ছবিঃ গৌতম মাহাতো
শ্যামাপ্রসাদ ঘোষ–র ছড়াগুচ্ছ
কৈশোর বয়সেই লেখালিখির শুরু । কবিতা, ছড়া, গল্প, নাটক,উপন্যাস , জীবনী ও প্রবন্ধ রচনার পাশাপাশি গান লেখার চর্চাও করেন। আকাশবাণী কলকাতার অনুমোদিত নাট্যকার ও গীতিকার। তাঁর লেখা গান নিয়ে কাজ করেছেন অজয় দাস, কল্যাণ সেন বরাট , গোরাচাঁদ মুখোপাধ্যায় প্রমুখ বিশিষ্ট সুরকারগণ । কণ্ঠ দিয়েছেন বনশ্রী সেনগুপ্ত, শ্রীরাধা বন্দ্যোপাধ্যায়, মানসী মুখোপাধ্যায়, সৌম্য বসু প্রমুখ প্রথিতযশা শিল্পীরা।
পেয়েছেন বিভিন্ন নামী প্রতিষ্ঠান থেকে অনেক পুরস্কার ও সম্বর্ধনা। সকল প্রতিষ্ঠিত কাগজে লেখেন। যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেছেন শিশু সাহিত্যে। তাঁর গ্রন্থের সংখ্যা ২৪।
এছাড়াও সম্পাদনা করেছেন দুটি ছোটদের কবিতার সংকলন ও একটি প্রবন্ধ সংকলন । প্রবন্ধের জন্যে পেয়েছেন রামমোহন লাইব্রেরী প্রদত্ত পুরস্কার। এছাড়াও পেয়েছেন বহু পত্রিকা ও সংস্থা থেকে পুরস্কার ও সম্মাননা।
সামাজিক দায়বদ্ধতার দিকেও থাকে তাঁর তীক্ষ্ণ মনোযোগ।
‘ তিতলি ‘ ও ‘ মাসে মাসে কবিতা ‘ নামে দুটি পত্রিকা সম্পাদনা করেন।
তোমাকে দিলাম
তোমাকে দিলাম বৈশাখী – হাওয়া হাই – তোলা ভোর,
এক কুচি মেঘ পুরো নীলাকাশ আধ – খোলা দোর।
শুকনো পুকুর ফেটে যাওয়া মাঠ তপ্ত সড়ক,
গাজনের ঢাক বিকেলের মাঠ ঘোরানো চড়ক।
তোমাকে দিলাম রঙ্কিনী – বিল কমে যাওয়া জল,
মাছ – ধরা বউ পিঠে বাঁধা শিশু স্থির নিশ্চল।
নিরালা দুপুর আম – কুসি আর ঝিনুকের গান,
পশ্চিমী মেঘ কালবৈশাখী বাজানো বিষাণ।
তোমাকে দিলাম দখিনা বাতাস বকুলের ঘ্রাণ,
খোলা জানালায় হারমোনিয়াম রবীন্দ্র – গান ,
“আজি এ প্রভাত , “ওরে বিহঙ্গ ” পদ্য – কুসুম,
ধুলো – ওড়া পথ হাওয়ার ঘূর্ণি দুপুরের ঘুম।
তোমাকে দিলাম আধো আধো বোল ছোট্ট খুকুর,
নিকোনো উঠোন পাতানো সইয়ের
পুন্যিপুকুর ।
ঠামির গল্প হায়েনার ভয় রাতের আঁধার
মাদলের তাল, শেয়ালের ডাক, দূরের পাহাড়।
ভাষা ভাবনা
বাংলা স্কুল ছেড়ে যেই না গিয়েছি
শহরে সি বি এস ই স্কুলে,
সকলে বলে দিল এবার রিক তুই
বাংলা ভাষা যাবি ভুলে।
আমিতো ভয়ে মরি বাংলা ভুলে গেলে
জীবনে থাকে কী বা বাকি,
মায়ের ভাষাটুকু মুখে না নিই যদি
জীবন হবে যে পুরো ফাঁকি।
অঙ্ক ইতিহাস ভূগোল বিজ্ঞান
সবই তো লেখা ইংলিশে,
ম্যামরা ক্লাসে বলে শুধুই ইংলিশ
বাংলা শিখি তবে কী সে ?
আবার এও শুনি না শিখে ইংলিশ
যারাই হয়ে গেছে বড়ো,
চাকরি পেতে গিয়ে ওরালে বসলে
ভয়েতে কাঁপে থরো থরো।
বাবা মা বলেছে, বাংলা ভুলবি না
এখানে বাংলাও পড়ায়,
পড়বি লিখবি বাড়িতে বলবি
পড়বি গল্প ও ছড়া।
বাংলা ভাষাকে তুচ্ছ না ভেবে
হিন্দি ইংরিজি যদি,
শিখিস তবে তোর আখের ভালো হবে
বইবে আলোকিত নদী।
রাজ্য দেশ ব’ লে এখন কিছু নেই
বিশ্বকে এক দেশ ভেবে,
করবি পড়াশোনা তবেই আগামী
তোকেও ভালো ফল দেবে।
দাঁড়িয়ে নিজপায়ে বলবি বাংলা গো
তোমাকে ভুলব না আমি।
বলবি, অক্ষর কলমে এসো তুমি
তোমাকে করে দেব দামি।
দুঃখবাদী কবি
আমি তো তোমাকে দেখিনি রূপাই
দেখিনি সাজুকে আগে,
তবুও কেন যে বুকের গভীরে
দুঃখের হাওয়া লাগে।
কুমার নদীর বুকে কত আছে
সাজুর চোখের জল,
দেখার জন্যে কেন হয় এ্যাতো
এ হৃদয় চঞ্চল ?
ঠিক যেইখানে দাদীর কবর
ডালিম গাছের তলে,
জানিনা কেন যে উদাসী দুপুরে
সেইখানে মন চলে।
মন উড়ে যায় গাঁয়ের বাঁকা সে
ধুলোর পথের কাছে,
ঠিক যেইখানে রাখাল ছেলের
বাঁশিখানি রাখা আছে।
হাসু, রূপবতী, সাকিনা এবং
হলুদ – বরনী কন্যার
সবার জন্যে, সবার জন্যে…
চোখে জল আসে বন্যার।
বেদের মেয়েকে দেখে আসবার
ইচ্ছে যে উঁকি দিচ্ছে,
মধুবালা তাকে, পল্লীবধূকে
চোখ যেন দেখে নিচ্ছে।
এক পয়সার বাঁশি নিতে মন
যায় পদ্মার দেশে,
ধানখেত ছুঁয়ে মাটির কান্না
চেয়ে নিতে ভেসে ভেসে।
তোমার কবিতা পড়ে আমি যেন
মাটির মতোই কাঁদি,
পল্লীর কবি জসীমউদ্দীন!
তুমি যে দুঃখ বাদী।
ঠাকুর
কালকে স্বপ্নে দেখেছি ঠাকুর
লালগোলা ট্রেনে চড়ছি,
শিশু ও কিশোর আকাদেমি গিয়ে
তোমার কবিতা পড়ছি।
দেখে পড়ছি না, মুখস্থ করে
বই না দেখেই বলছি,
বলার সঙ্গে মাকে সাথে নিয়ে
কোনো দূর দেশে চলছি।
বলছি যখন, দিদি এসে বলে
ডাকাতের হাতে পড়বি,
এই নে লাঠিটা, এটাকেই তুই
তরোয়াল করে ধরবি।
শুনে বলি, ধুস, ক্যারাটে শিখছি
কী করতে আমি তবে!
তরোয়াল দিয়ে কাটলে অনেক
ঝুট – ঝঞ্ঝাট হবে।
ক্যারেটের প্যাঁচে ঘায়েল না হলে
খেলনার পিস্তলে,
ডাকাত তাড়িয়ে সবাইকে আমি
ফেলে দেব মুশকিলে।
মুশকিল মানে আর কিছু নয়
সবাই ভাববে আমি,
হঠাৎ করেই হয়ে গেছি আমি
বড়োদের মতো দামি।
এমন সময় মা এসে যখন
হাত খানি রাখে গায়,
ঘুম ভেঙে যায়, জেগে উঠে দেখি
আমি আছি বিছানায়।
খিল
শুনেছি গল্প আমার দাদুর কাছে
ওইপারে নাকি আর এক বাংলা আছে
সেখানেও নাকি ফুল ফোটে গাছে গাছে
সেখানেও নাকি সাগর আকাশ নীল!
তবু কেন মাগো বন্ধ মাঝের খিল ?
ওরা পড়ে লেখে এমনই বাংলা ভাষায়
ওখানেও নাকি জমি চষে মেঠো চাষায়
ওরাও লাফায় ধান- মার ভালোবাসায়
ওখানেও নাকি হেমন্তে ওড়ে চিল
তবু কেন মাগো বন্ধ মাঝের খিল ?
টিভিতে দেখেছি মা বউরা পরে শাড়ি
আমাদেরই মতো উঠোন ওদের বাড়ি
খামারেতে রাখা দুই চাকা গোরুগাড়ি
রান্না চালায় হলুদ মাখানো শিল
তবু কেন মাগো বন্ধ রয়েছে খিল?
আমাদেরই মতো ওদের ঘরের চাল
খালে বিলে জেলে ছড়ায় খ্যাপলা জাল
ভাতের সঙ্গে ওরাও তো খায় ডাল
চলনে বলনে অনেকই তো আছে মিল
তবু কেন মাগো খোলে না মাঝের খিল ?
খিলের মানে যে কাঁটাতার আমি বুঝি
তার মাঝে আছে ছোট ছোট গলি ঘুঁজি
যাদের হয় না ঠিক মতো রুটি রুজি
অথবা বাধ্য হয়ে আসে খুলে খিল
তাদের কি মাগো দেব না আমার দিল ?
হিন্দু অথবা মুসলিম হোক তারা
জাত ভেদ করে তাদেরকে দেব তাড়া ?
তাতেই কাটবে আমাদের যত ফাঁড়া ?
তাতেই কাটবে বিপদ আর মুশকিল ?
তাতেই আসবে আনন্দ অনাবিল ?
ভেদ করে যদি আনন্দ হয় তবে
পৃথিবীতে লোক স্বস্তি পেয়েছে কবে ?
আনন্দ আছে মৈত্রীর উৎসবে
বড় যে আকাশ নিলে তার ঝিলমিল
খুলে যাবে সব বন্ধ মনের খিল।
সহজ পাঠের পদ্য – গদ্য
কালো রাত ওই চলে যায়
মোতিবিল ওই টল মল
দিঘিটার ঠিক মাঝখান
ছোটো নদী তার হাঁটু জল।
কেঁপে যায় আমলকী বন
সকালে ঘাসের শিশির
খালি ডাল যায় ভরে যায়
ফুল গুলি হয় অস্থির।
রাত্রে দেখছি স্বপন
হয়েছি আকাশে মেঘ
ছোটো কাকা যেই তোলে হাত
বাড়ালাম খুব গতিবেগ।
নারিকেল বনগুলি সব
তার ওপর যাই ভেসে যাই
উড়ে যাব যেই ভাবে ফুল
দীপ বলে, তোর ডানা নেই।
এই সব টুকরো লাইন
জেনে রেখো সহজ পাঠের
বিনি পিসি বামি দিদি
ওরা সব স্নানের ঘাটের।
রানী দিদি কাশছে খুবই
তিল খেত আর তালবন
বাঁশ গাছ ঝাঁকায় বাঁদর
চাঁপা গাছ টানে ওর মন।
এ বাঁদর সহজ পাঠের
খাঁদু ওকে ওই ছোঁড়ে ঢিল
এ বইএর গদ্য গুলোয়
নিয়ে নেই কোনো মুশকিল।
সরস্বতী মা গো
তোমাকে বলছি সরস্বতী মা গো
চেয়ে দেখো ভালো করে,
এখন যাচ্ছি আমার স্কুলেতে
এই পোশাকটা পরে।
এতে চলবে তো ? এটা পরে যদি
পুষ্পাঞ্জলি দিই
অঞ্জলি দিয়ে দুই হাত পেতে
তোমার প্রসাদ নিই –
ভালো করে দিতে পারব তো আমি
ফাইনাল একজ্যাম,
রেজাল্ট পাবার পরেই আমার
বাড়বে তো খুব ঘ্যাম ?
না যদি বাড়ে তো তোমার ওপর
খুব রেগে যাব আমি,
ভাবব সু – দেবী হিসেবে তোমার
একটুও নেই দাম- ই।
আমার নাম তো শায়েরী , নামের
অর্থ জানো কি তুমি?
অর্থ – – কবিতা , তাই তো বাজাই
কবিতার ঝুমঝুমি।
তুমি তো আবার কবিতারও দেবী
গানের দেবীও তুমি,
দক্ষিণ থেকে নিয়ে আসো তুমি
ছন্দের মৌসুমী।
গান ও কবিতা যেন ভালো পারি
সব কিছু হয় ভালো,
এ পোশাক পরে পাই যেন আমি
তোমার স্নেহের আলো।
না পেলে আগামী বছরে তোমার
পায়েতে দেব না ফুল,
পুষ্পাঞ্জলি দেবার সময়
মন্ত্র বলব ভুল।
★★★