“অন্য দেশ”
কাহিনি ও নাট্যরূপ – নন্দিতা পাল
৭ম দৃশ্য
ধলা গাঁয়ের একমাত্র অাপার প্রাইমারি ইস্কুল। অাজ মঙ্গলবার। ইস্কুলের ছোটো ছোটো ছেলেমেয়েদের ঘাস বাগান পরিস্কার করার অার নতুন গাছ লাগানোর দিন। অবশ্য সেসব হয় টিফিনের পরে, ছুটির এক ক্লাস আগে। এই নিয়ম ইস্কুলের নতুন দিদিমণির চালু করা। একজন কর্মবন্ধু কাম দারোয়ান মায় মালি। অার দিদিমণি একাধারে শিক্ষক, করণিক এবং হিসাব রক্ষক। যে কালে যে নিয়ম। শোনা যায় আরও দুজন শিক্ষক পাবে এই ইস্কুল। আটমাস হতে চলল , শোনা কথাই শুধু চালু এ অব্দি। কাজেই শিশুদের খাবারের বন্দোবস্ত নিজেই করে নিয়েছেন নতুন দিদিমণি, গাঁয়ের দুজন কর্মঠ মহিলার সাহায্যে।
সকালবেলার প্রার্থনা সঙ্গীত ভেসে যাচ্ছে মেঠো পথ ধরে। কচি কচি গলার এতোল সুর মাঝে মাঝেই খেই হারাচ্ছে, অাবার সুর টেনে নিচ্ছে।হাওয়ায় ভাসছে ‘আঁধারের গায়ে গায়ে পরশ তব, সারা রাত ফোটাক তারা নব নব..’
গ্রামের অাবহাওয়ায় অবশ্য এই অমলিন সুর ছাপ ফেলেনি গত সাতদিন ধরে। সেখানে মেঘলা গুমোট বাতাসের দমচাপা দশা। গ্রামের মানুষ কেমন যেন দিশেহারা। সৎ শিক্ষিত বামুন পরিবারটির জন্য অনেকেই মায়াবোধ করছে। আবার ধর্মের বিধান অস্বীকার করার সাহস কেউ দেখাতে পারছে না। তার উপর পয়সাওলা ঘোষালের দিকেও ঢের লোক ঝুঁকে রয়েছে। স্বার্থ বস্তুটি বড় গোলমেলে। কখন যে কোন দিকে থাকবে, অাগে ভাগে বোঝা মুস্কিল। ইস্কুলের দিদিমণি তার ছোট্ট অাপিসঘরে বসে দ্রুত এমাসের হিসেব মিলিয়ে রাখছেন। সামনে পুজোর ছুটি। তারপরে ইস্কুল খুলেই দম নিতে না নিতেই পরীক্ষা। বছরের শেষ পরীক্ষা। একা হাতে কাজ সামলাতে আগে আগে হিমসিম রইরই দশা। এখন অনেকটাই সয়ে গেছে। অভ্যাস করে নিয়েছে।
দিদি – ‘ রামদীন,, রামদীন,, ‘
ডাক শুনে দরজায় মাঝবয়সী মুখ দেখা গেল। ‘ নতুন চারাগুলো গোছানো আছে তো? এবার কটা লাল গাঁদার চারা অানার কথা ছিল, এনেছো! ‘
রামদীন – ‘আইজ্ঞা।’
দিদিমণি – ‘ শোনও,, ক্লাস ফোরের সুচেতনাকে ডেকে দাও তো! আর সবার খাওয়া শেষ হলে, খাবার ঘর বন্ধ করে,, আমায় জানিও। আজ একটু তাড়াতাড়ি ছুটি দেব।’
‘ কি বাগানের কাজ বাচ্চাদের নিয়ে সামলে দিতে পারবে, তো! আমায় ডেকো না হলে।’
রামদীন – ‘ আইজ্ঞে, দামিনী দিদি একটা পোলারে লইয়া বইয়া আছে। আপনের লগে দেখা করতে চায়। ‘
দিদিমণি – ‘ আচ্ছা,, ডাকো। তার আগে সুচেতনাকে ডেকে দিয়ে যাও।’
সুচেতনা – ‘ আসব,, দিদিমণি?’
দিদিমণি – ‘ হ্যাঁ, এস। ‘ ‘সুচেতনা তোমাদের রচনার খাতাগুলো তুলে নিয়ে এস তো। এনে ঐ তাকের ওপর গুছিয়ে রেখে দাও।৷ আর শোনো, ক্লাস সিক্সের রেশমা আর নবনীতাকে নিয়ে ছোটোদের সবাইকে বাগানে নিয়ে যাও। জানো তো, অাজ বাগানের দিন। এই সপ্তাহে কে কে দায়িত্বে অাছো?’
সুচেতনা – ‘ অামি অার নবনীতাদি।’
দিদিমণি – ‘ অাচ্ছা, যাও।তোমরা শুরু ক’রো। অামি কিছুক্ষণ পরে আসছি। ‘
সুচেতনা মাথা নাড়িয়ে সম্মতি জানিয়ে বেরিয়ে যেতে যেতেই মুখোমুখি হল দামিনী আর তথাগতর।
দিদিমণি – ‘ আরে, এস। এস। কি খবর? কেমন আছো?’
দামিনী – ক্লিষ্ট হেসে, ‘ আছি একরকম। একটা দরকারে বিরক্ত করতে এলাম দিদি।’
দিদিমণি – ‘ আরে না না, সে কি! বলো কি বলবে?’
দামিনী – ‘ এই ছেলেটিকে ভর্তি করতে চাই। সমস্যা হল, বার্থ সার্টিফিকেট নেই অামার কাছে। ‘
দিদিমণি – ‘ অসুবিধা নেই, দু একদিন পরে দিলেও হবে।’
দামিনী – ‘সেখানেই অসুবিধা।’
দিদিমণি – ‘ অাচ্ছা, ওর বয়স কত?’
দামিনী – ‘ অাসছে নভেম্বরে অাট পুরবে। ওর মাকে তালাক দিয়েছে ওর বাবা। ‘
দিদিমণি – ছেলেটির দিকে তাকিয়ে, ‘ তোমার নাম কি?’
তথাগত – ‘তথাগত ইসলাম।’
দিদিমণি – ‘ বাবার নাম কি?’
তথাগত – ‘ অাসরফ ইসলাম।’
দিদিমণি – ‘ মায়ের নাম কি?’
তথাগত – ‘অায়েশা খাতুন।’
দিদিমণি -‘ কোন ক্লাস অব্দি পড়েছো?’
তথাগত চুপ করে দাঁড়িয়ে থাকে।
দামিনী – ‘ ও এর অাগে ইস্কুলে পড়ে নি। ওর বাবা মূলধারার পড়াশোনায় অাগ্রহী নয়। ঐ মসজিদে যেত। সামান্য কিছু যা শিখেছে, ওখানেই। ‘
দিদিমণি – ‘ অঙ্ক শিখেছো? নামতা জানো? ধারাপাত?
তথাগত – মাথা দুদিকে নাড়ায়, ‘ না ‘ ।
দিদিমণি – ‘ অাচ্ছা। তুমি বাইরে যাও। অামি তোমার মাসির সাথে কথা বলব। ‘
‘রামদীন রামদীন, একে মেয়েদের কাছে দিয়ে এস তো। অার শোনো, তুমিও ওদের সাথে থাকো। মাটি খুঁড়ে রেখেছে তো! ‘
দামিনী – সুচির কাছে দিলেও হবে।
দিদিমণি – ‘ তাই কর। নিয়ে যাও ওকে। তুমি ওর সাথে যাও,, কেমন! ‘
মাথা হেলিয়ে তথাগত রামদীনের সাথে ঘর থেকে বেরিয়ে যায়।
৮ম দৃশ্য
দামিনীদের বাড়ি। দামিনীর ঘর। লো ভোল্টেজ বাল্বের অালো সন্ধারাতকে গভীর করে তুলেছে। চারজন মানুষ অালোচনায় মগ্ন। বাইরেটা শুনশান। দু একটা শাঁখের অাওয়াজ ভেসে অাসছে হাওয়ায়। মাঝে মাঝে দুটি কিশোর কন্ঠের এতোল বেতোল গল্পের সুর দরজার চৌকাঠে এসে থমকে যাচ্ছে। বাইরের অন্ধকার হার মেনে অাছে ঘরের অাঁধার মুখগুলোর কাছে। চলছে চাপাগলার জোর শলা পরামর্শ।
করিম – ‘ অামার কি মনে হয় জানিস, তথার ভর্তির চে ‘ বড় সমস্যা হল,, মানে অামি বলতে চাইছি – বারিণের নাকাবন্দীর বিরুদ্ধে রুখে দাঁড়ানোটা, দরকার বেশি। গাঁয়ের পাঁচজনকে বোঝাতে হবে। যা হচ্ছে অন্যায় হচ্ছে। অাজ একজনের সাথে হয়েছে। কাল অারেকজনের সাথে হবে।’
দামিনী – ‘ এই বোঝানোর কাজটা করবে কে? তুই? তাহলেই হয়েছে অার কি! ‘
করিম – ‘ হ্যাঁ। অামিই করব।’
সুরঞ্জনা দিদিমণি – ‘ কিন্তু একাজ একা করলে হবে না। সঙ্গে অারও লোক চাই। কম পক্ষে চার ছজন মানুষ লাগবেই।’
করিম – ‘ দু তিনজন পাওয়া যাবে, সুরোদিদি।’
দামিনী – ‘ থাক। তোর আর লোক জুটিয়ে কাজ নেই। ঘোষালের লোক ঢ্যাঁড়া পিটিয়ে গাঁ জুড়ে ভয় দেখিয়ে রেখেছ। ধর্মের জুজুর কাছে হার মেনে বসে অাছে সব। সবাই। ঘোষ কাকা, অমলের বাপ, রাঙাপিসিমার অমন দাপটও এর কাছে ফুস। ‘
‘অাসলে, তলে তলে অাসরফ ভাই বারিণের সাথে হাত মিলিয়েছে। সদু মাসি অব্দি যা নয়, তাই বলে বেড়াচ্ছে।’
করিম – ‘ রাখ তোর, আসরফ ভাই, আর বারিণ,,, স স্লা,,। ও আবার তোর ভাই হলো কবে থেকে। ব্যাটা আস্ত শয়তান। জানোয়ার একটা। একবারও ছেলেটার কথাও ভাবলো না! ‘
দামিনী – ‘ অ্যাই, চুপ! মুখ খারাপ করিস না তো! তোর বুদ্ধিতে আরোও খারাপ হয়েছে। কোথায় শহরে ছুটোছুটির কাজগুলো সেরে রাখতে চাইলাম। তা না, বাড়িতে আটকে বসে অাছি। কবে যে বাবা একটু সুস্থ হবে!’
করিম – ‘ তুই জানিস, সেদিন কি হয়েছিল!! ‘
দামিনী – ‘ তুই না থাকলে এত ঝঞ্ঝাট হতো না।’
করিম – ‘ আমি থাকলে চন্ডীমন্ডপেই বারিণের নাক ফাটাতাম। তারপর যা হতো,, হতো।’
সুরঞ্জনা – ‘ তোমরা এভাবে ঝামেলা করলে,, আলোচনার কি হবে? ‘
‘তাছাড়া এখন তিনটে বিষয়ের নিষ্পত্তি করা খুব জরুরি।
মেসোমশাইয়ের পুলিশ ডায়েরীর কপি নিয়ে ডি এমের সাথে কথা বলা এবং প্রয়োজনীয় সাহায্য নেওয়া। প্রশাসনিক পদক্ষেপ না নিলে ধোপা নাপিত বন্ধ করার ব্যাপারটা মিটবে না। নিলেই যে মিটে যাবে, তা নয়। তবে আপাতত স্বস্তি পাওয়া যাবে।’
‘ গাঁয়ের মানুষজনকে বোঝানোর সময় পাওয়া যাবে। নইলে গাঁয়ের ধর্ম অার পলিটিক্স একজোট হলে সব দিকেই সমূহ ক্ষতি।’
দামিনী – ‘প্রশাসন কি শুনবে আমাদের অসহায়তার কথা।’
সুরঞ্জনা – ‘ আইনের সাহায্য নিতে হবে। এক ভিনধর্মী অসহায় নারীকে আশ্রয় দেবার জন্য একজন সিনিয়র সিটিজেনের উপর হামলা এবং ধোপা নাপিত বন্ধ করা যায় না। সেটা বেআইনী। আরও ভাল হয়, যদি ব্যাপারটা খবর করে দেওয়া যায়। মানে মিডিয়ায় তুলে দেওয়া আর কি!’
দামিনী – ‘ কি করে হবে! আমি তো কাউকে চিনি না, দিদি।’
করিম – ‘ আমার কাছে একজনের নম্বর আছে। সেবার ইস্কুলের স্বাস্থ্য ক্যাম্পের খবর করতে এসেছিল এক ইয়ং জার্নালিস্ট। আলাপ পরিচয় হল। কি ভেবে ফোন নম্বরটা নিয়েছিলাম আঃ, মনে পড়ছে না, আরে,, মনে পড়েছে’ ‘সেই সময়’।’
সুরঞ্জনা – ‘ বাঃ, বেশ। অামার বন্ধু অাছে ‘ ছন্দ বাজারে’। তাকেও একটা ফোন করে দিচ্ছি। আর ওদের ইলেকট্রনিক মিডিয়ায় যাতে খবরটা স্প্রেড করে,, তারও কিছু ব্যবস্থা করছি। তোমরা আমাকে একটা দিন সময় দাও।’
‘আর কয়েকটা দিন কোনরকম থাকার ব্যবস্থা ক’রো। এখন একদিনও স্কুল বন্ধ রাখা যাবে না।’
দামিনী – কৃতজ্ঞতায়, ‘দিদি , তুমি যা করছো, অামাদের জন্য…।’
সুরঞ্জনা – হেসে, ‘কে বলল,, আমি তোমাদের জন্য করছি। গভীরভাবে, আমি নিজের জন্যই করছি। তুমি আয়েশার জন্য করছো। তথার জন্য করছো। আবার করিম তোমাদের জন্য করছে। এভাবেই করতে হয়। মানুষ এভাবেই করে।’
করিম – আবেগে, ‘দিদি।’
সুরঞ্জনা – ‘শোনো করিম, একটা ফাইল করে প্রতিটি ডকুমেন্টের রিসিভিং কপি রাখবে। যা এপ্লিকেশন পাঠাবে, সবগুলোর ফোটোকপি রাখবে। থানায় কমপ্লেন থেকে ম্যাজিস্ট্রটের কাছে করা অাবেদন সব এক কপি করে আমায় দিও। ‘
‘ ও হ্যাঁ দামিনী গোটা ফাইল তোমার জিম্মায় থাকবে। যত্ন করে রাখবে। কেস মিটে গেলেও ফেলবে না।’
দামিনী – ‘দিদি, আর আয়েশা?’
সুরঞ্জনা – ‘ওর বিষয়টা একটু সময় লাগবে। তালাকের আইনি সুরাহা সহ অন্যান্য দাবির সুবিধা পেতে বেশিই সময় লাগবে, ধরেই রাখো। ও একলা হলে কোন সরকারি হোমের হেল্প নিতাম।’
‘তবে তথাগতর এডমিশনে অামি ডিলে করব না। এটা অামার হাতে অাছে। শুধু ওর বার্থ সার্টিফিকেটের একটা কপি যোগাড় করতে যা সময়। তাতে অবশ্য ভর্তি করতে অসুবিধা হবে না। অাপাতত ওর মায়ের লিগাল ডিভোর্স এপলিকেশনের একটা কপি জমা করতে হবে, স্কুলে।’
‘ কি অায়েশা,, ভাল করে ভেবে নাও,, । তালাকপ্রাপ্ত মা হিসেবে ছেলেকে ইস্কুলে পড়াবে তো! না কি?’
অায়েশা – মাথা তুলে,, ‘ হ,, দিদি, অামার পরিচয়েই ছেলেরে পড়ামু। বাপের য্যান ছেলের জন্যি পরাণ পোড়ে না। ছেলেরো পুইড়বে না।’ জোরে,, ‘অামিই পড়ামু। অামিই তথার মা বাপ।’
সুরঞ্জনা – ‘ মা হও,, তাতেই ঢের। বাপ হবার দরকার নেই।’
‘ যাক একথার মর্ম পরে বুঝলেও হবে। ‘
‘এবার থেকে ছেলের সাথে সাথে নিজেও পড়াশোনা শুরু কর তো, দেখি। ‘
দামিনী – ‘ হ্যাঁ,, দিদি।’
করিম – ‘ হ্যাঁ,, হ্যাঁ দিদি। ঠিক।’
৯ম দৃশ্য
– ‘ হাতে একটা পেন চাই, বুঝলে দামিনী, ‘ – বলে ওঠে সুরঞ্জনা।
‘হাতে তুলে নেওয়া শুধু সময়ের অপেক্ষা।’
– আঁতকে উঠে দামিনী বলে,- ‘ আমি!!’
সুরঞ্জনা ফের বলে, — ‘ কেন নয় বলতে পারো, যা বলতে চাও, বলো। যা করতে চাও , করো। ছেড়ে আসা পড়াশোনাটা নতুন করে শুরু করো দেখি।’
দ্বিধা জড়িয়ে উত্তর দেয় দামিনী, –‘ আমি কি পারবো!’
‘পারবে কি না, জানি না। চেষ্টা তো করো পারার, ‘– বলতে থাকে সুরঞ্জনা। — ‘ তোমার পড়াশোনা ডিগ্রীর জন্য নয়, ধরে নাও তোমার চারপাশের মানুষদের জন্য ; তোমার চেষ্টা ধরে ধরে অনেকেই একটু একটু করে পারার রাস্তা ধরতে শিখবে। এই যেমন হাতের কাছের আয়েশা,পরে এমন আরও অনেক আয়েশারা.. এমনকি লেখারাও, বারিণের ঘরে থেকেও বারিণের বিরুদ্ধে মুখ খুলতে যারা চাইবে।’
হঠাৎ আয়েশার দিকে তাকিয়ে বলে, – ‘কি আয়েশা, চাও না পড়াশোনা করতে! তোমার নিজের কথা, তোমার নানীর কথা, ছোটোবেলার কথা, কষ্টের কথাগুলো বলতে চাও না সবাইকে! পড়াতে চাও না তথাকে!’
থম মেরে থাকা মুখে স্বর ফোটে আয়েশার, — ‘হ’ দিদি। পড়াইতেই তো চাই ছেলেডা রে, কিন্তুক …
— ‘ তথার জন্যই তোমাকে শিখতে হবে।যেমন ধরো সুচির জন্য দামিনীদিদিকে।দামিনীর জন্য মাসিমাকে… , ‘ রমার মুখের দিকে তাকিয়ে গভীর গলায় বলতে থাকে এই গাঁয়ের ইস্কুলের নতুন দিদিমণি, — ‘ কি মাসিমা, ভুল বললাম!’
সবার হাতে চায়ের কাপ ধরিয়ে দিতে দিতে হতাশ গলায় বলে ওঠে দামিনীর প্রৌঢ়া মা, — ‘ আমি আর পারলাম কই শেখাতে! ভেবে তো ছিলাম অনেককিছুই। সে আর হলো কই .. ‘, অাধবোজা গলায় সন্ধে ঘনিয়ে এল, ‘দামি পড়বে, দাঁড়াবে, সংসার করবে নিজের জোরে। কিন্তু .., ‘ বলা শেষ হয় না৷ ঝুপ ঝুপ আঁধারে মিলিয়ে যায় গলা।
সপ্রতিভ হেসে সহজ গলায় সুরঞ্জনা জবাব দেয়, — ‘সংসার করেনি ঠিকই। কিন্তু ছেড়ে তো এসেছে সংসার, নিজের জোরেই। সে জোর তো আপনি, মাসিমা! তা কি আপনি জানেন না!’
ব্যস্তব্যাকুল সংসারী গলায় কথার জবাব দেয় রমা, — ‘জানলেই সব হয় না, সুরঞ্জনা। জানাটাকে জোরের সাথে জানাতেও যে হয়। সেখানে যে পা টেনে ধরে ঘরের মানুষ ও, বাইরের মানুষের সাথে সাথে।’
নীরব থেকে দম নিয়ে নেয় রমা মিনিটখানেক। ফের ভাঙ্গা গলায় বলতে থাকে, — ‘আর সবকিছুর পরেও যে পড়ে থাকে খিদের লড়াই।দুবেলা তাকে শান্ত করবো কি সে, বলতে পারো। এ দায় তো আর কাউকে ঘাড় পেতে নিতে হয় না! ‘
দামিনী আর্তনাদ করে ওঠে, — ‘মা ! মা গো! ‘
‘মাসি, বন্দোবস্ত করছি একটা। ‘ — করিম বলে।
‘মাথা কিনেছো আমার ! ‘ — রমার রাগত জবাব আসে।
আয়েশা মুখে আঁচল চাপা দিয়ে উঠে যেতে চায়। রমার ধমক খেয়ে বসে পরে ধপ্ করে।
— ‘ এই বোস্ ছুঁড়ি.., উঠে যাচ্ছিস যে বড়, …’ বলে সুরঞ্জনার দিকে ঘুরে তাকায় রমা। — ‘ তুমি বল তো,.. আমাদের এই হাভাতে জীবনের সঙ্গে তুমি জড়িয়ে পড়ছো কেন? আমাদের বাঁচিয়ে তোমার কী লাভ? কেন তুমি এভাবে এই অজগাঁয়ে পড়ে আছো! কেন নিজের বিপদ বাড়াচ্ছো!! ‘ একদমে কথাগুলো শেষ করে হাঁপাতে থাকে রমা।
করিম বলে ওঠে, — ‘ হ্যাঁ দিদি, আপনি ও কিন্তু ওদের টার্গেট। বারিণের দলবল যে খুব সুবিধের নয়, সে তো আপনি আগেও দেখেছেন। রাত- বিরেতে একা চলাফেরা করেন, রোজ শহরে যাতায়াত করেন, আমাদের ভাবনা হয়, দিদি।’
জবাবে হেসে সুরঞ্জনা বলে, — ‘সে তো করতেই হবে করিম। বিপদ হবে ভেবে চলা- ফেরা তো বন্ধ করা যায় না! কি বল! বিপদ কি শুধু একা আমার, তোমরা বেরোচ্ছো না? ‘
— ‘ আমাদের ব্যাপারটা আলাদা দিদি, — তাছাড়া, .. ‘ দামিনী বলতে থাকে, — ‘আচ্ছা বলুন তো দিদি, আপনি এত শিক্ষিত, এত ডিগ্রী আছে আপনার, কেন এই ছোট্ট
গাঁয়ের ইস্কুলে পড়ে আছেন দিদি!!’
সঙ্গে সঙ্গে সুর মেলায় করিম, — ‘ হ্যাঁ দিদি, আমাদের ভারি জানতে ইচ্ছা হয়। আপনি তো বড় কোথাও কাজ করতে পারতেন , আরও বড় কোনো চাকরি, কোনও বড় শহরে, এখানে কেন পড়ে আছেন! ‘
— ‘ মাসিমা একদিন জানতে চেয়েছিলেন, সে তোমরা জানো না, আজ তোমরাও জানতে চাইছো, অল্প হেসে উদাস স্বরে সুরঞ্জনা বলে , — ‘সত্যি বলতে কি দামিনী, বলার মতো তেমন কিছু নেই। আমার কোনো গল্প নেই। ধরে নাও অজ্ঞাতবাস। অনেকটা স্বেচ্ছানির্বাসন।’ সুরঞ্জনার মুখে ব্যথার আর রাতের কালি মাখামাখি।
দামিনী তবু নাছোড়, — ‘না দিদি, এভাবে এড়িয়ে যাবেন না। আমরা কি কেউ নই আপনার! তবে কেন আপনি আমাদের জন্য এভাবে নিজেকে জড়িয়ে নিলেন?’
— ‘ শোনো, এসব ছাড়ো। বরং যা বলছি মন দিয়ে শোন।’ রমার দিকে তাকিয়ে, ‘আপনিও ভালো করে বুঝে নিন। আয়েশা তুমিও ভালো করে বুঝে নাও। করিম তোমার দায়িত্ব কিন্তু সবদিকেই , সে খেয়াল রেখো।’ গুছিয়ে নিয়ে গম্ভীর গলায় শুরু করে সুরঞ্জনা, —
‘গতবছর আমাদের সুপ্রিম কোর্ট এক অবিস্মরণীয় রায় দিয়েছে মুসলিম মেয়েদের জন্য। তোমার মতো হাজারে হাজারে মেয়েরা যাতে সুবিচার পায়, ন্যায়বিচার পায়, তার জন্য আয়েশা। তিন তালাক বা তাৎক্ষণিক তালাকের বিরুদ্ধে আমাদের সমাজের সব মানুষই কম বেশি মুখ খুলেছেন। আয়েশা, তোমার মতো মেয়েদের পাশে দাঁড়াতে চেয়ে দু’জন মানুষ বিরাট লড়াই করেছেন। তাঁরাও কিন্তু মেয়েই। তোমার আমার মতো। তফাৎ শুধু, তাঁরা পড়াশোনা করেছেন, নিজের পায়ে দাঁড়িয়েছেন। আর তাই নিজের পথ করে নিতে পেরেছেন। অন্যদেরকেও সেই পথে হাঁটতে সাহায্য করেছেন। জানো, তাঁরা কে? ‘
করিম বলে, –‘ আমি পড়েছি দিদি তাঁদের কথা, কাগজে। ‘
দামিনী বলে, — ‘ হ্যাঁ, হ্যাঁ, আমিও শুনেছি।’ উত্তেজিত গলায় খুশি ঝরিয়ে বলতে থাকে, — ‘ সুপ্রিম কোর্ট বেআইনি ঘোষণা করার পর আয়েশার তালাক কি করে হয়, দিদি! ‘
— ‘ তালাক হতেই পারে দামিনী, কিন্তু তাৎক্ষণিক বা তিন তালাক হতে পারে না। সেটা বৈধ নয়। আর এটা তো মানো দামিনী, আমাদের পোড়াদেশে অপরাধ প্রমাণের দায়ভার নিতে হয় অভিযোগকারিনীকেই। অপরাধী অপরাধ করেই খালাস। তাই বলছি শোনো, ধৈর্য ধরতে হবে,’ — স্পষ্টস্বরে জানায় সুরঞ্জনা।
দামিনী আবারো জিজ্ঞেস করে, — ‘ দিদি, ওঁদের নাম কি? যাঁরা লড়াই করেছেন তিন তালাকের বিরুদ্ধে? ‘
করিম বলে, –‘ এই বিরাট জয় কিন্তু আমাদের বিচারব্যবস্থার, তাই না দিদি?’
সুরঞ্জনা গম্ভীরমুখে বলে, — ‘শুনে রাখো করিম, একটা কথা। জয় বিচারব্যবস্থার নয়। এই জয় মানুষের। এগারোটা বছর নাগাড়ে লড়াই করে যে দু’ জন মানুষ এই জয়ের জন্য জনসমর্থন আদায় করেছেন , নিজেদের সুখ সুবিধা আরাম আয়াস ত্যাগ করে তিল তিল করে এগিয়েছেন অন্যদের জন্যে, তাঁদের একজন সমাজকর্মী নূরজাহান সাফিয়ানিয়াজ। অন্যজন অধ্যাপক জাকিয়া সোমান।’
অবাক-খুশি গলায় দামিনী বলে, — ‘ এ..গা..রো.. বছর! বাপ রে! , মানে জন্ম থেকে এখন অবদি আমার সুচির বয়সী মামলা!’
— ‘ এবারে বুঝেছো তো দামিনী, ‘ বলে সুরঞ্জনা। — ‘লড়াইটা সময় নিয়ে নয়, অন্যায়কে চেনা নিয়ে। অন্যায়কে ঠিক ঠিক চিনতে পারা আর চেনা সত্যকে অকপটে স্বীকার করতে পারা, – এরজন্যে ঢের ঢের সাহস লাগে। আর লাগে অনমনীয় ধৈর্য। ‘
বলে চলে, – ‘ এও শুনে রাখো দামিনী, করিম,, আয়েশার লড়াই ওকেই লড়তে দাও। তোমরা শুধু পাশে থাকো, পথটা চিনিয়ে দাও। তাহলেই হবে।’
‘তোমরা বরং তোমাদের লক্ষ্যে জোর দাও।’
একমিনিট দম নেয়, তারপর ভেতর গুছিয়ে শুরু করে ইস্কুলের দিদিমণি, –‘ মাসিমা, রমার দিকে গভীর চোখে তাকিয়ে, ‘যে পাঁচটি মেয়ের জন্য জাকিয়া সোমান আর নূরজাহান লড়েছেন, জয়কে ছিনিয়ে এনেছেন তাদের একজনের পাশে থাকার কথা ছিল আমার ও। পারিনি। না – পারার বোঝা মাথায় নিয়েই আমার এই অজ্ঞাতবাস। একলা চলার রমণীয় নির্বাসন, আর কি! ‘
গলাটা খাদে নামিয়ে বলে, ‘আর কিছু জানতে চাইবেন না, প্লিজ।’
মুহূর্ত পরেই করিমকে বলে, — ‘পারো তো ‘ ভারতীয় মুসলিম মহিলা আন্দোলন ‘ এর সংগঠনে আয়েশার নামটা লিখিয়ে দিও, করিম। না হয়, ও একলক্ষ এক হয়ে যোগ দিক সেখানে।’
১০ম দৃশ্য
— ‘ও সুচি যা তো, তোর দাদাইয়ের শরবতটা দিয়ে আয়। ‘ রমা নাতনীকে ডাকে।
— ‘যাই দিয়া,’ সুচির কচি গলার জবাব উড়ে আসে ঘর থেকে।
— ‘শোনো, পুরো শরবত খাইয়ে, মুখ মুছিয়ে, গ্লাস নিয়ে আসবে, বুঝলে, ‘ নাতনীকে নির্দেশ দিল রমা।
ঘাড় হেলিয়ে জবাব দেয় সুচি, — ‘ আচ্ছা।’
পরেই উসখুস করে ওঠে, — ‘দিয়া, আমরা খাবো না? আমি আর ভাই? ‘
সুচির গাল টিপে জানায় রমা, — ‘ হ্যাঁ রে বাবা, দেব, দেব। আগে দাদাইকে তো দিয়ে আয়।’
রান্নাঘর ছাড়িয়ে সুচির গলা ছড়িয়ে পড়ে বার বারান্দায়। — ‘দাদাই, দাদাই ওঠো, ওঠো তোমার শরবত এনেছি , খাও।’ একদমে গ্লাস নিয়ে হাজির নাতনী দাদুর ঘরে।
দিনের আলোর অবাধ প্রবেশ এ ঘরে নেই। আধভাঙা আসবাবগুলোর মতোই রংহীন কালচে ঘোলাটে আলো এদিক ওদিক এসে পড়েছে। বড় চৌকির এককোণে বৃদ্ধ নিবারণ চক্রবর্তী আধহেলানে শুয়ে আছে। নাতনির চৈ চৈ – য়ে চোখ খুলে তাকান।আস্তে-ধীরে শোওয়া থেকে উঠে বসে নাতনিকে জবাব দেন, —
‘ এই যে দিদি, উঠছি।’
রোদলাগা গলায় সুচি জানতে চায়, –‘ আজ কেমন আছো, দাদু? ‘ অস্থির আবদার মিশিয়ে ডাকে,’ দাদাই, তুমি কততো দিন আমাদের গল্প ব’লো না! ‘
সুচির ছোঁয়াচ লাগে শীর্ণ নিবারণের মুখে। হেসে জানান, — ‘বলবো রে বলবো। দে শরবতটা,’ হাত বাড়িয়ে দেন। ব্যস্তগলায় বলেন, — ‘হ্যাঁ রে দিদি, শোন্ তো, এসময় আমার একটা ওষুধ ছিল মনে হচ্ছে, তোর দিয়াকে ডাক তো! ‘
তখুনি ডাকাডাকি শুরু করে ,– ‘ দিয়া, দিয়া, , দাদাই তোমাকে ডাকছে,’ সুচির গলা ঘর ছাপিয়ে রান্নাঘরে ঢুকে পড়ে হুড়মুড়।
— ‘কেন রে,’ দরজা থেকে মুখ বার করে জানতে চায় রমা।
ঝটপট জবাবে নাতনি জানায়, –‘ ওষুধ খাবার কথা বলছে দাদাই। তুমি যাও না।’ আদুরে গলায় বলে সুচি, — ‘আজ আর পড়বো না দিয়া।খেলবো।’
— ‘ খেলবি কি রে, মা এসে বকবে, যা পড়গে যা।’ নাতনীকে জবাব দিতে দিতে রমা পা বাড়ায়।
— ‘না, না, না, আজ খেলবো, ছবি আঁকবো, ভাইকে শেখাবো। ‘ দ্বিগুণ আবদারে ঝুলোঝুলি করতে থাকে সুচি, — ‘ তুমি বলে দিও, মা আর বকবে না।’
— ‘ আচ্ছা। তাই হবে। যা ওদিকের বারান্দায় বসে ছবি আঁকবি। রোদে বেরবি না, কিন্তু। ‘
নাতনিকে রেখে পা বাড়াতেই রমার কানে আসে নিবারণের ক্ষীণ ডাক। – – – -‘ রমা.., ও রমা .. , ‘
— ‘ কি হল আবার!’ রমার গলায় বিরক্তি।
খাদে নামানো ক্ষীণ থেকে ক্ষীণতর স্বরে জানতে চায় নিবারণ — ‘দামি, আয়েশা এরা সব কোথায়? সুচি বললো শহরে গেছে।’
— ‘ হ্যাঁ। ‘গম্ভীরমুখে রমা বলে, ‘করিমও গেছে ওদের সাথে। তথার জন্ম সার্টিফিকেট করাতে হবে।সে কীভাবে কি করতে হবে ওরা সব জানে। সেসব ওরা ফিরলেই জেনো।’ দম নিয়ে আরও জানায়, — ‘উকিলের সাথেও না কি কথাটথা আছে, কিসব। ‘
‘তুমি গাঝাড়া দিয়ে বসো তো দেখি, হাঁড়ি বসিয়েছি, জল হলেই মুছিয়ে যাবো।’ কপালে হাত রেখে জানতে চায়, ‘দেখি আজ জ্বর আসেনি তো!’
নিবারণ কাতর গলায় বলে, — ‘ রমা, তুমি কি আমার উপর রাগ করেছো? আজ কতদিন হয়ে গেল, ভালো করে কথা কও না। এসে বসো না কাছে।’
ঝেঁজে ওঠে রমা, — ‘এ আবার কি ভীমরতি! এ বয়সে!’
— ‘এড়িয়ে যেও না রমা।’ স্পষ্ট কাতরোক্তি প্রৌঢ় নিবারণের। গাঢ় গলায় অসহায়তা ঝরে পড়ে,
— ‘একজন আশ্রয়হীনকে ঘর দেওয়া কি এতই বড় অপরাধ! সারাজীবন এত নিষ্ঠাসহ, আচারবিধি মেনে পুজো সারলাম, যে ডেকেছে বেলায় – অবেলায়, তারই দরজায় গিয়ে দাঁড়িয়েছি।’ কান্নাবোজা গলায় ফের বলতে থাকে — ‘নিজের এই দু হাতেই বারিণের মুখেভাত, পৈতে এমনকি বিয়ে পর্যন্ত দিলাম, আজ সেই হাত দুখান অশুচি! মায়ের পুজো দেবার অধিকার নেই আমার! ‘
চাপা গলায় স্পষ্ট ধমকে ওঠে রমা, –‘ চুপ করো, তুমি চুপ করো। ছেলেমেয়ে দুটো শুনতে পাবে যে!’
নিবারণ তবু রুদ্ধ গলায় বলতে থাকে, — ‘আমি ঢুকলে চণ্ডীমণ্ডপ অশুদ্ধ হয়ে যাবে! দেবতার অকল্যাণ হবে? মানুষকে বাদ দিয়েই তবে পুজোর সব শুচি – শুদ্ধতা ঠিক থাকবে।’
‘চোখের সামনে জন্মানো সেই সেদিনের ছেলেটা ঘাড় ধাক্কা দিয়ে এক গাঁ লোকের সামনে বের করে দিল। আমি কি এতই বড় অপরাধী! হা ঈশ্বর! বৃথাই সারাজীবন তোমায় ডাকলাম! বৃথাই তোমার পূজা! ‘
ডুকরে উঠে নিবারণকে থামায় রমা, –‘ চুপ করো। চুপ করো, আহ্। ‘
আঁচলে চোখ মুছে গলাটা গভীর করে রমা বলে, — ‘না, সেদিন তোমার কোন দোষ ছিল না। না দামির। কিন্তু আরও বড় দোষ তো করেছো একদিন। ধর্ম ধর্ম করেই তো এসেছো এতকাল! কি দিল ধর্ম তোমায়? বাপ হয়ে যে মেয়ের কষ্ট বোঝে না, সে কেমন বাপ! ‘
‘বন্ধুত্ব, সন্তানস্নেহ সবকিছু দলে পিষে ধর্মকে মাথায় বসিয়ে রেখেছো, আমার ভেতরটা যে ফালা ফালা হয়ে যাচ্ছে, বোঝো সেটা!’ — রাগ বিরক্তি এক হয়ে ঝরতে থাকে রমার।
— ‘ আমি যে প্রায়শ্চিত্ত করতে চাই, রমা ‘ — নিবারণের কান্না ঠেলে ওঠে।
— ‘ আজ আর তার দরকার আছে কি!’ রমা কঠিন হয়ে ওঠে, রুদ্ধ আবেগ সামলে বলে, — ‘ মেয়েটার মুখের দিকে আমি তাকাতে পারি না।বারিণের বাবা ঘোষালের আত্মীয়ের সাথে মেয়ের বিয়ে দিলে। বাপ হয়ে বুঝলে না, পয়সা দিয়ে সুখ কেনা যায় না! শান্তিও না। ‘
— ‘আমি তো দামির সুখই চেয়েছি, রমা।’ নিবারণের গলায় খেদ, — ‘ সারাজীবন যাতে দুটো খাওয়াপরার জন্য ছুটে বেড়াতে না হয়, আমার মতো, তোমার মতো, সে ও কি অপরাধ!’
— ‘অপরাধ কী না জানি না। সে বিচারের আমি কে? তবে তোমার চাওয়ার মধ্যে যে সত্য ছিল না সেটা সেদিনও বুঝেছিলাম, আজও বুঝি।’ — রমার গলা পাথর।
— ‘একই দোষঘাট আর তো করতে চাইনি, রমা। তাই তো দামির কথায় আয়েশাকে আশ্রয় দিয়েছি।’– জবাবদিহির সুর নিবারণের।
— ‘ দিয়া…দিয়া..,’
সুচির চিৎকার কানে আসে দুজনের। দাম্পত্য খন্ডালাপ থামিয়ে উৎকর্ণ দুজনেই। হাঁপাতে হাঁপাতে ঘরে এসে ঢোকে বুড়োবুড়ির আদরের নাতনি। ঝড়ের গতিতে জানায়, — ‘ দিয়া, দাদাইকে ডাকছে দুজন.. ‘
চোখ মুছে তড়িঘড়ি রমা নাতনির সাথে পা মেলায়, — ‘কই চল, কে ডাকছে দেখি!’
ঘর রান্নাঘর বারান্দা ছাড়িয়ে বাইরে এসে দাঁড়ায় দিদা নাতনি। উঠোনের আমগাছতলায় দুজন খাকি পোশাক পরা লোক চোখে পড়ে রমার। গায়ে আঁচল টেনে জিজ্ঞাসু চোখে তাকায়।
প্রশ্ন করার আগেই প্রশ্ন ধেয়ে আসে,
— ‘এটা কি নিবারণ চক্রবর্তীর বাড়ি?’ ধোপদুরস্ত কমবয়সী পুলিশ লোকটি জানতে চায়। ঘাড় নেড়ে সম্মতি জানায় রমা।
— ‘আচ্ছা আমরা ওঁর সাথে দেখা করতে চাই। একটা কেস ডায়েরির এগেনস্টে ওঁর সঙ্গে কথা বলা জরুরি। ‘
এতক্ষণে মুখ খোলে রমা, — ‘বলুন। যা বলার আমিই বলছি।’
— ‘ আপনি?’ জিজ্ঞেস করে কমবয়সী পুলিশ লোকটি।
–‘ আমি ওনার স্ত্রী। আপনারা যা জানতে চান আমাকে জিজ্ঞেস করতে পারেন।’ জবাব দেয় রমা।
বিনীত স্বরে স্মিত হেসে কমবয়সী লোকটি বলে, — ‘ম্যাডাম, ভেরি সরি, আমরা দুঃখিত। শ্রী চক্রবর্তীর সঙ্গে দেখা করাটা খুব জরুরি। ওঁকে কি দেখতে পারি!’
রমা বলে — ‘ পারেন। তবে উনি অসুস্থ। বিছানা ছেড়ে আসতে পারবেন না, কথা বলতে পারবেন না বেশি। যা জানার আমাকে বলুন। উত্তর আমি দিচ্ছি।’
কমবয়সী লোকটি বলে, — ‘নমস্কার ম্যাডাম। আমার নাম শুভাশিস নস্কর। ইনি আমার সহকারি দুলাল হালদার। আমরা বসিরহাট থানা থেকে আসছি একটা রুটিন ইন্সপেকশনে। বুঝতেই পারছেন, বিষয়টা বিশদে জানতেই আমাদের এখানে আসা। ‘
রমা দুহাত তুলে প্রতি নমস্কার জানায়। মুখ ধীরে ধীরে স্বাভাবিক হয়ে আসে।
–‘ ম্যাডাম, আপনাদের ধোপা নাপিত কবে থেকে বন্ধ? মানে দোকানপাট। ‘
— ‘তা প্রায় এগারো দিন।’
— ‘আর চক্রবর্তীবাবুর পূজাপাঠ কদ্দিন বন্ধ আছে?’
— ‘ওই গন্ডগোলের পরের দিন থেকেই।’
— ‘তা ও কতদিন? ‘
— ‘দিন পনেরো।’
–‘ নিবারণবাবুকে ধাক্কা দিয়ে ফেলে দেয় কে? মানে কে তাঁর গায়ে হাত তোলেন?’
— ‘ডায়েরীতে সব লেখা আছে তো।’ নরম স্বর রমার।
— ‘তা ও মুখে বলতে হবে, ম্যাডাম। সব রেকর্ড থাকবে। ‘
রমা দেখে কমবয়সীর মাঝবয়সী সহকারি একমনে মোটা খাতায় লিখে চলছে কি সব।
— ‘দেখুন, আমি তো ছিলাম না সেখানে, দেখিনি। চন্ডীমন্ডপ থেকে বের করে দেবার ধাক্কাধাক্কিতে কারা হাত তুলেছিল ভীড়ের মাঝে, কাকে দোষ দেব! ‘ জানিয়ে দেয় রমা।
–‘ কেস ডায়েরী কে করেছেন?’
— ‘আমার মেয়ে দামিনী।’
— ‘উনি কোথায়?’
— ‘শহরে গেছে। অন্যকাজে।’
— ‘উনি কি করেন?’
— ‘টুকটাক টিউশনি করে আমাদের গাঁয়ের ছোটোদের আর.. ‘
— ‘আর কি ম্যাডাম?’
— ‘শহরে একটা বই ছাপা আপিসে যায় পাঁচদিন, পুফ টুফ দেখে।’
–‘ কি দেখে?’
–‘ বই ছাপার আগে পড়ে পড়ে ঠিকভুল দেখতে হয় , সেসব দেখে।’
— ‘ওহ্ আই সি! প্রুফ দেখেন। তাতেই আপনাদের চলে! তাহলে তো সত্যি ই হরিবল সিচুয়েশন!’
— ‘ভাতের ওপর ডালটুক জুটলেই আমরা খুশি ছিলাম। শুধু শেষ বয়সে অপমানটা হজম হচ্ছে না, বাবা! কিছু মনে করবেন না।’
জলটা চোখে আটকে রাখতে পারে না রমা।
–‘ আই ট্রাই মাই বেস্ট ম্যাডাম। আমি একবার শ্রী চক্রবর্তীকে দেখবো।’
— ‘চলুন।’ সম্মতি জানিয়ে সঙ্গে নিয়ে চলে রমা দুজনকে। দিয়ার আঁচল ধরে সুচিও চলে।
ঘরে ঢুকে এসে দাঁড়ায় চারজনে। অবাক চোখে নিবারণ রমার দিকে তাকায়।
–‘ নমস্কার চক্রবর্তী মশায়। আমি বসিরহাট থানার এস আই। ইনি আমার সহকারি। আপনার কেসটার ব্যাপারে তদন্ত করতে এসেছি। ‘ কমবয়সী ইনসপেকটার পরিচয় দেয়।
— ‘আমার অপরাধটাই তো বুঝতে পারছি না, আমি।’ কাঁদো কাঁদো গলায় বলে ওঠে প্রৌঢ় । — ‘ চেনা গাঁ, চেনা মানুষজন, সবাই প্রতিবেশি। কোনোদিন কোনো গন্ডগোল ছিল না। আজ প্রায় চল্লিশ বছর বাস করছি। সবাই মিলমিশেই ছিলাম। কী যে হয়ে গেল!’
আশ্বস্ত গলা ফোটে কমবয়সীর , — ‘আপনি নিশ্চিন্ত থাকুন চক্রবর্তী মশায়, এসব নাকাবন্দি এখুনি উঠে যাবে। আমাদের লোকেরা সারা গ্রামে মাইকিং করে দেবে। বিডিও সাহেব খুব শিগগিরই এখানে আসবেন। আপনাদের চন্ডীমন্ডপে সবার সঙ্গে মিটিং করবেন। গ্রামের লোকেদের আমরাই বোঝাবো। এই ধরণের সাম্প্রদায়িকতা কোনোভাবেই বরদাস্ত করা হবে না।’
‘আচ্ছা চলি নিবারণবাবু। নমস্কার।’
সহকারী দুলালবাবু জানায়, –‘ স্যার একটা সই লাগবে। উনি কি করতে পারবেন? পরিবারের সবার নামগুলো লিখে নিতে হবে। ‘
রমা এগিয়ে এসে বলে ওঠে,
— ‘ দিন, আমি লিখে দিচ্ছি। পরিবারে আমি, আমার স্বামী, দুই মেয়ে আর দুটো নাতি নাতনি।
আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকটিতে ক্লিক করুন