লিটল ম্যাগাজিন প্রসঙ্গে ঋত্বিক ত্রিপাঠীর সাক্ষাৎকার
সাক্ষাৎকারটি নিলেন – গৌতম মাহাতো
গৌতম: প্রথমেই প্রশ্নে ঢুকে পড়ি। লিটল ম্যাগাজিন কি? খায় নাকি বাজায়?
ঋত্বিক ত্রিপাঠী : লিটল ম্যাগাজিন মূলত সাহিত্য, সংস্কৃতি, দর্শন, ইতিহাস, বিজ্ঞান, সমাজনির্ভর পত্রিকা, যা সমকালের হয়েও কালজয়ী স্বভাবে স্বতন্ত্র। হাতে লেখা বা মুদ্রিত বা ওয়েব মাধ্যমে মৌলিক সৃজনমূলক অনুভব প্রকাশের ক্ষেত্র। ‘লিটল’ শব্দটি ব্যঙ্গার্থে। আসলে সে চিরনবীন। সমকালীন বিনোদনে আস্থা না রেখে পাঠককে দীক্ষিত করে তুলতে চায়। সে বিজ্ঞাননির্ভর, মননচর্চায় বিশ্বাসী। অলৌকিকত্বের কোনও স্থান নেই। সে নিরপেক্ষ, স্বাধীন, মুক্ত। তার বাক স্পষ্ট। অহংহীন আত্মবিশ্বাস তাকে স্বতন্ত্র করেছে। এই কারণে সব লিটল ম্যাগাজিনই পত্রিকা। সব পত্রিকা কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন নয়।
প্রশ্ন —
বর্তমানে লিটল ম্যাগাজিনের প্রয়োজনীয়তা কতটুকু?
উত্তর–
শুধুমাত্র সৎ নির্ভেজাল সাহিত্য, দর্শনচর্চার জন্য নয়– ‘হ্যাঁ’-কে হ্যাঁ, ‘না’-কে না বলার ক্ষমতা একমাত্র এই মাধ্যমটিরই আছে। কোনও গণমাধ্যমই আজ আর স্বাধীন, নিরপেক্ষ নয়। তাই গণতন্ত্রকে রক্ষা করতে নির্ভীক নিরপেক্ষ এই মাধ্যম তথা লিটল ম্যাগাজিনই এখন একমাত্র।
প্রশ্ন–
একটা সময় বলা হত–“লিটল ম্যাগাজিন লেখক বা কবিদের আঁতুড় ঘর” তারপর তুমি বললে যে না, লিটল ম্যাগাজিন আঁতুড় ঘর নয় বরং বলা ভাল যে “লিটল ম্যাগাজিন একমাত্র ঘর”। কেন??
উত্তর–
হ্যাঁ। এটা বহুবার আমি বলেছি। বারবার বলি। আঁতুড়ঘরে মানুষ জন্ম নেয়। বড় হয় অন্য ঘরে। একসময় ভাবা হত লিটল ম্যাগাজিনে লিখে পরে বড় বাণিজ্যিক কাগজে প্রতিষ্ঠা লাভ করা যায়। এটা ভুল প্রমাণিত হয়েছে। বাণিজ্যিক কাগজে আদৌ না লিখেও
শুধুমাত্র লিটল ম্যাগাজিনে লিখেই নিজস্ব ভাষা ও পরিচিতি তৈরি করা যায়। আর পরিসংখ্যান নিলে দেখা যাবে বড় বাণিজ্যিক পত্রিকা হাতে গোণা মাত্র ৫-৭ টি। ফলে সাহিত্য প্রকাশের সু্যোগ সেখানে খুবই কম। পাশাপাশি বাংলায় লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা প্রায় ১০ হাজার। তাই লিটল ম্যাগাজিন জগতের ক্ষেত্র বড়। পরীক্ষা নীরিক্ষার সুযোগও তাই যথেষ্ট।
প্রশ্ন—
সবুজপত্র কি প্রথম বাংলা লিটল ম্যাগাজিন? যদি হয় তবে কেন? এর কি কোনও নির্দিষ্ট চরিত্র আছে? সেগুলো কি কি?
উত্তর—
আধুনিক বাংলা কবিতা আন্দোলনের প্রাণপুরুষ বুদ্ধদেব বসু-ই প্রথম বাংলায় ‘লিটল ম্যাগাজিন’ শব্দটি ব্যবহার করেন। সেইসঙ্গে ‘সবুজপত্র'(১৯১৪) পত্রিকাকে বাংলা ভাষার প্রথম লিটল ম্যাগাজিন হিসেবে উল্লেখ করেন।
লিটল শব্দটির মাধ্যমে ব্যঙ্গ প্রকাশ। আমি লিটল, আকারে। বিশেষ লেখকগোষ্ঠীর চেতনায় আমার শক্তি কিন্তু অনেক বড়। এই যে স্বভাবগুণ ও গোষ্ঠীচেতনার দর্শন তা কিন্তু ‘সবুজপত্র’-র আগেও দেখা যায়।
(১৮৫৭)’সংবাদ প্রভাকর’-এর মাসিক সংস্করণকে কেন্দ্র করে দীনবন্ধু, বঙ্কিমচন্দ্র, রঙ্গলালদের নিয়ে বিশেষ লেখকগোষ্ঠী গড়ে ওঠে। তবে চরম যুদ্ধ ঘোষণা ও প্রতিবাদ লক্ষ্য করা যায় ‘সবুজপত্র'(১৯১৪) পত্রিকায়। চলিত ভাষাকে মর্যাদাদান তথা বাংলা গদ্যভাষার জন্মান্তর ঘটে এই সবুজপত্র- র হাত ধরেই।
সে কারণেই আমরা প্রথম সার্থক লিটল ম্যাগাজিন হিসাবে ‘সুবজপত্র’-কে মর্যাদা দিয়েছি।
তবে মজার বিষয়, এর আগেও লিটল ম্যাগাজিন শব্দটা আমরা পাই। J.C.Marshman- এর ‘ The Life and Times of Carey, Marshman, and Ward'(London1859) তথা শ্রীরামপুর মিশনের ইতিহাস গ্রন্থ অনুসরণে বলা চলে– প্রথম সাময়িকপত্র ‘দিগদর্শন'(১৮১৮,এপ্রিল)। দিগদর্শন-কে লেখক বাংলার প্রথম ‘লিটল ম্যাগাজিন’ বলে উল্লেখ করেছেন ওই গ্রন্থে। পরবর্তী সময়ে যে অর্থে ও লক্ষ্যে লিটল ম্যাগাজিন শব্দটির বহুল প্রচার হয়, সে অর্থে হয়তো না। কারণ, তখন ‘সাময়িকপত্র’ নামকরণই ছিল একমাত্র।
সবুজপত্র নতুন কিছু বললো। নতুন ধারা তৈরি করতে সক্ষম হল। বাংলা চলিত গদ্যের মর্যাদা প্রতিষ্ঠা করতে সক্ষম হল। লিটল ম্যাগাজিনের স্বভাবই হল এই যে সে নতুন ধারা তৈরি করবে।
প্রশ্ন—
এই সমস্ত গুণাগুণ বা বৈশিষ্ট্য মেনে চলে না যে সমস্ত ম্যাগাজিন, সেগুলোকে কি বলা হবে?যেমন কোনও ক্লাবের বাৎসরিক ম্যাগাজিন সেটাও কি লিটল ম্যাগাজিন?
উত্তর—
জার্নাল, পত্রিকা, সাময়িক পত্র , ফোল্ডার, পুস্তিকা, সুভেনির ইত্যাদি বলাই যায়। ক্লাবের বাৎসরিক পত্রিকাকে সুভেনির বলা হয়। সাময়িকপত্রও বলা যায়।
প্রশ্ন—
বাণিজ্যিক পত্রিকার সাথে এর পার্থক্য কি? মানে এটা মূলস্রোতের সাহিত্য না বলে কেন সমান্তরাল সাহিত্য বলব?
উত্তর—
মূল স্রোত, সমান্তরাল — এসব নামকরণ ও বিভাজনের ব্যাখ্যা জানি না। আমি মানি, দু’ধরন। এক –পত্রিকা, দুই– লিটল ম্যাগাজিন। বাণিজ্যিক পত্রিকার লক্ষ্য অর্থ উপার্জন,পাঠক মনোরঞ্জন। দর্শনহীন পত্রিকার লক্ষ্য কী, আমার জানা নেই। লিটল ম্যাগাজিনের লক্ষ্য ১. নতুন কিছুকে আবিষ্কার ২. নিরপেক্ষতা ৩. তরুণ লেখকের সন্ধান ৪. বাকস্বাধীনতা ৫. সাহিত্যের পরীক্ষানিরীক্ষা। তাই তার সঙ্গে অন্য কোনও পত্রিকা বা অন্য কোনও মাধ্যমের তুলনা চলে না।
প্রশ্ন—
সত্যিই কি সমান্তরাল সাহিত্য বলে কিছু হয়? নাকি সোনার পাথরবাটি?
উত্তর—
এ প্রসঙ্গ আগেই আলোচনা করেছি, আবার বলতে গেলে চর্বিতচর্বণ হবে মাত্র।
প্রশ্ন—
বাণিজ্যিক পত্রিকার সাথে কি কোনও বৈরিতা আছে? নাকি শুধুই কৌলিন্যযাপন মাত্র?
উত্তর—
অনেকে ভাবেন বাণিজ্যিক পত্রিকার সঙ্গে লিটল ম্যাগাজিনের লড়াই। তা কিন্তু না। দুটো আলাদা মাধ্যম। কাগজ ও মলাটযুক্ত উভয়ই। এছাড়া আর কোনও যোগ নেই। বাণিজ্যিক কাগজের লক্ষ্য যেহেতু বাণিজ্য, তাই তার সীমাবদ্ধতা থাকাটাই স্বাভাবিক। সে ক্ষমতা ও বিজ্ঞাপন, অর্থ ও জনরুচির কাছে নত।
অনেকে দুটি বিষয়কে গুলিয়ে ফেলেন। ফলস্বরূপ, বাণিজ্যিক কাগজের অক্ষম অনুকরণে পত্রিকা প্রকাশ করতে সচেষ্ট হলে, তা হয় পত্রিকা, লিটল ম্যাগাজিন না।
লিটল ম্যাগাজিনের লড়াই তার নিজের সঙ্গে।
প্রশ্ন—
হয়তো (কৃত্তিবাস কালে)একসময় ছিল, এখন আছে বলে আমার আর মনে হয় না। যদি তাই হয়ে থাকে তবে এই লড়াই, এই আন্দোলন কেন?
উত্তর—
হ্যাঁ। লড়াইটা তার নিজের সঙ্গে। কীভাবে নির্ভুল ও সংরক্ষণযোগ্য সংখ্যা করা যায়, সেটাই মূল লক্ষ্য। লিটল ম্যাগাজিন এখনও তার সেই লড়াইটা চালাচ্ছে। নতুন সম্পাদকরা অনেক শিক্ষিত ও দীক্ষিত। অনেক সচেতন। অনেক পরিকল্পনা করে এগুচ্ছে। এটাই লড়াইয়ের বড় সাফল্য।
প্রশ্ন—
এত ক্রমবর্ধমান জেলায় জেলায় লিটল ম্যাগাজিন মেলা কেন? যেহেতু তোমরাও তো গত ১১ বছর আগে থেকে এই মেলার প্রয়োজনীয়তা অনুভব করে ছিলে! কি কারণে?
উত্তর—
এটাই তো স্বাভাবিক। লিটল ম্যাগাজিন সব সময় চেয়েছে বিকেন্দ্রীকরণ। গোষ্ঠীচেতনায় বিশ্বাসী হবে, কিন্তু গোষ্ঠীবাজী নয়। ঐক্যবদ্ধ শক্তিতে তার শক্তি।
চিরকাল কলকাতার ওপর আলো পড়েছে বেশি করে। সেটা হবে কেন! বর্তমান,
গ্রাম জেলার লেখক সম্পাদকের শক্তি প্রকাশ ও প্রমাণিত হচ্ছে জেলায় জেলার এই সব লিটল ম্যাগাজিন মেলা, সাহিত্যবাসর ইত্যাদির মাধ্যমে।
প্রশ্ন—
বিকেন্দ্রীকরণ একটা সময় সকলেই চেয়েছি বা আজও আরও বেশি করে চাইছি, কিন্তু আদৌ কি সেটা সঠিক পথে যাচ্ছে? মানে মর্যাদা রক্ষা কতদূর হবে বলে মনে হয়? এখনই কিছু ডিমেরিট নজরে আসছে?
উত্তর—
আমি আশাবাদী।
প্রশ্ন—
লিটল ম্যাগাজিনের সুখ দুঃখ নিয়ে কি ভাবায়? কিভাবে?
উত্তর—
আর্থিক সংকট আগেও ছিল, আছে, থাকবে। তবে এখন নির্ভুল সংরক্ষণযোগ্য সংখ্যা প্রকাশ করলে বিক্রি হয়, আর্থিক সংকট সেক্ষেত্রে অনেকটাই মিটে যায়। আর এখনকার তরুণ সম্পাদক যারা লিটল ম্যাগাজিন করতে আসছে তারা জানে, শুধু আর্থিক সংকটের হাহাকার করলাম, কিন্তু বানান সচেতন হলাম না, গোষ্ঠী তৈরি করে ৩০০ পাতার পত্রিকা করলাম, কিন্তু নতুন লেখার সন্ধান করলাম না তাতে লিটল ম্যাগাজিনের আন্দোলন কিছু হয় না। সৌখিন সাহিত্যচর্চার বিলাসিতা মানে না লিটল ম্যাগাজিন। এটা সুখের দিক।
দুঃখের দিক হল, আজও দেশ বুঝলো না লিটল ম্যাগাজিনের গুরুত্ব। তাই আজও লিটল ম্যাগাজিনের সরকারি রেজিষ্ট্রেশন হয় সংবাদপত্র হিসেবে। এটা একটা শিক্ষিত দেশের লজ্জা। দেশ বুঝলো না আজও, সংবাদপত্র ও লিটল ম্যাগাজিন সম্পূর্ণ আলাদা। এটা দুঃখের।
প্রশ্ন—
এত লিটল ম্যাগাজিন কেন? কোথাও এসে মনে হয় না কি যে সুশিক্ষিত বা স্বশিক্ষিত সম্পাদকের সংখ্যা অত্যন্ত সীমিত?
উত্তর—
‘এতো’ লিটল ম্যাগাজিন কোথায়!
লিটল ম্যাগাজিনের দর্শন নেই অনেকেরই। ফলে পত্রিকা অনেক। লিটল ম্যাগাজিনের সংখ্যা বরং কম। লিটল ম্যাগাজিন আর পত্রিকা এক নয়।
আর, সুশিক্ষিত মানে!
কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের পত্রিকা কিন্তু জার্নাল। সমাজ এঁদের শিক্ষিত তকমা দিয়েছে। এঁদের এই সব জার্নালে প্রকাশ পায় যে লেখা, তার অধিকাংশই লেখার লক্ষ্য হল কেরিয়ারে পদোন্নতি। তাই মৌলিক লেখা কম। অন্যদিকে আর্থিকভাবে দুর্বল, বেকার যুবক যুবতী যাঁরা লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে সৃষ্টি করে চলেছেন মৌলিক সাহিত্য, দেখা যাবে সমাজে তাঁদের মর্যাদা কম। কারণ আমাদের সমাজ মর্যাদা দেয় ডিগ্রি ও আর্থিক স্বচ্ছলতাকে। আবার এমন নয় যে এঁরা সবাই বেকার সুশিক্ষিত এবং এঁরা লিটল ম্যাগাজিনের মাধ্যমে দারুণ দারুণ কাজ করে চলেছেন। এঁদের মধ্যেও আছে ভুল বানান ও ভুল পরিকল্পনার কারণে আয়ুক্ষয়। আছে মেধার অভাবে আত্মঘাতী স্বভাব।
প্রশ্ন—
নতুনরা যারা নতুন লিটল ম্যাগাজিন করবে বলে ভাবছে বা করছে তাদের জন্য তুমি কি কোনও পরামর্শ রাখবে?
উত্তর—
পরামর্শ না। একটাই আবেদন, কিছুদিন পর্যবেক্ষণ করা ও মনে মনে অনুশীলন। আগে, অন্যান্য লিটল ম্যাগাজিন কেমন হচ্ছে তা লক্ষ্য করা। সেখান থেকে শেখা, কিন্তু সেখান থেকে বেরিয়েও আসা। যদি না আমি নতুন কিছু না করতে পারি, তবে নতুন পত্রিকা প্রকাশের পরিকল্পনা করবো কেন! আর, প্রতিটি সংখ্যা যেন হয় সংরক্ষণযোগ্য। এটুকুই।
প্রশ্ন—
এখন লিটল ম্যাগাজিনের গতিপথ কোন দিকে মোড় নিচ্ছে বা নেবে বলে তোমার মনে হয়?
উত্তর—
বিশেষ সংখ্যা ও সংরক্ষণযোগ্য সংখ্যার প্রতি আগ্রহ বাড়ছে।
আর, বর্তমান পরস্থিতিতে ওয়েব ম্যাগাজিনই হল ভবিষ্যৎ। মুদ্রিত কাগজ কমবে। তাতে লিটল ম্যাগাজিনের লড়াই কিন্তু একই থাকবে। শুধু ক্ষেত্রটা বদলে যাবে। কাগজ কালির বদলে আসবে ওয়েবজিন ও মহাকাশ।
প্রশ্ন—
তবে তো ছ’বছর আগের স্বপ্ন এরকম সত্যির দিকে হাওয়া পাচ্ছে! তুমি তো ভাবতে বা ভাবাতেও- ”কত গাছ উৎসর্গ করছি পত্রিকার জন্য, কিন্তু সে তুলনায় সৃষ্টির প্রতি দায়িত্বশীল হতে পারছি কি!”
উত্তর—
হাঃ হাঃ… তবে হ্যাঁ, এটা ঠিক– নিছক আবেগে লিটল ম্যাগাজিনের জন্ম আগামীদিনে কমবে।
প্রশ্ন—
লিটল ম্যাগাজিনের শক্তি কতটুকু?
উত্তর—
শক্তি অনেক। কারণ একক কোনও লিটল ম্যাগাজিন — লিটল ম্যাগাজিন নয়। একক পত্রিকা — পত্রিকা। সব লিটল ম্যাগাজিনের সমষ্টির শক্তিতে যে শক্তি তাই-ই হল লিটল ম্যাগাজিনের শক্তি। এই দর্শনে ভর করে লিটল ম্যাগাজিনের শক্তি ভয়ংকর।
প্রশ্ন—
সরকারি কি কি সুবিধা লিটল ম্যাগাজিনের জন্য রয়েছে, যা একটা লিটল ম্যাগাজিন সম্পাদক কাজে লাগাতে পারে।(ডাক ও অন্যান্য)
উত্তর—
লিটল ম্যাগাজিন থেকেই দেশের উচ্চ শিক্ষাদপ্তর অনেক উপকৃত হয়ে চলেছে। কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ের শিক্ষকরা আই এস এস এন যুক্ত লিটল ম্যাগাজিন ও আই এস বি এন যুক্ত লিটল ম্যাগাজিনের প্রকাশনার মাধ্যমে অতিরিক্ত নম্বর নিয়ে পদোন্নতি করছেন। অন্য দিকে লিটল ম্যাগাজিনের অস্তিত্ব রক্ষায় উচ্চ শিক্ষাদপ্তর তথা রাষ্ট্র নীরব ও অন্ধ। এটা খুব আশ্চর্যের দিক।
এক সময় সরকারি কিছু বিজ্ঞাপন পাওয়া যেত। এখন অমিল। কেন্দ্র সরকারের ডাক বিভাগে পোস্টাল রেজিষ্ট্রেশন করালে রেজিস্ট্রি ডাকের ক্ষেত্রে সামান্য আর্থিক সাশ্রয় হয়।
এছাড়া আর বিশেষ কোনও সুযোগ সুবিধা নেই। এটা দুর্ভাগ্যের।
প্রশ্ন—
লিটল ম্যাগাজিন করতে এসে আর কী-কী-ই বা প্রতিবন্ধকতা বা অভাব অনুভূত হয়েছে?
উত্তর—
মূল সমস্যা –ভালো লেখা না-পাওয়া। যাঁরা ভালো লেখেন, তাঁরা চাইবেন, অধিক প্রচারযুক্ত লিটল ম্যাগাজিন কিংবা বাণিজ্যিক কাগজ। যাঁরা লেখা দিতে চান, তাঁদের অনেকেই আবার লেখার প্রতি যত্নশীল নন। অনেক তরুণ পরে লেখাটাই ছেড়ে দেন।
এ গেল লেখার বিষয়।
বিজ্ঞাপন কিছু জোটে তো শেষমেষ সবাই টাকা দেয় না। বছর বছর নতুন নতুন লিটল ম্যাগাজিনের বিপণনকেন্দ্র গড়ে উঠছে, আর লিটল ম্যাগাজিন নতুন নতুন ফাঁদে পা দিতে বাধ্য হচ্ছে। বিক্রির টাকা সম্পাদক পায় না অধিকাংশ ক্ষেত্রে। বিপণন সমস্যা চিরকালের।
আর, আজও লিটল ম্যাগাজিনের স্বতন্ত্র স্বীকৃতি নেই। সরকারি রেজিষ্ট্রেশন দেওয়া হয় সংবাদপত্র হিসাবে। এতে প্রমাণিত হয়, দেশের শিক্ষা ব্যবস্থা কত পিছিয়ে। ভারতীয় ডাক বিভাগের উন্নতি হল না আজও। সাধারণ ডাকে পত্রিকা পাঠালে প্রাপক পান না। সবসময় রেজিস্ট্রার পোস্টের খরচ বহন অসম্ভব। রাষ্ট্র জানেই না দেশে লিটল ম্যাগাজিন কর্মীর সংখ্যা কত!
প্রশ্ন—
“তোমার যাপন ও অভিসারে লিটল ম্যাগাজিন”- কি ভাবে ব্যাখ্যা করবে?
উত্তর—
ব্যক্তিগত প্রসঙ্গ আর কী বলবো!
আমি একজন লিটল ম্যাগাজিন কর্মী। এটাই আমার একমাত্র পরিচয়।
প্রশ্ন—
লিটল ম্যাগাজিনের জন্য পরিকল্পনা নিয়ে শুরু করা উচিত নাকি পথ চলতে চলতে শেখা ও পরিকল্পনা গ্রহণ, কোনটা বেশি প্রাধান্য পাবে তোমার কাছে?
উত্তর—
দুটোই গুরুত্বপূর্ণ।
কিন্তু শেষমেষ অনুশীলনের মধ্য দিয়ে যেতেই হবে।
আবেগে পথে নেমে পড়তে পারি। দুম করে একটা সংখ্যা প্রকাশ করে দিতেই পারি। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিনের জগতে যদি থাকতেই হয়, তবে সম্পাদককে অনুশীলনের মধ্য দিয়েই এগুতে হবে। বাংলা বানান ও বাক্য গঠন অন্তত জানতেই হবে। সাহিত্যের পরীক্ষানীরিক্ষার মধ্যে যেতেই হবে। লিটল ম্যাগাজিনের দর্শনে সম্পাদককে দীক্ষিত হতেই হবে।
প্রশ্ন—
বহুবারই বলেছো, লিটল ম্যাগাজিন নিরপেক্ষ! এই নিরপেক্ষ হতে গিয়ে কি কোনও বিশেষ মতবাদে বিশ্বাসী হতে হবে! সেখানে কি কোনও দলের সমর্থক হওয়া যাবে না?
উত্তর—
যেহেতু স্বাধীনতার লক্ষ্যে এই নিরপেক্ষতার পথ অনুসন্ধান, সেক্ষেত্রে বিশেষ মতাদর্শে বিশ্বাসী হওয়া যাবে, কিন্তু বিশেষ দলে আস্থাশীল হয়ে তাকে সমর্থন করার কথা বলবে না লিটল ম্যাগাজিন। বলতে চাইছি, নিরপেক্ষতা থাকলে সবেতেই ‘হ্যাঁ’ না দিয়ে সঠিক সঠিক বিষয়ে বিষয়ভিত্তিক সমর্থন সম্ভব। তাহলে সমাজমনস্কও হওয়া গেল, নিরপেক্ষও থাকা গেল। অন্ধ সমর্থক না হয়ে ভালোকে ভালো, মন্দকে মন্দ বলা।
এই নিরপেক্ষতায় যেতে গেলে একটা মতবাদে অবশ্যই সমর্থক হতে হবে। তা হল ‘নিরপেক্ষ চিন্তা ও স্বাধীন মতপ্রকাশ’।
যা একজন লিটল ম্যাগাজিন কর্মী কাজ করতে করতে অর্জন করে।
প্রশ্ন—
তাহলে তো দেশের সমালোচনা! রাষ্ট্রদ্রোহী হতে হবে!
উত্তর—
দেশ মানে মানচিত্র না। নিছক জাতীয় পতাকার সোজা দিক উল্টো দিক বিচার নয়। দেশ মানে দেশের মানুষ। লিটল ম্যাগাজিন দেশকে ভালোবাসে বলেই সে দেশের সমালোচনা করবে সরাসরি। এতে যারা রাষ্ট্রদ্রোহিতার অভিযোগ তোলে, বুঝতে হবে, তাদের কাছে ‘দেশ’ বিষয়টি হয় পরিস্কার নয়, নয়তো তারা ধান্দাবাজ।
প্রশ্ন—
লিটল ম্যাগাজিন কি পরজন্ম, অলৌকিক শক্তিতে বিশ্বাস রাখে না! স্বপ্ন দেখবে না সুন্দরের?
উত্তর—
নিশ্চয়ই স্বপ্ন দেখবে, নতুন কিছু করার, কিন্তু বিজ্ঞানের পথ ধরে। অলৌকিক শক্তিকে লালন পালন করে শাসনযন্ত্র। কারণ যন্ত্র আমাদের যন্ত্র ভাবে। আমরাও ভাবতে থাকি : রাজ্য লটারিতে ধনবান হব, এ জীবনে যা পেলাম না পরজন্মে নিশ্চিত পাবো। অসহায় অবস্থায় পড়ে ভাবি : ভাগ্যলিখন। বোকাবোকা ভাবি, ভূত আছে মানে ঈশ্বর আছে, ঈশ্বর আছে মানে ভূতও আছে। এসব আসলে সমাজ ও শাসনযন্ত্র শেখায় আমাদের। তাতে শাসনকর্তাদের শাসনের সুবিধা হয়। লিটল ম্যাগাজিন শাসনযন্ত্রের এই সব অবৈজ্ঞানিক ব্যাখ্যা মানে না। কারণ সে কর্মযোগে শিক্ষিত, নিরপেক্ষতার দীক্ষিত।
প্রশ্ন—
লিটল ম্যাগাজিন কি পুরস্কার দেওয়া নেওয়ায় বিশ্বাসী?
উত্তর—
কর্মযোগেই লিটল ম্যাগাজিনের অস্তিত্ব। কাজের মাধ্যমেই সে নিজেই নিজেকে পুরস্কৃত করে চলেছে নিয়মিত। এক লিটল ম্যাগাজিনগোষ্ঠী অন্য লিটল ম্যাগাজিনগোষ্ঠীকে সম্মান দিতেই পারে। কিন্তু সরকার কেন লিটল ম্যাগাজিনকে পুরস্কার দেবে! তাতে তো লিটল ম্যাগাজিনের নিরপেক্ষতা নষ্ট হয়। ওই পুরস্কারপ্রাপ্ত লিটল ম্যাগাজিন কি আর সরকারের নিরপেক্ষ সমালোচনা করতে পারবে! সরকার যদি লিটল ম্যাগাজিনের জন্য কিছু করবে বলে ভাবে তবে লিটল ম্যাগাজিন সংরক্ষণাগার গড়ে তুলুক। গড়ে তুলুক কলেজ বিশ্ববিদ্যালয়ে লিটল ম্যাগাজিনের পাঠচর্চা। আর্থিক সংকটে পড়েছেন, এমন অসুস্থ লিটল ম্যাগাজিন কর্মীকে আর্থিক সহযোগিতা করুক।
প্রশ্ন—
লিটল ম্যাগাজিনে বিজ্ঞাপন কতখানি জরুরি?
উত্তর—
লিটল ম্যাগাজিন চলে মূলত দু’ভাবে । ১. নিজের টাকায়। যাঁদের আছে ও খরচ করতে পারেন, করেন। তাতে গোষ্ঠীচেতনা থাকে না। ব্যাট-বলের মালিক যেমন জোর করে নিজে থেকেই ক্যাপ্টেন হয়ে যায়। বন্ধুদের পরামর্শ নিতে চান না সেক্ষেত্রে সম্পাদক। ২. পাঠক-গ্রাহক, বিজ্ঞাপনদাতা-শুভানুধ্যায়ীর সহযোগিতা। পরীক্ষানীরিক্ষার পথে গেলে পাঠক-গ্রাহক কম হবেই। কিন্তু লিটল ম্যাগাজিন চাইবেই নতুন পরীক্ষার পথে যেতে। সেক্ষেত্রে কাছের বন্ধু, শুভানুধ্যায়ী ও বিজ্ঞাপনদাতারা পাশে দাঁড়ান, নিঃস্বার্থভাবেই।
বিজ্ঞাপনের টাকা তোলার সমস্যা থাকে। কিন্তু অধিকাংশ বিজ্ঞাপনদাতা জানেন বিজ্ঞাপন দিলে বিশেষ লাভ নেই। তাও ভালোবেসেই তাঁরা দেন। তাঁরা কিন্তু পত্রিকার চরিত্রকে বদলানোর চেষ্টা করেন না, কখনোই। তাই নিরপেক্ষতা বজায় রাখতে বিজ্ঞাপন বিষয়টি যথেষ্ট গুরুত্বপূর্ণ।
প্রশ্ন-–
তোমার নিজস্ব কথা, অভিজ্ঞতা থেকে শিক্ষা, ঘটনা যা নাড়িয়ে দিয়ে যায় আজও এমন সবকিছুর টুকিটাকি নিজের কথা বলো।
উত্তর—
নিজের কথা বলে কিছু নেই। কিছু অভিজ্ঞতা জন্ম নিয়েছে। তা নিয়ে লিখেছি ‘লিটল ম্যাগাজিন অন্তর বাহির’ বই। সেখানে লিটল ম্যাগাজিনের পথ ধরেই এসেছে দেশ, ধর্ম, ভাষা, কুসংস্কার, স্বাধীনতা, জাতিভেদ ইত্যাদি প্রসঙ্গ।
আসলে লিটল ম্যাগাজিন শেখায় নিরপেক্ষ হতে। স্বাধীন হতে।
গৌতম — বেশ। আমরা অনেক বিষয় জানলাম।সমৃদ্ধও হলাম। ভালো থেকো। ধন্যবাদ।
ঋত্বিক— আমিও ঋদ্ধ হলাম। ধন্যবাদ।