কানাকড়িতে কেনা একচিলতে আত্মচরিত
ছবি গৌতম মাহাতো
আমি যেখানে পিঁড়ি পেতে আড্ডা মারি খেয়ালখুশি মত,সেটা একটা পৈঠাই তবে বাঁড়ুজ্জে বা হালদার বাড়ির কোনও পৈঠা নয় সরকারি ও বেসরকারির যৌথোদ্দোগের একটা নমুনা বলা চলে,আর যিনি আমাদের উষ্ণপানীয়ের যোগান সামলান তিনি আমার চৌদ্দকুলের কেউ নন অথচ তিনি আমার অতি আপন, আমাদের দিদি।জন্মসুত্রে বিহারের ছাপরা জেলার পূর্ববাসিন্দা।দেহাতি মৈথিলি তাঁর ভাষা।আমাদের সাথে গ্যাটিসমারা বাংলায় কথা বলেন,ছটের সময় ঠেকুয়া খাওয়ায়। বলে -“তনিক বৈঠলবা বাবু হাম দৌড়কে যাবে অউর দৌড়কে আওয়েলবা।”আর তারপরেই ফিরে আসে হাতে ঠেকুয়ার মোড়ক নিয়ে।আমরাও ইহলোক পরলোক ভুলে অম্লানবদনে চিবোই সেই শুদ্ধ দেশি ঘিয়ে ভাজা অদ্ভুত সুস্বাদ।এই আমাদের ছোট্ট কাহন।এই আমাদের দিনান্ত যাপন।সেখানেই চা খেতে আসে মেঘাদা।কাকা(রাকেশ সিংহদেব); দেবুদা,চিন্টু,অমিতদা বা দেবাশিসদা আসতে দেরি হলে এই মেঘাদাই আমার স্টপগ্যাপ পার্টনার।
আমি তরিণীখুড়ো বা তারানাথ তান্ত্রিক বহু দফায় পড়েছি কিন্তু এই সব চরিত্রের অস্তিত্ব যে সত্যিই আছে তা এই চলতা-ফিরতা মেঘাদাই প্রমান! যদিও সত্যতা যাচাই-এর প্রয়োজন পড়েনি ঠিকই তবে অনেক প্রশ্ন আর উৎসাহ মাথায় লাফিয়ে ওঠে কিন্তু সে সব ছাপিয়েও যে মহান পরাক্রমে তলিয়ে নিয়ে যায় সেটা তার ক্ষুদ্রাতিক্ষুদ্র ঘটনা প্রবাহ, যাতে তরতাজা করে তোলে শিরদাঁড়ার রোমাঞ্চকর জীবন দর্শন ও অভিজ্ঞতার কিস্সা।
কোন এক অস্তিত্বহীন রাতে সে ঘর ছেড়ে পালায়।তখন সে ষোল(কিছু কম বা বেশি)। সে পালানো এক্কেবারে নির্ভেজাল।উত্তর পূর্ব নাকি দক্ষিন জানা নেই,ট্রেন বাস নাকি পয়দল তাও নিরর্থক, সে শুধু জানে হারাতে হবে।তা সে যে ভাবেই হোক। সে বলে-“জানো তো দোস্ত হারনোর একটা মদহৌসি আছে,যেটা সবাই বুঝবে না, আর যে বুঝবে! তাকে ধরে রাখা চালুনিতে জল ধরার সমান।” সে বলে চলে…
পালাতে পালাতে আমি ভিড়ে যাই জনা চার মেষপালকদের সাথে।চালচুলোহীন একটা বেসাহারা ছেলে যে তাদের রাতদিনের বেদর্দ সফরের সাথে মিলে মিশে যেতে থাকে ক্রমান্বয়ে। আমি তাদের ভেড়ার তত্ত্বাবধান করি, ফাইফরমাস খাটি, কোনও উদ্দেশ্য বিধেয় ছাড়াই,আমাকে তারাও অভ্যেসের মত আপন করে নেয়।সারাদিন ভেড়াদের পেছনে ঘোর দেখভাল কর গোঠের,সাঁঝে ডেরায় ফিরে লিট্টি বা খিচুড়ি খেয়ে পরের দিনের চারণ ভূমির অন্বেষনের অপেক্ষা করতে করতে ঘুম।সে নিশ্ছিন্ন ঘুম।এই রকম ভেড়ার পাল সাথে নিয়ে ঘুরতে ঘুরতে বছর তিনেক পর রাখামাইন্স ধলভুমগড় মৌভাণ্ডার হয়ে এসে আমরা এসে ঠেকি দলমা টেরিটোরিতে।ঠাহর হয় না তবে স্টেশন থেকে প্রায় ৪০-৪৫ কি.মি ভেতরের এক গ্রাম।তার কোনও চিহ্নিত রাস্তা নেই। পায়ে হাঁটা দেড়ফুটের রাস্তা,দুধারে বনজ উদ্ভিদ। লতাপাতা,ফুল,আর লম্বা বৃক্ষরাজ তার বুক পেতে ছায়া নত করে রেখেছে দূরর দূরান্ত।মাঝে মাঝে বর্ষার পোয়াতি মেঘের ঝলক দেখা যায় কচ্চিদ কখনও,তবে সেও স্পষ্ট নয়।শ তিনেক ভেড়ার পাল সার বেঁধে চলেছে,হয়তো তারাও বুঝতে পেরেছে ততক্ষনে যে বাঁ দিকে ফুটখানেক হেরফের হলেই আশি নব্বই ফুট গভীরে।
সন্ধ্যা হল যে গাঁয়ে তার চরিত্রের সাথে নামটিও বড্ড অদ্ভুত। লাইলেনবটা।এই গাঁ সভ্যতার বিকাশের অনেক আগের বলে মনে হতে পারে।পাতায় ছাওয়া ঝুপড়ি, জোনাকি খচিত রাতের রত্নরাজি আর লম্বা চিৎ হয়ে পিছলে আসা পাহাড়ি ঝোরার জলজ শরীর।লন্ঠনের আলো ওখানে নাকি বাহুল্য।মনে করা কষ্টকর যে সেটা বিংশ শতাব্দী।তারা ডেরা ফেলল সেই গাঁয়েরই সীমান্তে।জল আনতে হয় জঙ্গলের ভেতরে বাঘুৎথান পেরিয়ে সেই ছোট্ট তিরতিরে ঝোরার ওপর দিক থেকে,এই অমৃতকুম্ভের সন্ধান দিল গাঁয়েরই জল আনতে যাওয়া জনাকয়েক রমনী।তাদের সাথে আমিও চললাম।পায়ে তাদের মোটা মলের গমক।আলতা পেড়ে হলদে শাড়ি তাদের পায়ের গোছ বা গোড়ালি ঢাকতে স্বক্ষমতা হারিয়েছে। জল আনতে যাওয়ার সময়ই মেয়ে বৌ-রা সাবধান করে দিল — ডরনা নহী, বাবু হো! আর তুমি যাই দেখ এর পুনরাবৃত্তি মানা।পায়ে পায়ে যেতে যেতে তাদের সাথে আলাপ হল,ওদের ভাষা আদিম তবে বাইরের আদমি বলে আমার সাথে কথা হচ্ছিল দেহাতি হিন্দিতে ।ঝোরায় একে একে জল নিচ্ছিল তারা,আমিও জল নিতে গ্যালনটা সবে ডুবিয়েছি, একটা মুদু বুক্ বুক্ শব্দ তুলতেই শোনা গ্যালো এক গভীর হুংকার।এ হুংকার চিনতে জঙ্গলে বসবাস করতে হয় না,এ য্যানো সহজাত চেনা ধ্বনি।গ্যালন ছেড়ে সোজা হয়ে দাঁড়াই।মেরুদণ্ড বেয়ে প্রাচীন কোনও যুগ গড়িয়ে নেমে গ্যালো কোমরের দিকে।সে দেখে মেয়েগুলোর সেকি রিনরিনে হাসি।য্যানো সে এক বেজাই মস্করাকর কাণ্ড!
ফিরতে ফিরতে ওরাই আস্বস্ত করে, ভয় পাও ক্যানো বাবু! বাঘুৎঠাকুর থাকতে ওরা ঝোরা ডিঙিয়ে এপারে কখনও আসেনি,আসবেও না।তবে রাতে একা বেরিও না নইলে কুঙরের মত হারিয়ে যাবে।কুঙর! সে আবার কে? আর তার মত হারিয়ে যাওয়ার মানেটা কি!কেউ কি কারুর মত করে হারাতে পারে নাকি! পরে পরে শুনেছি, কুঙর ওই গাঁয়েরই ছেলে।হারিয়ে গ্যাছে, বনে।বনের ছেলে বনে হারায় কি করে? এ এক বড় অদ্ভুত কথা! কিন্তু কুঙর কিভাবে ক্যানো যে হারিয়ে গ্যালো কেউ জানে না।হিসেবও মেলাতে পারে না।
কয়েকটা দিন কাটতে, ধাতস্ত হওয়ার পর আমি সবকিছুর সাথে সম্পৃক্ত হতে থাকি একটু একটু করে।সেই ঝোরা সেই বাঘুৎথান, ঝিঁ ঝিঁ আর হুংকারের গুঁজ আমাকে ওদেরই একজন করে তুলছিল ক্রমশ। প্রায় রাতেই এরপর থেকে আমি ঝোরার ধারের পাথরে বসে চাঁদনি রাতে প্রেমিক হয়ে যাই।’হুঁড়ুর’ তার দাওয়ায় বসে পাহাড়ি সেরেঞের ধূন টানে বাঁশির ছিলিমে।আর আমি নেশায় বিহ্বল হয়ে পড়ি একটা সময়।ভাবি অনেকদিন তো হল এদের সাথে আর না,পালাতে হবে.. পালাতে হবে..আর না।তখনই সেখানে রাত জুড়ে বেজে উঠত ঘুঙুরের রুনুকুঝুনুকু রুনঝুন রুনঝুন রুনঝুন।
পরের সুবহায় হুঁড়ুরের কাছে জেনেছিলাম ও সব আসলে কিছুই না,ময়ুরের গমনাগমন।তারা ফি মাঘে মানত করে তো!আর তাই সেই মানত পূরণ হলে ময়ূরদের ঘুঙুর পরিয়ে ছেড়ে দিতে হয় বাঘুৎথানে।তারাই নাচে রাতে।আর বাঘুৎ ঠাকুর তাদের চরায় মায়াবি শিষে…
ক্রমশ…
★★★