ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী–র ধারাবাহিক উপন্যাস
চোরাবালি(পর্ব-২১)
খোকন আঁজিরবাগানের ভিতর দিয়ে ট্রাকটা ধীরে ধীরে নিয়ে এসে বাঁধে তুলল। আঁজিরবাগানের রাস্তায় আর বাঁধের উপর এলাকার বাচ্চা ছেলে গুলো খেলে বেরায়। এলাকার লোকজনের প্রাত্যহিক যাপনের অনেকটাই এই বাঁধের রাস্তার আসেপাশে। দুবার ব্রেক কষে ঝাঁকুনি দিয়ে ট্রাক থামাতে হয়েছে খোকনকে বাঁধের উপরে আসতে , একটা বছর দশের ছেলে টায়ার চালাচ্ছিলো লাঠি দিয়ে গড়িয়ে গড়িয়ে। সাবধানে বাঁধের উল্টোদিকে ঢালে ট্রাক নামাতে থাকে খোকন। টায়ার চালানো দেখে ওর নিজের ছোটবেলার কথা মনে পড়ে যাচ্ছিল! ওরাও দল বেঁধে টায়ার চালাতো লাঠি দিয়ে মেরে মেরে , তার সঙ্গে ছুট লাগাতো খালি পায়ে গ্রামের ধুলো রাস্তায়। সেসব অনেকদিন আগের কথা! ভাবতে ভাবতে খোকনের মনটা হালকা হয়ে উঠলো। আজকাল আর শহরে তো নয়ই, গ্রামে গঞ্জেও টায়ার চালাতে বাচ্চাদের দেখা যায় না! সব পালটে গেছে সময়ের সাথে সাথে। এখন যেন বড় দ্রুত গতিতে সবকিছু পালটে যাচ্ছে।
ঢালটার বাঁ ধারে একটা মন্দির, মন্দিরে চারপাশে একটা চত্বর মতো রয়েছে ফাঁকা। এখানেই ফি বছর পৌষ মাসে ঘুড়ির মেলা বসে। কাঠ গোলা ঘাটের মেলা নামেই বিখ্যাত সেটা, তখন গমগম করে এলাকাটা। ঢাল দিয়ে নেমে কিছুটা বালি রাস্তায় বাঁ ধারে আরও একটু যেতেই কাঠগোলা ঘাটের অফিসে। অফিসে এখন বুধুয়া থাকবে, নিয়ামত ভাইও থাকতে পারে। নিয়ামত ভাইয়ের কাছে ভাবির খবর নিতে হবে, শুনেছে অবস্থা ভালো নয় ভাবির।
ট্রাক রেখে লাফিয়ে নেমে আসে খোকন, বেলা পড়ে এসেছে অনেকটাই এখন। একবার নদীরে চরের দিকে তাকায়, মৃয়মান রোদে দামোদর কেমন ঘোলাটে লাগছে। ওপাড়টা ধোঁয়া ধোঁয়া হয়ে রয়েছে। কাঠের অস্থায়ী সাঁকোটা দিয়ে মানুষ এপাড় ওপাড় করছে, হেঁটে , সাইকেলে।
অফিসে ঢুকতেই দেখে বুধুয়া একটা চেয়ারে পা তুলে মুখের উপর গামছা ঢাকা দিয়ে ঘুম মারছে। খোকন গিয়ে পায়ের নিচের চেয়ারটা আচমকা টনে নিতেই ধড়মড় করে উঠে বসলো বুধুয়া। ওর হাল দেখে খোকন না হেসে পারল না। ব্যাটা এখানে দিব্বি ভাতঘুম মারছে!
“আরে… খোকন ভাই… হরন দাওনি তো!”
“ইচ্ছে করেই দিইই নি… দিলে তোর এই ঘুম মারার সিন দেখতে পেতাম?”
“কি করব! সকাল থেকে যা লোডিং হয়েছে হয়েছে, এখন খালি, আর খালি বসলেই নিদে একবারে জুড়িয়ে আসে গো…”
“দাঁড়া… তোর হচ্ছে! স্যারকে বলব…”
“এইইই নান না খোকন ভাই এরকম কোরো না! স্যার আমার গর্দান নিয়ে লিবে গো…”
“আচ্ছা বলব না… ভালো করে চা খাওয়া এককাপ তাহলে… আচ্ছা নিয়ামতভাই কোথায় রে!”
“সে খাওয়াচ্ছি… নিয়ামত ভাই তো এসেছিলো! দেখো নৌকোর পিছনে লেগে আছে মনে হয়…”
খোকন অফিসের জানালা দিয়ে দূরে নদীর চর বরাবর দেখতে লাগল। হ্যাঁ ঠিকই বলেছে বুধুয়া! দূরে একটা নৌকা দেখা যাচ্ছে জলের ধারে, সঙ্গে একটা প্রমান মাপের মানুষ কিসব করছে নৌকার গায়ে, দূর থেকে নৌকা আর মানুষ একটাই কালো ছায়ার মতো লাগছে, মানুষে আর নৌকায় যেন মিশে গেছে! ।নিয়ামত ভাইয়েরও এই নৌকাটা জানের থেকেও প্রিয় একথা খোকন জানে।
বুধুয়া চা করতে বাইরের চালার নিচে গেছে, যাক একবার যখন দেখা গেছে নিয়ামতভাইকে তখন বুধুয়ার চা খেয়ে একবার দেখা করে খবর নেবে খোকন ভেবে রাখে। লোকটাকে খোকন বেশ শ্রদ্ধা করে, এককথার মানুষ। একসময় বেশ তেজালো ছিলো, পাঁচজনে ভয় করতো, এখন বয়সে নুজ্ব্য হলেও মাঝেমধ্যেই সে তেজ বেরিয়ে আসে খোকন দেখেছে।
চা খেতে খেতে খোকন এদিক ওদিকে দেখতে থাকে। এ অঞ্চলের দৃশ্য যা ওর অনেকদিনেরই পরিচিত, এখানে গাড়ি নিয়ে আসছে তা তো কম দিন হলো না! তারও আগে ট্রাকটার ট্রলি নিয়ে, তারপর খালাসির কাজ থেকে এখন ড্রাইভার, পথ নেহাত কম নয়। মাঝে মধ্যে বাঁধের ওপাড়টায় ঝুপড়ি হোটেল খেয়েওছে অনেকদিন। যেতে আসতে কলপাড়ের একসময় জোয়ান মরদ–মেয়েছেলেকে আস্তে আস্তে বুড়িয়ে যেতেও দেখেছে! বাচ্চাগুলো চোখের সামনে জোয়ান হয়েছে, কানের উপর চাঁচা চুল আর বেয়াড়া চেহারায় তাদের চোখের চাহনি যেন কেমন একটা অস্থির অস্থির, ঘোলাটে। নেশায় হাতেখড়ি হয়েছে অনেক আগেই, কোথা থেকে যেন পকেটে মোবাইলও বড় বড় জুটে গেছে!…এক একটা জটোলায় সবাই বুঁদ হয়ে আছে ফোনের পর্দায়। অথচ এদের বাপকাকাদের ভাঙা সাইকেলও ছিলো অনেকের। খোকনরা নিজেরা কি কম নেশা করেছে! কিন্তু কম বয়সে বিড়ি, আর বেশ খানিক বড় হওয়ার পর পাশের গঞ্জের শুঁড়িখানায় চোলাইয়ে হাতেখড়ি। কিন্তু এরা …ইংলিশ ছাড়া দিন কাটায় না! কোথা থেকে যেন জুটে যায় ঠিক।
হিজিবিজি ভাবতে ভাবতে খোকনের চোখ যায় নিয়ামতভাইয়ের নৌকার দিকে। যাঃ।লোকতা গেল কোথায় ? নেইতো নৌকায়! এদিক ওদিক দেখতেই চোখে পড়ল খালের ঢালের কাছে বড় পাইপের যে নালামতো রয়েছে সেখানে নিয়ামতভাই উবু হয়ে বসে কি করছে ।খোকন পা চালিয়ে এগিয়ে গেল নিয়ামতভাইয়ের দিকে।
এখানটায় সারা বছর ভিজে স্যাঁতসেতে হয়ে থাকে। পাড়ের জল বাঁধের তলা দিয়ে এদিকে এসে জমে থাকে। জমা জল কালো হয়ে আছে, চ্যাঁ আর ডাঁরকে মাছের আনাগোনা আর মশার ভনভনানি।
“এখানে বসে করো কি! ও নিয়ামতভাই…” খোকন হাঁক পেড়ে বলে।
নিয়ামত ভাই একটু চমকে ঘাড় ঘুরিয়ে খোকনকে দেখে একটু হাসির মতো মুখভঙ্গী করে।
“আরে…খোকন যে ! আরে এখানে বসে কি করি… এই দেখো… ”বলে একগোছা সদ্য তোলা সবুজ কলমি শাকের দিকে ইসারা করে নিয়ামতভাই।
“ আরে …বাহ এখানে তো আগাছাই আছে জানতাম …”
“ আগাছাই তো! …তারই মাঝে কলমি ,কুলেখাড়া আছে , এ খবর অবশ্য বাঁধের লোক জানে না! জানলে ন্যাড়া হয়ে যেত এতদিনে।”
খোকন বালিঘাসের উপরই থেবরে বসে পড়ে নিয়ামতভাইয়ের সামনে। নিয়ামত ভাই লুঙ্গির কোঁচড় থেকে বিড়ির বান্ডিল বের করে একটা বিড়ি বাড়িয়ে ধরে খোকনের দিকে।
“ভাই বলেন ভাবির খবর কি? কেমন আছে?”
প্রশ্ন শুনে কয়েক মুহুর্ত নিয়ামতভাই খোকনের মুখের দিকে তাকিয়ে থাকে। দামোদরের উপর দিয়ে আলগা দলছুট কোনো মেঘের ছায়া যেন পড়ে অজস্র বলিরেখা আঁকা মুখের উপর। একটা আস্ত মানুষের মুখের রেখা তো শুধুই রেখা নয়! প্রতিটা রেখা নানা কাহিনি, নানা সংঘর্ষের সাক্ষ্য বহন করে চলে।
“ভালোনাই গো খোকোন… ভালো নাই” ঘোলাটে চোখে অব্যক্ত যন্ত্রণা্র আবছা ছবি ফুটে ওঠে ঘষা স্লেটের মতো।
“সেকি ! এইতো সেদিন বললে দক্ষিনে নিয়ে যাবে ছেলে …” খোকনের কন্ঠস্বরে উদ্বেগ স্পষ্ট।
“সেতো মুম্বাই থেকে ছেলে ফিরলে… আর তাছাড়া ডাক্তারও বলেছে ওই…ফোরোত ইস্টেজ…”
“কোথায় দেখাচ্ছো?”
“এখানেই… সরকারিতে… একুশদিনে একবার করে সুই ফুঁড়িয়ে চিকিচ্ছে হচ্ছে, নানা ওষুধ ঢোকাচ্ছে রক্তে”
“এখন কেমন আছে?” খোকনের নিজের কানেই নিজের করা প্রশ্নটা অর্থহীন লাগে!
“ওই …দিন দিন শুকিয়ে যাচ্ছে, মাথার চুল উঠে গেছে সব… ফ্যাকাসে পারা হয়ে গেছে, ওর লেগেই তো কুলেখাড়া…”
“ভালো ভালো… কুলেখাড়ার রসে রক্ত হবে” খোকন শব্দ হাতড়াতে থাকে বলার জন্য। কি যে বলেবে লোকটাকে বুঝে উঠতে পারে না। এরকম সময় কি বলা উচিত তা ওর জানা নেই। মানুষের অদৃষ্টে যে কি লেখা থাকে কে জানে! এই লোকটার দু দুটো জোয়ান ছেলে, একটা গুজরাতে তো আর একজন মুম্বাইয়ে পেটের ধান্দায় পড়ে আছে। তারা কালে ভদ্রে আসার সুযোগ পায়, আর এই লোকটা লড়ে যাচ্ছে একা!
খোকনের হঠাৎই ওর বউ ছেলে মেয়ের কথা মনে পড়ে। তারও তো একটা সংসার আছে, মাঝে মধ্যে নিজেই ভুলে যায়। যদিও ইন্দাস এমনকিছু দূরে নয় তবুও যাওয়া হয় কোথায়! যখনই যায় দেখে ছেলেটা আরও একটু যেন লম্বা হয়ে গেছে।
“বুঝলে খোকন মিঁইয়া… এ কাল রোগ যার বাড়িতে ঢুকবে সব কিছু নিংড়াইয়ে একেবারে ছিবড়া করে দিবে!… কষ্ট কি শুধু যার হয় তারই! বাকিরাও শুকিয়ে যাবে…”
খোকন চুপ করে থাকে। এসব কথার কিছু উত্তর হয়না। হাসপাতালের আউটডোরে যাওয়ার অভিজ্ঞতা রয়েছে। শ’য়ে শ’য়ে হাজারে হাজারে মানুষ কেমন পাংশু মুখে সরকারি হাসপাতালের বিনামুল্যের পরিষেবাটুকু পেতে কেমন হত্যে দিয়ে পড়ে থাকে ওর জানা আছে। তাও তাদের ঘটি বাটি পর্যন্ত বিকিয়ে যায় জীবনের কটা দিন কিনতে!
বেলা ঢলে এসেছে। নিয়ামতভাই আর খোকন হলদে থেকে কমলা হেয়ে আসা দামোদরের উপরের আকাশ দেখতে দেখতে বিড়িতে টান দিতে থাকে। একসময় উঠে ঘাট অফিসের দিকে হাঁটা লাগায় দুজনে, নিয়ামতভাই আজ ঘাট অফিসেই থেকে যাবে কাল সকাল সকাল বোট ছাঁকনি নিয়ে বেরবে অন্ধকার থাকতেই। খোকন একবার সদর ঘাট অফিস হয়ে ডেরায় ফিরবে, দেবু বাবুর খবর নেওয়া হয়নি অনেকদিন। শুনেছে খুব তাড়াতড়ি নাকি কাজ শিখে নিচ্ছে দেবু বাবু। ট্রাক এখানেই রেখে যাবে ,কাল সকালে লোডিং হবে। খোকোন একটা ভ্যান রিক্সা ঠিক ম্যানেজ করে নেবে। বাঁধে বাঁধে সদরঘাট আর কতক্ষন!
অন্ধকার বাঁধের উপর টিম টিম করে আলো জ্বলছে, আলোর নিচে ফুট কুড়ি সে আলোয় আলোকিত, তারপরেই অন্ধকার। খোকন দ্রুত পা চালায়…
ক্রমশ…
আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন–