ই ন্দ্র নী ল ব ক্সী-র ধারাবাহিক উপন্যাস
চোরাবালি(পর্ব-১৫)
মিনিট পাঁচ সাত হয়ে গেছে দুজনে পাশাপাশি হাঁটছে, অথচ কেউ কারও সঙ্গে কোনো কথা বলেনি। কলেজ থেকে বেরিয়ে কলেজ মোড়ে রাস্তা পেরিয়ে বাঁদিকের ধার ধরে দেবু আর নন্দিতা হাঁটছে শাঁখারিপুকুর মোড়ের দিকে। দুদিন দেবু মনে মনে উসখুস করেছে জানার জন্য, সেদিন নন্দিতারা ওখানে ঠিক কি করছিলো! সামনাসামনি জানার ইচ্ছেই ছিলো তাই আর ফোন করেনি। আজ সুযোগ রয়েছে জিজ্ঞেস করতেই হবে ওকে।
“সেদিন তেলিপুকুর মোড়ে কি করছিলি…!” শেষ পর্যন্ত নীরাবতা ভেঙে প্রশ্নটা করেই ফেলে দেবু
নন্দিতা সম্ভবত একটু অন্যমনস্ক ছিলো, একটু চমকেই ভ্রু কুঁচকে দেবুর দিকে তাকায়
“কবে রে!”
“এই তো গত পরশু, তুই ছাড়াও আরও অনেকে ছিলো … একই ধরনের টি শার্ট পরে ।“
“ওহো… আরে ওটা তেলিপুকুরে নয়, ক্যাম্পেন ছিলো পূর্তভবনের সামনে…”
“ক্যাম্পেন! কিসের ক্যাম্পেন? আর ওই একরকমের টি শার্ট!”
“সবুজ পাঠ … আমাদের সংগঠন…”
“সংগঠন! …কিসের? তুই আবার এসবে কবে জড়ালি!”
“এটা কোনো রাজনৈতিক সংগঠন নয়…”
“তাহলে !” দেবু কিছুটা থমকে দাঁড়িয়ে পড়ে , চোখে বিস্ময় …
“এটা পরিবেশ রক্ষার লড়াইয়ের জন্য একটা প্ল্যাটফর্ম…কিছু বুঝলি?”
“পরিবেশ রক্ষা ! বাব্বা … তুই আবার এসবে কবে থেকে?”
“মাস কয়েক হলো এদের সঙ্গে যোগ দিয়েছি , প্রথমে ফেসবুকে এদের গ্রুপটা দেখে বেশ ইন্টারেস্টিং লেগেছিলো…দেখবি একদিন সবাইকে এই প্ল্যাটফর্মে আসতে হবে”
“পরিবেশ রক্ষা…গাছা বাঁচাও , সবুজ বাড়াও …গ্লোবাল ওয়ার্মিং! …উরিব্বাস হেব্বি তো!” দেবু কিছুটা রসিকতার ঢঙেই বলে ওঠে।
“আরে গান্ডু… পরিবেশ মানে শুধু গাছ নয়, তোর আমার চারিপাশে যা রয়েছে প্রাকৃতিক তার সবটাই, আর যার গুষ্টির ন্যাতা মারছি আমরা রোজ নানা অজুহাতে…”
“ভালো টাইম পাশ বল!”
“টাইম পাশ!… তোর শালা তো তাইই মনে হবে …তোর মতো পাবলিকই তো বেশি… ” নন্দিতার চোয়াল শক্ত হয়ে ওঠে।
“আরে তুই তো সিরিয়াস হয়ে যাচ্ছিস!… এসবে কি হবে শুনি?”
“যা চলছে, যেভাবে প্রতিদিন আমাদের চারিপাশের প্রকৃতি ধ্বংস হচ্ছে তার এফেক্ট থেকে কেউ বাঁচবে না, কেউ না! তাই এখনও সময় আছে এসব নিয়ে লড়ার…”
“বেশ বুঝলাম… তা তুই এতদিন বলিসনি তো আমায়!”
“কাউকেই বলিনি… তোকে বললেই বা কি হতো ? তুই যেতিস আমার সঙ্গে!” নন্দিতা একবার কয়েক মুহুর্ত দাঁড়িয়ে দেবুর দিকে সোজা তাকিয়ে প্রশ্ন করে আবার পা চালায়।
“না আমি এসব ঝোলঝালে নেই… এসব আমার মনে হয় বড়লোকের খেয়াল, এসব বেশিদিন লাস্টিং করে না।”
“তুই জানিস না, খোঁজ রাখিস না তাই এরকম বলছিস… সারা পৃথিবীতে বহু সাধারন মানুষ এরকম মুভমেন্টে জড়িয়ে আছে… নিজেদের ঘরে আগুন না লাগলে মানুষ সচেতন হয় না।”
“বেশ বেশ… ছাড়… যা করছিস কর শুধু ঝামেলায় জড়াস না“
“ঝামেলায় তো জড়াতেই হবে যদি দরকার পড়ে…”
দেবু লক্ষ্য করে নন্দিতার চোখে মুখে একটা অদ্ভুত কাঠিন্য। একটা প্রত্যয় নিয়ে কথাগুলো বলে গেল নন্দিতা। মেয়ে খুব জেদি সেটা ও জানে, এ আবার নতুন কি ভুত চাপলো! দেবু আর কথা বাড়ায় না। শাঁখারিপুকুর মোড়ের কাছাকাছি চলে এসেছে ওরা প্রায় , কথা বলতে বলতে বেশ অনেকটাই হেঁটেছে।
“তোর বল… কাজে ঢুকলি, কাজের কি খবর?” নন্দিতাও প্রসঙ্গ পালটে জিজ্ঞেস করে দেবুকে।
“ঠিকই আছে… এখন কদিন লাগবে, শুধু কথাবার্তা হয়েছে। এক তারিখ থেকে লাগব…”
‘আচ্ছা … তা ম্যনেজারবাবুর মাইনে কত!” নন্দিতার চোখে কৌতুক খেলে যায়।
“ঠিক হয়নি … তবে খারাপ হবে না আশাকরি!”
“বেশ … মাইনে পেলে পার্টি দিস…”
“সিওর…”
নন্দিতা একটা টোটোকে হাত দেখিয়ে দাঁড় করায়। ও একবার বি সি রোড হয়ে শ্যামলাল যাবে, কিসব কেনার আছে।
“ওকে বাই…” টোটোটা নন্দিতাকে নিয়ে এগিয়ে যায়।
দেবু রাস্তার ধার থেকে সরে আসে, একটা পান সিগারেটের দোকানে এসে দাঁড়ায়। সিগারেট কিনে কিছুক্ষন ওখানেই দাঁড়িয়ে থাকে। রাস্তার লোক, বাসের পেরিয়ে যাওয়া দেখতে থাকে। শহরটা নিজের গতিতেই চলছে, কোনো ঘটনাই বিশেষ হেলদোল হয় বলে মনে হয় না! কদিন আগেই দিনদুপুরে গুলি চলল, একটা লোক খুন হয়ে গেলো তার কোনো ছাপ পড়েনি আড়ে বহরে বাড়তে থাকা এই শহরে। এরই মধ্যে নন্দিতাদের মতো কিছু মানুষ আবার পরিবেশ রক্ষার জন্য সংগঠন গড়ে তুলেছে সে খবরও কি এই শহর রাখে! আশ্চর্য লাগে এসব ভাবতে দেবুর।
আজ মাস্টারের দোকানে আর যাবে না দেবু ঠিক করে , ও উলটো দিকে অনেকটা এসেছে, একবার বরং সদর ঘাটের অফিসে ঘুরে গেলে হয়! কিন্তু কাজে ঢোকার আগেই কাজের জায়গায় যাওয়া কতটা উচিত কাজ হবে বুঝে উঠতে পারেনা দেবু। ঘড়িতে এখন বেলা তিনটে বাজছে এখন বাড়ি ফিরতেও মন চাইছে না! বাড়িতে এখন বাবা থাকবে , আর বাবা থাকা মানেই নানারকম প্রশ্ন আর মতান্তর ! দেবুর ভালো লাগে না এসব। একটা আরামবাগ রুটের বাস আসছে , দেবু এগিয়ে গিয়ে হাত দেখাতেই বাসটা গতি কমিয়ে দেবুকে তুলে নিলো। বাসে তেমন ভিড় নেই এসময়ে। বাস একে একে ম্যালেরিয়ে হাউস, কলেজ মোর পেরিয়ে মাস্টারের দোকান পেরিয়ে গেল, মাস্টার একমনে ভারী ইস্তিরি ফিয়ে কিছু একটা ইস্তিরি করছে। ফ্লাইওভারের এপারে দেবু নেমে গেল, ওপারে দাঁড়াবে না। এখান থেকে দেবুকে হেঁটেই সদরঘাট অফিসে যেতে হবে। ফ্লাইওভারের নিচ দিয়ে গিয়ে বাঁদিকে হাঁটা লাগালো দেবু। মোড়ে শনি মন্দিরটা পেরইয়ে ডান হাতে হাঁটতে লাগল। এই অফিসে এর আগে ওই একবারই এসেছে খোকনদার সঙ্গে, সেদিনের কথা বার্তা বেশ স্পষ্ট মনে আছে দেবুর।
অফিসের সামনে পৌঁছতেই দেবু দেখল একটা জেসিবি দাঁড় করানো আছে, দুজন উবু হয়ে বসে তার নিচে কিছু দেখছে। কিছু রিপিয়ারিং করছে সম্ভবত! অফিস পেরিয়ে যে মাটি–বালির রাস্তাটা নেমে গেছে নদীর পাড়ের দিকে সেদিক থেকে একটা বালি ভর্তি ট্রাক গোঁ গোঁ করতে করতে উঠে আসছে। দেবু অফিসের সামনে গিয়ে দাঁড়াতেই একজন উঠে এলো উবু হয়ে জেসিবির সামনে বসে থাকা দুজনের মধ্যে থেকে। বছর তিরিশের ছিপছিপে লম্বা দোহারা চেহারার লোকটার চোখে জিজ্ঞাসা।
আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুন—