ভিজিটিং আওয়ার
স র্বা ণী রি ঙ্কু গোস্বামী
প্রতিদিন ভিজিটিং আওয়ারে আসি, অত্রির কেবিনে ঢুকে ওর বেডের পাশে টুলে বসি তারপর অত্রির বুকের ওঠানামা লক্ষ্য করি। আমাকে দেখে ওর পুরুষ নার্সটি বাইরে চলে যায় কখনো আমি থাকতে মাঝে একবার আসে তখন বিড়ির গন্ধ পাই। চেক করে ওর অক্সিজেন চালু আছে কিনা , ওর ক্যাথিটারের থলিতে জমা বর্জ্য তারপর আমার দিকে মাথা নেড়ে চলে যায়। আমি চুপচাপ বসে অত্রির শিরায় ঢোকানো নলে টুপটুপ রক্ত পড়া দেখি আর অসম্ভব একটা আশা করি , অত্রি হঠাৎ চোখ খুলে বলবে , “কি রে … কতক্ষণ?”
প্রথমদিকটা অনেকেই আসতো, ওর অফিসের নাটকের দলের ওর আত্মীয়স্বজন। আজকাল কমতে কমতে খালি আমি, তবু অভ্যেসবশতঃ একবার রিসেপশনে রোজ জিজ্ঞেস করি, “একশো কুড়িতে অত্রি চ্যাটার্জির কোনো ভিজিটর?” ওরা না তাকিয়েই মাথা নাড়ে আজকাল। আমার গলাটা ওদের চেনা হয়ে গেছে, রাতে অত্রিদের বারান্দার সামনে বাইকটা থামাই, মাসিমার সাদা থান দূর থেকেই নজরে আসে। গ্রীল গলিয়ে টুকটাক বাজার দিই , শিরাওঠা লজ্জিত হাতে মাসিমা নেন আর বিড়বিড় করেন, “কেন রে রোজরোজ !” আমি শুনতে না পাওয়ার ভান করে বলি, ” চিঁড়ে আছে তো তোমার , দুধ? কিছু লাগলে বোলো। পল্টু ঠিক আছে আজ।”
ঠিক মানে যে বেঁচে আছে এখনো তা মাসিমাও জানে , আমিও। পল্টু মানে অত্রি এই নামে ডাকার মত মাসিমা ছাড়া ওর আর কেউ নেই বোধহয়, মানে থাকলেও তারা ডাকে না। আমিও অত্রি বলি সাধারণত কিন্তু কেন যেন মনে হয় পল্টু বললে মাসিমা একটু শান্তি পাবে। স্কুলে পড়তে এই নিয়ে অত্রির সঙ্গে বহুবার মারপিট হয়েছে, ও খুব অপছন্দ করতো ডাকনামটা। বিশেষ করে যখন আমাদের সদ্য গোঁফ গজাচ্ছে, গার্লস স্কুলের সামনে দিয়ে যাওয়ার সময় ইচ্ছে করে ডাকতাম, “অ্যাই পল্টুউউউ!” ও মাথা ঘুরিয়ে তাকাবার আগেই আমি দৌড়। কতবার মারামারি করে ধুলো মেখে কনুই ছড়ে ইস্কুল পৌঁছে আবার হেডস্যারের ঘরের সামনে দুজনে নীল ডাউন হয়ে থেকেছি।
কে জানে কেন, আমার ডাকনাম কিন্তু অত্রি কখনো ডাকতো না, ডাকলে সত্যিই কি লজ্জাতে যে পড়তাম । আমার ডাকনাম ছিল ,লেবু …বড় জ্যাঠার দেওয়া । আমাদের একান্নবর্তী পরিবারে বড় জ্যাঠার হুংকারে সব বাঘ গরু ছাগল ভেড়া একঘাটে জল খেত। বড় জেঠার দেওয়া নাম ছিল আলু লেবু লঙ্কা ছানু পটলা এবং মেয়েদের বেলায় পুঁটি টেংরি খলসা ইত্যাদি। এই অত্যাচারে পাড়ার লোকে আমাদের আড়ালে বলত ডাইনিং টেবিল, কিন্তু অত্রি কখনোই না।এমনকি প্রতিশোধের সুযোগ পেয়েছে বহুবার তবু না।
অত্রিটা আসলেই ভালো বন্ধু ছিল আমার, ভালোবাসতো আমাকে। ওর ঘরের জানলা দিয়ে হাসপাতালের লনটা দেখা যায়, ওদিকে তাকিয়ে থাকযে থাকতে মাঝেমধ্যে গলার কাছটা খুশখুশ করে। আমার মত একটা কিস্যু না ছেলের প্রতি একটা অদ্ভুত মায়া ছিল ওর, সুবিচার করিনি আমি। পাড়ায় আমাদের বড়লোক বলে নাম ছিল বাবা জ্যাঠাদের দৌলতে, বড়বাজারে চার পাঁচটা কাপড়ের দোকান, তিনটে লরি তাছাড়া নামে বেনামেও টুকটাক। একটা বিধবা মায়ের সম্বলহীন ছেলে খালি বন্ধু বলে সবেতে আমাকে টপকে যাবে, অসহ্য লাগতো। আরো অসহ্য ছিল ওর ঠোঁটে লেগে থাকা হাসিটা।
কলেজ পেরিয়ে নাটক ধরলো, গ্রুপ থিয়েটার। একে নুন আনতে পান্তা ফুরোয় তার ওপর ঘরের খেয়ে বনের মোষ তাড়ানো। আস্তে আস্তে কিন্তু গ্রুপটার নাম হচ্ছিলো, বাইরে শো পাচ্ছিল। ওর জোরাজুরি তে একদিন দেখতে গেলাম, ফার্স্ট রোয়ে মাঝামাঝি কমপ্লিমেন্টারি সীটে বসে দেখলাম শান্তাকে, দেখলাম নাটকে ওদের আশ্চর্য রসায়ন। গা জ্বলে গেল রাগে, প্রতিজ্ঞা করলাম অত্রিকে কিছুতেই শান্তাকে পেতে দেব না।
কয়েকদিন পরেই কল শো আদর্শ পল্লীতে, জানতাম অত্রির ফিরতে রাত হবে। মেরে ফেলতে বলিনি, বলেছিলাম হাত পা ভেঙে যেন বিছানায় পড়ে থাকে কয়েকমাস। বাড়াবাড়ি করে ফেলেছিল গুণ্ডাগুলো, ঘন্টাখানেক রাস্তায় পড়েছিল রক্তে ভেসে। মাসিমার সঙ্গে আমি যতক্ষণে হাসপাতালে আসি , জ্ঞান নেই আর। পরে খবর পেয়ে শান্তা আসে, অন্যরাও তখন করিডরে ভীড় করে থাকত সকলে। তারপর আস্তে আস্তে শুধু আমি , শান্তাও না। শেষ যেদিন এসেছিল, হলুদ লাগানো কার্ডটা হাতে গুঁজে দিয়ে বললো,” ইউ এস এ তে চলে যাব দাদা, ও ওখানের ডাক্তার। অত্রিদা সব জানতো, বাড়ি থেকে রাজি ছিল না বলে অত্রিদা আমাদের মাধ্যম ছিলো।” আমি চুপ করে ওর চোখের দিকে তাকিয়ে ছিলাম। যাওয়ার আগে শান্তা শুকনো হেসে বললো ,”আসছি, পারলে যেও । অত্রিদা হলে খুব খুশি হতো!”
আমি হইনি, একটুও হইনি। আমার হাতে তখনও টাটকা রক্তের গন্ধ, একশোবার হাত ধুয়েও ওঠাতে পারছি না। মনে হচ্ছে চামড়াটা ছুরি দিয়ে উঠিয়ে ফেলি। পরদিনই অ্যাকাউন্ট থেকে টাকা তুলে অত্রিকে কেবিনে ট্রান্সফার করলাম, এ সি কেবিন। মাসিমাকে বলে এলাম চিন্তা কোর না, আমি আছি আর তারপর থেকে রোজ বিকেলে অত্রির বেডের পাশে বসে ওর বুকের ওঠাপড়া দেখি আর ভাবি, অত্রি হঠাৎ করে চোখ খুলবে আর ঠোঁটের কোনে হেসে বলবে ….” কতক্ষণ?”
যেদিন থেকে তোর জন্য শেষ বোতল রক্তটা দিলাম রে শালা!