ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস– “চোরাবালি”(পর্ব-১৬)

পরিচিতিঃ ইন্দ্রনীল বক্সী, “জন্ম – নকশাল পিরিয়ডে ..৭৩ এ দুর্গাপুরে , উচ্চতা মাঝারি, গায়ের রঙ মাজা, গাঁয়ে মানে না আপনি মোড়ল টাইপ। লিখছি সেই কিশোরবেলা থেকে, দুর্গাপুর বেলা থেকে বর্তমান নিবাস – বর্ধমান। কি লিখছি ছাই নিজে তো জানিই না অন্যরাও জানে বলে মনে হয় না। হাবিজাবি করে চারটি বই প্রকাশিত।” বাইফোকালিজম্-এ তাঁর আজ ধারাবাহিক উপন্যাস ‘চোরাবালি‘-র ১৬তম পর্ব

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সীর ধারাবাহিক উপন্যাস

চোরাবালি(পর্ব-১৬)

 

 

ষোলো ।।
“কাউকে খুঁজছেন?” জে.সি.বি-র সামনে উঠে দাঁড়ানো লোকটার কাছ থেকে প্রশ্ন ভেসে এলো দেবুর দিকে।
“হ্যাঁ… না… আসলে আমি এসেছি এখানে ঘাট অফিসটা দেখতে!” দেবুর নিজের গলাই কেমন অপ্রস্তুত শোনায় নিজের কানে, এভাবে দুম করে চলে আসাটা বোধহয় ঠিক হয়নি!
“অফিস দেখতে!… বালির অর্ডারের ব্যাপার বা অন্য যেকোনো কিছু থাকলে আমায় বলতে পারেন , আমিই থাকি এই ঘাট অফিসে।”
“আসলে গদাই বাবু আমায় কাজে জয়েন করতে বলেছেন… অবশ্য তা এক তারিখ থেকে! তা দাদা আপনার নামটা?”
“গদাই বাবু! মানে গদাই ঘোষ?” লোকটা অবাক চোখে দেবুকে পা থেকে মাথা পর্যন্ত জরিপ করতে থাকে। ওদের কথার মাঝেই একটা বালি লোড ট্রাক এসে লোকটার পাশে গোঁ গোঁ করতে করতে এসে দাঁড়ায়। লোকটা পকেট থেকে একটা কাগজের টুকরো বের করে ড্রাইভারের হাতে দিয়ে ইশারা করতেই ট্রাকটা আবার প্রচন্ড আওয়াজ তুলে ধীরে ধীরে মেইন রোডের দিকে এগিয়ে যায়। ফিরে এসে দেবুর সামনে আবার দাঁড়ায় লোকটা।
“ আমার কাছে তো সেরকম কোনো খবর নেই!…স্যার নিশ্চয়ই আমায় জানাতেন নতুন কেউ জয়েন করলে। আমিই…”
“আসলে এক তারিখ আসতে বলেছিলেন, আমিই এদিক দিয়ে বাড়ি যাওয়ার পথে একবার দেখতে এলাম জায়গাটা।”
“তা বেশ … স্যার হয়তো বলবেন এর মধ্যেই … তা কি নাম? আমার নাম পিনু , আমি এই অফিসের ম্যানেজার …”
“ও আপনিই পিনুদা ! আমার নাম দেবু …খোকনদা আপনার কথা বলেছে …” দেবু এবার বুঝতে পারে এ লোকতা এতক্ষন কেন ওকে জেরা করছে।
“খোকন ! মানে ড্রাইভার খোকন? …ও তুমি খোকনের লোক! এ লাইনে নতুন?” এক নিমেষে পিনু আপনি থেকে তুমি তে নেমে আসে, এমনিতেই দেবুকে দেখে নেহাতই বাচ্চা ছেলে বলেই মনে হচ্ছে!
“হ্যাঁ…“
“ ঠিক আছে … স্যার বলুক তারপর না হয় কথা হবে …এমনিতে ঘাট ঘুরে দেখতে পারো … কত লোকেই তো বাঁধে ঘুরতে আসে।” বলেই পিনু অফিসের ভিতরে চলে যায় । দেবুর বুঝতে অসুবিধা হয়না যতক্ষন না স্যার অর্থাৎ গদাই ঘোষ অর্ডার করছে এই পিনু তাকে বিশেষ পাত্তা দেবে না।
দেবু হাঁটতে থাকে বালির রাস্তাটা ধরে নদীর চরের দিকে । কয়েকটা ছোটো ছোটো ঘর পেরিয়ে এক সময়ে হঠাৎই সামনেটা উন্মুক্ত হয়ে যায়। সামনে দামোদর, বালির মধ্যে হাঁটতে পা বসে বসে যাচ্ছে দেবুর, কত মানুষের পায়ের যাওয়া আসার দাগ চরের বালিতে। মাঝখান দিয়ে ট্রাকের, টায়ারের দাগ চলে গেছে। বাঁদিকে তাকাতেই দেখ একটা রাক্ষুসে জেসিবি প্রকান্ড যান্ত্রিক হাত দিয়ে নদীর চর থেকে খাবলে খাবলে বালি তুলে এক জায়গায় একটা বিরাট ঢিবি করে তুলেছে।
চরের উপর একটা এলোমেলো বাতাস বইছে, একটা হাল্কা আঁশটে গন্ধ মাঝে মধ্যে বাতাসের সঙ্গে ভেসে আসছে। চরে এখানে সেখানে বড় বড় গর্তে মতো হয়ে আছে, তাতে জল জমে মজে আছে, হোগলার ঝোপ, এ তারই গন্ধ সম্ভবত। ডানদিকে কৃষক সেতুর উপর দিয়ে মানুষ হেঁটে যাচ্ছে, লোক ভর্তি বাসগুলো পেরিয়ে যাচ্ছে । ঘটাং ঘটাং করে শব্দ হচ্ছে চাকার চাপে। ব্রিজের অবস্থা নাকি ভালোনা এ অনেকদিন ধরেই শুনে আসছে দেবু। মাঝে কি সব সারাইয়ের কাজ হলো একদিক বন্ধ করে! এমনিতেই আরামবাগ রোডের অবস্থা ভালো না , মাঝে মধ্যেই সাংঘাতিক জ্যাম লেগে যায়। সেই সময় তো এক দেড় কিলোমিটার লম্বা জ্যাম লাগছিলো।
একটা সিগারেট শেষ করে চরে দাঁড়িয়ে দেবু।ঘড়িতে সাড়ে চারটে বাজছে এবার ফেরা যেতে পারে।
অফিসের সামনে দিয়ে পেরোনোর সময়ে একবার আড় চোখে দেখে নেয় দেবু, পিনু নামে লোকটা ভিতরে কিস সব করছে খাতা নিয়ে বসে টেবিলে, টিভি চলছে। হাঁটতে হাঁটতে তেলিপুকুর মোড়ে এসে হাত দেখিয়ে একটা বাসে উঠে পড়ে।ব্রিজ পেরোবার সময় বাসের জানালা দিয়ে আবার চোখ চলে যায় দেবুর নিচে বালির চরে, যেখানে জেসিবিটা এখনও বালি তুলে যাচ্ছে।

এদিকে ঘাট অফিসে পিনু এন্ট্রির এক নম্বর খাতা সেরে রাখছে খুব হিসেব করে, স্যারের সেরকমই নির্দেশ। যখন তখন জেলা অফিস থেকে লোক আসতে পারে, কদিন কিসব হাল্লা হয়েছে বালি নিয়ে! পেপারে খবর হয়েছে। এরকম মাঝে মধ্যেই হয় আবার ঠান্ডা হয়ে যায়। এসব তেমন চাপের নয় , সরকারি লোক মানে বড় পেট, পেট ভরিয়ে দিলেই চুপচাপ কেটে পরবে। কিন্তু আজ নিয়ে দুদিন হয়ে গেল পিনু ২৪১৭ গাড়িটা থানা থেকে ছাড়াতে পারেনি , ড্রাইভারও লক আপে। স্যার তো খুব ক্ষেপে আছে, মনে হচ্ছে যাত্রায় পিনুর লেবেলে কাজ হবে না! আরও উপর থেকে জ্যাক লাগাতে হবে আর সেটা একমাত্র স্যারই পারবে। স্যার বলেছেন আজ রাতটা দেখে কাল ব্যবস্থা করবেন। পিনু জানে স্যার চট করে বড় লেবেলে এসব খুচরো ঝামেলা নিয়ে কথা বলেন না। কিন্তু এটা শুধু একটা গাড়ি নয়, এটা স্যারের প্রেস্টিজের ব্যাপারও হয়ে দাঁড়িয়েছে। এসব হিজিবিজি ভাবতে ভাবতেই একটা গাড়ির আলো এসে পড়লো অফিসের জানালায়! …স্যার এলেন নাকি? পিনু অফিসের বাইরে বেরিয়ে এসে অবাক হয়ে দেখলো ২৪১৭ এসে দাঁড়িয়েছে অফিসের সামনে। গাড়ি থেকে নেমে এলো খোকন !
“আরে পিনু ম্যানেজার! …নাও তোমার ফাঁসা গাড়ি… একটা ভালো করে চা আর ডিম টোস্ট বলো দেখি …তার আগে একটা বিড়ি দাও।” খোকন লম্বা পা ফেলে গলার গামছায় মুখ বুঝতে মুছতে উঠে আসে অফিসের সিঁড়ি দিয়ে।
গাড়ি এসেছে কিন্তু তা খালি! ব্যাপারটা জানার জন্য পিনুর কৌতুহল বেড়ে যায়, কি করে সেটিং হলো খোকনই বা গাড়ি নিয়ে এলো কেন! এ গাড়িতে তো খোকন ছিলো না! নানা প্রশ্ন ভিড় করে …হাঁক দিয়ে লেবারদের একজনকে ডেকে চা আর ডিম টোস্ট আনতে বলে পিনু সঙ্গে স্পেশাল চা।
খোকন অফিসে বসে টিভির রিমোটতা নিয়ে চ্যানেল বদলে বদলে চলেছে।
চা আর টোস্টের সৎকার করতে করতে খোকন জানালো। কিভাবে কোথায় সেটিং করেছেন স্যার তা উনিই জানেন, ওকে শুধু বলা হয়েছে বড়শুল থানা থেকে গাড়ি নিয়ে পি ডাব্লিউ ডির সাইটে বালি আনলোড করে গাড়ি এখানে আনতে। ড্রাইভারকে এখন ছাড়বে না, সম্ভবত কেস ওরা ঘাড়ে নামিয়ে গাড়ি বের করে আনা হয়েছে। ড্রাইভারের ব্যবস্থা স্যার দায়ীত্ব নিয়েছে, তবে দুদিন পরে যা করার করবেন।
পিনু এবার একটু হাঁফ ছেড়ে এলিয়ে বসে, মনটা হাল্কা লাগছে, মুড হচ্ছে একটা রামের পাঁইট আনাতে।
“কি খোকন ভাই … একটা জট কাটলো একটু চাম্পু হবে নাকি?”
“সে হলে মন্দ হয় না… আনাও…”
দামোদরের পাড়ে অন্ধকার নেমেছে আগেই , সন্ধ্যে পেরিয়ে রাতের দিকে ঢলেছে। বাঁধের ছোটো ছোটো এসবেস্টের ঘর গুলও থেকে মৃদু আলো দেখা যাচ্ছে। কোনোটা থেকে টিভির শব্দ ভেসে আসছে তো কোনোটা থেকে বাচ্চার কান্নার সঙ্গে কথা কাটাকাটির আওয়াজ।
ঘাঠ অফিসের টেবলে দুটো কাচের গেলাস সাজিয়ে পিনু লালচে তরল ঢালতে থাকে, প্লেটে ডালের বড়া আর কয়েক কুচি শশা ছাড়ানো। সত্যিই গদাই ঘোষের জবাব নেই ! স্যার কোথায় যে কি কলকাঠি নেড়েছেন কে জানে। এক গাড়ি বালি কোনো ব্যাপার নয় , গাড়িটা ছাড়ানো গেছে এটাই আসল কথা !
“আরে খোকন ভাই বলতে ভুলে গেছিলাম, আজ তোমার এক লোক এসেছিলো …বাচ্চা মানুষ, বলছিলো স্যার নাকি ওকে কাজে রেখেছে ! অফিস দেখতে এসেছে… হা হা হা…”
খোকন একটু থমকে যায় গেলাস মুখ থেকে নামিয়ে রাখে …
“কে!… দেবুবাবু?…”
“হ্যাঁ ওরকমই কি একটা নাম বলল বটে … তোমার চেনা?”
“হ্যাঁ গো … ভালো ছেলে … স্যার বলেছেন আসতে, একটু খেয়াল রেখো… এ লাইনে নতুন, কিন্তু কিছু করার খিদে আছে ছেলেটার মধ্যে।”
“বেশ …আসুক , লাইন তো সহজ নয়… পাতে পড়লেই দম বোঝা যাবে…”
পিনুর নিজের কথা মনে পড়ে যখন ও এ লাইনে এসেছিলো, কতই বা বয়স হবে! ২৩-২৪ …অনেক দিন হয়েও গেল বালি ছানতে ছানতে।

ক্রমশ…

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন–

ই ন্দ্র নী ল   ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস–চোরাবালি(পর্ব-১৫)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *