‘বিকাশ চন্দ’ র কবিতাগুচ্ছ
ছবিঃ গৌতম মাহাতো
নিপুণ প্রসাধন
অক্ষত ছিলো না আমার পুরনো হৃদয়ের প্রত্যয়,
চতুর্দিকে অনাঘ্রাত পাশব শ্বাস…
প্রান্তিক জীবন আর পথ ছিল বড় মায়াময়
কেবল ঘরে ফেরার রাস্তা উধাও,
যে হৃদয়ের উষ্ণতায় এতো দিন বেড়ে ওঠা…
হঠাৎই নির্দয় বরফ কাল উস্কে দিল ঠাণ্ডা রক্ত,
এখন প্রাগৈতিহাসিক চিৎকারে দিনে ও অন্ধকার।
★
সবই ঠিক ছিল জল ছল ছল উদাস নদী স্রোত,
অকস্মাৎ সব ঈশ্বরের হাজারো দোসর ধূনি জ্বালে—
বেপথু ভগীরথ আজ পথ ভোলা লক্ষ্যহীন পথে,
জড়িয়ে রয়েছে চতুর্দিকে নিরীহ বংশধর শেকড়ে বাকড়ে…
চরাচর বিছিয়ে শান্তি আর সবুজের আঁচল,
হঠাৎ যেনো এসেছে জোয়ার সবই ভাসিয়ে নেবার…
আহা বিষাদের রাত… দেখো বেঁচে আছি সমস্ত ঢেউ ভেঙে।
★
গাছে গাছে সবুজ আস্তরণ ফুল ফল পাখি—
পাখির পিঠে তেমনই দু’টি ডানা, বুকের ওমে বাঁচে তার ছানা,
এভাবেই প্রতিদিন আত্মসমর্পন সুগভীর বিশ্বাসে—
পাখিদের চেনা সুর আসে নেই সানন্দ সুর ছন্দ লয়,
পাঁঁজরের যন্ত্রণা ছুঁয়ে আরও উষ্ণতম শান্তি জল ভাঙে..
কেউ বলেনি ক্রিতদাস হও বা নাগরিক দ্বিতীয় শ্রেণির,
কেমন আছি দেখুন নিপুণ প্রসাধনে গোপন গেরুয়া সুনীলে।
নিজস্ব বিষাদ
ভেজা কপালের ঘাম মুছে আনলেই
রুমালটায় ছোপ ছোপ চেনা মিছিলের রঙ,
জীবনের কথা বাদ দিলে জমে থাকে নির্বাক শরীর,
ঘনীভুত মেঘ রঙ খোলা চুল পরকিয়া বৃষ্টি মাখে—-
সমস্ত জীবন মোচড় খায় জানে সে একলা বৈশাখ,
তোমার যত না লজ্জা তার চেয়ে বেশী তৃষ্ণা দু’ঠোঁটে
বুকের ভেতর জানান দেয় সন্তর্পণে ক্ষুধার্ত শৈশব,
কতকাল নিশ্চিন্ত জেগে থাকা, দু’বাহুর বাঁধন সোহাগে।
★
কোথাও ভেঙে পড়ে সামাজিক সুরম্য জগৎ সংসার,
জীবন নাকি জানে সে একাকী, মৃত্যুর অহংকার যত —-
হিসেবী সংখ্যা তত্ত্ব ক’খানা পাঁজরের হিসেব কষে শুধু
নিঃশব্দে মায়া জন্ম কাল এক পায়ে দাঁড়িয়ে নিজস্ব বিষাদে।
★
এখনো প্রতিদিন নিষিক্ত রক্ত ঘাম ভেজায় সারাটা শরীর,
সে কি প্রথম পুরুষ নাকি নারী বা অন্য কেউ—-
বিমূর্ত সে চিরন্তন জীবনের অন্য সুরে জাগরণী—
মুগ্ধতায় পৃথিবীর এ পিঠ ও পিঠ যুদ্ধ জীবন একাকার।
ও বেহুলা বসন্ত
শূন্য পাতায় দাঁড়িয়ে গাছের ডাল—
জীর্ণ শরীর ছিঁড়ে ফেলছে ছাল,
হয়তো সময় আগলে আছে অনিন্দ্য—-
কেউ দেখেনি গোপন বুকের অলিন্দ।
★
সময়গুলো ভাঙছে অকাল ঢেউ—
জীর্ণ শরীরে হৃদয় আড়ালে কেউ,
ধর্ম কথায় গল্প শোনায় হৃদ্যতা—
মরছে মরুক রক্তাক্ষরে বিদ্ধ তা।
★
অন্ধ সময় পুড়ছে শরীর স্বীকৃতি—
দহন জ্বালায় অট্টহাসি কী বিকৃতি,
শীতল সময় বুকের ভেতর কান্না —
বিপন্নতায় আর তো কোনো গান না।
#
বিকিয়ে গেলে হঠাৎ জীবন সাঁকো—
কেমন করে অঙ্কুর কথা আঁকো।
বিসর্জনের বাজনা ভেজা রঙ নীলে,
ও বেহুলা বসন্তে আজ মন দিলে !
প্রাণের পরাগ
যতো বার কাছে এসেছে বাতাস তত বার জেনেছি সমুদ্র উচ্ছ্বাস—-
হাতে হাত যতো বার দিশা হীন ঝরে পড়ে চেনা সব ফুলের সুবাস,
পরমা সময় হে বর্ণপ্রভা কতটা দ্যুতিময় অভিন্ন অরূপ বিশ্বাস—-
কাম গন্ধ নেই বা আছে কি প্রত্যাশায় জাগে অনিবার্য উল্লাস।
★
শূন্যে দু’হাত তুলে অট্টহাসি অজানা শব্দ জুড়ে বিদীর্ণ আকাশ—
ঘূর্ণমান আমরা পরস্পর টানা পোড়েন ঝরা ফুল ফল কুঁড়ি,
সাম্প্রতিক ভেঙে পড়া জাতক সম্পর্ক ভিন্ন স্রোতের বাতাস—-
রূপায়ন চাই বলেই বিবর্তনের বাতাসে উড়ে যায় ভোকাট্টা ঘুড়ি।
★
চেনা শিশুদের স্বর্গীয় হাসি বোঝে না অযাচিত ভয়ের জন্মান্তর—-
মদন রসিয়ার গোপন মহিমা নাচার সময় ডাকে কোন আর্তস্বর,
বাউল বাতাস কলাকুশলী হঠাৎ উধাও কেনই বা ডাকে স্থানান্তর—-
হার মেনেছি এ শূন্য সময়ে কাদা মাটি ধানের চারার মোহন স্বর।
★
যতই বিশ্ব ঘুরতে থাকুক দীঘির জল আয় চই চই হংস মিথুন রাগে
কচি পাতা রঙের আলোর শিশু নির্বিকার ভেঙে যায় লক্ষ্মণ রেখা,
আবারও প্রসব কাল সংসারী গোলাপ কুঁড়ি মুখ সংসার সংরাগে—
আজন্ম দাঁতে দাঁত চেপে নিজভূমে আবারও তোমার আমার দেখা।
★
যে ভাবে জীবন চলেছে তুহিন সীমায় কত বার দেখা সেই আত্মহনন—
সমতল জানে গো চারণ তৃণভূমিতে ছায়া ঘেরা প্রিয় গ্রামের হাওয়া,
কঠিন যন্ত্রনাগুলো বুঝে গেছে সন্তান সন্ততি বোঝে কি আপন মরণ,
প্রাচীন সংসারী বহুজন প্রতিক্ষায় কাল গোনে একটু স্বাস্তি ছাওয়া।
★
সবাই জেনেছে ফেলে যেতে হবে কখনও নিজের গার্হস্থ্য অনুরাগ—-
রাজত্ব গিলে খায় ছিঁড়ে ফেলে জন্ম বসন করজোড়ে প্রাণের পরাগ।
আজন্ম বন্ধকি নজরানা
অনাদৃত সময়েও ধুইয়ে দেবো শরীর সংসারী সহবাসে…
ছুঁয়ে থাকি নিজেদের দুঃখ বোধ অনাবিল পরমানন্দে,
জমা জলে তখন পদ্মগন্ধী রেনু ভালোবাসা মাখামাখি…
মায়াময় দুটো পদ্ম কলির সুগন্ধ নিতে পারিনি এখনো।
★
বারোমাস জল ভরা সাঁকো পেরোতে ঝিরঝিরে ঢেউ…
অম্লান হাসিতে বকুল ঝরেছে দু’জনের শরীরে উচ্ছন্ন সময়,
নির্নিমেষ চোখের স্বচ্ছ কাঁচের তারায় আমার মুখে আলো…
সম্ভ্রান্ত সেই সকল অনুযোগ ভাসিয়েছে অনিন্দ্য নোনা চাতর।
★
পৃথিবী বুঝেছে প্রকৃতি বাসনা উড়ে যাচ্ছে আঁচল বিবাগী বসন্তে…
উঠোন পেরিয়ে সবুজ অভিলাষ অকৃত্রিম উষ্ণ শ্বাসের ঘ্রাণ,
সে কথা জানে একে অপরে অন্তরঙ্গ বাসন্তী বাসনা বিলাস…
সে কোন দৃষ্টি কেবলই শুভ অন্য সব কেন স্তুতিময় চাওয়া।
★
দেবতারাও জানেনা অন্তরীন জন্ম কুঠির কোথায় জলতল…
দিন রাত ঘুরে ফিরে রিক্ত বিষণ্ণ মুখের জবজবে রক্ত জল ঘাম,
বেদনার ভেতরে স্মৃতিময় অরূপ উচ্চারণ সূক্ষ্ম প্রাণায়াম…
শিউরে উঠেছে শরীর অন্য স্পর্শ কিচু অবিকল অনন্ত আশ্রয়।
★
কত দিন ভর পেট খাওয়া বা উচ্ছিষ্ট পানীয় দেয়নি কেউ…
কাছে দূরে উড়ছে বাতাস মুক্তির আয় ব্যয়ের কলুষ খতিয়ান,
নদী জলের এপার ওপার মাঝামাঝি স্রোতের আর্তি বিষণ্ণতা…
ঘনিষ্ট বাজনা বাজো তন্ত্রভুক্তির আজন্ম বন্ধকি নজরানা।
না শরীর না সংসার
সমস্ত বনাঞ্চলে থাকে গোপন সরোবর জল টলমল
ধারে কাছে শ্বাপদের পায়ের ছাপ আর বুনো হরিন
কিছু থাকে অবাক জলপান আর অবাধ রক্তক্ষরণ—
★
বিষণ্ণ প্রেমিকের গল্প বলে একা এক শালিক
বিলুপ্তপ্রায় চড়ুই জানতো খড়ো ঘরের আলু থালু ঘুম
সমস্ত ঘুমের ভেতর অলীক ঘুমের শরীর দিব্যি কথা কয়
★
হঠাৎ অকাল ঝড় বৃষ্টি আশ্চর্য প্রাণের ঈশারা অভ্যাসের
প্রাচীণ সময় থেকে একই সেই বুনোট বর্ষা বৃত্তান্ত
ভাসিয়ে দেয়া ভাসিয়ে নেয়া কুক্ষিগত ভাসানী খেলা
★
অন্তহীন কালাতিপাত কিছু বিনিময় শব্দমালা সব
পলাশ কৃষ্ণ চূড়া মহুয়া বকুল কাল বেলা জানে নিভৃত সময়
বসন্ত ভালোই জানে ফুল ফোটার শর্তহীন মরশুমি রমণ
★
হয়তো জানে মন খারাপের শিশিরকণা বৃষ্টি অন্ধকার
তবুও ঈশারায় না শরীর না সংসার পরস্পর
অন্য তর কিছু থাকে চোখের ভেতর আলোর চমৎকার।
★★★