একখণ্ড আত্মজৈবনিকের পরবর্তী অংশ আবার বৃষ্টি আসুক

একখণ্ড আত্মজৈবনিকের পরবর্তী অংশ

আবার বৃষ্টি আসুক

        

                                               ছবিঃগৌতম মাহাতো

হাসল বােধ হয় বুঝতে পারছিলাম না। ঘুরে সােজা হতেই দেখি অমিতা উকমার কৌটোটা আমার দিকে ধরে। সেই মুহর্তে ভীষণ খিদে পেল। এই সময় ভাইজানের এককাপ চা আর একটা সিগারেট খিদে ভুলিয়ে দেয়। ভাবছি নেব কিনা। অমিতা বলল – অব থ্যাঙ্কস মত কহনা। হাসি পেল। প্রায় ছঘন্টার রাস্তা, প্রথমের দিকে সবাই গানটান গাইছিল, বেশ জোরালাে চেঁচামেচিও হচ্ছিল। এখন একেবারে নিশ্চুপ। যে যার মতাে করে মেতে আছে। আমি আরও একবার মাসিকে খােজার চেষ্টা করলাম। পেলাম না। আবার ঝিমলির দিকে চোখ গেল। ওর বেগনি শাড়ি আর অগােছালাে চুল তখন হাওয়া মাখছে। আমার কাঁধে মাথা রেখে অমিতা দেদার ঘুমােচ্ছে। একবার সরিয়ে দিয়েও কাজ হয়নি। আমার বা হাতটা ওর হাতে। আলতাে করে ধরা একটু অপ্রস্তুত হলাম। আমি জানালা দিয়ে গাছেদের সরে যাওয়া দেখছি তখন। কত ধরনের গাছ হয়। বনকুল, নিমচা, পুটুস। হঠাৎ যেন এরা সবাই ব্যস্ত হয়ে পড়েছে। দুরে তামাটে মাটির বুকে মেঘ চরছে। অমিতা কখন চোখ খুলেছে জানিই না। হাতে আলতো চাপ পড়তে ফিরলাম। অমিতার কোণে এক চিলতে লজ্জা, মুখ জানালার দিকে ফেরানাে; চোখের তারা চঞ্চল। গুরগাঁও-এ নামলাম তখন বেলা ১১টা প্রায়। কারও ছেলে কোন টাওয়ার নেই। ম্যাডমরা ব্যস্ত রান্নার তােড়জোড়ের দিকে। জলখাবারের প্যাকেট নিয়ে যে যার মতাে করে বেরিয়ে গেল ডাটা কালেকসনে। কেউ জোড়ায় কেউ বা গ্রুপে। আমি একাই হাঁটছিলাম। দূরে দূরে গ্রাম। পাহাড়টার ওপাশের গ্রামটার ডাটা নেব ভেবেছি। হঠাৎ পেছন থেকে কে যেন ডাকল – মুসাফির। ঘুরে দেখি ঝিমলি। প্রায় ছুটতে ছুটতেই আসছে। অবাক হলাম। মেয়েদের ভাগে তার কাছের গ্রামগুলাে পড়েছে। ও আবার এদিকে কেন! কাছে এসে হাঁপাতে হাঁপাতে উবু হয়ে বসে পড়ল। ওর কাঁধে হাত রেখে বললাম – ঠিক আছে? জল খাবে? ঝিমলি মাথা নাড়ল; তখনও ইাঁপাচ্ছে। পাশেই একটা পাহাড়ি ঝোরা, তিরতিরে তার ধারা। আমি সূর্য আড়াল করে দাঁড়ালাম। কেন্দুগাছের নিচের পাথরটাতে দুজনে বসেছি কতক্ষণ জানি না। আমি সিগারেট ধরালাম। ঝিমলি পা গুটিয়ে হাঁটুতে থুতনিতে রেখে বসেছিল। ওকে কিছু জিজ্ঞেস করতে ভয় হচ্ছিল। মেঘ করেছে। বললাম– চলাে ডাটা নিতে হবে। ঝিমলি  কোন কথা বলছিল না। আমি একমনে সিগারেট আর ধোয়ার লুকোচুরি দেখছিলাম হঠাৎ ঝিমলি বলে উঠল – তুমি নাকি ধর্ম পাল্টাচ্ছে। এমন একটা নৈঃশব্দ এভাবে ভাঙবে ভাবিনি। আমার মাথার সতের হাত ওপর দিয়ে যাচ্ছিল প্রশ্নটা। নিজের অজান্তেই মুখ দিয়ে বেরিয়ে এলাে – গোটা কলেজ তো তাই বলছে। মুসাফির থুতনিতে দাড়ি রাখে গোঁফ রাখে না ভাইজানের প্যায়ারের লােক। মসজিদে যায়, রােজা রাখে – আরও কত কি। এবারে বুঝতে পারলাম মার্সির ঐ কথাগুলাের মানে। সব এলােমেলাে হয়ে যাচ্ছিল। ঝিমলির দিকে তাকালাম যেমনভাবে বসেছিল ঠিক তেমন ভাবেই বসে আছে। এবার আমি সজোরে হেসে উঠলাম। ঝিমলি মুখ তুলল। মেঘ কেটে গেছে। খুব আলতাে একপশলা বৃষ্টি হল। ঝিমলির কোন ক্ষেপ নেই। একটা চোরকাটার গাছ দিয়ে পাথরের ওপরে বােলাচ্ছিল। ওর কানের পাশ দিয়ে একে একে খসে পড়ছিল অগােছালাে চুলগুলাে। ও গুনগুন করে কি যেন গাইছিল। বললাম – জোরে গাও। ও গাইছিল তুমি রবে নীরবে কতদিন রবীন্দ্র সঙ্গীত শুনিনি। ইস ..1 আজ অনুভব হল বহুদিন পর -। ছত্তিসগড় বিদায় তার একাকী হয়ে যাওয়া, ট্রাকের সারি, রাজনন্দগাঁও-এর পড়ে থাকা বেবাক রাস্তা আর মুসাফিরদের আদুরে কিসসা। খুব চেয়েছিলাম ঝিমলি আসুক দেখা করতে। আসেনি। মার্সি এলাে চকলেট আর ফুল হাতে। পেছন থেকে একটা প্যাকেট বাড়িয়ে দিল অমিতা। বলল – তুমহারে লিয়ে। খুলে দেখলাম সেই উমা। কিন্তু সেই উষ্ণতা কই। হারিয়েই গেল বােধ হয়। এতাে সবের মাঝেই চোখ খুব খুঁজেছিল। প্রবাসী বাঙালীর বেগনি শাড়িটা। নিজের সিটে এসে বসলাম। সিগন্যাল হয়ে গেছে। খুব শ্রান্ত লাগছিল। তখনও আশা করেছিলাম রূপকথার মতাে ঝিমলি আসবে ছুটতে ছুটতে ট্রেন গতি নিল। অমিতার চোখের কোণ চিকচিক করছে। মার্সি আর তাকালাে না এদিকে। ট্রেনটি সাবলীল গতি নিল। আমি তাকিয়ে আছি। একসময় ওরা বিন্দু হয়ে মিলিয়ে গেল চোখে। আলসে হাতে ব্যাগটা সরাতে গিয়ে চোখে পড়ল সেই বাদামী ডায়েরিটা ব্যাগের ওপরেই রাখা। খুব আলতাে হাতে খুললাম শেষ পাতাটা। টাটকা একটি টিউলিপ আর তারই নিচে লেখা দিতে চাইনি বােধ হয় তাই ভালাে লাগেনি তােমায়, বডড শ্রান্ত লেগেছে। এতে কি খুঁজছিলে মুসাফির ?” “কয়েকটা চুরি করলাম। এসময় তামায় দেখা ফিরে গেলাম তােমারই কবিতার মতো করে।

 আজ জিন্দেগী হ্যায় পানী কী বুলবুলে জ্যায়সা
 চন পল ঠ্যহর গয়ে তাে খতা ক্যায়া হ্যায় 
মুসাফির হম মুসাফির হো তুম
 কৌন জানে রাস্তা কৌন সা।।
                         ★★★

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *