সন্দীপ দত্ত
দূরে চলে যেতে হবে কানুকে। অনেক দূরে। দামোদরের ঘোলাটে দৃষ্টিজালের বাইরে গিয়ে যদি পারে তো বাঁচবে, মরলেও কোনো আক্ষেপ নেই। অমন ছেলের বাঁচা মরা সমান। এতদিন দামোদর কানুর শৈশবটার জন্য রেয়াত করেছিল। আজ সেটাও করল না। কানাভাঙা সানকিতে গরম ভাতের গন্ধটা ছেলে নিয়েছে কি নেয়নি, পেছন থেকে এসে সজোরে একখান লাথি মারল দামোদর। ” ওঠ, ওঠ শালা। আর কত খাবি রে তুই? খেতে পাস বলেই বেঁচে আছিস। খাওয়াটাই বন্ধ করে দেব তোর। শালা কুত্তা কোথাকার ! এক কণা অন্ন ছুঁবি না আমার। ভালয় ভালয় ভেগে যা, নইলে লাঠি দিয়ে তাড়াব। মাগিটাও তেমনি। বিয়লো যেন একেবারে অষ্ট গভ্ভের কেষ্ট ! শত্তুর নাশ করবে আমার। শালা তুই নিজেই তো একটা শত্তুর ! “
সানকির ওপর হুমড়ি খেয়ে পড়ল কানু। থ্যাবড়ান নাকের ফুটো দুটো বেশ বড়ো তার। চোখগুলো ভেতরে বসা। চৌকো মুখের এখান সেখানে লেপ্টে যাওয়া থ্যাতলানো ভাতের টুকরোগুলোকে সরাতে চেষ্টা করল সে। দশে মাসে একবার চিরুনি দেওয়া রুক্ষ শুষ্ক চুলগুলোয় মাড়ের ছিঁটে লেগে গিয়েছিল। গরম ভাতের দিকে তখনও তার চোখ। স্বপনে কতবার যে সে গরম ভাত দেখে ! তবে সেখানে কানা ভাঙা সানকিটা থাকে না, থাকে ফুলঅলা কোনো স্টিলের থালা। বাবার থালাার মতো দেখতে কিছুটা। পুকুরঘাটে দুপুরবেলা বামুনঘরের বউঝিরা এটোঁ বাসনের ডাঁই নিয়ে আসে যখন,অমন সোনার বরণ লাগা নকশা আঁকা থালাও মনে হয় যেন। মনে হয়,থালার ধারে পুঁইশাকের তরকারিটা আর একবার এসে টুক করে দিয়ে গেল মা। বাবা নিজের পাত থেকে ছোট মোরলা একটা তুলে দিল স্নেহভরে।
কানু একবার চাইল বাবার দিকে। গরম ভাত কটা খাওয়ার পরই না হয়__। আজ অনেকদিন পর উনোন জ্বলেছে উঠোনে। কড়ে হিসেব করতে জানলে কানু বুঝত, দিন কুড়ি পর হাঁড়িতে ফুটল ভাত।
চলে যেতে হবে কানুকে। অনেক দূরে। কিন্তু কোথায় যাবে সে? তার যাওয়া মানে তো পা টানতে টানতে যাওয়া। বড়ো তালের মতো মাথাটাতে তাও যদি একটু বুদ্ধি থাকত !
তারপর পাছায় বাবার লাথির ব্যাদনা নিয়ে সেই যে কোথায় চলে গেল কানু,আর ফিরল না। খোঁজ নিল না দামোদর।
চূড়ামণির অষ্ট গভ্ভই বটে ! ফুটোফাটা সংসারে মেয়ের কদর দেয়নি দামোদর। তাই বিয়নোর পর তিন তিনটে মেয়েকে রাতের আঁধারে অনেক দূরে কোথাও ফেলে দিয়ে এসেছে। তারপর হল চারটে ছেলে। কিন্তু ওপরঅলার বিচারে একটিও বাঁচল না। বাঁচল ওই কানু। মাস কয় যাওয়ার পর গাঁয়ের ষষ্ঠীতলায় ধূপ সিঁদুর দিয়ে এল দামোদর। মুঠোর ঘামে প্রায় জল হয়ে আসা গোটা চারেক বাতাসা। চূড়ামণি বাঁধল মানতের ডুরি। পুরুত তখনও চুল না হওয়া কানুর নেড়া মাথাটায় প্রসাদী ফুল ছুঁইয়ে বলেছিল,” আর কোনো ভয় নেই দামোদর। তোমার বিপদ কেটে গেছে। মা ষষ্ঠীর কিপায় এ ছেলে তোমাদের সুখ আনবে। “
চোখ বন্ধ করে কথাগুলো সেদিন বিশ্বাস করেছিল দামোদর। কিন্তু বছর তিন পরেই সেই বিশ্বাসটা একটু একটু করে বিবর্ণ হতে শুরু করে। দাঁড়াল কানু ঠিকই তবে পা দুটো না টেনে হাঁটতে পারল না। সেই থেকে ছেলে হল দামোদরের চক্ষূশূল। শত্তুর। শত্তুরের আবার কেউ খোঁজ নেয় নাকি? তাই চূড়ামণির সমস্ত অনুনয়ের কাছে পাষান রইল দামোদর।
কানু যে কোথায় গিয়ে পৌছল, সে নিজেও জানে না। পা টেনে উদ্দেশ্যহীনভাবে হাঁটতে হাঁটতে সে গিয়ে দাঁড়াল নকুল আড়তদারের আঙিনায়। নকুল ভিন গাঁয়ের মানুষ। যে গাঁয়ে কান পাতলে রেলের বাঁশি শোনা যায়। অহরহ বাসের পোঁ। নকুলের ঘরে এখন হাতে তৈরি কাগজের ঠোঙার মিনি ফ্যাক্টরি। দু দুজন নিচু জাতের মেয়ে সেখানে কাজ করে। ন বছরের কানুকে নিয়ে হল তিন। উৎপাদন বাড়াতেই চেয়েছিল নকুল। উৎপাদন বাড়লে মুনাফার পোয়াবারো। তাছাড়া কানুর পা দুটো অচল, হাতদুটো তো অচল নয়। বাতাসে ভাসছে সদরের ত্রিলোচন নাকি তার থার্মোকলের ব্যবসা লাটে তুলে শালপাতা আর কাগজের বাজার ধরতে চাইছে। নকুলের ফড়ে কার্তিকও বলছিল পলিথিন বন্ধ হওয়ার ফলে দোকানে দোকানে কাগজের ঠোঙার চাহিদা বাড়ছে খুব। এখন যে বাজার ধরবে, দিন তারই। বাজার ধরতে তাই কানুকে কাজ শেখানো হল। শেখানোর পর দেখা গেল, কানুর হাতে যেন ঘোড়ার গতি। ফুলেফেঁপে উঠল নকুল।
এটাই চেয়েছিল কার্তিক। নকুলের ব্যবসা বাড়লে নিজের একটা হিল্লে হয়। একটা বাড়তি উপার্জন। নকুলের মিনি ফ্যাক্টরি থেকে সে খুলবে আরও মিনি ফ্যাক্টরি। নকুলের থেকে নেওয়া কাগজের ঠোঙাগুলো নিজের কাছে গচ্ছিত করে সে লোক খাটাবার কথা ভাবে। এখন একটা লোক চাই। একটা থেকে দুটো হবে তারপর। এ গাঁ থেকে ভিন গাঁ, ভিন গাঁ থেকে মফস্বল, কার্তিকের লোক দোকানে দোকানে দিয়ে বেড়াবে কাগজের ঠোঙা। রাজা হয়ে যাবে কার্তিক।
দামোদরের সাথে হঠাৎ করেই একদিন আলাপ হয়ে গেল কার্তিকের। সেইদিনেই হল, যেদিন ননী মুদি তার দোকানের জন্য ভাল মানের কাগজের ঠোঙার খোঁজ করছে। এতদিন যে তাকে ঠোঙা দিত, তার আঠা ঠুনকো। জিনিস ভরতে গেলেই ছিঁড়ে পড়ে যায়। কার্তিকের কাছ থেকে সুযোগটা নিতে চায় দামোদর। বুড়ো হাড়ে এমনিতেই সে আর মুনিশ খাটতে পারেনা এখন। বুঝে নেয় এসব ত্রিলোচনের কারসাজি। মানুষ ঠকানোর ব্যবসা লোকটা প্রথম থেকেই করত।
দামোদর তৈরি হয়। বিড়ি ফুঁকতে ফুঁকতে কোমর বাঁধে। এবার শত্তুরের মুখে ছাই দেবে সে।
——————-