অলক জানা-র কবিতাগুচ্ছ

কবিতাগুচ্ছ

    অলক জানা-র কবিতাগুচ্ছ  মূলত কবি,তবে গদ্য ও গল্পেও তার সমান গতায়াত।দীর্ঘদিন নানান লিটল ম্যাগাজিন সহ বানিজ্যিক পত্রিকাতেও লিখে চলেছেন।আমাদের ক্যানভাসে আরও এক নিভৃত কবির অন্তহীন যাপনের উদযাপন ধরা রইল..

                                           

                   চরিৎ   

দু একটা বিষাদ
ভালোটি সেজে নিরাপদে নিরুপদ্রব চুপ, 
দীর্ঘপ্রহর একত্রেই হেঁটে গেছে বহুপথ 

শ্বাস পড়ার সময়টুকুই যথেষ্ট 
সেই মুখরবিষাদ একবারটি তেতে উঠলেই 
পৃথিবীতে অনিবার্য মহাপ্রলয়।

ধ্বংসের বিপরীতে যে সংগীত হাঁটে 
তার জন্যই সূর্যশিখার আরতি,
আঁচল জড়িয়ে থাকা পুষ্প ঘ্রাণের উদাস।

উঠোন আগলে থাকা সম্পর্করা পীড়িত হলে নিজেকে কেমন পরাজিত লাগে ?

                   যাপন চিত্র 

বৃষ্টির পর ভেজা অন্ধকারে পথ ভাঙছে 
বিশ্বাসমগ্ন একটা সম্পর্ক, বিরতিহীন কথা ফুটে আছে পথবাতির মায়ায়, সেই রেশ ক্রমার মুখে হাঠাৎ  থেমে গেলে পথিকের পায়ে একদা পথ বাড়ন্ত হয়ে যায়। তবুও রাতের জোনাকি আঙুলে জ্যোৎস্নাবাসর সাজায়, সমস্ত চৈতন্যে সন্ন্যাসীর রিপুজয়ের আনন্দ খেলাকরে। আজ কোন পরাজয় নেই, পৌরুষ ঘুমিছে অন্দরে
কুমতলব হয়তো ছিল, কিন্তু গতজন্মের ইতিহাস।

                     প্রহর 

সরে আসার পরই কিছু অসমাপ্ত 
স্পষ্টত উঁকি মারে, তখন সতর্ক অভিপ্রায়ে 
ভাবতে হয় তাদের কথা —–
কিছু ছেলেমানুষি স্বভাবদোষ চোখের সামনে অনিবার্য মরবেই, তবু নীরবচারী দর্শক সেজে মানতেই হয় পালটে আসা প্রহরের অনুশাসন।

ঈশ্বর ভেবে যার পায়ে শাব্দিক ফুল ফেলে আসি
একদা সেও কেমন পাথর হয়ে যায়,
তখন অনভ্যস্ত অপরিচিত জলবায়ু সামলাতে 
শরীরে প্রয়োগ জরুরি উচ্চমাত্রার দাওয়াই,

পরমায়ুর প্রহর পুড়ে গেলে অভিমানেরা 
কেমন আকাশ হয়ে যায়।

                      বিপন্নতা

দিনের সমস্ত ব্যস্ততা চুকেবুকে পড়ি মরি ফিরে আসা মানেই একটা ঘর, নির্দিষ্ট বিছানা বালিশ কিছু বাস্তুঘুঘু বিপন্ন দুশ্চিন্তা, যারা আহত অসহায় জেনে বুঝে ভালোবেসে কতকাল থেকে গেছে, তাদের জন্য এখন গা-সওয়া অপার উদাসীনতা।
স্বাচ্ছন্দ্য নাটকীয়তায় ঢাকতে চেষ্টা মাত্র, এভাবেই মানুষের বনে ঘুরে ঘুরে একার ভেতর একান্ত একা
হয়ে পড়া না জানি কখন ডুবে যাবে শেষ অন্তরীপ ঋতু ভাঙা সম্পর্কে বাসা বাঁধে বিপন্নতা।

                      শাস্তি 

কী এমন চেয়েছি ? কিছু কংকালনিঃস্ব অক্ষমতা,
বিষণ্ণ শূন্য আবছায়া ভয়, 
ভাগাভাগির জন্য এই আয়োজন।

বেশ তো হেঁটে এলে অর্ধেক দিগন্ত
ধুলো বালি বাতাসের ওপর পায়ের ঋজুতা ফেলে
নদী হতে চেয়ে বাঁক নিলে যখন 
ভাবনাতীত অভিমুখ বদল, কীভাবে সহ্য করি ? 

আলো ও ফুলেরা শাস্তি দিতে শিখে গেলে
গলন্ত হিমের মতো খাটো হয়ে আসে
নির্ভরতার আয়ু , বিশ্বাসের মায়াচর  
এই অসহিষ্ণু দিনযাপন যদি সমর্থনযোগ্য ভাবো ? 
তবে বসবাসের সবটুকু মাটি 
একদা পাথর হয়ে যায়।

                     আসর 

সবাই চলে গেছে, টিমটিম আলোয় দু-একটি ছায়ার সঙ্গে একা মঞ্চ, গোছগাছের ব্যস্ততা।
গত রাতে যে দিলদার সেজেছিল,
তার স্রী ক্যানসারসঙ্গী, বাড়িতে দুখঃ তবু 
শিল্প ও শ্রোতামঙ্গলে তুবড়ির  মতো জ্বলে। 

আসর জানে প্রত্যেক 
কুশিলবের আঢাকা কিছু দিক, 
কাঁটাফুল সংলাপে আড়াল কয়েক প্রস্থ 
ক্ষত ও ত্যাগ, আনন্দ ভাগ হয়ে গেলে কাকজ্যোৎস্নায় বদলে যায় পোশাক, মুখশ্রী রঙ, সাদা থানের নীচে সঞ্চিত আবির বসন্ত।

                  পর্ণমোচী

সময়ে আসন ত্যাগের নামই বর্ষবরণ
মায়া বাড়ানো লক্ষণ রেখায় 
ফুল ফোটে, ফুল ঝরে —-
প্রতিটি পরিস্থিতি অঙ্কে বাঁধা 
গাছে গাছে মুকুলিত আবির পাতার দিন।

ছোটো ঘরে অভিমান রাখি কোথায় ? 
এখন তুমিও জেনে গেছো 
গ্রহের নিজস্ব কক্ষপথ থাকে, 
ভুল অক্ষাংশে আলো হয়ে নেমে এলে 
জন্ম হয় নতুন কিছু কাহিনি 
অবসর বুঝে স্মৃতির সেটুকু তরজমা 
বন্ধুতার অধিকার হোক।

                      জল 

জলের সঙ্গে বসবাস অতো সহজ কথা নয়, 
বুনো রাগ ও শীতল নম্রতায় যে চির অপ্রতিবাদী, দুর্বলতাহীন জেগে থাকা হৃৎপিণ্ডের মতো ,
তার প্রতি যত্ন সহ্যের বাইরে গেলে 
আলোর নালিঘা, বাষ্প কিংবা 
বরফের স্তূপ শ্বেতকায় দানব হয়ে যায়। 
কিছু সম্পর্ক,সম্পর্কের মানুষ 
জলের চেয়ে কম কিছু নয় 
চিরতরে হারিয়ে যাওয়া পৃথিবীর অমোঘ নিয়ম, তাই সতর্ক মেজাজ রেখে তৃষ্ণার ওম সংগ্রহ হোক।



                      বিভাব  

।।এক।।

মেরুকরণে ফিকে রঙ, 
বিধ্বস্ত জটায়ুর মতো একপাশে 
পড়ে থাকে কিছু অপেক্ষা,
বিকেল থেকে সন্ধ্যা অনিবার্য আলোপার্বণ,
ধারাপাত লিখে দিলে নির্ধারিত সুচি বদলে যায় অধৈর্য ঠেউ প্রলাপে তখন গলতে থাকে অধিক যত্নের মায়াচর, ঘর ভাঙ্গে, উড়ে যায় মেঘেরপালক। 

।।দুই।।

জড়োয়ার কানপাশায় সূর্যাস্তের একটুও মনখারাপ নেই, অভাবী গারিগর পুড়ে আসা প্রত্যেক শ্বাসে রেখে গেছে আনন্দভৈরব। সেভাবেই সেজে ওঠা কোন মুখমণ্ডলকে তীর্থ ভেবে বুকের একাংশে লালন করার স্পর্ধা কেবল সাচ্চা প্রেমিকেরই। 
ক্ষত পেরিয়ে যায় জন্মদিনের বিনির্মাণ
পাশাপাশি অপেক্ষার সঙ্গে বিয়োগ হতে থাকে পরমায়ুর এক একটা সৌরদিন।

                  দিকনির্ণয়

নির্ধারিত সুচির বাইরে বাজছে অবিরাম 
যে যেমন গড়েছে পৃথিবী, তারই কোন এক সংগোপন সীমার ভেতর, রোজনামচার বিপরীতে বেজেই চলেছে একটা নীলরোদের সুর… 

সেই নিপাতন সুরসম্পর্কের জন্য সেজে ওঠা 
তাসের ঘর আর একটা নেশার নাম।
সব দাবি মঞ্জুর হয় না, তবুও তার কক্ষপথে ফুসফুসের কিছু ক্ষয় রেখে আসা বড়োবেশি দরকারি ভাবে জীবন। 

ল্যাম্পপোস্ট স্বভাবে অনন্ত পথ খরচ হয়ে যায় 
অপার চঞ্চলতার ভেতর জন্ম নেয়
অচল ডাকবাক্স প্রতীক্ষালয়, যার সঞ্চয়ে 
পড়ে থাকে কেবল ফেরার একটা চিঠি।

                                 ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *