স্ব প্ন ক ম ল   স র কা র-র গুচ্ছকবিতা

পরিচিতিঃ ছোট পত্রিকায় স্বপ্নকমল সরকারের লেখালিখির হাতেখড়ি সত্তরের মাঝামাঝি। আটের দশকে ‘অনিকেত’, ‘অক্ষর’, ‘ম্যাজিক লণ্ঠন’ সহ বিভিন্ন পত্রপত্রিকার সম্পাদনা কর্মে যুক্ত ছিলেন। মাঝে দীর্ঘ বিরতির পরে শূন্য দশকের শুরুতে শান্তিনিকেতন থেকে উৎপলকুমার বসুর প্রত্যক্ষ সহায়তায় প্রকাশ করেন ‘আলোবাতাস’ পত্রিকা। ধারাবাহিক সাহিত্যচর্চায় কিছুটা নিস্পৃহতা থাকা সত্ত্বেও তিনি গত দশকে বিভিন্ন পত্রপত্রিকা ও সংবাদপত্রে লিখেছেন কিছু উল্লেখযোগ্য প্রবন্ধ-গল্প-কবিতা আর বইয়ের রিভিউ। তাঁর প্রথম কাব্যগ্রন্থ ‘বেঁচে আছি’ ১৯৮০ সালে প্রকাশিত হয়। অন্যান্য কবিতার বই: ‘বাতাসে পুরুষ হরিণ’ (১৯৮৭), ‘নির্বাচিত কবিতা'(২০১৯), ‘ভার্চুয়াল মেঘ’ ও প্রবন্ধ সংকলন ‘অর্কপ্রভ বিদ্যাসাগর’ বইদুটি প্রকাশিত হয় ২০২০ সালে। ২০২১ সালের ডিসেম্বরে প্রকাশ পেয়েছে গল্পগ্রন্থ ‘আলোছায়ার গল্প’। বর্তমানে লেখালিখি, বইপড়া, ও ‘আলোবাতাস’-এর আগামী সংখ্যার প্রুফ সংশোধনে ব্যস্ত। তরুণ কবি লেখক ও সম্পাদকদের উৎসাহে অফুরন্ত বারুদ জোগান তিনি। দেশ-বিদেশ ঘুরে বেড়াতে, ছবি তুলতে, সবার রঙে মিলেমিশে নানান কর্মকাণ্ডে জড়াতে স্বপ্নকমলের জুড়ি মেলা ভার। বাইফোকালিজম্-র পাতায় তাঁর গুচ্ছকবিতা।

 

 

স্ব প্ন ক ম ল   স র কা র-র গুচ্ছকবিতা

কথামৃত

 

কথারা রাতজাগা তারা,
জোছনায় ভিজে ওঠা মাটি
সুর খোঁজে আনমনে,
ছায়াপথে বিছোয় শীতলপাটি
ঘন হয়ে বসে, ভালোবেসে বলে,
এখানেই বাঁচুক তবে স্বপ্নেরা?

আকাশে আরও যারা ছিল,
সেইসব হিংসুক মেঘেরা
তড়িঘড়ি উড়ে আসে
জুড়ে বসে তারাদের মনে, তারপর
মেঘে মেঘে ঢেকে দেয় কথার বাসরঘর,
দর্পণে বসায় প্রহরা।

আলো ফোটে, মনমরা কথারা
একে একে নিভে যায়,
আধফোটা ভোরের আলোয়
চেয়ে দেখে তারা
খেলাসাথী সংসার পেতেছে
সেইসব হিংসুটে মেঘেরা…

 

মরণ
চিত্রঃ ২

যখনি বলেছি তাকে, থাকো তুমি দূরে দূরে সরে
অমনি সে এসে দাঁড়িয়েছে শিয়রে, কত যেন চেনা!

‘বলোনি তো এত তাড়াতাড়ি এসে যাবে
বৃষ্টি-বজ্রপাত মেঘে অকালে হঠাৎ চমকাবে?’

প্রান্তরের কুয়াশা সরিয়ে সে আরো কাছে আসে
চোখে চোখ রেখে বলে, ‘হাত ধরো,
এখানে আঁধার বড়,
সময় হয়েছে, চলো নিয়ে যাই আলোর সকাশে…’

বলি, ‘এই আলোআঁধারি একান্ত আমারই,
মুঠো মুঠো জোনাকির আলো
রোজ জ্বালি আমি কালো সে প্রান্তরে
আলো মাখি,ভরে রাখি সব দান সোনার কৌটোয়…
সময় এখনও যে বাকি,রয়ে গেল নাকি
অপূর্ণ অধরা মন,
কীকরে যে যাই এখন?
যদি চাও,পড়াই ভালোবাসার নতুন পাঠক্রম’…

সে বোঝেনি আমাকে, জানে না প্রেম বলে কাকে,
তবু ডাকে,শ্মশানে পড়ে থাকে স্বপ্নের একমুঠো ছাই…

 

জলছবি

 

তরঙ্গ ছড়ালে জলে ক্রমে বৃত্তগুলি বড় হয়
বড় হতে হতে তারপর
কখন যে জলেই মিলিয়ে যায়।
সেই দৃশ্য স্মৃতির অ্যালবামে
জলছবি হয়ে থেকে যায় একাকী জীবনে তার।
জারুলের ছায়ায় বসে কখনও সে
ঝুঁকে থাকে জলের আকাশে।

মেঘ তার নিজের অভ্যাসে
একে একে ভাঙে
স্মৃতির মিনার গড়ে
আঁকে তার প্রিয় মুখ জলের ক্যানভাসে…

কচুরিপানার নিচে একা জলপোকা মিছিমিছি
জলজ সংসার পাতে, অশ্রু মিশে গেলে জলে
মরামাছ ভেসে ওঠে কবিতার লবণাক্ত অক্ষরে…

 

মানুষ

সমুদ্রের কিনারায় আর আকাশের নিচে অথবা
পাহাড়ের পায়ের তলায় মানুষকে বিন্দু দেখায়,
যে নদীতে নিজেকে ভাসায়,
ইচ্ছের পাল তুলে দেয়
পরমা সে নদীকেই তবু মানুষের বাঁধা চাই,
ভুল জলাধারে।

ক্ষার জমে, ক্রমে পলি পড়ে অধিকারে তার
মন মানে সে জানে শুধু নিজেকেই।
মানুষ হয়েই থেকে যায়, নদী খাত পাল্টায় তবু
দুঃখ পেলে হৃদয়ে বরফ জমে, কুয়াশা জড়ায়
ঢেউ ফিরে পেলে সে তন্বী, মুহূর্তে স্রোতস্বিনী…

 

তোমাকে

 

কিছু জানোই না তবে, অজানা সব কিছু?
মেঘেরা স্বপ্ন হয়ে কখনও ঝরেনি আকাশে?
বোঝো না কি তোমার শিরায় শিরায়
কেন দীপক সংরাগে বাজে রুদ্রবীণা!
দহনের সুখে সুর মিশে যায়, অবেলায়
চৈত্রদিনে উষ্ণ হাওয়ায়,আগুন ইথারে।

মিছে ভয় ডুবজলে? সাঁতার শেখোনি?
না হয় ডুবেই মরি, বাঁচি একসাথে।
আমায় জড়িয়ে ধরো, ভাবো খড়কুটো…

 

সাগরিকা

তোমাকে ভাবি যেই, ফিরে যায় ঢেউ
যদি চাই শুধুই তোমায় তখনই অন্য কেউ
এসে দাঁড়ায়, পথ আটকায়,পাথুরে সে পথে
আমি তবু ফুলই ছড়াই, যাই না দ্বৈরথে!

মনের ভিতরে থাকে যে গোপন, সে যখন
ডাকে সমুদ্র-বাতাসে, যেও তুমি, ধরা দিও
মায়াবন্দরের দেখা চেয়ে মন বাতিঘর হলে
সে বিরহ আলোয় দিনান্তে ভেলাটি ভাসিও
ঢেউ দেব, ভাসবো আমিও সেই লবণাক্ত জলে…

 

এই প্রেম

 

চুমু ক্ষণস্থায়ী হবে ভেবে তার
স্বপ্নের সব রং শুষে নিয়ে
নিভৃতে শব্দ সাজাই ঠোঁটে

চকিতে চুম্বনের অস্ফুট ধ্বনি শোনা গেলে
ফাঁকা রাসমঞ্চে কখন যে বেজে ওঠে
করতাল, মৃদঙ্গ, আপনি বাজে বীণ
দেবী তার বেদী ছেড়ে হন হৃদয়াসীন।

অর্বাচীন আমি তার অমৃত কলস তুচ্ছ করি
মেলে ধরি আলজিভ, উদ্যত ফণা
মধুবনে আজ তবু কিছুতেই শঙ্খ লাগেনা
অমৃতে পূর্ণপ্রাণ আরবার ফিরেও আসে না
ভালোবাসা চেয়ে নিতে নিতে দেখি
কেবলি তা চুম্বন বাসনা…

 

চৈত্রের এলিজি

 

দাউদাউ হোমানলে শব্দের কবোষ্ণ ওম
নিহিত উত্তাপ নিতে জানে, জানে পূর্বরাগ।
অরণি অগ্নি নিভে এলে বীত সংরাগে
কাচের শরীর ভেঙে আমিও বাতাসে
ওড়াই মুঠো মুঠো বিরহ পরাগ…

আমাকে কোথাও আর খুঁজে পাবে না
টেনে নেবে কেউ একদিন তোমাকেও বুকে
এইসব চোরাটান, অরণ্যের নিভৃত বিতান,
পুরাতনী গান, দান প্রতিদান সব একদিন
স্মৃতি হবে জেনো, ভেসে যাবে উল্টোস্রোতে।

অনুভাবে আকিঞ্চন স্বভাবে তাই আজ
লিখে রাখি হাহাকার, চৈত্রের এলিজি।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *