গৌ ত ম ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস
হেঁতালপারের উপাখ্যান(১৩তম পর্ব)
সে ও তারা
“লরযতা হ্যায় মেরা দিল য্যাহমতে মেহরে দরখশা দেখ কর/ম্যায় হু ও কাতরায়ে শবনম কি হো খারে বাঁয়াবা পর” —গালিব
(উদার সুর্যের কষ্ট দেখে বিচলিত হৃদয় আমার/আমি যে মরুর বুকে কাঁটার ওপরে পড়া শিশির)
খবর পেয়ে দৌড়ে যখন চন্দ্রানীর ঘাটে পৌঁছালুম, তখন অনেক কিছু হয়ে গেছে। শম্ভুকে তখনো পুরানো কৃষ্ণচূড়া গাছের সংগে পিছমোড়া করে মোটা কাছি দিয়ে বেঁধে রাখা হয়েছে। তার চোখ মুখ ফুলে গেছে, সম্ভবত এলোপাথাড়ি কিল চড় ঘুষিতে। খালি গা। হাঁটু অব্দি কাদা তখন শুকিয়ে চটচটে হয়ে গেছে। কাদার উপরে জায়গায় জায়গায় লাঠির দাগ। ফুলে উঠেছে। হাতের কনুইএর উপরে পাঁকাল মাছের মতো লম্বা লম্বা হয়ে লাঠির দাগ পড়েছে। আমি গিয়েই কেঁদে ফেল্লুম। আমার কান্না বুক থেকে গলা অব্দি উঠে এসে একটা অদ্ভুত হেঁচকি ওঠার মতো শব্দ করে মুখ দিয়ে বেরিয়ে এল। রাম মাইতি আমার দিকে প্রায় তেড়ে এল ” অই শ্লা, হাঁড়ির বাচ্চার জন্য দরদ উথলিয়া উঠছে?” আমি কিছু বলতে যাচ্ছিলাম। শম্ভু মাথা নেড়ে বাধা দিল। ওর ঠোঁট দুটো একটু ফাঁকা হয়ে আবার বন্ধ হয়ে গেল। ঠোঁট দুটো পাকা কলার মতো ফুলে উঠেছে। জমাট বেঁধে আছে রক্ত। মহল্লার মোড়ল ভানু বাগকে ঘিরে চারপাশে বসে আছে নীতি পুলিসের দল। কেউ চায় আরো দু চারটে কিল চড় ঘুষি মারতে, কেউ মা বাপ তুলে হঠাৎ হঠাৎ খিস্তি দিয়ে সবার নজর কাড়ছে, কেউ অতি উৎসাহে বলছে ” শালার ঘরে আগুন ধরি দুবো”।
আজ সবাই স্বাধীন। যে যার মতো যা ইচ্ছা বলতে পারে, করতে পারে। এতবড় অপরাধী ধরা পড়েছে! যে কিনা লোকের মেয়ের সিঁথিতে সিঁদুর লাগিয়ে দিয়েছে। লক্ষণ আড়িকে দেখলুম একপাশে বসে আছে। তার বৌ মানে গৌরির মা, যাকে শম্ভু নিজের হাতে মাছ দিয়ে আসে, সে অতি ক্রুদ্ধ। সে চায় আরো কিছু হোক। উদবাস্তু করে দেওয়া হোক শম্ভুকে।
ঝন্টু সাউ বসে আছে ভানু বাগের ডান পাশে। তার হাতে শংকর মাছের লেজ। বোধ হয় কেউ এনেছিল শম্ভুকে পেটানোর জন্য। সে কেড়ে নিয়ে রেখেছে। আমার গা শিরশির করে উঠল। আমি আর একটু ডাইনে ঘেষে দেখলুম শম্ভুর পিঠে দুটো একটা শংকর মাছের লেজের ঘা পড়েছে। দু তিনটে লম্বা সাপের মতো রক্তাক্ত দাগ শম্ভুর পিঠে। রক্ত গড়িয়ে তার রং চটা ধুসর গামছায় কিছুটা লেগেছে। ভানু বাগের পা ধরে বসে আছে শম্ভুর খোঁড়া বাপ। সে একসময় এই ভানু বাগের আড়তে কাজ করত। নৌকা থেকে মাছ তুলতে গিয়ে পা পিছলে তক্তা খুলে নৌকার খোলে পড়ে পা ভেঙেছিল। সে পা আর সারেনি। হাঁটুটা কেমন অদ্ভুতভাবে ঘুরে গেছিল। কত গাছ গাছড়া বেঁধেছে, কত গাঁ গুণীন করেছে! কিচ্ছু হয়নি।
“বাবু, ছাড়িয়া দও না আমার মা মরা টকাটাকে, ও আর কুনদিন অরকম করবেনি” শম্ভুর বাপ হাউহাউ করে কাঁদছিল আর ভানু বাগের পা জড়িয়ে ধরছিল। ভানু বাগ নির্বিকার। সে এই মহল্লার সবচেয়ে ধনী লোক। এখানকার একমাত্র আড়ৎটা তারই। “গংগা, পা ধরলে কি সব সমস্যা মিটে রে? জাঁউ এটা কত বোড় অপরাধ!” ঠাণ্ডা মাথায় ভানু বাগ ঈশ্বর পরমেশ্বরের মত বলছিল। যেন সেই বিধাতা। শম্ভুর অন্যায় সে বলেই স্খলন হওয়ার সম্ভাবনা আছে। কারণ এ স্বর্গে সেই একমাত্র দয়াময় দেবতা।
আমাকে শম্ভু কিছু ইশারা করল। আমি কাছে যেতেই লোকগুলো রে রে করে উঠল। “এই শ্লা, চুদির ভাই! দেখচু শংকর মাছের ল্যাজ!” আমি দমে যাবার বদলে খাস খালে নামলাম। হাতের চেটোয় করে জল আনলাম। শম্ভু তার তেষ্টার কথাই আমাকে বলতে চেয়েছিল। আমি ঠিক বুঝেছিলাম। পঞ্চা পাত্র হঠাৎ উঠে পড়ল, আমাকে একটা জোর ধাক্কা দিয়ে ফেলে দিল মাটিতে। মনে হোল নাকটা থেঁতলে গেছে আমার। নাকে হাত দিয়ে দেখলুম রক্ত বেরিয়ে এসেছে। “শ্লা, খানকির পো, দরদ মারাওট!” আরো বিশ্রী বিশ্রী গালাগাল ছুঁড়ে দিল আমার চেনা লোকগুলো। দু একজন উৎসাহী উঠে পড়ল “ঘা কতক দুবো শ্লাকে..” ভানু বাগ তাদের থামিয়ে দিল। আমি উঠে দাঁড়ালুম। শম্ভু ইশারা করে আমাকে চুপচাপ দাঁড়াতে বল্লে।
গাঙের দিকে চোখ পড়ল। শম্ভুর নৌকা জল থেকে কারা কাদার উপর টেনে তুলেছে। ত্রিপলের কুঁড়েটা ভেঙে তছনছ করে দিয়েছে। হাঁড়ি কড়াই চাল ছড়িয়ে আছে কাদার উপর। পারসে জালটা ফালাফালা করে বাঁধের গায়ে ফেলে দিয়েছে। কাঁকড়ার দনটা ধনু বরের হাতে। গুছিয়ে নিয়েছে। লুটের মাল কিনা! আমার শরীরে আগুন ধরে গেল “শম্ভু, লৌকার কী হইচে?” শম্ভু আবার ইশারা করে আমাকে চুপ করে থাকতে বল্লে। আমার নাক দিয়ে এক ফোঁটা রক্ত মাটিতে পড়ে গেল। শম্ভু সেদিকে তাকিয়ে মাথাটা নামিয়ে নিল। বোধ হয় এতক্ষণ ও দমে যায়নি। আমার রক্ত দেখে ও হতাশ হয়ে গেছে।
অনেকক্ষণ এই সালিশির নামে অত্যাচার হোল শম্ভুর উপর। অনেক ভেবে চিন্তে ভানু বাগ মুখ খুল্ল “তা’লে ওর তো জরিমানা হবে। কত টাকা হইলে ঠিক হবে গো, তুমান্নে কও।” ভিড়ের ভিতর থেকে কেউ একজন বল্লে “,ওর লৌকা লিয়া লও কাকা”। কোলাহল শুরু হয়ে গেল। ” হঁ হঁ লৌকা লিয়া লও, শ্লার খুব বাড় বাড়চে”। ঠিক হোল শম্ভুর নৌকা জব্দ করা হবে। “কিন্তু লৌকা লিয়া আমানকের কী হবে? জরিমানা টাকায় দিতে হবে।” শুয়োরের পালের ভিতর থেকে মোটা গলার হেঁড়ে আওয়াজ এল। ঝন্টু সাউর গলা। এখানে সে বাঁধা বন্দকীর কারবার করে। চড়া সুদে টাকা ধার দেয়। লোকের বাসনপত্র বন্দক রাখে। নির্দিষ্ট সময় পেরিয়ে গেলে কিছুই ফেরৎ দেয়না আর। তার বিরুদ্ধে ঘাঁটাবার লোক এ মহল্লায় নেই। তার অনেক টাকা। আর টাকা যার হয়ে কথা বলে, তার বিরুদ্ধে যাবে অমন শক্তি কোথাও আছে কিনা জানিনা, অন্তত এই হাড়হাভাতে দ্বীপে নেই। “আমি লৌকা কিঁআ লুবো, তা’লে টাকা পায়াবো।”
শম্ভুর নৌকাটা মাত্র সাড়ে সাতশ’ টাকায় ঝন্টু সাউ কিনে নিল। ভানু বাগ হাতে টাকা নিয়ে উঠে পড়ে। “অকে ছাড়িয়া দে, সব ঘর যা”। সবাই উঠে পড়ল। যাবার সময় সবাই মিলে নৌকা ঠেলে গাঙে নামিয়ে দিল। ঝন্টু সাউ হাল ধরে নৌকা নিয়ে সাউর ঘাটের দিকে যাওয়া শুরু করেছে। লোকেরা ফাঁকা হওয়ার আগে শম্ভুর নৌকার ছেঁড়া ত্রিপল, হাঁড়ি, কড়াই,ছেঁড়া জাল যে যা পারল, লুটের মালের মত ছেঁড়াকামড়া করে নিয়ে গেল।
” আহহহহহ! আর দেইনা, লাগেটে”। আমি আর শম্ভু চন্দ্রানীর ঘাটে বসে আছি। সমস্ত বিপর্যয়কে চোখ দিয়ে দেখছি, ভিতরে আগুন জ্বলছে। আমি ভেরাণ্ডা গাছের ডাল ভেঙে এনে আঠা লাগাচ্ছি শম্ভুর পিঠে। শম্ভু গাছে ঠেস দিয়ে বসে আছে। আমাকে ইশারা করে ডান পায়ের বুড়ো আঙ্গুল দেখাল। আঙ্গুলের উপরেই কেউ কিছু দিয়ে মেরেছে। নখের পাশ দিয়ে কাদা ভেদ করে রক্ত বেরচ্ছে। ভেরাণ্ডা গাছের রস লাগাতে লাগাতে বল্লেম “ঘর চ’। তোর বাপ ডাকিয়াল।” শম্ভু পিছন ফিরে কিছু দেখার চেষ্টা করল। তার বাপ বেশিদূর যায়নি। খুঁড়িয়ে খুঁড়িয়ে খুদি পাত্রের দোকান অব্দি গিয়ে একটা নিম গাছ ধরে দাঁড়িয়ে জিরোচ্ছে।
যাবুনি, শম্ভু?
হঁ
তা’লে চ’
শুঁ
কী?
তুই যা, আমি পরে যাইটি।
নাহ! তোকে লিয়া যাবো।
আমি একটু জংগয়ে ঢুকবো।
কেনি?
একটু গিরা শাক তুউবো।
চাউ(ল) নেই?
দুটাক্ষানে খুত আছে।
চ’ আমিও যাবো।
শুঁ।
ক’
তোর নাকে খুব লাগচে, না?
আমি শম্ভুকে জড়িয়ে ধরে কেঁদে ফেল্লাম। আমার নাক নিয়ে কি এখন ওর ভাববার কথা! যে নিজে এক্ষুণি, একটু আগেই বেদম এলোপাথাড়ি মার খেয়েছে, সর্বস্ব হারিয়েছে। দু’জন খালে নেমে হাতে মুখে জল দিলাম,পেটপুরে জল খেলাম তারপর বাঁধ পেরিয়ে, চন্দ্রানীর ঘাট থেকে কয়েক পা এগিয়ে জংগলে ঢুকে পড়লাম। আমি গিরা শাক তুলতে শুরু করে দিলাম। শম্ভু এদিক ওদিক তাকাচ্ছে। বল্লেম “কী রে? শাক তুউবুনি?”
না, তুই তুউ (ল), আমি একটু দেখি দাঁড়া,আর কী পাবা যায়।
আমি শাক তুলছি। শম্ভু আর একটু ঘন জংগলে ঢুকে পড়ল।
অপু রেএএএএএএএ,
শম্ভু ডাক শুনে সাড়া দিলুম “হঁ রে এ, ক’অ অ অ
এখাঁয়ে আয়য়য়
যাইটিইই দাঁড়া।
কাছে গিয়ে দেখলুম শম্ভু একটা বড় কেওড়া গাছের মোটা ডালের উপর।
কী রে?
দ্যাখ।
কী?
এই তো।
হাতে খড়হাসের (বুনোহাস) ডিম। শম্ভুর চোখ চিক চিক করছে।
ক’টা আছে?
এক দুই তিন চার…. ন’টা
বাচ্চা হইচে নাকি দ্যাখ।
শম্ভু এক চোখ বন্ধ করে একেকটা ডিম হাতে নিয়ে দেখল।
না রে, ভাল আছে।
তা’লে লিয়ায়।
ধর।
আমি হাত বাড়িয়ে একেকটা ডিম ধরে নিলুম। শম্ভু নিচে নেমে এল। আমার কাঁধে হাত রেখে হাসল।
শাক কাই?
সেটি।
চ’
শম্ভু গামছা খুলে ডিম আর শাক বাঁধল। একটা পুরানো ছেঁড়া আণ্ডার প্যান্ট পরা। পিছন ফাটা। আমি সেদিকে তাকাতে শম্ভু বল্লে “জাঁউ তো, লৌকায় প্যান্ট থাইল। শ্লারা সব লিয়া লিল।”
জংগল থেকে বেরিয়ে বাঁধে উঠলুম। শম্ভু এদিক ওদিক তাকাল। বল্লে ‘দাঁড়া তো একটু”।
কাই যাবু?
চঞ্চলী বৌদির দরে।
কেনি?
আরে জাঁউনি, ঝন্টুদা হারি যাওয়ার পরনু খাইতে পাটেনি।
কায়ো কাজ পায়নি?
হুম, পাইতল। দুদিন যায়া আর যায়নি।
কুন্ঠি?
ভানু বাগের আড়তে।
আর যায়নি কেনি?
ভানু বাগকে তো জাঁউ
টাঁআটাঁয়ি করতল। এক দিন রাত্রে তো বৌদির কুঁড়িয়ায় লোক পাঠিয়া জোর করিয়া লিতল।
“শ্লা, খানকির পো” আমার মুখ থেকে বেরিয়ে গেল।
শম্ভু দ্রুত পা চালিয়ে চঞ্চলী বৌদির কুঁড়ে ঘরে গিয়ে দুটো ডিম আর একটু শাক দিয়ে এল। ফিরে এসে আমার হাতে দুটো ডিম দিয়ে বল্লে “তুই মাঝুর রাস্তা দিয়া যা, এগা লিয়া যা, তরুবালা ঠাকমাকে দিয়াবু, বিকাএ দ্যাখা হবে, অখঁ যা।”
শম্ভু দ্রুত পা চালিয়ে বাড়ির দিকে যাচ্ছে। আমার হাতে গুরু দায়িত্ব দিয়ে ফিরে যাচ্ছে তার বুড়ো খোঁড়া বাপের কাছে। একটা রোগা কালো ঝাঁকড়া চুলওয়ালা লোক খালি গায়ে কাদা মাখা শরীর নিয়ে বনের পথ ধরে যাচ্ছে। একটু আগে যে সর্বস্ব হারিয়েছে। আমি বিহ্বল হয়ে ওর যাওয়ার দিকে তাকিয়ে আছি। মনে হচ্ছিল ও কিছু হারায়নি, বরং ওর পায়ের তলায় গোটা পৃথিবীর সমস্ত ঐশ্বর্য সর্বস্ব হারিয়ে বসে আছে।
ক্রমশ…
আগের পর্ব পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন–
গৌ ত ম ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস– হেঁতালপারের উপাখ্যান(১২তম পর্ব)