গৌ ত ম ম ণ্ড ল-র কবিতাগুচ্ছ
ছা য়া র মৃ ত্যু
নির্বিবাদি ছায়ার মতো দুলছি তোমার
আইনত আড়াই হাত জমিতে,
তুমিও জানো সূর্য সরে গেলে উঠে যাবো অন্যখানে,
সবাই জানে সূর্য ভুলে গেলেও সরে যাবো
সন্ধ্যার সমুদ্র-পাড়ে।
অথচ, কখনো মাড়িয়ে যাচ্ছ কঠিন পায়ে,
কখনো গোলাপ রাখছ অস্থির ছায়ার নাভিতে,
আমি বলছি, সমস্ত রাগ অভিমান ভালোবাসা
ক্রোধ আর বন্যা হাতে রাখো কন্যা,
ছায়ার ও একটা মালিক নিশ্চই থাকে,
সমস্ত গোপন বাক্স নিয়ে প্রস্তুত থেকো,
ছায়ার মৃত্যু হ’লে সব কিছু রেখে আসো
একটি অগোছালো সমাধির কাছে,
একটি গোলাপও…
ই উ টো পি য়া
এর পর হাত ধরে রাস্তা পার হলাম,
রামধনুর মতো ফুলেল আলো এসে
পড়লো তোমার চিবুকে
সমস্ত স্বাধীন রাস্তা জুড়ে শুয়ে আছে প্রজাপতি,
রক্ত নেই, বারুদের গন্ধ কাকে বলে ভুলে গেছি।
ঢাকা শহরবের মতো রঙীন রিক্স এসে দাঁড়ালো
তোমার গা ঘেঁষে।
তুমি তর্জনি তুলে ইশারা করলে
“শুদ্ধ নগরীর দিকে চলো, যেখানে
প্রেম ছাড়া বাকী সব অবৈধ”।
ই উ থা না সি য়া
অতএব সে তাকে ছেড়ে চলে গেল
মৃদুমন্দ হাওয়ায় চুল ওড়াতে ওড়াতে,
দূরন্ত স্রোতস্বিনী মোহনার দিকে।
পরিত্যক্ত প্রেম ব’সে পড়ে তারাখসার মতো,
জল ও আবেগের বেহিসেবী ধার দেনায়
একদিন বৃক্ষ হয়ে যায় কালক্রমে।
বহু যুগ পর এক ঝড় জলের রাতে
ভাঙনের তোলপাড়ে ঝাঁপ দেয় প্রবাহি জলের বুকে,
এখন স্রোতস্বিনীর বুকে প্রেম আর মৃত্যু।
গাছেদের যন্ত্রণা দেখেনি কেউ, দেখেনাও।
ক্ষী রা ই ও স ন্দী প দা
সাঁকো পেরিয়ে ঢুকে পড়া গেল
সুন্দরীদের মেলায়,
না, শৈশবের খেলাঘরে
তাও ভুল,
ফুলেদের ভীড়ে।
আপাতত ফুল শিশু ও সুন্দরীকে
একইরকম লাগে,
গুন গুন করে গলা বেয়ে ওঠে গান
বিড়ি হাতে সন্দীপ দা কে বদ্ধ উন্মাদ লাগে,
ফুলেদের ভীড়ে ফুল
শিশুর মতো অনিশ্চিত
সুন্দরীর মতো স্বপ্নালু।
কে সন্দীপ দা
কে উন্মাদ
কে ফুল
কে শিশু
কে সুন্দরীর মতো লাস্যময়ী
এলোমেলো হয়ে যাচ্ছে।
প থ
ঈশ্বর ও শয়তান হেঁটে চলে পাশাপাশি,
প্রতিবাদ নেই
প্রতিরোধ নেই
আস্ত শরীর পেতে ঘুমোয় দিনরাত,
জেগে থাকলে পৃথিবী অন্যরকম হতো।
আ মি
একেক করে বন্ধ হয়েছে সমস্ত পথ
একমাত্র রাস্তায় হেঁটে যাই সাবধানে
জোরে পা ফেলিনা
জুতো পরিনা
এমন কি নখ কেটে রাখি সময়ে সময়ে
একটিই রাস্তা,
আহত হ’লে হাঁটবো কোন মুখে!
পু কু র
ঘুমের ভিতর আদেশ করেছিলাম
সমস্ত রাস্তার দু’পাশে পুকুর থাক।
ছাপোষা আমি জেগে উঠে দেখি
খোঁড়াখুঁড়ি চলছে জোরকদমে
ক’দিন পরেই দেখি দু’ধারে মাথা তুলে
সারি সারি বহুতল।
কে জানতো প্রাসাদ বানাতেও পুকুর লাগে!
তবু বদমাসগুলো পুকুর বোজাতে ব্যস্ত রাত দিন।
ক বি তা স ম্মে ল ন
দুরন্ত গতির ট্রেন দাঁড়িয়ে পড়লো
আগুনের হলকা আসছে নাগাসাকির মতো,
একটা দুটো তিনটে একদল কুকুর দৌড়ে এলো
রাস্তার মোড়ে
মড়াকান্না জুড়ে দিল, মাংস পোড়ার গন্ধে ভূ কম্প
হচ্ছিল যেন।
দূরে এ গাছে ও গাছে কয়েকটা বন শালিখ
এত ধোঁয়া আর গন্ধের ভিতর আকাশ হারিয়ে গেছে কোথাও…
কীসের যেন প্রহর গুনতে গিয়ে নির্বাক হয়ে গেছে ওরা।
অগোছালো মানুষ নেমে এসেছে রাস্তায়
বৃদ্ধ বৃদ্ধা যুবক যুবতী স্ত্রীলোক বাচ্চা
সভ্যতাকে বাঁচাতে হবে যেকোনো মূল্যে।
সবাই ভাবছে প্রত্যেক দিনের মতো আজ সূর্য উঠবে কিনা,
সূর্য উঠলে তবে স্নান খাওয়া ঘুম
নতুবা পোড়া মাংসের গন্ধ
শিশুর কান্না
পেট্রলের গন্ধ
৫০০, ১০০০ টাকার নোট
সব একাকার করে দেবে, যন্ত্রণাময় নরক।
পোড়া গন্ধ কুকুর পাখি মানুষ সবাইকে উদভ্রান্ত করে দিয়েছে,
শুধু একদল কবি পাঞ্জাবি পাজামা পরে কবিতা সম্মেলন করে যাচ্ছে দ্বিধাহীন।
কবিদের নাক থাকেনা।
শো ক
শোক কোনো নিভৃত যাপন নয়
আধ শোয়া চোখের নীরব স্রোতস্বিনী থেকে
হঠাৎ উথলে ওঠা প্লাবনও নয়।
শোক একটি উৎসব,
তার ঘোষিত দিন থাকে
দুর্ঘটনার মতো ভারী হয়ে ওঠেনা বাঁ দিক অকস্মাৎ।
শোক একটি মাইক্রোফোনের নাম,
শোক একটি কবিতা উৎসব,
অদ্ভুত সুরেলা কন্ঠে, পাঞ্জাবি আর পাজামায়
শাড়ি আর মখমলের সামিয়ানায়
শোক আসলে একটি সংগঠিত অনুষ্ঠান।
একটি তোরনও প্রয়োজন থাকে শোক জ্ঞাপনে,
হাত জোড় করা কার্ট আউট হাসি হাসি মুখে
আহ্বান করে,
” আসুন, এখানে আনন্দ ও নির্লজ্জতার সাথে
শোক জ্ঞাপন করি।”
শোক কোনো আকস্মিক বাঁধ ভাঙা ঢেউ নয়
বরং সাজানো তোরন, আমানত আর জ্ঞাপনের জন্য
ভেবে নেওয়া রণ-কৌশল।
হেলেনের চশমা
পা ভাঙার গল্প শুনতে শুনতে
কোমর ভাঙার কাহিনিগুলো বাদ পড়ে যাচ্ছে;
শশী মণ্ডলের মেজো ছেলে
যে বাপের মতো কক্ষনো কোমরে থলে বেঁধে মাছ
ধরতে যায়নি কার্জন ক্রীকে,
বরং সোজা হ’য়ে দাঁড়িয়ে বীরেশ্বরপুর কলেজের
সামনে বলেছিল ‘আমি ফার্স্ট ক্লাস পেয়েছি’।
তার কোমর ভেঙে যাওয়ার গল্পটা ইদানিং চাপা
পড়ে গেছিল,
ভোটের মাত্র দু’দিন আগে হঠাৎ সে নিজেই বিক্রী
করে বসলো নিজের মাথা,
কেমন একটা বিস্ফারিত চোখে শশী মণ্ডল
বসে যাওয়া বামপন্থী নেতার কাছে জানতে চায়,
” আচ্ছা, কোমর ভাঙলে কি মাথা বিক্রী করে দিতে হয়?”
সা ম্রা জ্য বা দ
ঘুমে দু’চোখ বুজে আসছে,
ঠিক তখনই ঘরের মধ্যে ঢুকে এলো একটা ব্যাঙ,
তার পিছনে ঠিক মুসোলিনির মতো একটা সাপ
তাড়া করে আসছে,
আধো-ঘুমে মাথায় আসছে উপনিবেশ, সাম্রাজ্যবাদ
এই সব হিজিবিজি,
ভাবছি উঠে পড়া ভালো,
এই সুযোগে সেলফোনে তুলে রাখা যায় তৃতীয় বিশ্বযুদ্ধের একখানা ছবি,
ঠিক তখনই সাপ অনুসরণ করে ঢুকে এলো চকচকে এক ময়ূরী ;
অকস্মাৎ ফোন রেখে হাত খুঁজতে শুরু করল’ একটা খুনে বন্দুক,
সাম্রাজ্যবাদের গল্পটা বেমালুম ভুলে গিয়ে
একটা অস্ত্র কারখানার কত প্রয়োজন
সেই চিন্তায় বিভোর হয়ে উঠলাম।
কবিতা, শব্দ,অক্ষর আর সেই জেলে
‘ধুত্তোর’ এভাবেই বলছিল সে,
“বাঁধ ভাঙছে, ঝড়ের পূর্বাভাস যারা দেয়,
তারা জানেনা এই বন জঙ্গল আর নোনা জল
কখনো কখনো ঈশ্বরকেও তাচ্ছিল্ল করে,
ক’ঝুড়ি কবিতা ফেলে দে ওই ফাটলে”
অনেকের মতো সে হারিয়ে যায়নি,
কথামতো ফিরে এসেছিল মৃত্যুর দু’দিন পর,
আমি প্রতিপদের জোয়ার থেকে আজ অব্দি
কবিতা পুরতে পারিনি ঝুড়িতে।
ছাই খুঁড়ে এলোমেলো শব্দ ভরছি ব্যক্তিগত ঝুলিতে
পুড়ে গেলে শব্দেরা খাঁটি হয়,
সমস্ত কবিতা এসে অদৃশ্য হয় নাভির ভিতর,
বিচ্ছুরিত হয়ে উঠে পঙতি সকল।
কবিতা লেখার আগে বুঝে নিতে হয়
কীক’রে শব্দের কঠিন বোল্ডার ফেলে বোজাতে হয়
বাঁধের ফাটল,
যতিচিহ্নের বীজ বুনে জন্ম দিতে হয় ম্যানগ্রোভ,
শব্দের তীর ছুঁড়ে থামাতে হয় বয়ে যাওয়া অবিশ্বাসের নোনা জল,
কখনো কি এমন সনেট লিখেছি,
ডুবন্ত জেলে
যাতে চড়ে ভেসে আসে এই দ্বীপে?