গৌ ত ম ম ণ্ড ল-র ধারাবাহিক উপন্যাস
হেঁতালপারের উপাখ্যান
১ম পর্ব
এক
“হাজার বছর ধরে আমি পথ হাঁটিতেছি” জীবনানন্দ দাশ
সাগর থেকে এঁকে বেঁকে কিশোরীনগরের গা ধরে বনশ্যামনগরকে বেড় দিয়ে কে. প্লটের দিক দিয়ে নদী উলটো বাঁক নিয়েছে তার গর্ভে ফেরার জন্য। বনশ্যামনগরের কাছে নদীতে স্রোত আছে কিন্তু ঢেউ কম। সাগর থেকে দূরে চলে গেলে নদী যৌবন ভুলে যায়। এখানে চরের উপর বালির একটা কণাও নেই। শুধু কাদা আর কাদা। এক হাঁটু কোথাও বা এক কোমর আঁঠালো কাদা। মাঝে মধ্যে এক আধটা চৌকা। পলি পড়ে পড়ে মজে গেছে বেশীরভাগ অংশ। পাড়ে মাটি দেওয়ার জন্য চৌকা কেটে মাটি নেওয়া হয়। আর পাড়ে মাটি প্রায় প্রত্যেক বছরই দিতে হয়। বর্ষায় নদীর জল বেড়ে যায়, পাড় ঘেঁসে স্রোত। একটু আধটু ঢেউ। ওদিকে বৃষ্টির জল ধুইয়ে দেয় নদীর পাড়, ক্ষয়ে যায়। তাই নিয়ম করে বর্ষার আগে মাটি দিয়ে পাড় না বাঁধলে বর্ষায় পাড় ভেঙে গ্রামে জল ঢুকবে। গ্রাম আর দ্বীপ সমানই কথা। কতটুকু আর দ্বীপ একটা! জল ঢোকা শুরু করলে আস্ত দ্বীপটাই হয়তো ভেসে যাবে। তাই নিয়ম করে বাঁধের খেয়াল রাখতে হয়। তবুও যে ভাঙে না, জল ঢোকে না তা নয়। কোথাও একটু আধটু বাঁধ ভাঙলেই হু হু করে জল ঢোকা শুরু হয়। চোখের অলক্ষ্যে হলে গ্রাম ভাসবে, দ্বীপ ডুববে। তাই সবাই মিলে লক্ষ্য রাখে। নদীর বাঁধ তো মা বাপ। তবুও ঢোকে। তড়িতগতিতে সে খবর পৌঁছে যায় গ্রামবাসীদের কানে। চিৎকার করে একে অন্যকে খবর দেয়। রাত হোক, দিন হোক হৈ হৈ করে লোকেরা বেরিয়ে আসে কোদাল আর ঝুড়ি নিয়ে। ফটাফট কোদালের কোপ পড়ে আর মাটি ফেলে জল আটকাবার চেষ্টা হয়। জলের তোড়ে সদ্য দেওয়া মাটি থাকতে চায় না। হুড়মুড় করে মাটিসুদ্ধু জল ঢুকে পড়ে। তখন চরের লবনাম্বু বানি টরা কেওড়া এই সব গাছ কেটে খুঁটি তৈরি করে গায়ে গায়ে পুঁতে দেওয়া হয়। কোদালের উলটো পিঠ দিয়ে খুঁটির মাথায় আঘাত করার ধপাধপ আওয়াজ উঠে। কাছাকাছি যাদের বাড়ি তেমন দু তিনটে চারটে বাড়ীর দরজার বাঁশের কবাট খুলে এনে খুঁটির গায়ে আড়ায়াড়ি বসিয়ে দেওয়া হয়। তাতে জল আটকায়। জল আটকালেও লোকেরা চলে যায় না। সবাই থাকে। কোদাল রাখে হাতের কাছে। দু চারটে খুঁটি কেটে রাখে। বলা যায় না।সব ভেঙে হুড়মুড়িয়ে জল ঢুকে গেলে রাতের অন্ধকারে বাল বাচ্চা, গোরু বাছুর সব ডুববে। জল নেমে গেলে লোকেরা মাটি কেটে ভাঙা জায়গা মজবুত করে বেঁধে দেয়। তারপর ঘরে ফেরা।
গ্রামের মহিলারা সজাগ থাকে। পুরুষরা বাঁধ বাঁধতে গেছে বলে তারা নিশ্চিন্তে ঘুমোয় না। কখন কী হবে বলা যায় না। তারা জেগে থাকে। তেমন কিছু হলে গরু বাছুরগুলোর দড়ি খুলে দিতে হবে। গোয়ালে বাঁধা থাকলে প্রথমেই মরবে, যদি জল ঢোকে। গলায় দড়ি না থাকলে অন্তত উঁচু জায়গা খুঁজে দাঁড়াবার চেষ্টা করবে অবলা জীবগুলো। উঁচু জায়গা মানে সেই নদীর দিকেই দৌড়াতে হবে। নদীর বাঁধের চাইতে উঁচু কিছু দ্বীপে আর নাই। জেগে থাকতে যে বাঁচাতে পারলনা, ভেঙে গিয়েও রক্ষার দায়িত্ব তার।
যা বলছিলাম। পাড় থেকে অল্প দূরে ওই চৌকাগুলোতে নানারকম মাছ নদীতে জল নেমে যাওয়ার পর, অর্থাত ভাঁটা হওয়ার পর আশ্রয় নেয়। চিংড়ি, পারসে, তাউরি এইসব মাছ। তাই ভাঁটা হওয়ার পর গ্রামের মহিলারা, বাচ্চা বাচ্চা মেয়েরা গুড়িজাল নিয়ে চলে যায় মাছ ধরতে। কেউ বা হাতে করে একটা থালা নিয়ে যায়। জল অল্প হলে থালা দিয়ে জল ছিঁচে তুলে দিয়ে মাছ ধরা যায়। মাছ ধরতে গিয়ে কেঁদে মাগুরের হুল খায় অনেকে। কী ভীষণ যন্ত্রণা! বেঁধে রাখতে হয় লোককে। নয়তো যন্ত্রণার চোটে আত্মহত্যাও করতে পারে। আগুল জ্বালিয়ে ক্ষত স্থান পুড়িয়ে দেওয়া হয়। গাছ গাছড়ার পাতা শিকড় এসব খাওয়ানো হয়। গুণীন আসে। ঝাড় ফুঁক মারে, শিকড় বাকড় বেটে দেয়। তবু যন্ত্রণা চলতে থাকে। এক সারাদিন যন্ত্রণা হয়ে তবে কমে। তখন রুগির অচৈতন্য অবস্থা প্রায়। তাই কেঁদে মাগুরের নামে খুব ভয় সবার। কিন্তু তবুও কেউ মাছ ধরা ছেড়ে দেয় না। মাছ ধরা হয়, টাটকা মাছের ঝাল হয়, টক হয়, লংকাবাটা দিয়ে ভাজা হয়। মালাবতী বা ভুঁড়ি চালের পাথরের মতো শক্ত মোটা ভাত তবেই না গলা দিয়ে ভিতরে যায়।
এক হাঁটু কাদা চড়ায় ঝাঁকে ঝাঁকে ঘুরে বেড়ায় ডাকুর মাছ। আহা, কী স্বাদ তার! ঝাল চাপ দিয়ে মাখা মাখা রান্না করলে খেয়ে যেন মানুষ ধন্য হয়ে যায়। কিন্তু তাকে ধরা অত সহজ নয়। খুব দ্রুত দৌড়াতে পারে কাদার উপর। বেগতিক দেখলে গর্তে ঢুকে যায় চোখের পলকে। গর্তের দুটো মুখ। এক মুখ দিয়ে ধরার জন্য হাত চালালে অন্য মুখ দিয়ে বেরিয়ে যায়। খুব কৌশলে দুই মুখে দুই হাত দিয়ে ধরতে হয়। একে বলে গর্ত টিপে মাছ ধরা। কৌশল না রপ্ত থাকলে দুই মুখে হাত দিলেও পাওয়া যাবে না ডাকুর মাছ। সে এক হাঁটু কাদায় কোথায় হারিয়ে যায়। আর একটা কৌশল আছে ডাকুর মাছ ধরার। সারা গায়ে কাদা মেখে চড়ার উপর মড়ার মতো পড়ে থাকতে হয়। ডাকুরমাছ গুলো কাদা দেখে গায়ের উপর উঠে আসে, আর তখনই বিদ্যুতবেগে নিজের গায়ের উপর নিজেকে থাপ্পড় মারতে হয়। এরকম করলে একেকবার অন্তত গোটা দশেক ডাকুর মাছ তো মারা যায়ই। আর গোটা দশেক ডাকুর মাছ মানে কম কীসে! অন্তত দুটো লোকের খাবারের জোগাড় তো বটেই!
এখানে নদী গভীর, কিন্তু চওড়া কম। জলে স্রোত আছে কিন্তু ঢেউ নেই। এপার ওপার একটা আড়খেয়া চলে সকাল থেকে সন্ধ্যে।ছোট ছোট ডিঙি নিয়ে লোকেরা দন ফেলে। একটা লম্বা দড়ির থেকে অনেক ছোট ছোট দড়ি ঝুলে থাকে, সেই দড়িগুলোর ডগায় একটা করে কাঁটা, তাতে টোপ লাগানো। দন ভাসিয়ে রাখার জন্য ভাঙা থার্মোকল, প্লাস্টিকের বল যে যা পায় জুড়ে দেয়। ছোট ডিঙি, বৈঠা নিয়ে ছপাস ছপাস শব্দ করে দন তুলতে যাওয়া হয়। কোনটায় ট্যাংরা, কোনটায় ভোলা, কোনটায় কুচভেটকি লেগে থাকে। অনেকে জাল ফেলে। চিংড়ি পারসে পড়ে। এই নদীর আসলে শুরুও নেই শেষও নেই। বরং একটা পেট আছে। সেখানে জল শান্ত তুলনামূলক। তাই কুমীরও থাকে। কুমীরের ভয়ে লোকে জাল ফেলতে যেতে চায় না। ভয় টা খুব বেশী হয় যখন কুমীর কাউকে তুলে নিয়ে যায়। তবে কিছুদিন পর আবার সব ঠিক হয়ে যায়, লোকেরা জাল ফেলে, মাছ ধরে, আবার নতুন কেউ কুমীরের শিকার হয়।
গত বছরের কথা। আষাঢ় শ্রাবণ মাস হবে। বিকেল গড়িয়ে সন্ধ্যে হয় হয়। ঝির ঝির বৃষ্টি চলছে। তার ওপর কোটাল। জাল ফেল্লেই চিংড়ি ট্যাংরা উঠবে। নান্টু জালানী, পঞ্চা ঘোড়ুই, ভানু মালো, গোবিন্দ রুইদাস, মনা পুরকাইত, উমেষ মণ্ডলরা জাল হাতে আর খেলুই কোমরে বেরিয়ে গেল। আধ ঘন্টা খানেক হয়নি। হঠাত চিৎকার। মনা পুরকাইতকে কুমীরে টেনে নিয়ে গেছে। চরে গোটা চারেক ডিঙি ছিল, সব কটাকেই টেনে নামানো হল, খোঁজ খোঁজ করে নদী উথাল পাতাল করে দিল সবাই, কিন্তু মনা পুরকাইতের খোঁজ পাওয়া গেল না। রাত শেষ হয়ে সকাল হল। মনা পুরকাইতের লাশ ভেসে উঠলো কামদেবপুরের ঘাটের কাছে। কিছু দিন জাল ফেলা বন্ধ হল। কিছু দিন। তারপর যে কে সেই। এটাই নিয়ম। এরকম করেই চলে দিনের পর দিন, বছরের পর বছর, যুগের পর যুগ।
নদী মানুষ এভাবেই সব একাকার হয়ে গেছে। সপ্তমুখি, হাতানিয়া দোয়ানিয়া, মৃদংগভাঙা সব মিলে মিশে এক। আলাদা জল নেই, রঙ নেই, আকার নেই। একই অংগ। কখনো সে উদ্দাম, কখনো ধ্যানমগ্ন ঋষি, কখনো রহস্যময় অন্ধকার। জীবন, মৃত্যু, জীবিকা। প্রান্তিক মানুষজনের বেড়ে ওঠা, জীবন দর্শন, মৃত্যু সব তাকে ঘিরে।