ব ন্ধু সু ন্দ র পা ল-র গুচ্ছকবিতা
যেন আমি কেউ নই
এক
ঠিক জেনে যাব, তোমার বাড়ি থেকে বৃষ্টি কতদূর। আমাকে লোকাবে কোথায়! হীনমন্যতার গোপন কারখানায় যে কবির মন নিয়ে এতদিন তুমি ছিনিমিনি খেলেছ, তুমি কি ভাব, এই বৃষ্টি থেকে পার পেয়ে যাবে? তোমার বিনম্র অশ্রুর ধারে যাকে তুমি শীতলতা দিয়ে এতদিন ভুলিয়ে রেখেছ, মেঠো শরীরের আলপথে যার লিঙ্গাভিষেক করে ভাস্কর্য নির্মাণ করেছ, এই বৃষ্টি তাকে রক্তমাংসের মানুষ কোরে ছেড়ে দিয়েছে। অথচ, এখনও কী দাম্ভিক তোমার দুঃখ! দুঃখের সর্বনাম খুঁজতে খুঁজতে তোমার বাড়ির ঠিকানা চলে এল, হরপ্পা সভ্যতা জলের তলায় তলিয়ে গেল, তবু তোমার দুঃখ এই বৃষ্টিতে ভিজে নরম হল না! যেন মনে হয়, এ লেখার টেবিল, তোমারই শরীর। যতই বৃষ্টি হোক, কবি তার ঠিকানা জানে, কিন্তু নাগাল পায় না। তোমার সাজানো সংসার ভাঙে, কিন্তু কবির কলম ভাঙে না…
দুই
অনেক দিন না-লেখার দিনগুলোর মতো তোমাকে দেখতে, যেন কোনও অপরাধ, যাকে মাথা পেতে মেনে নিতে হবে। হয়তবা পড়েছে মনে, তুমি শাস্তিযোগ্য কি না, আমাকে যাচাই করার লক্ষ্যে! এতটাও ভালোবাসি না, জানো, যে তোমাকে পাহাড় মনে হবে! অথচ সেই তো লিখি, এমন লেখার দিনে তোমাকে তিলে তিলে দগ্ধে মারি। মরা-শব্দবন্ধের চোখে কাজল পড়িয়ে বলি, যেন নজর না লাগে, অথবা, অনুশোচনায় চোখে জল এলে যেন ধরা না পড়ে। ধরে-ফেলার মতো বড় অপরাধে যাকে তুমি কবি বলে শাস্তি দিলে, সেও কি চায়নি, এইসব লেখা ফেলে তোমার চিতার জন্য নিজে হাতে কাঠ কেটে এনে তোমাকে সাজিয়ে দিতে!
তিন
যতটা দিয়েছ তুমি, তার থেকেও বেশি কি ফেরত দিইনি তোমায়! তোমাকে শনিমন্দিরের ভিতরে ঢুকিয়ে বলিনি কি, আমার দুর্ভাগ্য জুড়ে শুধু তুমিই! দুঃশাসনের অবয়ব ফেলে যাকে তুমি গোপন করছ, এই শরীরী গোপনীয়তা আসলে তোমারই উলঙ্গ শব্দবিমুখতা, যা দিয়ে তোমাকে রচনা করেছি। তোমার খোলা চুলে ধুনোর গন্ধ ছড়িয়ে বলেছি, আমাকে এবার নিস্তার দাও! এই কবিতার শেষ লাইন থেকে আমাকে লাথি মেরে ফেলে দাও তোমার অন্ধকার সুড়ঙ্গে। সেখানে আমি ক্রুদ্ধ বাজপাখির মতো পাহারা দেব তোমার সোনায় মোড়া যোনীপথ। গণতন্ত্রের আদলে যে স্তন তুমি খুলে রেখেছ মৃতকবিদের সামনে, তারা যেন প্রতি শনিবার তোমার প্রসাদ পায়! এই লোভেই আমাকে তুমি কবিতা থেকে নির্বাসনে পাঠাও, আমাকে তোমার সকল দুর্ভাগ্য দাও…
চার
এমন ভাবে তোমাকে মনে করি, যেন আমি কেউ নই! অথচ মনের বদলে যাকে লিখে রাখতে চাই, সে-ও তুমি নও। এই দ্বন্দ্বের শেষ কোথায়! আমি সীমাহীনতার দারিদ্রপনায় তোমার খোঁপার ফুল ছিঁড়ে নিজেকে আহুতি দিয়েছি। বাথরুমের আয়নায় দাড়ি কামানোর ব্লেড ধরে নিজেকে বলেছি, এই শরীর সর্বস্ব কবিতায় তোমাকে জায়গা দেব না। অথচ সাবানের ফেনার মতো তুমি বাথরুমের চারদেয়ালে ঘোরো। তখন আমার বাথরুমকেই স্বর্গ মনে হয়। সেখানে আমিই জলের দেবতা, আর তুমি কবিতা হতে চেয়ে নর্দমার দিকে ভেসে যাও! এমন কবিতা-জীবন আমি চাইনি, জানো! যেখানে তোমার শরীর ভেঙে আমার শব্দরা পাতাল হয়ে যাক। আমি তো শুধু চেয়েছিলাম, মন নয়, তোমার দু’মুঠো পুরনো-চোখের-জল জমিয়ে এই গ্রীষ্মের দুপুরে পাড়ায় পাড়ায় ডুগডুগি বাজিয়ে জল-আইসক্রিম বিক্রি করতে যেতে…
পাঁচ
তারপরও বলি, ঐ দূরে যেও নাকো। ওখানে কোনও যুবক কবিতা লেখে না। তোমার শরীরকে বশ করতে আমার এই মুখবন্ধ সেফটিপিনের কাছে এসে দাঁড়াও, আমি তোমার খোলা পিঠে রচনা করি প্রাচীন প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপ। সেখানে অন্ধকার শব্দের নিমিত্তে এক ডাকুবুড়ি পাহারা দেয় তোমার কেটে ফেলা কোমর পর্যন্ত চুলের মাহাত্ম্যকে। আমি ভুলিনি, সেই রাজপ্রাসাদের একান্ন’টা বাঁজা রাণীর গোপন কবিতা প্রেমের কথা। তবুও তুমি বলবে, কবিতা দিয়ে কী হয়! প্রসবের বেদনা ভুলে যে প্রাসাদ তুমি একা পিঠে বহন করে চলেছ, তার ভিতরে বসে এখন হাজার হাজার যুবক শব্দ নিয়ে জুয়ো খেলে! নিজেরা নিজেদের খুনোখুনি করে, তোমাকে কবিতা পড়ে শোনানোর জন্য। ওরা জানে না– এই প্রেমের, এই কবিতার, এই প্রাসাদের ধ্বংসস্তূপের তুমিই একমাত্র উত্তরাধিকারী। আর, আমি তোমার খোলা পিঠের রক্তবাহক…