পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চোরাবালি‘-র ২৩তম পর্ব।
ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস
চোরাবালি(পর্ব-২৩)
সদরঘাট অফিসের ভিতরটা এখন শব্দহীন। বাইরে দুটো ট্রাক চুপচাপ দাঁড়িয়ে আছে, ড্রাইভার নেই সে গুলিতে। অফিসের বারান্দায় বসে আছে ড্রাইভার খোকন। আর অফিসের ভিতরে তিনজন, গদাই ঘোষ স্বয়ং, পিনু আর দেবু। গদাই ঘোষ মন দিয়ে এন্ট্রি খাতার পাতা একটা একটা করে উল্টে যাচ্ছে আর মন দিয়ে দেখে যাচ্ছে। দেবু আর পিনু চুপচাপ বসে আছে সামনের চেয়ার দুটোয়। বাইরে ভর দুপুরের রোদে ভেসে যাচ্ছে ঘাট অফিস চত্ত্বর থেকে চর অবধি। নদীর পাড়ের ঝুপড়িগুলোর কোনো একটা থেকে তারস্বরে ভোজপুরি গান বেজে চলেছে। বেশ কিছুক্ষণ মনোযোগ দিয়ে খাতা দেখার পর গদাই ঘোষ মুখ তুলে তাকালো পিনুর দিকে সরাসরি।
“যা দেখছি লাগাতার তিন মাস ধরে লোডিং কমছে! এর মানে কি পিনু? পার্টি বালি কিনছে না নাকি লোকে বাড়িঘর করা কমিয়ে দিয়েছে!” আপাত দৃষ্টিতে ভাব-লেশহীন মুখে অথচ ঠান্ডা গলায় কথাগুলো বলে গদাই ঘোষ পিনুর দিকে তাকিয়ে থাকে।
“স্যার… সেরকম তো লোডিং কম মনে হয়নি !… মাঝে একটু ডাউন ছিলো কিন্তু…” পিনু জবাব দেয়।
“পিনু…এ লাইনে আমার অনেক বছর হলো… লোডিং কম হচ্ছে যখন বলেছি তখন লোডিং কমেছে বলেই বলছি।” আরও বরফ শীতল গলায় বলে ওঠে গদাই ঘোষ। পিনু কিছু জবাব খুঁজে না পেয়ে উসখুস করতে থাকে। দেবু চুপ করে থাকে, এর মাঝে তার কথা বলার কিছু নেই।
“তোমার কি মনে হচ্ছে দেবু! লোডিং কেন কম হচ্ছে?” হঠাৎই দেবুর দিকে তাকিয়ে প্রশ্ন করে গদাই ঘোষ। দেবু একটু চমকে মুখ তুলে তাকায় গদাই ঘোষের দিকে। দেবুও দেখেছে একটু করে হলেও লোডিং কমছে। আগের রেকর্ড দেখলে সেটা ভালই বোঝা যায়।
“স্যার আমার মনে হয় পার্টি কমছে লোডিং এর…মানে কেউ কেউ মাইনাস হয়ে যাচ্ছে, আগে আসতো এখন আসছে না” দেবু যা মনে হয়েছে বলে ফেলে সবটাই।
“হুম… কি রকম সেটা?” গদাই ঘোষ স্থির চোখে তাকিয়ে থাকে দেবুর দিকে।
“যেমন স্যার সামন্ত বিল্ডার গত এপ্রিলে আট গাড়ি মাল নিয়েছে, এ মাসে তিন গাড়ি মোটে… এরকম আরও আছে স্যার…”
“কি পিনু… বলছিলি যে সব ঠিক আছে! …সামন্তরা কেন মাল কম নিচ্ছে খোঁজ নিয়েছিস নাকি এখানে বসে সন্ধ্যে বেলায় রামের পাঁইট ওড়ালেই হবে?” এবার ঝাঁজ টের পাওয়া যায় গদাই ঘোষের গলায়।
“না…মানে স্যার…আমি দেখছি…” পিনু আমতা আমতা করতে থাকে। মনে মনে বেশ রাগও হয় , দু’দিনের যোগী এই দেবু বেশি জেনে গেছে! …ওকে বেকার ফাঁসালো…।
“হ্যাঁ দেখো … কেন মাল কম নিচ্ছে ! কিসে প্রবলেম হচ্ছে … যারা কমিয়েছে তাদের সবার সঙ্গে কথা বলো , কিসে প্রবলেম, রেটে নাকি ডেলিভারিতে না কোয়ালিটিতে! …কোনো কিছুতেই হওয়ার কথা নয়… খুঁজে বের কর অন্য কোনো কারণ আছে নাকি। এখানে বসে শুধু ম্যানেজারি মারালে হবে না বুঝলি?” গদাই ঘোষের গলা বেশ চড়েছে এবার, খোকনও উঠে এসে দাঁড়িয়েছে দরজায় চুপচাপ গদাই ঘোষের গলার আওয়াজে। বাইরে ভোজপুরি গানের তোড় এখন বন্ধ হয়ে গেছে , শুধু একটা কুকুর চিৎকার করে চলেছে।
“দেবু, তুমি এন্ট্রির খাতা থেকে মার্কিং করে বের করো কারা মাল নেওয়া কমিয়েছে। একটা লিস্ট করে পিনুকে দেবে ঠিক আছে?” গদাই ঘোষ দেবুর দিকে তাকিয়ে নির্দেশ দিতে থাকে। দেবু নিঃশব্দে মাথা নেড়ে সম্মতি দেয়, আড় চোখে একবার পিনুদার দিকে দেখে নেয়, পিনুদার মুখটা থমথম করছে। কে জানে ওর উপর বেশ খচেই যাবে মনে হয়! কিন্তু যা দেখেছে তাই বলেছে দেবু।
“আগামী তিন দিনের মধ্যে আমার রিপোর্ট চাই পিনু মনে থাকে যেন… আজ থেকেই কাজ শুরু কর।”
বাইরে গাড়ির হর্ণের আওয়াজ পাওয়া যায়, রমেশ, গদাই ঘোষকে এখানে নামিয়ে গ্যারেজে গেছিলো গাড়ির কাজ করাতে। গাড়ি সব সময় মেন্টেনেন্সে রাখে রমেশ, গদাই ঘোষের সে রকমই নির্দেশ দেওয়া আছে। গাড়িতে কোনো রকম আওয়াজ বা অসুবিধা একদম বরদাস্ত নয় তাঁর।
“আমি উঠছি, রমেশ এসে গেছে, আমায় মিলে যেতে হবে। যা বললাম করে রাখা হয় যেন…আর হ্যাঁ দেবু , কাঠ গোলার এন্ট্রিটাও চেক করবে আজ কালকের মধ্যেই…” গদাই ঘোষ কথা শেষ করে উঠে দাঁড়ায়। হাতের মোবাইলে একবার চোখ বুলিয়ে অফিস থেকে বেরিয়ে গাড়িতে উঠে পড়ে। টেবলে রাখা চা জুড়িয়ে গেছে ততক্ষণে, গদাই ঘোষ একটা চুমুকও দেয়নি তাতে। একটা আওয়াজ তুলে গাড়িটা ঘাট অফিস ছেড়ে বেরিয়ে যায়।
অফিসটা থমথম করতে থাকে। পিনু বসেই থাকে গোঁজ হয়ে। ওর বেশ প্রেস্টিজে লেগেছে আজ… কালকের ছেলে, যাকে ওই সব শেখাচ্ছে তার সামনেই স্যার এরকম কড়কে দিল! …আর এ মালটাও ঢ্যামনার এক সের… এমন করে বলল যেন কত জানে শালা…!
“এই যে চাঁদু… দুদিনে সব জেনে বসে আছো! মাল কম টানছে পার্টি… আমি কি তাহলে এতদিন ঘাস ছিঁড়লাম!”
“পিনুদা…মাইরি বলছি আমি দেখেছি এন্ট্রির খাতা সারার সময় বিশ্বাস করো… তুমি বেকার রেগে যাচ্ছো” দেবু পিনুকে শান্ত করার চেষ্টা করে।
“না শালা… এসব শেয়ানাগিরি আমি জানি! মালিকের কাছে এক্সপার্ট সাজা …আমায় ডাউন করা…আমি কি গান্ডু? কিছু বুঝিনা!” বেশ গলা চড়িয়েই বলতে থাকে পিনু।
“আরে ভাই পিনু কি হচ্ছে! এত খচে যাচ্ছো কেন?… দেবু ভাই তো যা দেখেছে তাই বলেছে! এতে তুমি ডাউন খাচ্ছো কোথায়?” এতক্ষণ চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকা খোকন এবার বলে ওঠে।
“নাঃ শালা… আমায় বোঝাতে এসো না…তুমিও শালা…”পিনু ফুঁসতে থাকে।“
“আরে পিনুদা আমি তোমায় ডাউন করব! আমি কদিন এসেছি? তুমিই তো কাজ শেখাচ্ছো আমায়… আরে বাবা লোডিং কম হলে আমাদের সবার লস! তাই…” দেবু পিনুর আরও একটু কাছে সরে এসে শান্ত গলায় বলে।
“ওসব ছাড়ো পিনু ভাই… স্যার চলে গেছেন…আজ সন্ধ্যেয় পাঁইটের দায়িত্ব আমার, চাখনাও আমি আনব, ইস্পেশাল, চুস্তার ঘুগনি… একবার চেখে বোলো কেমন শুধু।” খোকন এগিয়ে এসে পিনুর কাঁধ দুটো ধরে ঝাঁকিয়ে দেয়। পাঁইটের কথা শুনে পিনুর রাগ রাগ মুখটা কিছুটা হালকা হয়ে আসে। খোকনও জানে পিনু মাথা গরম হলেও চট করে ঠান্ডাও হয় আর ওকে ঠান্ডা করার এটাই মোক্ষম দাওয়াই।
গদাই ঘোষের গাড়ি তখন বাঁকুড়া মোর ভেঙে ডান দিকে মিলে দিকে অনেকটাই চলে এসেছে। গাড়ির ঘেরা টোপের ভিতরে গদাই ঘোষের চিন্তা তবু কমছে না! কি ব্যাপার জানতেই হবে, কেন মাল কম উঠছে! ব্যবসায় ঢিলা দেওয়া একদম নাপসন্দ তার। অনেক কষ্ট করে এই জায়গা তৈরি করেছে গদাই ঘোষ, তার সাম্রাজ্যে একটুও ছায়া পড়া সে সহ্য করতে পারবে না। এই দেবু ছেলেটা বেশ স্মার্ট! ঠিক রোগটা ধরেছে। পিনু এতদিন ধরে কাজে থাকলেও বেশ ঢিলে, তবে গদাই ঘোষের অনুগত ও বিশ্বস্ত সে বিষয় সন্দেহ নেই কোনও। কিন্তু ওকে রগড়ে কাজ করিয়ে নিতে হয়। এই দেবুটাকে কাজে লাগাতে হবে ভালো করে। ছেলেটার মাথা পরিষ্কার, আর কথা বলতে ভয় পায় না।
মিলের সামনে গাড়ি গিয়ে হর্ণ দিতেই বজরং এসে গেট খুলে দাঁড়ায়। অফিস থেকে সনাতনও বেরিয়ে আসে, সনাতনও গতকাল থেকেই কাজে জয়েন করেছে। ওর বউ-র অপারেশন হয়ে গেছে , এখন ভালো আছে।
হাসি মুখে সনাতনকে দেখে গদাই ঘোষের মনটা একটু হালকা হয়। এই লোকটা তার বিশেষ পছন্দের। কিছু লোক থাকে, যাদের চোখ বন্ধ করে বিশ্বাস করা যায়, সনাতন সে রকমই একজন।
“কেমন আছো সনাতন? বৌমা কেমন আছে?…” হেসে জিজ্ঞেস করে গদাই ঘোষ।
“আজ্ঞে স্যার ভালো আছে আপনার বৌমা… ঠাকুরের কৃপায় সব ভালোয় ভালোয় মিটেছে স্যার…” বিগলিত হাসি আর নিখাদ আনুগত্যের ছাপ সনাতনের চোখে মুখে ফুটে ওঠে। গদাই ঘোষ সনাতনের কাঁধে হাত রেখে মিলের অফিসের দিকে এগিয়ে যায়। মিলের ভাত ভাত গন্ধ মিলের চত্বর পেরিয়ে ছড়িয়ে পড়তে থাকে চরাচরে।
লেখা পাঠাতে পারেন
আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন–
ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“চোরাবালি(পর্ব-২২)”