত থেকে কোচবিহার এর সৈন্যবাহিনী এবং অস্ত্রশস্ত্র রক্ষা করার জন্য চিলাপাতার গভীর জঙ্গলে এই দুর্গ তৈরি করা হয়েছিল। রাজার প্রধান সেনাপতি চিলা রায় এখানে থাকতেন। লোকমুখে প্রচারিত তার নাম অনুসারেই এই জায়গার নাম হয়েছিল চিলাপাতা। অপরদিকে পরবর্তীতে এখানকার স্থানীয় মানুষজন রাজা নর নারায়ণের নামের উচ্চারণের ত্রুটি হিসেবে এই দুর্গ নল রাজার দুর্গ হিসেবে পরিচিতি লাভ করে। জানা যায় ১৫৮৭ খ্রিস্টাব্দে এই দূর্গের ধংস নিয়ে মতানৈক্য থাকলেও অনেকেই মনে করেন প্রাকৃতিকভাবেই এই দুর্গ ধ্বংস হয়ে যায়। কিছুই অবশ্য অবশিষ্ট নেই গড়ের, গোটা কতক ইটের দেওয়াল ছাড়া। পুরো এলাকাটির উত্তর অংশে একটি পরিখা দু’টি ভাগে বিভক্ত করেছে নলগড় জায়গাটিকে। মনে করা হয়, এখান থেকেই কোচবিহারের সৈন্যরা ভুটানিদের আক্রমণ থেকে রাজ্যকে রক্ষা করত।
দুর্গের কাছের জঙ্গলে একটি অনন্য ধরনের গাছ রয়েছে (রামগুয়া বা রাম গুনা গাছ) যার গায়ে আঘাত করলে মানুষের রক্তের মতো লাল রঙের তরল নির্গত হয়। পৌরাণিক কাহিনী হল যে নলগড়ের অনুগত রক্ষীরা দুর্গের ধ্বংসের সময় রক্ষক গাছে রূপান্তরিত হয়েছিল। বানিয়া ব্লকের বানিয়া ধ্বংসাবশেষ, ঐতিহাসিক স্থানের অবশিষ্টাংশ এবং একটি বড় পুকুর এই অঞ্চলে একটি প্রাচীন জনবসতি ও সংস্কৃতির অস্তিত্ব নির্দেশ করে। স্থানীয় লোকেরা বিশ্বাস করে যে মহাকাব্যের ‘নল রাজা’ এখানে বাস করতেন। অন্যান্য সূত্রগুলি নির্দেশ করে যে “বানিয়া ধ্বংসাবশেষ” বা “নলরাজার গড় (কেল্লা)” বলা হয়, এটি সেই জায়গা যেখানে কোচবিহারের মহারাজাদের সৈন্যরা অবস্থান করত এবং বানিয়া নদীর ওপর দিয়ে নদী পরিবহন ব্যবস্থা আক্রমণ-বিরোধী কৌশলগুলিকে বাস্তবায়িত করার জন্য পরিচালিত হয়েছিল। চিলাপাতায় দেখতে পাওয়া যাবে হাতির দল, চিতাবাঘ, এমনকি দু-একটা গন্ডারকেও।


দয়ামারা লঙ্কাপাড়া রেঞ্জের মধ্যে টিটি-১ ব্লকে দয়ামারা নদীর ডান পাশে অবস্থিত একটি সুন্দর স্ট্যালাকটাইট-স্ট্যালাগমাইট গুহা। এটি শিবালিক হিমালয়ের একটি অংশ এবং ক্যালসিয়াম জমা হয়ে গঠিত। পৌরাণিক কাহিনী অনুসারে এই এলাকায় টোটো এবং দয়া নামে দু’টি আদিম উপজাতি বাস করত (টোটো এখনও এলাকায় বাস করে)। এই দু’টি উপজাতি প্রায়শই একে অপরের ওপর তাদের আধিপত্য প্রতিষ্ঠা করার চেষ্টা করত যতক্ষণ না গুহার পাশে শেষ যুদ্ধ শুরু হয় যখন দয়ারা যুদ্ধে হেরে ভুটানে পালিয়ে যায়। সেই দিন থেকে নদী ও গুহাটি দয়ামারা নামে পরিচিত। এখন প্রতি বছর ‘হোলি’র সময় স্থানীয় আদিবাসীরা গুহাটিতে পূজা করে।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *