অসভ্যের সভাকবি
কবি ভবতোষ শতপথী
লেখাটা কোথা থেকে শুরু করা উচিত দিনগুলি ফস্কে যাচ্ছে একে একে।এযাবৎকাল পর্যন্ত যা বুঝেছি বা কবিতা বুঝার বা আত্মস্থ করার জন্য যেমন মনের প্রয়োজন তার চেয়েও বেশি প্রয়োজন কবির জীবন জানার। আর সৌভাগ্যক্রমে আমি এই কবির সখ্যতা পেয়েছিলাম আমার প্রায় শৈশব কাল থেকেই । আমার কাকাদের ঝুমুর টিমের সময় থেকেই। সেসময় ঝুমুর সম্রাট বিজয় মাহাতো কে দেখেছি প্রায়শই বাবার কাছে আসতে। তার কাছেই শুনতাম কবির কথা কবির লেখা। বোঝার মত মাথা আমার হয়তো তখনো তৈরি হয়নি কিন্তু তার মাটির একটা পরিচিত ধন আমাকে নাড়িয়ে দিত। যা আমার মাতৃভাষা যা আমার দিবারাত্রির চলন-বলন সহায়ক পা দিয়ে কাব্য হয়? আমি হাঁ করে শুনতাম তাদের কথা, মনে হতো কোন দৈব পুরুষ বুঝিবা।
ডুলুং এ বহু বর্ষার বান পেরিয়েছে কবি প্রৌ এসেছেন । আমি যৌবনে। এ সময় বহু আড্ডা বহু বিনিময়। বহু দুপুর গড়িয়েছে। বুঝেছি এরকম বোহেমিয়ান চরিত্র পাওয়া বড় মুশকিল। কবিতার জন্য জমিদারি ছেড়ে দেওয়া গল্পে সম্ভব বাস্তবে নয়। যাই হোক আসা যাক তার কাব্যের কথায়। 1988 তে তার অরণ্যের কাব্যের প্রথম প্রকাশ, শুনেছি সে সময় কিভাবে জঙ্গলমহলে বিকোচ্ছে এই ভুখা মানুষের কাব্য। এমন খুব কমই কুড়মি ঘর ছিল যে ঘরে এক কপি ও অরণ্যের কাব্য নেই। দিন আনা দিন খাওয়া মানুষগুলো ফোঁটা ফোঁটা করে জমানো অর্থ দিয়ে কিন্তু কবির লেখা।। সেই সময় এক বা দুই টাকা দিয়ে হাটে বাজারে বিক্রি হতো টুসু গান, ঝুমুর গানের বই। এই বইগুলি তে অনেক কবির সাথেই থাকতো কবি ভবতোষের গোটা তিন চার গান বা লেখা।ওই নামটাই ছিল বারুদে আগুন দেওয়ার পক্ষে যথেষ্ট মুহুর্তের মধ্যে ৫০০-৭০০ কপি ভ্যানিশ হয়ে যেত। কিন্তু ম্যাজিকটা ছিল অন্য জায়গায় কবির ভাঁড়ে মা ভবানী। তার চেয়েচিন্তের নিত্তি ভিক্ষাবৃত্তি থাকত বরকরার। চা দোকানে এক কাপ চা খাওয়ালেই হাতে গরম ভাপ ওঠা গোটা দুই কবিতা, বিস্কুট হলে আরো গোটা চার। পাঠক ভাবছেন এসব কি? কাব্য পর্যালোচনা করতে বসে এই শিবের গীত কেন বাওবা! আসলে এটাই তার কাব্যের সঠিক পর্যালোচনা। তিনি আপামর জঙ্গলমহলের নিপীড়িত নিরন্ন মানুষের কথা চিৎকার করে ধিক্কার জানিয়ে বলতে শিখিয়ে ছিলেন আর তারই শব্দ ঘুরে ব্যাড়ায় আজও রাঢ়ের আনাচে-কানাচে।আসলে তার জনপ্রিয়তাই তার কাব্যের মূল সমালোচক-
বাপের বেটা বঠি
টাঙি উঁচায় বাঁচ্যে থাইক্যব
যদিন বাঁচ্যে আছি
মঙ্গলকাব্যের সময়টা যদি বিচার করি, তবে কবি মুকুন্দরাম যেভাবে সাধারণ মানুষের হেঁসেলে ঢুকে পড়েছিলেন ঠিক সেইভাবেই, বরং তারচেয়েও জোরালো ভাবে পাঞ্চ করেছিলেন কবি ভবতোষ। চন্ডীমঙ্গল, মনসামঙ্গল যদি হয় মঙ্গলকাব্য তবে “অরণ্যের কাব্য” হল “জঙ্গল-কাব্য”। বর্তমান সমাজের মুখে একটা সজোরে তামাচা,এ অসভ্য নির্যাতিত নিপীড়িত মানুষের “জঙ্গল কাব্য”। কবির ভাষায়-
“আমি অসভ্যের সভাকবি মানিনা কালাকাল ব্রাহ্মণের পৈতা ছিঁড়ে হাহাকারে হয়েছি চন্ডাল”
এত তীব্র জোরালো ভাষার জন্যই হয়তো এই কাব্য এক সময় বাধ্য করেছিল মান্য ভাষাচর্চাকারদেরও নাড়াচাড়া করতে। তবে ব্যস ওইটুকুই আর তথাকথিত কোনও সম্মান বা স্বীকৃতি কবির কপালে জোটেনি। অথচ দাবি রেখে বলতে পারি জনপ্রিয়তার নিরীখে বাংলায় যেকোন প্রথমসারির কবিকেও নাড়িয়ে দিতে পারে।শুধু জনপ্রিয়তার কথাই বা বলব কেন! কাব্যগুণেও অত্যন্ত উৎকৃষ্ট।
এবার আসি তার ভাষায়, মানে কাব্য ভাষায়। একদিন দুপুরে কবির বাড়ি গিয়ে দেখি কবি অসংলগ্ন। কিন্তু আমি যতদূর তাঁকে চিনতাম তিনি মদ্যপান করতেন না, তবে..! সেদিন আর কথা হয়নি, পরের দিন যেতে দেখলাম তিনি স্বাভাবিক। বললেন আসলে একটা লাইন -“শুখায়ঁ যাছে চইখ্যের জল” কিন্তু ‘সুখায়ঁ‘ শব্দটা কিছুতেই আমার মন নিতে পারছিল না।সারা রাত ভেবেছি, আজ সকালে পেলাম শব্দটা-“জিজাঞ যাচ্ছে চইখ্যের জল”। কতটা ধ্বনিতাত্ত্বিক জোর ও এই ভাষার উপর দখল থাকলে তবে এই উপলব্ধি আসে!অথচ তিনি আনন্দবর্ধন জানেন না, ধ্বনি কাব্য কিনা তাও তার চর্চার বহির্জগৎ। কিন্তু তিনি তাঁর চর্চায় নিরঙ্কুশ। একটা সময় কবির “শিরি চুনারাম মাহত” এই অঞ্চলের কুটুম হয়ে গেছিল। মুখে মুখে সেই চেনা উদ্ধৃতি-
“হায় রে ভালবাসা ভেস্তায়ঁ গেলে -যার বাপ হবার কথা -সে মামা হয়্যেঁ যায়।”
ভালোভাবে পর্যবেক্ষণ করলেই বুঝতে পারা যায় এই ভাষা তে রূঢ় ধ্বনির বোলবালাই বেশি। তাই এই ভাষায় নরম আতুপুতু প্রেমের-কাব্য জমানোটা বেশ চাপের। কিন্তু আচার্য বিশ্বনাথ বা মম্মটের নবরসের বীর ও কারুণ্যের মিশ্রণে একটা নতুন ফ্লেভার তাক লাগাতেই পারে। কবি এত ঝুটঝামেলা বোঝেন না, তিনি বুঝেছিলেন অন্তরের কথা। আমার বাবা একটা কথা বলতেন- বহিরঙ্গ দিয়ে যে নির্মিতি বলা হয় তা মানুষের বহিরঙ্গেই আবদ্ধ থাকে,কিন্তু যে কথা অন্তরাত্মার থেকে বেরিয়ে আসে তা স্পর্শ করে অন্তরাত্মাকে। তাই কবি যখন বলেন –
ধামসা বনায়ঁ দে একটা মাদল কিনে দে
আর গাঁউলি এক দু কলি ঝুম্যইর শিখায়ঁ দে
হামি গাহ্ইব বাজাব
মইচ্ছা পড়া জীবনটাকে বেদম পাজাব।
এই লাইনগুলি আওড়াতে-আওড়াতে খেটে খাওয়া আপামর জঙ্গল-ভূমের পাঠকদের চোয়াল শক্ত হবেই। হতেই হবে।
স্ল্যাং-কে একটি অলংকারেরর পর্যায় উন্নীত করেছিলেন তিনি। কবিতায় ও কাব্যে সেসবই যথার্থ মান্যতা দিয়েই তিনি স্ল্যাংকেও যথাযথ মান দিয়েছেন। কোথাও কোন সময় মনে হয় নি সেগুলো কাব্যের চরিত্র হানি করছে, বরং বারবার মনে হয়েছে সেসবই তীব্র ব্যঞ্জনা ও অলংকারের নামান্তর
লুপুং ঢেমনা মায়্যাঁমুঁহা-
বিহা করলিস কেনে
মায়্যাঁর জীবন মাটি হল্যঅ
মাইচ্যা লকেরঠিনে
( ঢ্যামনা মঙ্গল)
অথবা
” নিয়ায়ঁ লাগ্যেঞ ঠেং-হাথ ভাঁগ্যেঞ
মরবিস বেধ্যামড়া।”
(ঢেমনা মঙ্গল)
এরকম উদাহরণ দিতে গেলে পাতার পর পাতা চলে যাবে, কিন্তু কোথাও অপ্রাসঙ্গিক মনে হবে না। বরং মনে হতে পারে উল্টোটাই কারণ তাঁর কাব্য এবং কবিতার ছত্রে ছত্রে রয়েছে বঞ্চিত সেই সব মানুষদের শব্দের কথা। তাদের দৈনন্দিন যাপনের লড়াইয়ের আর উপেক্ষার হাতিয়ার যাদের কথা এরকম ভাবে কেউ কখনও কোনদিনও বলেন নি।
” মানুষ চুষ্যেঁ মানুষ বাঁচে কার যে কনটা দেশ
বুঝতে লারি গঁগাঞ মরি ।কবে হবেক শেষ।।”
★★★