গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস হেঁতালপারের উপাখ্যান(তৃতীয় পর্ব)

পরিচিতিঃ ১৯৮৩ এর ১৫ই জুন সুন্দরবনের প্রত্যন্ত দ্বীপ বড়রাক্ষসখালিতে জন্ম। জল জঙ্গলে বড় হয়ে ওঠা। বর্তমানে দক্ষিণ২৪ পরগণার কাকদ্বীপের একটি বিদ্যালয়ে ইংরেজি বিষয়ের শিক্ষক। কবিতার নিয়মিত লেখক নয়।বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁর ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান-র  তৃতীয় পর্ব

 

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস

হেঁতালপারের উপাখ্যান(তৃতীয় পর্ব)

 

অপু, দাদা ও মা
“We are no other than a moving row
O Magic Shadow shapes that come and go” Omar Khayyam

ছোটবেলায় যখন পুরানো ঘরে থাকতুম, নদী মানে বুঝতুম একফালি একটা নোনা খাল। ঘরের পুব পাশ দিয়ে একটা খাল উত্তর দক্ষিণ বরাবর নেয়েদের ঘর অব্দি চলে এসেছিল। সে খালের নাভি ছিল ফুট দশেক চওড়া। বাদ বাকী খালটার দুপাশে চড়া। সেখানে গরান গেঁওয়া এইসব গাছেদের ঝোপঝাড়। ভরা জোয়ারের সময় জল উঠলে দু একটা নৌকা কাঠ বোঝাই করে নেয়েদের বাড়ীর কাছে এসে খালি করতো। নেয়েদের বাড়ির কাছেই স্লুইস গেট। গেটের উলটো দিকে একটা ছোট জলাশয়। চাপসা বলতুম। জাল টেনে লোকেরা মাছ ধরতো। সেখানে মাছ ধরতে যেতুম রাতভিতে। কড়া চিংড়ি, ট্যাংরা, চেঁওয়া মাছ পাওয়া যেত। দু একটা ভাঙন মাছও উঠে আসতো কখনো সখনো।অনেকে বড়শি ফেলতো। বড়শিতে ট্যাংরা মাছ লাগতো। বড় বড় ট্যাংরা। পেটভর্ত্তি ডিম। সেই ডিম খাওয়ার জন্য মুখিয়ে থাকতুম।
মা বেশির ভাগ সময়ে গুড়ি জাল দিয়ে চিংড়ি চেঁওয়া ধরে আনতো। চেঁওয়া মাছের পেটে তেল থাকে, তাই দিয়েই মাছ ভাজা হয়ে যেতো। রান্নাও হয়ে যেতো। আমি যখনকার কথা বলছি তখন আমরা দোকানে যেতুম একটাকা বা দেড়টাকা নিয়ে। তাতেই হলুদ, লংকা, আর ১০ বা ২০ গ্রাম সরষের তেল কেনা যেতো। তারপরেও অন্তত দুটো শেফালি লজেন্স কিনে একটা দাদার জন্য আনতুম আর একটা নিজে চুষতে চুষতে আসতুম। দাদা সেই একটা লজেন্স কে দুভাগ করে মাকে দিতে চাইতো, মা নিতো না। আমি দাদার কাছ থেকে শিখে নিয়েছিলাম ভাগ করে সবাই মিলে খেলে খুব আনন্দ হয়। আমিও এরকম করতে শুরু করেছিলাম পরের দিকে। আমাদের দুই ভাইকে মা যখন ভাত দিতো দাদা জিজ্ঞেস করতো ” মা, হাঁড়ি দেখি, তুমার আছে?” মা খুশিতে ডগমগ করে বলত “হঁ, আইজ বেশী করিয়া রাধঁছি।” যদিও জানি বেশি কোনোদিনই রান্না হত না। মায়ের হাঁড়ির খবর আমরা দুই ভাই নিতাম। আমি দাদার কাছে এটা শিখেছিলাম। যদিও মায়ের খবর পাওয়া অত সোজা নয়। আমার মা’র তো সকালে আর রাত্রে ঠিকমতো ক্ষিদে হতো না। মা বলতো খেলে নাকি শরীর খারাপ করে যাবে তাই কম করে ক্ষুদ নিয়েছে। মায়েদের ছলনার অভাব হয় না। মায়েরাও যে মিথ্যে বলে আর একটু বড় হয়ে বুঝেছিলুম।
সে যাই হোক, ছোটবেলায় নদী মানে ওই খালটাকেই বুঝতাম। আর ওরকম একটা আধ-বোজা খাল নিয়ে মানুষের কী-ই বা স্মৃতি থাকতে পারে! ওই খালে জোয়ারের জল ঢুকলে মা মাঝে মাঝে সুতলি ফেলে কাঁকড়া ধরতে যেত। আমিও মাঝে মাঝে মা’র সঙ্গে যেতাম। সুতলি ফেলার জন্য আগে থেকে আধার জোগাড় করে রাখতে হয়। কোলাব্যাঙ মেরে একটু পচিয়ে নিলেই হয়। খুব ভাল খায় কাঁকড়া। কাঁকড়ার ঝাল আর তেঁতুল দিয়ে টক মা খুব সুন্দর করতো। লঙ্কা বাটা দিয়ে ঝালটা তো আজীবন মায়ের প্রসাদ মনে হয়েছে।
নদী মানে আমার শৈশবের ধারণা এভাবেই জন্মেছিল। একটা সরু নালি খাল। দুপাশে ঝোপঝাড়, কালেভদ্রে একটা আধটা নৌকা আসবে কাঠ বোঝাই করে, সেই নৌকার গলুইএর উপর বৈঠা হাতে বসে থাকবে ব্রহ্মদত্যির মতো লম্বা একটা লোক। তার মুখে খিস্তি খেউড় থাকবে সারাক্ষণ। সেই কাঠ নেয়েদের বাড়ির পাশে ডাঁই করে রাখা হবে। দু একটা ফোঁপরা কাঠের মধ্যে থেকে হঠাৎ বেরিয়ে আসবে বিষধর কেউটে যা কিনা কাঠের কোটরে বাসা বেঁধে ছিল আর কাঠুরেগুলো সেই কাঠ কেটে কেউটে সমেত বয়ে এনেছে এই দ্বীপে। এখানে এসে দুম করে ফেলতেই ফনা তুলে বেরিয়ে এসেছে। অবহেলায় সে সাপ কেউ না কেউ মেরে ফেলতো। কানু বারুই-র ব্যাটার মতো উৎসাহি লোক থাকলে কৌশল করে সাপটা ধরে কিছুক্ষণ খেলা দেখাতো, ছেলে পিলে প্রবল উতসাহ নিয়ে দেখতো, চিৎকার করতো, আবার বয়স্ক দু একজন এসে বকাবকি করে সাপটাকে মেরে ফেলার কড়া বিধানও দিতো।
যা বলছিলাম, নদী মানে আমার আর তেমন কোনো ধারনা ওই বয়সে ছিল না। নদী আমার কাছে তখন সংকীর্ণ একটা ব্যাপার। ওর চেয়ে আমার বাড়ির সামনের ড্রেনটা আমার অনেক প্রিয় ছিল, কেননা মা ওখান থেকেই বাগদার পোনা ধরে বিক্রি করে চাল নুন কিনে আনতে পারতো। ড্রেনের মরম মাটি তুলে আমরা কত কী।বানাতুম। কালীঠাকুর, লক্ষ্মীঠাকুর, গণেশ ঠাকুর, বিশ্বকর্মাঠাকুর কত কত কিছুই না বানাতুম! এখানে ওখানে পুজো হলে মাইক বাজতো। আমরা অনুকরণ করতুম। মাইকসেট বানাতুম কাদা মাটি দিয়ে। আরো কতকিছু, তার ইয়ত্তা নেই। পাড়ার শিবুকাকা ইঁট তৈরি করে পোড়াতো। ইঁট পাঁজা সাজাতো। তাই দেখে আমার দাদা একদিন কাদামাটির ইঁট তৈরি করে পোড়ানোর মতলব করল। সামনে কাকাদের পোয়াল খড়ের গাদা ছিল। ধান ঝাড়াই করার পরেও কিছু ধান খড়ের সংগে রয়ে যায়। বাঁশের কবাটের মতো করে তখনকার দিনে ধাবড় তৈরী করা হতো। সেই ধাবড়ের ওপর খড়ের বিচালি আছাড় মেরে মেরে ধান আলাদা করা হতো। কিন্তু দু একটা ধান তাতে থেকে যেতো। সেই ধান বের করার জন্য গোটা দশেক গোরুকে এক দড়িতে পর পর বেঁধে একটা খুঁটির চার দিকে বৃত্তাকারে ঘোরানো হতো। একে বলে পোয়াল মারা। ধান খড় থেকে আলাদা হয়ে যেত। তারপর সেই খড় ডাঁই করে রেখে দেওয়া হতো, সারা বছর গোরু বাছুরের খাবার কিনা! যাই হোক আমার দাদার ইঁট পোড়ানোর বাতিক মাথায় উঠল আর সামনে এই সহজদাহ্য শুকনো পোয়াল খড়ের গাদা দেখতে পেল। ব্যাস! তার ভিতর কাদার তৈরি ইঁট ঢুকিয়ে দিয়ে দিল আগুন ধরিয়ে। সে কী পয়মাল কাণ্ড! সে নিয়ে কম ভুগতে হয়নি মাকে।
যা বলছিলাম, আমার মনে হয় আমার ভাবনাগুলোই ছোট ছিল। নইলে নোনা খালকে কেউ নদী ভাবে! তখন তো ভাত দেখলে পোলাও ভাবতুম। অন্তত কিছু একটা লোভনীয় ভাবতুম। মুড়ি খাওয়া তো বড়লোকি ভাবতুম।
তবে আমাদের আকাশটা আর অত ছোট রইলনা। নতুন জায়গায় এসে একটা সত্যিকারের নদী, দিগন্তহীন ছাতার মতো আকাশ আর অগণিত গাছপালার জঙ্গল পেয়েছিলুম। একটা বিশাল কৃষ্ণচূড়া গাছ আর তার সম্পর্কে জনশ্রুতি আর কল্পনা মিশিয়ে একটা আস্ত আদিম সারল্য পেয়েছিলুম। মাকে পেয়েছিলুম অন্যরূপে। নদী আর মা মিলে মিশে একাকার হয়ে গেছিল, আর সেই নামহীন গোত্রহীন নদীর বুক থেকে উঠে এসেছিল এক রাশ আকাঙ্ক্ষার সীমাহীন প্রশান্তি। সেই নদীই পরবর্তীকালে ঠেলতে ঠেলতে মা’কে দাঁড় করিয়ে দিয়েছিল একটা বালুকাবেলায়, সেখানে রত্ন যেমন ছিলনা, তেমনি ছিলনা চোরাবালির হাতছানি।

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্ব পড়তে নিচের লিংকটি ক্লিক করুন

গৌ ত ম   ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস “হেঁতালপারের উপাখ্যান” (২-য় পর্ব)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *