সৌমিত বসু -র কবিতাগুচ্ছ

 কবিতাগুচ্ছ

    সৌমিত বসু -র কবিতাগুচ্ছ

                                                   

কবি দীর্ঘ সময় ধরে কবিতার আশ্রয়ে তাঁর সাধনা ও ব্রতে নিশ্চল।কবি সৌমিতও এক নিভৃতের কবি।দুই বাংলা তথা বিভিন্ন রাজ্যের লিটল ম্যাগাজিন সহ বাণিজ্যিক পত্র-পত্রিকাতেও তার অবাধ বিচরণ।

     বঙ্গবন্ধু, জুড়ে যাওয়া কাঠের আনন্দ 

একটি নদী যদি দু-হাত দিয়ে
শাখা প্রশাখাকে ডেকে আনে 
তবে তা সমুদ্র হয়ে যায়। 

একটি মানুষ যখন 
দুহাত দিয়ে অজস্র মানুষকে 
বুকে টেনে নেয় 
তখন তা বৃষ্টি হয়ে নামে। 

সমুদ্র ও বৃষ্টি যেদিন হাত ধরাধরি করে 
বাঁধের ওপর দিয়ে এগোতে থাকে 
এ ওর কাঁধে মাথা রাখে 
রাত্রি হলে ছাতা খুলে আড়াল করতে চায় মানুষের পাপ 
তখন তোমার কথা আমার খুব মনে পড়ে 
তোমার মেলে দেওয়া কোটের পকেটে 
গুটিসুটি মেরে ঢুকে যেতে ইচ্ছা করে শুয়োপোকার মতো 
দূরে দেখতে পাই অজস্র মেয়ে তাকিয়ে আছে তোমার ভরসায়। 
আমার ঘুম আসে, শান্তির ঘুম। 

নদী আর মানুষ 
আমার ছোটবেলাকার চেনা 
যারা পরস্পরকে ভয় পায়, 
তুমি তাদের মেলাতে চেয়েছিলে একদিন। 

আমরাও তোমার শেখানো পথে 
ক্রমাগত জুড়েই চলেছি। 

                        পুরুষতান্ত্রিক 

মেয়েটি বুক পেতে দিয়েছিলো  কবিতা লেখার জন্য। 
বলেছিলো,  যদি একটিতে না কুলোয় আর একটিও হাতে রইলো। 
আমি শুধু নিজের নাম লিখে গেছি, নিজের নাম। 

আজ যখন টুপটাপ বৃষ্টির ফোঁটা
নেমে আসছে তোমার ওপর
আমি আড়াল করতে চাইছি, 
তোয়ালে দিয়ে মুছিয়ে দিতে চাইছি  তোমার আনন্দস্পর্শ। 
তখন তুমিও ক্রমাগত সময়ের সাথে পাল্টে ফেলছো নিজেকে, হয়ে যাচ্ছ হরিণ, হয়ে যাচ্ছ রাজঁহাস। 
ডানা পেয়েছো কিন্তু উড়তে পারছো না। 

একদিন আকাশের সমস্ত তারাগুলো  বিদ্রুপ করবে আমাদের।

                    শকুন্তলা   

অশিক্ষিত বনকন্যা শকুন্তলার 
যেটুকু সম্ব্রম ছিলো 
বুকে ভর করে চলা 
অনেক মানুষের ভাগ্যে 
সেটুকুও জোটেনি। 
সত্যি সত্যি প্রতিষ্ঠানকে কেউ যদি
সপাটে থাপ্পড় মেরে থাকে 
সে আমাদের শকুন্তলা, 
পরজন্মে যে অহল্যা হয়ে জন্মেছে 
কিংবা ইলা মিত্র, 
যাদের পায়ের ছাপ ধরে মানুষ
কিছুদূর পর্যন্ত  যায় 
কিন্তু পৌঁছনোর আগেই হারিয়ে ফেলে পথ
সে ভুলে যায়,সে শুধু নিজের বঞ্চনার কথা বলতে আসেনি 
চিরকালীন অবজ্ঞার স্রোত 
জানাতে এসেছে একটা খোলা মাঠে, 
উচ্ছিষ্টের মতো দুটো রুটি
কিংবা একপাতা লেখার বিনিময়ে
যারা সমঝোতা করে 
তাদের বিপ্রতীপে দাঁড়িয়ে 
শকুন্তলা কিন্তু নাকচ করে দিয়েছে 
রানী হবার প্রস্তাব। 
সারাজীবন কিছু না পাওয়া 
শকুন্তলা যা পারে,
আমাদের সব পাওয়া বহুরূপীরা কেন 
সেটুকুও পারেনা? 

তাই শকুন্তলা কোনো মেয়ে নয়, 
নয় পাটরানী,প্রতিদিনের আকাশে
ভেসে বেড়ানো এক আগুনরঙা মেঘ, 
প্রতিষ্ঠান বিরোধিতা যার অঙ্গের ভূষণ। 

                        বনলতা সেন 

আমার বৌ আমার প্রতিটি মিথ্যের ওপর বসে থাকা জলফড়িং। 
আমার ডানা নড়লে তার মনের জলে ছায়া পড়ে। 
তার প্রতিটি “আচ্ছা” উচ্চারণের ভেতর লুকিয়ে থাকে কতটুকু বিশ্বাস -অবিশ্বাস, 
অনেক অনেকদিন আগে 
সে আমাকে সবটুকু দিয়ে ভালোবাসতে চেয়েছিলো 
আমি হেসে আমার অক্ষমতার কথা জানিয়েছিলাম। 

ও আমার বৌ,  তুমি আমার সমুদ্রের ভেতর জেগে থাকা একলা মাস্তুল 
যেদিকেই উড়ে যাই ফিরে এসে তোমাতেই বসি

                        সে


প্রায় সাতমাস পরে সে ফিরে এলো।
ফিরে এলো কারণ সে এখন ভাবছে বাকিজীবন এই গ্রামেই থেকে যাবে।
তার প্রথম বউ গলায় পরিয়ে দিয়েছে কঙ্কালের মালা
ছেলেমেয়েরা হাতে ধরিয়ে দিয়েছে
মুড়ো ঝাঁটা,টায়ারের চটি
যাতে ভর দিয়ে সে উড়ে যেতে পারে আত্মীয়স্বজনের আকাশে
দুটো ভাত পাবার আশায় আজ সে এসে দাঁড়িয়েছে নতুন বউ এর উঠোনে।

বউ তাকে দেখছে আর ভাবছে
পাড়ার আশিসকে সে আজ
কি জবাব দেবে
হাড় জিরজিরে মানুষটাকে দেখে
কান্না পাচ্ছে তার
একটা সরু সুতোর ওপর দাঁড়িয়ে
একথালা গরম ভাত
তার কাছ থেকে সরে সরে যাচ্ছে।

অহেতুক স্বপ্নের ভেতর
আজ জন্ম নিলো যে উপকথা
তোমরা কি আদৌ টের পেলে?

                    শৃঙ্গার

সারা সকাল দাঁড়িয়ে আছি তোমার মায়ায় 
হলুদ ত্বকে জড়িয়ে থাকা সোনালি ঘাম, 
পিঠ বেয়ে তার পড়ছো ঝরে তুমুল খাঁজে 
সব পেয়েছি আসর জুড়ে আমায় কে পায়। 

মুঠোর ভেতর অনন্তকাল শূন্য বাদাম 
পুড়ছে দেখো রূপের ছটায় জলোচ্ছাসে 
ভাঙছি আমি ভাঙছি তোমায় উন্মাদিনী 
নিজের মতো ভাবনা দিয়ে তুমুল ত্রাসে। 

তূমি আমার হারিয়ে যাওয়া একটি বোতাম 
তূমি আমার ঝড়ের রাতের একলা আলো 

           ভোর হলে শত্রুরা ঘুমোতে যায় 


রাজনীতি করে কবিতা হয় না 
গুন্ডামি করেও নয় 
একটা স্লেটের মতন মন চাই 
যাতে লেখা যায়, মোছা যায় 
রাগ, হিংসা, ঘৃণা পুষে রাখেনা সে 
আমি সেই মন খুঁজি, বেলা গড়িয়ে যায় |

আমি রাজনীতি করে দেখেছি 
কবিতা নিয়ে তার কোনো মাথাব্যাথা নেই 
ক্ষমতা ছাড়া অন্য কোনো কবিতার ভাষা
সে বুঝতেই চায় না 
সে বড়জোর কবিতাকে ব্যবহার করে 
টিকে থাকার তাগিদে  
জনগণকে বোঝাতে তিনিও 
সংস্কৃতি পরায়ণ। 

আমি গুন্ডামি করেও দেখেছি 
তা দিয়ে শুধুমাত্র 
শরীরের দখল নেওয়া যায় 
হাত ধুয়ে ফেললেও মাঝরাতে 
লাল হয়ে ওঠে হাতের তালু 
বালিশের নিচ থেকে চাকুর গন্ধ 
ভেসে ওঠে, ঘুমোতে দেয় না। 

আমি মনের দখল চাই 
এসো বন্ধু, দুদন্ড বসি গাছের ছায়ায় 
এই নাও জল ন্যাকড়া, স্লেট পেন্সিল 
তুমি লেখো, আমি মুছি 
আমি লিখি তুমি মুছে দাও।

                                           ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *