পরিচিতিঃ শ্রী লিল্টু মণ্ডল। বাবা – শ্রী দক্ষিণ মণ্ডল, মা – কবিতা মণ্ডল। জন্মভূমি, পশ্চিম বর্ধমানের বারাবনী থানার অন্তর্গত বালিয়াপুর গ্রাম। বর্তমানে পশ্চিম মেদিনীপুর জেলার সবং থানার অন্তর্গত সবং সজনীকান্ত মহাবিদ্যালয়ের বাংলা বি ভাগের স্টেট অ্যাডেড কলেজ টিচার। পড়া আর পড়ানোর পাশাপাশি একটু আধটু লেখালেখি করে থাকেন। সখ বিভিন্ন আঞ্চলিক জায়গায় ঘোরাঘুরি, আত্মীয়তা বজায় রাখা আর বিশিষ্ট মানুষের সান্নিধ্য লাভ করা।
লি ল্টু ম ণ্ড ল-র ৩টি অণুগল্প
ভীমরুলের চাক
পটলা গেছিল কচু কুঁড়তে কচুবনে, তা দিব্যিই তুলছিল সে। অন্যদিকে পচা পাহারা দিছিল বনের ছামুটাই। বেশ মোটা মোটা কচু, দুজনের ভাগে ভালোই পড়েছে। আর যাই হোক আজ পর্যন্ত তারা ধরা পড়ে নাই। গাঁয়ের লোক তাদের ভালো ছিলা বলেই জানে। সময়ে অসময়ে তারা দুজনে গাঁয়ের লোকের পাশে থাকেই থাকে। পচা আর পটলার কী অমন বয়স, জুয়ান তাগড়াই শরীর তাদের। পড়াশুনা সব শেষ আর শেষ হাতের পাঁচও, জমি-ডাঙ্গা সব। গত বারো বছর তারা চাকরির পরীক্ষা দেওয়ার সুযোগ পাই নাই। তাই কোনো রকমে জীবনটা বাঁচাই রেখেছে। পচা আর পটলা কাকা-জ্যাঠার দু ভাই। পচার বাবা বড়। দুজনের বয়স সমান সমান।
ঘর যেতে যেতে পটলা পচাকে, কী রে বিয়ার বয়স তো সরকারই পার করে দিল, এখন কোন বাপে তুখে বিটি দিব্যাক ? আগুতে কী করবি ভেবে রেখেছিস?
পচা, কী আর করা যাবেক তুথে আর আমাতে প্রাইভেট পড়াব গাঁয়ের ছিলা গ্যালাকে। যা শিখেছি সব ঢেলে দিব বুঝলি। এতদিনে সব ভুলতে বসেছি। বিদ্যা দানে বাড়ে বৈ কমে না। তাতে যা হব্যাক তুর আমার চলে যাব্যাক।
পটলা, দ্যাখ তবে কতটা ভাগ্যে আছে। তবে আমার মন বলছে রাজনীতি যদি করতে পারিস লাভই লাভ। কোন টাকা লাগব্যাক নাই।
পচা ঝ্যাঞ্জকারে বলে, এখন রাজনীতির আঙিনাতেও টাকা ঢালতে হয়। ওটা একটা ভীমরুলের চাক বটে, যারা একবার মধুর স্বাদ পেয়েছে তারা চিটাই গ্যাছে। তুর জায়গা হব্যাক কথা থেকে। শেষকালে ঝাণ্ডা বওয়া সার হব্যাক।
তারা ঘরে ফিরে মাটিতে পাতা উনান কাঠকুটো দিয়ে ধরায়, চাল আর কচু ধুয়ে হাড়িতে ফেলে দেয়। পচা ভাবে, পড়াশুনা তারা ঠিকই করেছে লাইন ধরে ধরে। এই দুর্দশা তাদের মা-বাপেরা দেখে যেতে পারে নাই। সেইদিক থেকে ঝাড়া হাত-পা। এখন পটলার খুব ইচ্ছা নেতা হবার। বিগত কয়েক বছরের শিক্ষা। যা দেখছে চোখে আর শুনছে কানে, তারই ফলে তার নেতা হবার বাসনা তুঙ্গে। পচার ভাবনা ভালো শিক্ষক হবার। ফুটন্ত হাড়ির টগবগানিতে চিন্তার জাল ছিঁড়ে যায়। ভাত নামিয়ে, কচু ভাতে ভাত খেতে বসে তারা। পোশাকী নাম তাদের অবশ্যই একটা আছে খাতা-কলমে। তাদের ধারণা, ভীমরুলের চাকে তারা মিশতে পারে নাই, তাই পোশাকী নাম তাদের ব্যবহার করা মানায় না।
অঘ্রানের শেষ সন্ধ্যায়
কুয়াশা জড়ানো গলায় রথীন বলল, আজকে আমাদের বিবাহিত জীবনের পাঁচ বছর পূর্ণ হয়ে গেল। সকালের নরম হাওয়া গায়ে মাখতে মাখতে শেফালি, ওও তোমার মনে আছে বেশ। আমি তো ভাবলাম তুমি সব ভুলে গেছ। ধুর কী যে বলো না তুমি! এটা কি আমি ভুলতে পারি, রথীন বলল একটু মুচকি হেসে। হাতে গরম চায়ের কাপটা এগিয়ে দিতে গিয়ে শেফালি একটু ক্ষণ কী যেন ভেবে নিল, তারপর রথীনকে চা-টা ধরিয়ে চলে গেল ঘরের ভেতরে।
শেফালি আসছে না দেখে রথীন ভেতরে গিয়ে দেখে, জানালার কাছের চেয়ারটায় বসে সে বাইরের দিকে তাকিয়ে আছে। কাছে গিয়ে কাঁধে হাত রাখতেই শেফালি চমকাল। গালে জলের দাগ মুছে নিয়ে উঠে দাঁড়ালো। তারপর খাটে শুয়ে থাকা তিন বছরের টিকলুকে আদর করে জাগিয়ে তুলল। সে ছেলেকে নিয়ে ব্যস্ত হয়ে পড়ল।
রথীন ঠিক ব্যাপারটা বুঝে উঠতে পারল না, শেফালির আবার কি হলো সাত-সকালে। বাড়ির স্তব্ধতায় কেটে গেল আরও ঘণ্টা দুয়েক।
রথীন বাজারে যাচ্ছে দেখে শেফালি বলল, রজনীগন্ধার মালা পেলে নিয়ে এসো একটা। ঘাড় নেড়ে রথীন বেরিয়ে পড়ল। রজনীগন্ধার মালা কী হবে, ভাবতে ভাবতে চলল বাজারের দিকে। সবজি বাজার সারা হয়ে গেলে, ফুলের দোকানের সামনে এসে দাঁড়াল সে। মালার দাম মেটাতে গিয়ে দোকানে টাঙানো ছবির ফ্রেমে রজনীগন্ধার মালা দেখে রথীনের খেয়াল হলো, আজকে মানে অঘ্রানের শেষ দিনেই বাড়ি থেকে পালিয়ে শেফালি বাড়ির অমতে তাকে বিয়ে করেছিল। আর আজকের দিনেই সন্ধ্যা বেলায় শেফালির বাবা স্ট্রোক হয়ে মারা যান।
ব্যতিক্রমী
ভেবেছিলাম চিনে জোঁকের মতো আঁকড়ে ধরবে মেয়েটা। নাহ্ তা আর হলো কই। মারাত্মক বিদ্ঘুটে লাগলো ব্যাপারটা। চিরাচরিত নিয়মে এ মেয়ে চলে না। আমি ঠাঁই দাঁড়িয়ে মেয়েটার চলে যাওয়ার পথের দিকে তাকিয়ে থাকলাম। কোথায় যেন একটু গোলমেলে মনে হলো। অগত্যা দাঁড়িয়ে না থেকে আমি আমার বাসায় ফিরে এলাম।
পর পর দিনগুলো কেটে যাচ্ছিল আমার তবুও মনের খচখচানি আর যাচ্ছিল না। উপায়ন্তর না দেখে স্পাইগিরি করতে শুরু করলাম। মেয়েটা যেন ঘুণাক্ষরেও টের না পায়। তার দিনলিপি প্রায় আমি মুখস্থ করে ফেললাম। এই ক’দিনে মনটা খুব অশান্ত হয়ে উঠেছে। একবার না একবার বাগে পাবই, এই আশাতেই দিন গুণতে থাকলাম। বাড়িতে বেশ কিছুদিন নিরুৎসাহে ছুটি কাটিয়ে আমার কর্মক্ষেত্রে ফিরে গেলাম। আর পি এফ ছাওনিতে গিয়ে কাজে ব্যস্ত হয়ে পড়লাম। ধীরে ধীরে একদিন মেয়েটার স্মৃতিও হারিয়ে গেল আমার জীবন থেকে।
আরও বছর দুয়েক পর, ছুটিতে বাড়িতে থাকার সময় একটা কার্ড এলো, সম্বর্ধনা অনুষ্ঠানের। তা ছিল আমাদের গ্রাম পঞ্চায়েতের সভাগৃহে। সেখানে সম্বর্ধনা দেওয়া হবে এলাকার প্রথম আইপিএস অফিসারকে। নির্দিষ্ট দিনে সেখানে গিয়ে দেখি, ও হরি! এ যে সেই মেয়েটা।
লেখা পাঠাতে পারেন