ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস “চোরাবালি”(পর্ব-২০)

পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চোরাবালি‘-র ২০তম পর্ব।

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস

চোরাবালি(পর্ব-২০)

ছাদের উপর থেকে শ্যামলাল কলোনি ছাড়িয়েও অনেকটা দেখা যায়। নন্দিতা অভ্যাস মতো একবার স্নান সেরে রোজ ছাদে আসে সাধারনত। ভিজে জামাকাপড় মেলার সঙ্গে সঙ্গে ছাদে এসে দাঁড়ালে সব সময়েই ওর একটা ভালো লাগা চারিয়ে যায় শরীরে মনে। আকাশটা অনেকটা বড় লাগে, বেশ কিছুটা দূর পর্যন্ত দেখা যায়। ওদের এদিকে গাছপালার পরিমান বেশ ভালই। শহরের মুল রাস্তাগুলো থেকে একটু ভিতরের দিকে বাড়ি বলে রাস্তার সোরগোলও কম।
আপন মনে ভিজে চুলে আঙুলের বিলি কাটতে কাটতে ছাদের পাঁচিলে ভর দিয়ে দাঁড়ায় নন্দিতা। কিছু কি ভাবছে! কি যে ভাবছে সেটা নিজেও জানে না। চমকে দিয়ে একটা টিয়ার ঝাঁক তীব্র ডাকতে ডাকতে কাছেই কৃষ্ণসায়রের দিক থেকে উড়ে গেল ওদের ছাদের উপর দিয়ে। লম্বা লেজ, গাঢ় সবুজ, লেজের প্রান্তে কালো দাগের এই জংলা টিয়ার ঝাঁক এখানে প্রচুর। ইউনিভার্সিটির রাজবাড়ি অফিসের যে বিশাল মেহগনি গাছটা আছে ওটার নিচে পরন্ত বিকেলে একবার নন্দিতা দাঁড়িয়ে ছিলো, শয়ে শয়ে টিয়া্র ডাকে কানপাতা মুশকিল হয়ে যাচ্ছিলো। এ শহরে টিয়ার সংখ্যা প্রচুর, রাজবাড়ি ক্যাম্পাস, গোলাপবাগ ক্যাম্পাস, রমনা বাগান…থাকার আর বেড়ে ওঠার কত জায়গা! আরও অনেক পাখিই আছে বর্ধমান শহরে, বক, প্যাঁচা, ফিঙে, মাছরাঙা, পানকৌড়ি… আরও কত! গাছপালা, দিঘি সবই রয়েছে এখানে, বাতাসে দুষণ কম। কারন এখানে সেভাবে কলকারখানা নেই। মুলত চাষ এবং চাষাবাস কেন্দ্রিক শিল্পই কিছু রয়েছে, তাও রাইসমিল আর বড়জোর কোল্ড স্টোরেজ। তাই শিল্প তালুক না হওয়া দুষণ থেকে বাঁচিয়েছে এই শহর বর্ধমানকে।
কিন্তু এ শহরটাও বদলে যাচ্ছে দিনে দিনে! প্রাচীন বনেদি গন্ধ খসে পড়ছে শহরের গা থেকে। যে গন্ধ লেগে আছে এ শহরের দুশো আড়াইশো কিংবা আরও পুরোনো বিশাল বিশাল জানালা দরজার ইমারত গুলোয়, কিছু এলাকার সামান্য কিছু এরকম প্রাচীন বাড়ি রয়ে যাচ্ছে ক্রমশ। সরিকি ঝামেলায়, যুগ্ম পরিবারের যুগের অবসানে সেইসব বড় বাড়ির মোটা মোটা দেওয়াল ভেঙে নতুন একাধিক বাড়ি উঠছে কিংবা ফ্ল্যাট কমপ্লেক্স হচ্ছে। বাড়ি থাকছে, কিন্তু এমনি পড়ে থাকা বাগান বা উঠোনের বনেদি বিলাসিতা ক্রমে লোপ পাচ্ছে। পাখিও কি কমছে না! নন্দিতার তো মনে হয় কমছে… চড়ুই কমে গেছে আজকাল অনেক। বউকথাকও কতদিন দেখেইনি ও! গাছ কমছে, নতুন গড়ে ওঠা শহরের দুই প্রান্তে তো গাছের অভাব লক্ষ্যনীয় ভাবে কম। যা ছিলো তা কেটে ফেলা হয়েছে উন্নয়নের দোহাই দিয়ে।
আরে! নন্দিতা একটু ঝুঁকে ভালো করে দেখতেই বুঝলো একটা মা বেজি গোটা তিনেক ছানা নিয়ে ওদের বাগানটা পেরিয়ে পাশের ঝোপটার ভিতরে ঢুকে গেল। নন্দিতার মুখে আপনা থেকেই একটা ভালোলাগার হাসি খেলে গেল। তবু কিছু কিছু প্রানী, এই বেজি বা নেউল, এদের মতো মানিয়ে নিয়ে থেকে গেছে শহরের আনাচে কানাচে।
নাঃ অনেক্ষন হলো ও ছাদে এসেছে, এখুনি মা ডাকবে বা ঠাকুমা নড়তে নড়তে উঠে আসবে! নিচে যাওয়া দরকার। তাছাড়া ওকে বেরতেও হবে আজ , একবার কলেজ হয়ে উল্লাসে হাউসিং এ যাবে ওখানে ওদের সবুজ পাঠের একটা মিটিং আছে।
“বনি তুমি আজ একটু সকাল সকাল বেরচ্ছো মনে হচ্ছে!” ঠাকুমা মোটা ফ্রেমের চশমার ওপার থেকে প্রশ্ন করে। নন্দিতা তখন রেডি হয়ে ব্রেকফাস্টের জন্য খাওয়ার টেবলে এসে বসেছে।
“হুম… কলেজে যাবো ,তারপর একটা কাজ আছে…”
“সেইতো … তা কি কাজ একটু জানতে পারি !”
“নিশ্চয়ই জানতে পারো … সবুজ পাঠের একটা মিটিং আছে… তোমার এনকোয়্যারি সম্পূর্ণ হয়েছে?” নন্দিতা ঠাকুমার দিকে সোজাসুজি তাকিয়ে উত্তর দেয় ।
“আহা…রাগ করোছো কেন দিদিভাই…আমি এমনি জানতে চাইছিলাম…”
“হ্যাঁ এ বাড়িতে সবাই সব খুটিনাটি এমনিই জানতে চায়…” মেয়োনিজ দেওয়া স্যান্ডুইচে বড় একটা কামড় দিতে দিতে বলে নন্দিতা।
“বেশ বাবা আর কিছু কোনোদিন জিজ্ঞেস করবো না” ঠাম্মির কি অভিমানে একটু গাল লাল হয়ে উঠল! নন্দিতা আড়চোখে বোঝার চেষ্টা করে। খাওয়া শেষ করে উঠে এসে দাঁড়ায় ঠাকুমার সামনে, অজস্র কাহিনীর বলিরেখা আঁকা ঠাম্মির টুকটুকে গাল দুটো টিপে দেয়।
“কেন জিজ্ঞেস করবে না ! তুমি তো জিজ্ঞেস করবেই সে আমিও জানি আর আমিও গোঁসা দেখাবো…”
“ছাড় ছাড়…শয়তান মেয়ে…আজকাল আমায় কিছু বলো না তুমি !”
“ভালো করি… মেয়ে বড় হয়েছে জানোনা!” হাসতে হাসতে নন্দিতা নিজের ঘরে ঢুকে ব্যাগ নিয়ে বেরিয়ে একবার রান্না ঘরে মায়ের সঙ্গে দেখা করে দরজা ঠেলে বেরিয়ে আসে বাড়িতে থেকে। একটু হাঁটতে হবে ওকে, তারপর টোটো ধরে কলেজমোড়।
এইসময় শহরের বেশিরভাগ রাস্তায় জ্যাম লাগে, টোটোওয়ালা সর্বমঙ্গলা মন্দির হয়ে ভাতছালা হয়ে ভিতরে ভিতরে ওকে কলেজমোড়ে পৌঁছে দেয়।
একটু হেঁটে কলেজের গেট পেরিয়ে ক্যাম্পাসে ঢুকে যায় নন্দিতা। কে জানে দেবু এসেছে কিনা! কলেজে পা দিতেই ওর কথাই মনে পড়লো নন্দিতার। কি যে করছে ছেলেটা… কলেজে পড়তে পড়তে কেউ কাজে ঢোকে! গত দিন পাঁচ সাত দেবুর সঙ্গে দেখাও হয়নি, এমনকি ফোনে কথাও হয়নি। কে জানে কাজের জায়গায় কেমন লাগছে ওর! নন্দিতা ভেবে পায়না এতো কেন ও ভাবছে দেবুকে নিয়ে!…দূরে নাজমাকে দেখে পায়ের গতি বাড়িয়ে নাজমার পিঠে আলোতো টোকা দিতেই নাজমা চমকে উঠলো।
“কি ব্যাপার ডার্লিং এতো অন্যমনস্ক কেন!” নন্দিতা চোখ টিপে জিজ্ঞেস করে।
“কই…! ছাড়তো …তোর আর কাজ নেই না! তোর কি খবর বল, লিডারগিরি চলছে?” নাজমা দুহাত দিয়ে নন্দিতার দুহাত ধরে অল্প ঝাঁকায় হাসতে হাসতে।
“লিডারগিরি! …উফ পারিস তোরা… আমাদের কোনো লিডার নেই, আবার সবাই লিডার বলতে পারিস।”
দুজনে আরও কিছু কথা অনর্গল বলতে বলতে ক্লাশরুমে ঢুকে যায়। কলেজের কর্কশ বেলটা জানান দেয় সময়ের।

দেবু তখন পিনুদার নির্দেশ মতো ট্রাকের নাম্বার নোট করে কত টন লোড হচ্ছে সে সব লিখতে ব্যাস্ত। সকাল থেকে আজ লোডিং দেওয়া গেছে ভালোই। ছয় ট্রাক লোডিং হয়েছে এখনও পর্যন্ত, বেলা গড়াতে গড়াতে এটা বারো চোদ্দো ট্রাক হয়ে যাবে পিনুদার আন্দাজে। তারমধ্যে খুব বেশি হলে গোটা পাঁচেক ট্রাকের টোকেন কাটা হবে আর একনম্বর খাতায় তার এন্ট্রি হবে। এই কাজটা পিনুদাই করবে, ওটা এখন দেবুর হাতে ছাড়া যাবে না আরও অন্তত কিছুদিন।
দেবুর এমনিতে মন্দ লাগছে না কাজে লেগে। কিন্তু মাঝে মধ্যেই কলেজের গমগমে পরিবেশ, ক্যান্টিনের হৈ চৈ ও মিস করছে। মাঝে মধ্যে কলেজ যে যেতে হবে সেটা পিনুদাকে বলে রেখেছে। এখান থেকেই চলে যাবে আবার ফিরে এসে কাজ গুছিয়ে দেবে। এটা পিনুদা আর ওর মধ্যে একটা অলিখিত চুক্তি হয়েছে বলা যায়। বদলে বিশেষ কিছু নয়, মাসে একটা রামের পাঁইট দিতে হবে ভালোবেসে পিনুদাকে নিজের মাইনে থেকে। দেবুর রাজি না হওয়ার কিছু নেই, এতো সামান্যই নজরানা!
এখন সবে এক সপ্তাহ হয়েছে এখনও কুড়ি বাইশ দিন বাকি ওর মাইনে পেতে! মাইনে পাওয়ার সাম্ভাব্য দিনটার কথা মনে করে দেবুর মনটা হালকা হয়ে থাকে। আরও দুটো ট্রাক লোডিং নিয়ে ঘরঘর আওয়াজ করতে করতে আসছে অফিসের দিকে। দেবুর সামনে এসে দাঁড়িয়ে ড্রাইভার গোঁ গোঁ করে ইঞ্জিন রেইজ করে ট্রাক থামিয়ে দাঁড়ায়। ট্রাকের নাম্বার নোট করতে করতে দেবু লক্ষ্য করে চকচকে বনেটের উপর লেখা
“বুরি নজর ওয়ালে তেরা মুহ কালা”…

ক্রমশঃ…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস–“চোরাবালি”(পর্ব-১৯)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *