হাটের মানুষ বাটের মানুষ(পর্ব দুই) লিখছেন–কৃ ষ্ণা   মা লি ক

পরিচিতিঃ পূর্ব বর্ধমানের প্রত্যন্ত গাঁয়ের ধুলোমাটিতে জন্ম ও বেড়ে ওঠা। বর্ধমান বিশ্ববিদ্যালয়ে স্নাতকোত্তর। পায়ের তলার সরষেকে গড়িয়ে যেতে না দিয়ে জোর করে পিষে ফেলে ঘরে আটকে থাকা। কলমের কাছে মুক্তি চেয়ে নিয়েছিলেন। প্রকাশিত কবিতার বই কয়েকটি। একটি গদ্যের। এখন গদ্য দ্বিতীয় প্রেম। কৃৃৃৃষ্ণা, যাজ্ঞসেনী গুপ্ত কৃষ্ণা ছদ্মনামেও লেখেন। 

 

কৃ ষ্ণা   মা লি ক-র হাট দর্শন লিখছেন

 

হাটের মানুষ বাটের মানুষ(পর্ব দুই)
প্রান্তরের গাছ

নাম কী আপনার?
দুই হাটুরের মাঝে বসে তাদের মাথায় ছাতা ধরে কথা বলে চলেছেন দেখে চোখ চলে গেলো। দু-একখানা কথা শোনার পর কথা না বলে পারলাম না। নাম জিগ্যেস করতে –
নাম দিয়ে আর কী হবে – ? নামের দরকার নাই কুনো।-থেমে থেমে দিলখুশ মার্কা মুখ করে বলা কথাগুলো ভাইস্যা আইল।
বলার পর কেমন যেন দুঃখু দুঃখু মুখ করে রাস্তার ওপারের দিকে তাকিয়ে থাকলেন খানিক।বিশ্বাস করুন, আমি সেই মুখে – দেখলাম একটা ভ্যাবলাকান্ত ছেলে একমনে ঘুড়ি ওড়াচ্ছে।সারা মুখের চামড়ায় মোটা মোটা ভাঁজ।ভাঁজগুলোর খাঁজে খাঁজে লুকোনো ঘাম। তেলতেলে মুখ জবজবে ভিজে,কপাল আর গলা বেয়ে ঝরে পড়ছে জষ্টিমাসের শেষে।খোঁচা খোঁচা দাড়ি।পরণে লুঙ্গি পরা, ভাঁজ করে গিঁট মারা।খালি গা, কাঁধে লাল চেক পুরনো একখানা গামছা ফেলা।
হলপ করে বলতে পারি, হাটে আর দ্বিতীয় কোনো মানুষকে কুলকুচি করার স্টাইলে এয়সান দ্বিধাহীন খালি গায়ে দেখা যাবে না।এ ব্যাপারে আমি একশ’র মধ্যে দুশো ভাগ নিশ্চিত।এহেন বয়স্ক চেহারায় তাঁর চোখে আমি কিশোরের সারল্য খুঁজছি! বলি আমার চোখে কি ন্যাবা হয়েছে? মনে মনে নিজেই নিজেকে বলছি তখন।আর থোড়াই কেয়ারও করছি!
নাহ্! তিনি হাটের কেউ নন, বাটের বটে।হাটে এসেছেন বটে, তবে ভীড়ের বাইরেকার এক ছুটকো মানুষ।যতই না কেন হেটো ব্যবসাদারের গা ঘেঁষে বসে গা ঘসাঘসি করুন না কেন! যেমন ধরুন, কোনো বরযাত্রীর দল ঝিঙ্কাচিকা ঝিঙ্কাচিকা —! মানে নাচনকোঁদন করতে করতে রাস্তা দিয়ে চলেছে, আর আপনি কোন এক উটকো লোক আচমকা সেঁধিয়ে পড়ে ভীড়ের সুযোগে একবার কোমর দুলিয়ে নিলেন, তাহলেই কি আপনি বরযাত্রী হয়ে গেলেন? আমাদের এই হাটে আসা মানুষটিও তেমনি কস্মিনকালেও বরযাত্রী নন।
তিনি একটু পরেই রাস্তার ওপার থেকে চোখ গুটিয়ে নিয়ে ফেললেন আমারই মুখের উপর।-আমি দিবাকর গো! দিবাকর রায়।—
এবার গল্পের লাটাই খুলে যাচ্ছে ধীরে, খু -ব ধীরে।কথাগুলো তাঁর নিজেরও বলার দরকার যে, সেও বেশ বোঝা গেল।পাশেই দুজন হাটুরে তাঁদের সামানপত্র নিয়ে মিচকে মিচকে হাসির ফচকেমি করতে লাগল।একজন কাঞ্চননগরের।তা সেখানকার ছুরিকাঁচি একদা বানিজ্যসফল চরিত্র ছিল বটে, এখন তার দিন গিয়াছে।মধ্যবয়সী তারকদা, ততক্ষণে নামটা জানা হয়েছে, আম আর লিচু বিক্রি করছেন ছুরি কাঁচি ছেড়ে।তাঁর পাশে, আর দিবাকর রায়েরও পাশে বসে , মানে একজনের বামে, অন্যজনের ডানদিকে বসে বসে আর একজন কেজি কেজি মাছের স্বপ্ন দেখাচ্ছেন। কখনও কখনও কোনো হাফ খদ্দের সামনে এসে দাঁড়ালে বলতে হয় বলা গোছের আওড়ানো।হাফ মানে, প্রায় কিনবে কিনবে করছে এমন।দরদাম করা পাবলিক যেমন হয়, একটু পর ভেগে যাবে।মাছের কাঁটা, বঁড়শি, সুতো, চার এসব হান্নানদা সামনে সাজিয়ে রেখেছেন, তবে ডাক হাঁকে বিশ্বাস করেন না। তিনি মাছের কারবারী।ছিপ ফেলে মাছ ধরতে যে ধয্যি লাগে হান্নানদার সেই ধয্যি।মাছের কাঁটায় সুতো জড়িয়ে ছিপে বেঁধে চলেছেন চুপচাপ।বরং আম-লিচু মাঝে মধ্যেই হাঁকাড় ছাড়ছেন।
দিবাকর রায়- , সেই অহাটুরে লোকটার বেড়াল এসে পড়ল এইবার ।তাঁরা মায়ে -পোয়ে থাকেন ।-মায়ের তো বয়েস হয়েছে, যে কুনোদিন মরে যাবে- ! দূরে তাঁর মেঘলা চোখ ভেসে গেল এক পলক।আবার শুরু: ত্যাখন আমি থাকব কীকরে বলো দিকিনি? আমার বয়েস হলে কে দেখবে? তাই এই দাদাদি’কে দুটো মেয়ে দেখার জন্যে বলছিনু আর কি!দিবাকর রায় পরিষ্কার খোসামোদ করছেন।
মাছের কাঁটায় নাইলনের সুতো পেঁচিয়ে গিঁট দিতে দিতে হান্নানদা মৃদু গলায়, দুটো মেয়ে কার জন্যে? এই তো বললে তোমার ভাগ্নের জন্যে মেয়ে দেখতে।
পাশ থেকে ফলওলা তারকদার টিপ্পুনি, আর একটা বুধায় ওর নিজের জন্যে? না কিগো, খুড়ো? সঙ্গে গা জ্বালানো হাসি।
হান্নানদা গিঁট দেওয়া স্থগিত রেখে মাছের কানকো উল্টে একবার মেপে নিলেন খুড়োকে।তাতেই হবুপাত্র একটু মাথা চুলকে ঠাকুরঘরে লুকিয়ে কলা খায় না।- না না! আমার বয়েস সেরখম হয় নে।এই কত হবে – চল্লিশ, কি পঁতাল্লিশ -! লোক তো আরও কত বুড়ো বয়েসে বিয়ে করে? নাকি? আমার দিকে তাকিয়ে, আমি হলুম গিয়ে সাক্ষী।
হক কথা, খন্ডাবে কে?
– তবেই বলো দিকিনি! এই তো, বামুন পাড়ার রমেনদা।আমাদের গেরামের গো! তার তো – ধরো বয়েস হয়েছিল, – হ্যাঁ – তা হবে বইকি ষাট বাষট্টি।চাকরি থেকে তো রিটার করে ফেলেছেল।বুড়ি মা, আর খোঁড়া বুনটা শুদু আছে।তা সে নোক যেদি বিয়ে করতে পারে তালি আমার বেলা দোষ ক্যানে হবে?
তারকদা ফুট কাটে, শোনো খুড়ো! এই হান্নান যদি বিয়ে করে তাহলে কিছু বলার নাই।কিন্তু তোমার বিয়ে করা কি মানায়?

হাটের মানুষ বাটের মানুষ

এ কথা শুনে দিবাকর খুড়োর কপালে কিন্তু একটা বাড়তি ভাঁজেরও অভিযোগ নেই। ছাতা ছেড়ে হাত দুটো বেড় দিয়ে হাঁটু জড়িয়ে ধরে বসে থাকল।তা দেখে হান্নান মন্ডল তাকে খালি বোতল দিয়ে জল আনতে পাঠাল।আমি গল্প শুনব।খুড়োর সব কথা না শুনে তো নড়ব না!
ফিরে এসে তারক আর হান্নানের মাঝে বসে পড়ল আবার তাদের মাথায় ছাতা ধরে।তারপর আমাকে বলতে লাগল, লোকে হাসি ঠাট্টা করে করুক । দরকার আমার, আমাকে তো চেষ্টা করতেই হবে।নাকি?
আপনার ভাগ্নের বয়স কত?
তা হবে বইকি।পঁচিশ ছাব্বিশ।ঠিক বলতে পারবুনি।ওই ধরো না ক্যানে, যি বছর মেজদা আর এই ভাগ্নার বড়োদাদা বাস চাপা পড়ে মারা গেল –
বলতে বলতে চুপ করে যান তিনি।ফিকে হয়ে যাওয়া একটা ব্যথা মেঘলা ছায়া ফেলে যায় একপলক তাঁর ধূসর হয়ে আসা দুই চোখে।আমি আফশোস করি দুঃখিত হয়ে।
-তা হয়ে গেল সেও -!” কথায় পারম্পার্য না থাকলেও বুঝতে অসুবিধা হয় না। তাছাড়া আমিও মাছ ধরতে বসেছি, কিছুতেই উঠছি না।আচমকা কথা ঘাই মেরে উঠল, ওদের বাড়ি সেই সন্ধিপুর।ওখানে আমার দিদি থাকে তো – ভাগ্নাও ওখানেই থাকে।তার ভ্যান আছে নিজের।টো টো কিনবে বলে ট্যাকাও জম্মেছে। পাকা ঘর করে ফেলিচে।ওদের আবস্তা খারাপ নয়।আমারও মাটকুঠা ঘর।এক বিঘে জমি আছে।আমি লোকের ঘরে কাজ কাম করি না।দরকার কী বলো না! চলে যায় ভালুই।বোরো করি, বর্ষায় তো আছেই।একটুন আলু পেঁয়াজও করি।সোমবচ্ছর আমার ভালুই চলে।

হাটের মানুষ বাটের মানুষ

তা দুটো মেয়েই দেখতে হবে, বুঝলে? একটানা বলে চলেছেন।- একটা আমার জন্যি, আর একটা আমার ভাগ্নার জন্যি।সবাইকেই বলছি ধরো না ক্যানে। আমার দিকে তাকিয়ে বলেন, তুমাকেও বলছি কিন্তুন।ধরো না ক্যানে, মায়েরও তো বয়েস হয়েচে।আমি একা হয়ে গেলে আমার অদিনে কে দেখবে? আমাদের সাত ভাইবুনের মদ্যি তিনজন চলে গে’ চারজন বেঁচে।সবাই নিজির নিজির নিয়ে ব্যস্ত।” – একটু থেমে নির্বিকার গলায় বলে ফেললেন এমন একখানা কথা, যা বলতে মেলা লেখাপড়া জানা লোকজন থমকাবেন।নারীবাদী মহিলারা ঠ্যাঙা নিয়ে মাথার উপর বনবন ঘোরাতে ঘোরাতে এসে পড়বেন নির্ঘাতঃ এ কেমন স্বার্থপর মানুষ? নিজের সুবিধার জন্য এতো নিছকই একটি মেয়েকে ব্যবহার করার মতলব! তুমি এপারে আর কদিন হে? তারপর সেই মেয়েটির বা মহিলাটির কী উপায় হবে?
তা সে যাইই হোক, বাংলায় কৌলিন্য হয়তো গেছে, তাই বলে এমন দরকচা মার্কা পাত্রের কনের অভাব হবার মতো দুর্দিন চলে যায়নি মশাই! থুড়ি ! সুদিনের অভাব হয়নি।তা তিনি কী বললেন জানেন? বললেন, ছেলেপুলের দরকার নাই কো।একজন দুটো ভাত রাঁদবে, দুটো কথা বলবে সে বই তো আর লয়!
নিজের প্রয়োজনটুকু জানিয়ে দিতে তাঁর কসুর নেই।নিজের দাবিতে শান্ত হয়ে তিনি অটলবিহারী।জনাকয় খদ্দের আর দুই হাটুরের সঙ্গে আমাকেও ঘটকালির দায়িত্ব দিয়ে তিনি উঠে পড়লেন।গামছায় মুখটা একবার মুছে সেটা ঝেড়ে কাঁধে ফেলে সাইকেলটি নিয়ে রওনা দিলেন এক আশ্চর্য নির্জন নীলাভ রাস্তা দিয়ে।আমি তাকিয়ে দেখি, তাঁর সামনে যেন সবুজ ঘাসে ঢাকা একটা প্রান্তর আর তিনি নরম সবুজ ডালপালা মাথায় একটা গাছ।আমার বড্ড মনকেমন করে উঠল।
তিনি দিবাকর রায়।সাকিন – আজবনগর।যেখানে পায়ে পায়ে পথটি চলে গেছে এক পুঁইমাচাওলা মাটকোঠা বাড়ির দিকে।যার দাওয়ায় আঁচল বিছিয়ে শুয়ে আছেন এক বৃদ্ধা মা।আর তারাভরা আকাশ দেখতে দেখতে উদাস হয়ে যাওয়া একজোড়া কিশোর চোখ।
তাঁর চাহিদাটুকু আপনাদের মনে আছে তো?

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্ব পড়তে ক্লিক করুন নিচের লিংকে

হাটের মানুষ বাটের মানুষ(১ম পর্ব)–লিখছেন- কৃ ষ্ণা মা লি ক

 

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *