যে জন থাকে প্রানের মাঝে

পরিচিতিঃ সনৎকুমার বটব্যাল ও হরিপদ কেরানী ছদ্মনামে ২০১৫ সাল থেকে সম্পাদনা করে চলেছেন একটি মননশীল  সাহিত্য পত্রিকা ‘পৃথ্বী’। থাকেন তমলুকে। জন্মসুত্রে পুর্বমেদিনীপুরের মানুষ। বর্তমানে অবসরপ্রাপ্ত শিক্ষক। হরিপদ কেরানী ছদ্মনামে দীর্ঘকাল লেখালিখি করে আসছেন। ২১/১১ তেঘরিয়া, নন্দনকানন, কলিকাতা-৭০০১৫৭। বাইফোকালিজম্-এ আজ একটু অন্য স্বাদের লেখা।

স ন ৎ কু মা র  ব ট ব্যা ল-র জীবনীচর্চায়

যে জন থাকে প্রানের মাঝে

আজ বরং বাংলা সাহিত্যের একজন দিকপাল লেখকের কথা বলি। একদিকে তিনি একজন বিখ্যাত ডাক্তার, আবার উল্টোদিকে একজন
নামকরা বাঙালি সাহিত্যিক।তাঁর লেখা গল্প, উপন্যাস, নাটক বাঙালি পাঠক গোগ্রাসে গেলে ।তিনি আমাদের হৃদয়ের প্রিয় প্রনম্য লেখক-

ডাঃ নীহাররঞ্জন গুপ্ত

ভূমি স্পর্শ– ৬ই জুন,১৯১১সাল
অবিভক্ত বাংলার যশোর
ব্রিটিশ ভারত।

অমৃতলোকে যাত্রা-২০শে ফেব্রুয়ারী,১৯৮৬ কলকাতা
ভারত।

বাবা- সত্যরঞ্জন গুপ্ত
মা- লবঙ্গলতা গুপ্ত

তিনি ছিলেন একজন বাঙালী ডাক্তার ও লেখক। তিনি ছিলেন জনপ্রিয় রহস্য কাহিনীকার । তিনি বিখ্যাত গোয়েন্দা চরিত্র কিরীটী রায়ের স্রষ্টা হিসেবে উপমহাদেশে স্মরণীয় হয়ে আছেন। তিনি তৎকালীন যশোরের (বর্তমান নড়াইল জেলার) লোহাগড়া উপজেলার ইটনায় জন্মগ্রহণ করেন। তাঁর পরিবার ছিল বিখ্যাত কবিরাজ বংশীয়। তিনি শৈশবকাল অতিবাহিত করেন কলকাতায়।
বাবার স্থানান্তরিত চাকুরীর কারণে তিনি অনেক বিদ্যালয়ে পড়াশোনা করেন। তার মধ্যে গাইবান্দা উচ্চ বিদ্যালয় অন্যতম। ১৯৩০ সালে কোন্নগর উচ্চ বিদ্যালয় থেকে ম্যাট্রিকুলেশন পাস করেন। কৃষ্ণনগর সরকারি কলেজ থেকে আই.এসসি ডিগ্রী অর্জনের পর তিনি কলকাতায় কারমাইকেল মেডিকেল কলেজ (তৎকালীন কারমাইকেল স্কুল) থেকে ডাক্তারি বিদ্যায় কৃতকার্য হন। এরপর তিনি লন্ডন থেকে চর্মরোগ বিষয়ে স্নাতকোত্তর ডিগ্রী লাভ করেন। ছাত্রাবস্থায় তাঁর বড় বোন পোকার কামড়ে মারা যায়। ফলে চিকিৎসা বিজ্ঞানের মহান পেশায় নিয়োজিত থেকে এই রোগ সারানোর জন্য স্বপ্ন দেখেন ও পরবর্তী জীবনে বাস্তবায়িত হয়।

দ্বিতীয় মহাযুদ্ধ চলাকালীন সময়ে ভারতীয় সেনাবাহিনীতে যোগ দেন ও বিশ্বের বিভিন্ন জায়গায় স্থানান্তরিত হন। এরপর তিনি মেজর পদে উন্নীত হন। এই চাকুরীর সূত্রে তিনি চট্টগ্রাম, বার্মা (মায়ানমার) থেকে মিশর পর্যন্ত বিভিন্ন রণাঙ্গনে ঘুরে বহু বিচিত্র অভিজ্ঞতা সঞ্চয় করেন। যুক্তরাজ্য থেকে বিশেষ ডিগ্রী অর্জন শেষে তিনি কলকাতা মেডিক্যাল কলেজে যোগ দেন। এরপর তিনি ভারতের বিভিন্ন হাসপাতালে কাজ করেছেন। ভারত ভাগের পর ১৯৪৭ সালে তিনি ও তাঁর পরিবার স্থায়ীভাবে কলকাতায় বসবাস করেন।

নীহাররঞ্জনের স্ত্রী কনক এবং চার মেয়ে ছিল। তাঁর বাড়ির নাম ছিল উল্কা।

তাঁরই এক কাহিনীর নামে। রবিবার ছাড়া বাকি দিনগুলো তিনি শ্যামবাজার স্ট্রিটের (পরে ধর্মতলা স্ট্রিটে) চিকিৎসকের চেম্বারে বসতেন। লেখালেখি, পূজা, পোষা প্রাণীর যত্ন নেওয়া আর বন্ধুবান্ধবের সঙ্গে গল্পগুজব নিয়ে ব্যস্ত থাকতেন। লেখালেখি করতেন দুপুরবেলা। তিনি প্রচুর সিগারেট খেতেন। প্রকাশক সবিতেন্দ্রনাথ বলেন তিনি রোজ এক টিন ‘‌পিকাডেলি’‌ সিগারেট খেতেন। পরে ‘‌পিকাডেলি’‌র চালান বন্ধ হতে ‘‌গোল্ডফ্লেক’‌ খেতেন। তবে হার্টের গোলযোগের কারণে ডাক্তার ধূমপান নিষেধ করায় একদিনেই সিগারেট খাওয়া ছেড়ে দেন। পরবর্তীতে পান খাওয়া অভ্যাস করেন। ব্যক্তিগতভাবে কোনারকের সূর্যমন্দির, পুরী আর বারাণসী পছন্দের গন্তব্য ছিল তাঁর।

বাংলাদেশের জন্মস্থানের প্রতি তীব্র নাড়ির টান ছিল। বাড়ির নাম ছিল ‘‌আনন্দ অন্নদা কুটির’‌। তিনটি ভবন রয়েছে সেখানে, যার মাঝেরটি দোতলা। নীচতলার বারান্দার ভিতরের কপাটহীন দরজার উপরে দেওয়ালে বাড়ির নাম লেখা ছিল। বাড়িটি বর্তমানে বাংলাদেশ সরকারের সম্পত্তি। নীহাররঞ্জনের আত্মীয় কেউ সেখানে থাকেন না। তিনি বাংলাদেশের স্বাধীনতা যুদ্ধের খোঁজ-খবর নিয়মিত রাখতেন। বাংলাদেশের জাতির পিতা শেখ মুজিবুর রহমানের আদর্শের প্রতি অনুরক্ত ছিলেন তিনি। ১৯৭৫ সালের পরে বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী শেখ হাসিনা নীহাররঞ্জনের সাথে একবার দেখা করেন। শৈশবকাল থেকেই তিনি সর্বদাই স্বপ্ন দেখতেন লেখক হবার। কলকাতায় গেলে পরে বইপাড়ায় আশুতোষ লাইব্রেরি নামক ছোটদের বইয়ের একটি গ্রন্থাগারের শিশুসাথী নামে একটি পত্রিকা ছিল। আইএসসি পড়াকালীন নীহাররঞ্জন সেখানে একটি গল্প পাঠালেন যা মনোনীত ও পরে ছাপা হয়। ছাপা পত্রিকার সংখ্যা তাঁকে পাঠিয়ে সম্পাদক আরও লেখা চাইলেন ও একদিন দেখা করতে বলেন। দেখা করার পরে সম্পাদক তাঁকে পাঁচ টাকা সম্মানী দেন। এরপরে সেখানেই তিনি তাঁর রাজকুমার শীর্ষক ধারাবাহিক উপন্যাস লেখেন। এটাই তাঁর লেখা প্রথম উপন্যাস। তখন তাঁর বয়স ১৮। তাঁর মা তাঁকে সর্বদা লেখালেখির জন্য উৎসাহিত করতেন। কলকাতায় আসার আগে তাঁকে বলেন, “খোকা, ডাক্তারি পড়তে যাচ্ছিস যা, তবে লেখা ছাড়িস না, লেখার অভ্যাস ছাড়বি না।”

একসময় তিনি শান্তিনিকেতনে গিয়ে রবীন্দ্রনাথ ঠাকুরের আশীর্বাদ নেন ও তাঁর স্বাক্ষর বা অটোগ্রাফ সংগ্রহ করেন। শান্তি নিকেতনে থাকার সময়ে তিনি গোয়েন্দা গল্প রচনায় আগ্রহী হয়ে লেখার উত্তরণ ঘটান। আগাথা ক্রিস্টির সাথে সাক্ষাৎ করেন। ভারতে ফিরে এসে তিনি তাঁর প্রথম গোয়েন্দা উপন্যাস কালোভ্রমর রচনা করেন। এতে তিনি গোয়েন্দা চরিত্র হিসেবে কিরীটী রায়কে সংযোজন করেন যা বাংলা গোয়েন্দা সাহিত্যে এক অনবদ্য সৃষ্টি। পরবর্তীতে কিরীটী তীব্র জনপ্রিয়তা পায় বাঙালী পাঠকমহলে। তিনি বাংলা সাহিত্যে রহস্য কাহিনী রচনার ক্ষেত্রে অপ্রতিদ্বন্দ্বী লেখক ছিলেন।

উপমহাদেশীয় প্রেক্ষাপট ও উপযোগী করে রচিত হয়েছে তাঁর রহস্য উপন্যাসগুলো। বার্মা বা অধুনা মায়ানমার দেশের কথা বার বার ঘুরে ফিরে এসেছে তাঁর রচনায়। এ পর্যন্ত প্রায় পঁয়তাল্লিশটি উপন্যাসকে বাংলা ও হিন্দি ভাষায় চলচ্চিত্রায়ণ করা হয়েছে যথাক্রমে টলিউড ও বলিউডের চলচ্চিত্রাঙ্গনে। এছাড়াও তিনি শিশুদের উপযোগী সাহিত্য পত্রিকা সবুজ সাহিত্যের সম্পাদকের দায়িত্ব পালন করেন। খ্যাতনামা অভিনেতা উত্তম কুমার নীহাররঞ্জন গুপ্তের কাছে কিরীটী রায়ের ওপর ভিত্তি করে চলচ্চিত্র তৈরির প্রস্তাব নিয়ে গিয়েছিলেন। তবে নীহাররঞ্জন রাজি হননি, কারণ উত্তমকে কিরীটীর চরিত্রে মানাবে না বলে তিনি মনে করেছিলেন। তিনি অজিতেশ বন্দ্যোপাধ্যায়কে কিরীটী চরিত্রের জন্য মনে মনে ভাবতেন।

বড়দের ও ছোটদের উপযোগী – উভয় ধরনের গোয়েন্দা উপন্যাস রচনায় সবিশেষ পারঙ্গমতা প্রদর্শন করেছেন নীহাররঞ্জন। মোট দুই শতাধিক গ্রন্থ তিনি রচনা করে গেছেন। উল্লেখযোগ্য রচনাগুলো হলো –

# কালোভ্রমর
# মৃত্যুবাণ
# কালনাগ
# উল্কা
# উত্তরফাল্গুনী
# হাসপাতাল
# কলঙ্কিনী কঙ্কাবতী
# লালুভুলু
# রাতের রজনীগন্ধা
# কিরীটী অমনিবাস
# অপারেশন

১৯৮৮ সালে বাংলাদেশের বিখ্যাত চিত্রকর এস এম সুলতান ইটনায় অবস্থিত নীহাররঞ্জন গুপ্তের বাসভবনে শিশুস্বর্গ-২ প্রতিষ্ঠা করেন। ২৪শে নভেম্বর, ১৯৯৩ সালে নড়াইলের তৎকালীন জেলা ম্যাজিস্ট্রেট মোহাম্মদ আলী হোসেন এর আনুষ্ঠানিক উদ্বোধন করেন। পরবর্তীতে এস এম সুলতানের মৃত্যুর পর শিশু সংগঠনের কর্মীরা তা দখল করে। ২০০৩ সালে প্রত্নতত্ত্ব বিভাগ নীহাররঞ্জন গুপ্তের বাসভবন অধিগ্রহণ ও সংরক্ষণের জন্য উদ্যোগী হয়। কিন্তু, আজ পর্যন্ত এ বিষয়ে কোন পদক্ষেপ গ্রহণ করা হয়নি। পূর্ববাংলায় ফেলে আসা পৈতৃক ভিটে নিয়ে অসম্ভব টান ছিল লেখকের । সত্তর একরের মত জায়গার ওপর ছিল তাদের দোতলা বাড়ি, পুকুর, বাগান। প্রবেশপথ দুটি। তিরিশের দশকে সেই বাড়ি ছেড়ে এ পার বাংলায় চলে আসেন তারা। তখন তাঁর বয়স মোটে চোদ্দো-পনেরো।কোন্নগর, কৃষ্ণনগরে কিছু কাল পড়াশোনার পর ভর্তি হয়ে যান কারমাইকেলে। এখন যার পরিচয়, আর জি কর মেডিক্যাল কলেজ। তার পর তো নানা খাতে বয়েছে তাঁর জীবন, কিন্তু ভিটের টান তাঁর কোনও দিনই ফিকে হয়নি। তখন বাংলাদেশে মুক্তিযুদ্ধ। প্রায় প্রতি দিন খবর শুনছেন মন দিয়ে। যুদ্ধ শুরু হলে রোজ সাহিত্যিক বন্ধুবান্ধব, সাংবাদিকদের কাছে খবর নিচ্ছেন, কত দূর সফল হলেন মুক্তিযোদ্ধারা।

আদর্শ হয়ে ওঠেন শেখ মুজিবর রহমান। তাঁর ‘লালুভুলু’ উপন্যাসের কাহিনী নিয়ে ছবি হল। পরিচালনায় অগ্রদূত। সেই ছবি দুই বাংলাতেই বেশ জনপ্রিয় হয়। এর অনেক পরে উপন্যাসটিকে সম্মান জানাতে ঢাকা থেকে সপরিবার নিমন্ত্রণ আসে তাঁর কাছে। সপরিবারে গেলেন বাংলাদেশ। এর কিছু কাল আগে মারা গিয়েছেন মুজিবর। বাংলাদেশে যেখানেই যাচ্ছেন, মুজিবরের স্মৃতি হাতড়াচ্ছেন।

একদিন বাংলাদেশের প্রধানমন্ত্রী মুজিবকন্যা শেখ হাসিনা তাঁর কাছে এলেন, পায়ে হাত দিয়ে প্রণাম করলেন। কথায় কথায় হাসিনা গভীর শোকের সঙ্গে দেখালেন, ঠিক কোথায় বঙ্গবন্ধুকে গুলি করা হয়। হাসিনার মুখে তাঁর পিতৃহত্যার নৃশংস কাহিনী শুনতে শুনতে তাঁর দু’চোখের কোণ চিকচিক করে উঠছে বাধ-না-মানা জলে। বিড়বিড় করে আওড়াতে শুনলাম, ‘‘জয় বাংলা।’’আদ্যন্ত বাঙালী এই মানুষটিই সাহিত্যিক নীহাররঞ্জন গুপ্ত। লোকে যাঁকে শুধুই কিরীটী-জনক বলে চেনে! আজ এই কিংবদন্তি ডাক্তার ও লেখকের শুভ জন্মদিন ।আসুন সবাই মিলে আন্তরিক শ্রদ্ধা ও আভূমি প্রনাম জানাই । বাঙালি পাঠকদের মনের মণিকোঠায় তোমার স্থান চির অক্ষয় হয়ে থাকবে।

তথ্যসুত্রঃ হিমাদ্রি বর্মন

সৌজন্যে– উইকিপিডিয়া

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *