আমাদের হারিয়ে যাওয়া স্মৃতি
লিদুদুমালিঙ্গানি মেকোমবথি (দঃ আফ্রিকা)
. অনুবাদঃ কা মা রু জ্জা মা ন
যা ঘটার তা ঘটতই, পূর্ব্বাভাস কিছু পাওয়া যেত না। কোথা থেকে এসে হাজির হোত, ভুতের মতো, যেমন করে আসত তেমন করেই অদৃশ্য হয়ে যেত। যখনই চলে যেত, আমি আমার হাতগুলো চতুর্দিকে মেলে ধরতাম, বিড়বিড় করে দু’টো প্রার্থনা আওড়ে নিতাম – একটা ঈশ্বরের উদ্দেশ্যে, অন্যটা পূর্ব্ব-পুরুষদের উদ্দেশ্যে, এবং তারপর অপেক্ষা করে থাকতাম কখন আমার বোন ভয়ে মুখ শুকিয়ে আমাকে জড়িয়ে ধরবে। আমার মনে আছে, জড়িয়ে ধরাটা ছিল বেশ শক্ত করে এবং বহুক্ষণ ধরে, যেন সে মনে মনে আশা করত যে মুহূর্তটা বুঝি আর কাটবে না।
যখনই তার এইরকম কিছু হোত, সে পাল্টে যেত, তাকে চেনা যেত না, মনে হোত দু’জন তার মধ্যে ফাঁদে আটকা পড়ে গিয়েছে, দু’জনেই বেরিয়ে আসার জন্য ছটফট করছে, তার আগে দু’জনেই দু’জনকে ছিঁড়ে টুকরো করে ফেলতে চাইছে। প্রথম যে-জিনিসটা তা তার কাছ থেকে, এবং আমাদের কাছ থেকে কেড়ে নিয়েছিল তা হোল আমাদের কথা, এবং তারপর আমাদের ধরে রাখা যত স্মৃতি। সে এমন ভাষায় কথা বলতে শুরু করত যা ছিল একেবারে অচেনা, তার কথা কেঁপে কেঁপে উঠত, মনে হোত যেন ঈশ্বরের কিছু অচিন্ত্যনীয় ভাবনার প্রকাশ ঘটানোর চেষ্টা করতে চাইছে। একটার পর একটা স্মৃতি উবে যেতে যেতে আমাদের স্মৃতি ঝাপসা হোয়ে উঠেছিল।
কিছু স্মৃতি আমার মধ্যে রয়ে গিয়েছিল, সেই স্মৃতি তার আর্তনাদ আর তার বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাওয়ার স্মৃতি। আমার মনে আছে মধ্যরাতে সে যখন চিৎকার করতে করতে মাঠে চলে যেত, প্রথমে তা আমার মা’কে জাগিয়ে তুলত এবং তারপর সারা সারা গ্রামকে তাদের ঘুম থেকে জোর করে তুলে নিয়ে যেত। পুরুষ মানুষ ও ছেলেপুলেরা বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসত আংটা লাগানো একটা লাঠি নিয়ে, মনে হোত তারা যেন পশু শিকারে বেরিয়েছে। মেয়েরা ও বাচ্চারা বাড়িতেই রয়ে যেত, বাচ্চারা ভয়ে তাদের মায়েদের রাতের ঘাঘরা আঁকড়ে ধরে থাকত। উত্যক্ত ও উদ্ভ্রান্ত হোয়ে পুরুষ ও ছেলেরা অন্ধকারে এদিক ওদিক তোলপাড় করে বেড়াত, কী করবে না করবে ভেবে উঠতে না পেরে একজন কেউ নিজেই নেতা সেজে তাদের ছোটো ছোটো দলে ভাগ হোয়ে যাওয়ার নির্দেশ দিত। যাদের কাছে টর্চ থাকত তারা এখানে ওখানে আলো ফেলত যাতে তারা অন্ধকার কাটিয়ে উঠতে পারে। কারুর কারুর কাছে মোমবাতি থাকত, তারা তাদের দেহকে পেঁচিয়ে সারা শরীর কম্বল মুড়ে নিত যাতে করে হাওয়া আটকানো যায়, কিন্তু একটাও মোমবাতি জ্বালিয়ে তোলার আগেই তাদের সব দেশলাই কাঠি নিভে যেত।
যাদের কাছে টর্চ বা মোমবাতি কিছু থাকত না তারা ওই অন্ধকারেই তাদের পরের পর পা ফেলে যেত, তারা কখনো সখনো হয়ত’ পাহাড়ি পথে ঝাঁপ দিয়ে পড়ত। সেইসঙ্গে এটাও বলতে হয় যে তেমন কিছু ঘটার সম্ভাবনা ছিল না কারণ তাদের প্রায় সবারই গ্রামে জন্ম, সেখানেই তারা মানুষ হয়েছে, সেখানেই তারা বিবাহিত, সারা জীবনেই তারা ওই মাঠেই শৌচকর্ম্ম করতে যেতে অভ্যস্থ, এবং একই সময়ে তারা বড়ো বড়ো শহরে সাদা মানুষদের জন্য কাজই করতে গিয়েছে। তাদের মনে গ্রামের নকশা আঁকা হোয়ে থাকত; হাঁটার রাস্তা, তার আঁকবাঁক, নদী, পাহাড়, যেখানে ভূতেরা বাস করত সেইসব গর্তে তাদের রক্তের ছাপ পড়ে গিয়েছিল।
বেশ কিছু ঘন্টা কেটে যাওয়ার পর, প্রথম একদল পুরুষ ও ছেলে, তারপর আর এক দল, তারও পর একদল অন্ধকার থেকে বেরিয়ে আসত। তারা তাকে খুঁজে পায়নি। তারা দাবি করত, তারা সর্ব্বত্র তার খোঁজ করেছে। তারা আমার বোনকে খুঁজে পায়নি বলে হাহুতাশ করত, না কি মাঝরাতে তাদের জেগে ওঠার জন্য বিরক্তি প্রকাশ করত – তা আমি বলতে পারি না। পরাভূত মানুষের মতো রূপক্লিষ্ট, তাদের মুখগুলো মেঝের দিকে ঝোঁকানো, এবং দেহগুলো জুবুথুবু অলস ভঙ্গীতে ঝুঁকে চলেছে যেন তারা একটা দুর্ভার বহন করে আছে। কোনো দলই অন্য দলোর খোঁজ জানে না। এমন কি তারা এও জানে না অন্য দলগুলোর অস্তিত্ব আছে কি না, বা রাত্রি তাদের গিলে খেয়ে ফেলেছে কি না। তারা তাদের শেষবার দেখেছিল যখন তারা দলছাড়া হওয়ার আগে শুভেচ্ছা বিনিময় করেছিল। তারা তাদের আমার বোনের নাম ধরে চিৎকার করতে শুনেছিল, অন্ধকারে নীরব নিঝুম হোয়ে পড়ার আগে পর্য্যন্ত।
সে আর্তনাদ করেনি।
সে চিৎকার করেনি।
সে আর্তনাদ করেনি।
সে চিৎকার করেনি।
সে আমাদের ডাকে সাড়া দেয়নি।
সব দলই আতঙ্কে নাম-সঙ্কীর্তন করছিল। প্রতিটা দল যখন বেরিয়ে আসছিল, আমার আশা হচ্ছিল তারা অন্যরকম কিছু সঙ্কির্তন করবে; কিন্তু না, তেমন কিছু ঘটল না; সঙ্কীর্তনটা ছিল যেন দীর্ঘদিন ধরে মহড়া করে রাখার মতো একই ধরনের পুনরাবৃত্তি। আমার বুক ভেঙ্গে যেত।
সে আর্তনাদ করেনি।
সে চিৎকার করেনি।
সে আর্তনাদ করেনি।
সে চিৎকার করেনি।
সে আমাদের ডাকে সাড়া দেয়নি।
এইরকম সঙ্কীর্তন চলতেই লাগল যতক্ষণ পর্য্যন্ত না সব দল এক-এক করে ফিরে এল। মা’য়ের বেশ লম্বা-চওড়া চেহারা। মা ফিরে এল যখন পরের দিনের সূর্য্য তখন মধ্যাকাশে, ফিরে এল আমার বোনকে পিঠে করে বয়ে নিয়ে।
মধ্যে মধ্যে সে আর্তনাদ করে আমাকে বিদ্রূপ করার জন্য, আমার মা বলল।
আমার মনে আছে, একবার আমার বোন দেয়ালে মাথা ঠুকতে ঠুকতে রক্ত বের করে ফেলেছিল। সে আর আমি একটা বৃত্তাকার কুঁড়েঘর বরবার ছুটছিলাম কে আগে শুরুর জায়গায় ফিরে আসতে পারে দেখতে চেয়ে। আমার ধারণা, তখন তার বয়স বারো আর আমার পনেরো। সেই বয়সে তার বুক দু’টো পুরুষ্টু হোয়ে উঠতে শুরু করেছিল। সে আমাকে বলছিল যে তার বুক দু’টো খুব স্পর্শকাতর। সে তাদের উপর আঙ্গুল বুলিয়ে চলেছিল, তাতে তার এমন অনুভূতি হয়েছিল যা আগে কখনও তার হয়নি, সেই অনুভূতি তার সারা দেহে ছড়িয়ে পড়েছিল। সে বুঝতেই পরেনি কী এমন হচ্ছে বা সেই স্পর্শে কেনই বা তার সারা শরীর এমন শিরশির থিরথির করে উঠছে। আমার মনে আছে, তারই মাঝে আমি তাকে বলে উঠেছিলাম যে সে নারী হোয়ে উঠছে, সে কামজ হোয়ে উঠছে – এই নয় যে আমি নিজে সবকিছু জানতাম।
সে আমার কথা হেসে উড়িয়ে দিল যেভাবে সে সবকিছু উড়িয়ে দেয়, কাউকে বুঝতে দেয় না সে কী বুঝল না বুঝল। আমার বুকটা পরীক্ষা করে সে বলল, স্তন সম্পর্কে তুমি কিছুই বোঝো না। আমি তাকে বললাম, ভুলটা আমি অনেক পরে বুঝেছি। আর সকলের যেমন হয়, মিথ্যাটা সত্যের মতোই আমার মুখ ফসকে খুব সহজে বেরিয়ে এল। আমার মা এবং তাকে যারা চিনতে তাদের আমি বলেছিলাম যে তাকে কখনও যেন জানতে না দেওয়া হয় কেন আমার বুকে স্তন নাই। সেইদিন ও তার পরের বেশ কয়েকদিন দীর্ঘক্ষণ ধরে আমাকে উত্যক্ত করে চলেছিল। অবশ্য তাতে তেমন খারাপ কিছু লাগেনি, এটা ছিল তেমনই যেমন ভাই-বোনের মধ্যে কেউ বলে যে তার মাথাটা বেশ ঢাউস, কিন্তু অন্য কাউকে ওই একই কথ বললে সে বিচলিত হোয়ে উঠতেই পারে।
তারপর সেটা এল। আমি সেটা লক্ষ্য করিনি। আমি আশা করেছিলাম, আসতে দেখলে আমি সেটা রুখে দেব। যখন আমি বুঝতে পারলাম যে যদি কেউ ভালো করে লক্ষ্য করে তবে সে অবশ্যই,সেটাকে দেখতে পাবে তার শিঙ, কাঁটা ও তার বেঢপ আকারের মাথা সহ – সেটাকে দেখতে তেমনই হবে বলে আমি কল্পনা করেছিলাম। আমি জানি না সে সেটা কখনো লক্ষ্য করেছিল কি না। কিন্তু আমার মনে হয়, না। কারুর দিকে এগিয়ে আসা একটা দানবকে দেখতে পাওয়ার বিভীষিকা এবং এমন কি স্বপ্নে সেইরকম কিছুর মধ্যে দিয়ে ছুটে যেতে না-পারাটা তার কাছে অসহ্য লাগত।
একবার আমি তাকে ক্লাসের ছেলেদের আমার বুকে স্তন গজিয়েছে বলে তাদের কীভাবে বোকা বানায় সেইকথা বলছিলাম। দিনটা ছিল শুক্রবার। স্তনের মতো দ্যাখাতে চেয়ে আমি জামার মধ্যে মেয়েদের প্যান্টিহোস ঢুকিয়ে তার উপর মা’য়ের ব্রা পরে ছিলাম। এইরকম অসম্ভব সম্ভাবনা দেখেও বোকা ছেলেরা অবাক না হোয়ে পারেনি। একদিনের ম্যধ্য আমার বুকে স্তন গজিয়ে ওঠা কীভাবে সম্ভব হোতে পারে?
তো, ছেলেরা সারাদিন আমার দিকে চেয়ে তাকিয়েই ছিল, তারা বুঝল যে হঠাৎই আমি ফুলফুলে হোয়ে উঠেছি, আমি তাকে বললাম।
আমি বাইরে প্রকৃতির দিকে তাকালাম, সেখান আমার মা’য়ের বাগান শুরু, দূর দিগন্ত পর্য্যন্ত বিস্তৃত। বনের পিছনে সূর্য্য ঢলে পড়ছে। ধুলো উড়ছে সর্ব্বত্র। যেখানে ধুলো বেশ ঘন, সেখানে মনে হোত তারা যেন এদিক ওদিক নাচ করতে করতে ঘুরে বেড়াচ্ছে। একটা অনুপম নাচছন্দ, সেই ধরনের নাচ যা আমার কল্পনায় মনে হোত বুঝি ঘটে চলেছে কোনো অপার্থিব জগতে, গ্রাম কে গ্রাম ছাড়িয়ে দূরে, বহুদূরে। গ্রামটা ক্রমশঃ নিঝুম শান্তু হোয়ে আসছিল। গ্রীষ্মের কুলকুল ঠান্ডা হাওয়া গ্রামের মানুষদের খালি পা ও হাতে কামড় দিতে শুরু করেছিল। সবকিছুই যেন ছায়াচিত্র, ঘোড়াগুলোও যারা দুলকি চালে ঘাসজমি মাড়িয়ে বেড়াচ্ছিল, গরুগুলো মুখ নামিয়ে চড়ে খাচ্ছিল, এবং উৎরাই থেকে নেমে আসছিল জলের ধারা। পাহাড়গুলো প্রাচীন, তবুও খাড়া হোয়ে দাঁড়িয়ে, নিসর্গের উপর তাদের বিস্তারিত দীর্ঘ ছায়া। ছায়ারা পাহাড় থেকে এতদূর অবধি প্রসারিত ছিল যে তারা তাদের সারবান অস্তিত্ব নিয়ে বিরাজ করতে শুরু করেছিল।
একটা গল্পের মাঝে আমি তাকে বলছিলাম, সে সামনে পিছনে আস্তে আস্তে দোল খাচ্ছিল, তারপর মাথাটা দেয়ালে ঠুকতে শুরু করল। আমার কিছুক্ষণ মনে হোল আমার কাহিনী তাকে দোলার ছন্দ যুগিয়ে চলেছে। যখন সে এই সবকিছু তার ভিতর থেকে উগরে বের করে দেওয়ার চেষ্টায় চিৎকার করতে শুরু করল, আমি আশঙ্কিত হোয়ে উঠলাম। ততক্ষণে সে তার মাথায় আঘাত খেয়ে বসেছে, দেয়ালে রক্তের দাগ ধরে গিয়েছে। সে অন্য কেউ হোয়ে উঠেছে। সে আর সেখানে ছিল না। তখনো সেখানে তার যতটুকু পড়ে ছিল আমি তা-ই ধরার চেষ্টা করলাম। আমি তাকে থামানোর চেষ্টা করলাম। আমি তার হাত দু’টো ধরলাম, তার পিছনে ধরে রাখলাম, আমার শরীরটা তার শরীরে শুইয়ে দিলাম। কিন্তু সে একটা প্রবল শক্তিতে খুব সহজেই ঠেলে সরিয়ে দিল, শক্তিটা তখনই এল যখন ব্যাপারটা তাকে ছিঁড়ে টুকরো টুকরো করে ফেলছিল। সেটা যদি না মাটির দেয়াল হোত, পুরানো না হোত, তবে তার মাথার খুলিটা ভেঙ্গে ঘিলু বেরিয়ে আসত। তা না হোয়ে সে তার মাথা দিয়ে দেযালে চিড় ধরিয়ে দিল।
আমার মা রক্তটা চেঁছে তুলে দেওয়ার পরে সেটা দেয়ালে বহুক্ষণ চোখে পড়ছিল, তার উপর তিন তিনবার লেপন দেওয়ার পরেও, তাতে জলরঙ ধরানোর পরেও। সাঙ্গোমা (শামান) এসে আমার বোন যেখানে মাথা ঠুকেছিল সেই জায়গাটা পূত করে তোলার পরেও দীর্ঘঁক্ষণ দাগগুলো রয়ে গিয়েছিল। আমি আমার স্বপ্নে রক্তের ছোপ দেখতে লাগলাম, আমার জামা-কাপড়ে, সবকিছুতে। বহু সূর্য্যাস্তের পরও রক্তের গন্ধ ঘ্রাণে লেগে রইল, এমন কি বৃষ্টি শুরু হওয়ার পরও।
অন্য এক সময়ে এমনই কিছু আমার বোনের মধ্যে অনুপ্রবেশ করেছিল বলে আমার মনে আছে যখন সে আমার গা’য়ে গরম পরিজ ছুঁড়ে দিয়েছিল। ব্যাপারটা যখন তার মধ্যে এসে হাজির হয়েছিল, সে একপাত্র পরিজের উপর ভেসে ছিল। সে মস্করা করছিল কিন্তু সে সেটা শেষ করতে পারেনি, তারই মাঝে সে পাত্রটা ঘরের মধ্যে ছুঁড়ে মেরেছিল। সেটা আমার মুখে এসে লাগেনি বটে, কিন্তু আমার বুকটার সেই ভাগ্য ছিল না। গোল কুঁড়ে ঘরটার দরজার নিচের দিকটা আধাআধি খুলতে পেরেছিলাম কি না তা আমি মনে করতে পারি না, কিন্তু আমি বাইরে দাঁড়িয়ে ছিলাম, পোশাক খুলে ফেলে আমি তখন উলঙ্গ। অসহ্য যন্ত্রণা হচ্ছিল। ঘন্টা কয়েক পর যখন সে তার চেতনা ফিরে পায়, আমার যা অবস্থা হয়েছিল তা দেখে সে স্থম্ভিত ও দিশেহারা হোয়ে যায়। আমি তাকে বলি যে আমি ভুল করে গা’য়ে গরম জল ঢেলে ফেলেছি। সে নিজেকে ক্ষমা করতে পারেনি, তবুও।
পরের কয়েক মাসে পরিস্থিতির কিছু শুধার না হলেও, নভেম্বরে পরিস্থিতি আরও বিগড়ে ওঠে। ব্যাপারটা, এই ব্যাপারটা তাকে গ্রাস করে স্কুল পর্য্যন্ত টেনে নিয়ে গিয়েছিল। এবং তাকে স্কুল ছাড়তে হয়েছিল। ক্লাসে থাকলেও তার ব্যাপারটা ঘটত। তখন তার এত জোর বেড়ে যেত, সে নিজের উপর এমন নিয়ন্ত্রণ হারিয়ে ফেলত যে একদিন ঘরের একটা ডেস্ক উল্টিয়ে ফেলে দিয়েছিল, একটা জানালা ভেঙ্গে চুড়মার করে ফেলেছিল। যখন আমি তার ক্লাসে এসে পৌঁছাই, তখন সবাই দাঁড়িয়ে দেখছিল। সে দেয়ালে ঘা মেরে একটা চেয়ারও ভেঙ্গে দিয়েছিল, সে চিৎকার করে এমন সব কথা বলছিল আমি যার কিছুই বুঝতে পারিনি। আমি তার থেকে একটু দূরে এসে দাঁড়ালাম। সে শুধু আমার চোখে চোখ রেখে স্থির হোয়ে ছিল। দয়া করে আমার চোখের দিকে তাকাও, আমি মিনতি করে বললাম। তার চোখগুলো রক্তের মতো লাল হোয়ে উঠেছিল, তার সারা দেহ থরথর করে কাঁপছিল। জনতার হতভম্ব মুখগুলোর দিকে তাকিয়ে নিয়ে সে যখন আমার দিকে চেয়ে তাকাল, সে চিৎকার করা থামিয়ে দিল। সে আমাকে বুঝত। আমি সোজা তার চোখের দিকে তাকালাম এবং আমি বুঝতে পারলাম ব্যাপারটা কেটে যাচ্ছে। আমার বোন নিজের মধ্যে ফিরে আসছে, আবার।
ওই ঘটনার পর আমি স্কুল থেকে পালিয়ে এলাম। প্রতিদিন সকাল হলেই আমার বমি পেত। মা’কে বোঝালাম আমার একটা কিছু অসুখ হয়েছে। মা আমার স্কুলের একটা ছেলেকে ডেকে পাঠাল এবং আমার ক্লাস টিচারকে বলতে বলল যে আমি অসুখে পড়েছি।
আমি তোর সঙ্গে একই ক্লাসে থাকতে চাই, আমি আমার বোনকে বললাম। কাজেই যতদিন না তুই ভালো হোয়ে উঠিস আমি অপেক্ষা করে থাকবো, তারপর আবার আমরা একসঙ্গে স্কুলে যাবো।
তারা কেউ কিছুতেই তা করতে দেবে না। মা, স্কুলের শিক্ষকরা, এবং প্রিন্সিপাল।
হ্যাঁ, তারা অনুমতি দেবে। এটা এই নয় যে আমি এক ক্লাস নিচুতে পড়তে চাই। আমি শুধু তোর সঙ্গে একই ক্লাসে পড়বো।
সেই সপ্তাহে সে আর আমি ছবি এঁকে কাটালাম। একটা পেন্সিল নিয়ে সে কাগজে আমার ছবি আঁকল, কাগজে আমি জীবন্ত হোয়ে উঠলাম, এ যেন আর এক আমি, আরও সুখী, আরও পূর্ণ, আমার অস্তিত্ব সর্ব্বত্র বিরাজ করতে লাগল।
সে আমাকে স্কুল যাওয়ার জন্য বারবার মিনতি করে চলল এবং আমাকে আশ্বস্ত করল সে ভালো হোয়ে উঠবে, প্রতিদিন ফিরে এলে সে আমার জন্য নতুন নতুন ছবি আঁকবে।
আমরা কথা বলে দিন কাটালাম, আমার মা’য়ের পা’য়ের আওয়াজের জন্য একটা কান খাড়া হোয়ে থাকত। দরজা বন্ধ হওয়ার শব্দে আমরা বুঝতে পারতাম মা আসছে, যখন মা ভিতর বাড়ি থেকে কোথাও বেরিয়ে আসত, তখন আমাদের বাড়ির দরজা দিয়ে প্রথমে তার ছায়া চোখে পড়ত।
আমার মা আমার বোনকে আরও অনেক সাঙ্গোমার কাছে নিয়ে যেতে লাগল, আরও অনেক গির্জায় – তাকে বোতল বোতল দাওয়াই খাওয়াল। ওষুধে তার কোনো কাজ দিল না। সে শুধু মাথা নাড়াত, মাথা ঝাঁকিয়ে উঠত অসতর্ক মুহূর্তে – তেমন আর কিছু হোত না। পরে বোঝা গিয়েছিল যে সপ্তাহ ধরে আমার স্কুল কামাই করা সত্ত্বেও খাতায় দাগ পড়েনি। এই নিয়ে আমার ক্লাস টিচার বা আমার কোনো মাথাব্যথা ছিল না। কয়েক বছর ধরে আমার বোন এত স্কুল কামাই করার সূত্রে আমি তাকে ধরে ফেলেছিলাম, এবং বস্তুতঃ তার চেয়ে আমি দু’ক্লাস উঁচুতে উঠে যাই।
আমার স্কুলে ফিরে আসার এক সপ্তাহ পর, শিক্ষক আমাদের সিজোফ্রেনিয়া অসুখ নিয়ে কিছু বললেন এবং তখন আমি জানতে পারলাম যে আমার বোনের ঠিক এটাই হয়েছে, এবং সে যেসব ওষুধ খাচ্ছে তাতে কাজের কাজ কিছু হবে না, বরং তা তার ক্ষতিই করছে। শিক্ষক আমাদের বললেন যে এর কোনো ওষুধ নাই কিন্তু আমি বুঝলাম যে আমার বোনকে সবকিছু অনুভব করার সামর্থ্য অর্জ্জন করতে হবে।
প্রথমে আমার বোন ও আমি গুষ্ঠিশুদ্ধ সব ওষুধকে ঝেড়ে ফেললাম। এটা গোপনে করতে হবে, আমি বললাম। আমাদের মা’র কাছ থেকে দূরে বহুদূরে হেঁটে গিয়ে আমরা কিছু গর্ত খুঁড়লাম, এবং তাকে যেসব জড়িবুটি চিবুতে হোত সেগুলো সব মাটিতে পুঁতে দিলাম। পাচন রসের গুষ্ঠিতুষ্টি করার জন্য কী করে সেটাকে মগে ঢেলে শূন্য চুমুক দিতে হবে তা তাকে বুঝিয়ে বললাম, এবং যখন আশেপাশে কেউ থাকবে না, তখন সেটাকে ফেলে দিতে হবে পিছনের জানালা দিয়ে যার নিচেয় ঘাস গজিয়ে উঠেছিল। সেই জানালা দিয়ে চোখে পড়ে একটা বিশাল নিসর্গভূমি, সেখানে গরু-বাছুর চড়ে বেড়াত। মা যখন জিগ্যেস করবে আমি তোকে দাওয়াই খাইয়েছি কি না, তুই শুধু ঘাড় নেড়ে যাবি, আমি বললাম তাকে।
পরের দিন সোমবার বিকেলে আমি স্কুল থেকে ফিরে এলাম, সে আমাকে বাড়িতে নিয়ে এল, ওষুধ ডালল, এবং শূন্য চুমুক দিল। এবং হেসে সেটাকে জানালা গলিয়ে ফেলে দিল। এটাই ছিল আমাদের খেলা।
সে নিজেকে চিনতে শুরু করল। সে ও আমি আবার নিজেদের মধ্যে কথা বলতে লাগলাম। আমরা নিজেদের ভাষা উদ্ভাবন করে ফেললাম কারণ সে কথা বলা বন্ধ করে দিয়েছিল। আমরা শুধু নিজেদের মধ্যে ইশারা বিনিময় করে চললাম। তারপর কিছু সময় কেটে যাওয়ার পর তার সঙ্গে একটা দু’টো কথাও জুড়ে দিতে লাগলাম।
আমরা একে অপরকে ভালোবসতে লাগলাম, আবার। আমার সেইদিনের কথা মনে আছে যখন আবার আমাদের মধ্যে সেই সংযোগ গড়ে উঠল। আমরা যে-ঘরে বসতাম, আমরা তখন সেই ঘরেই ছিলাম, যেমন করে সবসময় বাইরের প্রকৃতির দিকে, পাহাড়ের দিকে তাকিয়ে থাকতাম, তেমন করেই চেয়ে তাকিয়ে রইলাম, তাকিয়ে রইলাম দিগন্তের সূর্য্যরে পানে, তাকিয়ে রইলাম যতক্ষণ না আমাদের চোখগুলো ধাঁধিয়ে উঠে আর বেশী তাকিয়ে থাকতে পারল না। দিনটা ছিল মন খুলে বাইরে তাকিয়ে থাকার, সামান্য একটু হাসি থেকে আরও হেসে গড়িয়ে পড়ার, দিনটা ছিল কাঁদার, পরস্পরের হাত ধরাধরি করে থাকার।
আমরা সেখানে বসে রইলাম, দেখলাম দিনটা আমাদের সামনে দিয়ে গড়িয়ে চলেছে। আমাদের মুখ দিয়ে একটা কথাও বেরিয়ে এল না, আমরা চুপ করেই থাকার চেষ্টা করে রইলাম। তখন আমার উপলব্ধি হোল যে তার ও আমার কথা বলার কোনো মানে হয় না।
সেইদিন বিকেলের দিকে বৃষ্টি ঝরতে শুরু করল। আমি তাকে বাড়ির বাইরে টেনে নিয়ে গেলাম। আমরা বৃষ্টিতে লাফালাফি করে উঠলাম, আমরা চাইলাম আরও বৃষ্টি আমাদের উপর ঝরঝর করে ঝরে পড়ুক যাতে আমরা খুব লম্বা, বড়োসড়ো হোয়ে উঠতে পারি, আমাদের দেহে শক্তি ও সাহস ফিরে আসে। ঠিক সেই সময়ে আমার বোন তার নিজের মধ্যে ফিরে এল, সে মৃদু হাসল, সেই হাসি ছড়িয়ে পড়ল তার মুখে। সেইদিন আমরা আমাদের নূতন শৈশবের স্মৃতি জমিয়ে তুলতে শুরু করলাম, সেই শূন্যতাকে ভরিয়ে তুললাম যা মুছে গিয়েছিল।
আমরা বৃষ্টি ভেজা মাটিতে শুয়ে রইলাম, হাত-পাগুলো ছড়িয়ে দিলাম। বৃষ্টি পড়তে লাগল আমাদের মুখের উপর। আমরা মুক্তির স্বাদ অনুভব করলাম। কিন্তু আমাদের মা আমাদের হাসাহাসি ও লাফালাফি করতে দেখেছিল। তাতে মা’র ভাবনা হোল যে আবার সেটা ফিরে আসছে।
পরের দিন গোটা গ্রাম আমাদের বাড়ির বাইরে এসে ভিড় জমাল। আমার বোনের চিকিৎসার জন্য যজ্ঞের মতো আরও একটা কিছু হবে। তাকে গীর্জার বিধান সহ এইরকম আরও অনেক কিছু সহ্য করতে হয়েছে – কিছুতেই কিছু হয়নি। প্রতিবার সাঙ্গোমা আর গির্জার যাজকরা বলেছিল, ও কিছুদিনের মধ্যেই ভালো হোয়ে উঠবে। একবার, অন্ততঃ বঢ়িষ্টদের মতে, সাঙ্গোমারা আশার আলো দেখতে পেয়েছিল। অনেক তামাশার মধ্যে তখন রাত্রে গোলঘরে তামাক, মাংস ও দেশলাই কাঠি পূর্ব্ব-পুরুষদের উদ্দেশ্যে সাজিয়ে রাখা হয়েছিল, পরের দিন সেগুলোর আর খোঁজ পাওয়া যায়নি, তাতে তাদের বিশ্বাস জন্মেছিল যে পূর্ব্ব-পুরুষরা তাকে সারিয়ে তুলেছে। বেশ কিছুদিন পর তার আবার তেমন ঘটেছিল, তাতে না কি এটাই প্রমাণিত হয়েছে যে চোরেরা এসে তামাক, মাংস ও দেশলাই কাঠি সব চুরি করে নিয়েছে।
আমার মনে আছে, যেদিন ওইসব শাস্ত্রকম্ম চলছিল আকাশ দিয়ে দুর দুর করে মেঘ ভেসে যাচ্ছিল। ঘন তুয়াশা থিকথিক করছিল ঘাসের উপর, পাহাড়ের বুকে, নদীর বাঁকে – যেন মৃত্যুঘন্টা ঘোষিত হোয়ে চলেছে। কুয়াশা এত নিচুতে ঝুলে ছিল যে দেখে মনে হচ্ছিল মানুষগুলো হাঁটুকাটা পা নিয়ে ভেসে বেড়াচ্ছে। লোকজন চোখে ভেসে ওঠার বহু আগে থেকেই মেয়েদের কথাবার্তা ও গান আমাদের কানে এসে পৌঁছাচ্ছিল। মনে হচ্ছিল কুয়াশা যেন তাদের গিলে খেয়েছে, মেয়েদের আর বুঝি চোখে দ্যাখা যাবে না। তা সত্ত্বেও, তাদের দ্যাখা গিয়েছিল। তারা আমাদের বাড়ির দিকে আসতে আসতে উলুধ্বনি দিচ্ছিল, গান সঙ্কীর্তন করছিল।
অনেক মানুষ আসার সময় কোনো কথা বলছিল না। তাদের হাতগুলো পিছনে ভাঁজ করা, সঙ্গে লাঠি।
মেয়েরা আসার কিছুক্ষনের মধ্যেই উনুনের ধুঁয়া আকাশে মিলিয়ে গিয়েছিল, আকাশকে নৃত্যাঙ্গন করে ধুঁয়ারা উড়ে চলা মেঘেদের সঙ্গে নাচে মেতে উঠেছিল। ছেলেরা ছুটোছুটি করে বল খেলছিল – বল তো নয়, কাগজ ভরা প্ল্যাস্টিক প্যাকেট। সবাই ঘুরছিল ফিরছিল একটা উচ্ছৃঙ্খল নাচের তালে। একটা মোটকা মেয়ে মাথায় জলভরা কলসি নিয়ে হেলে দুলে তার ভারসাম্য রক্ষা করছিল। একটা বাচ্চাছেলে টেবিলের চাদর ঝুলিয়ে যাচ্ছিল। একটা কুকুর মুখে একটুকরো হাড় নিয়ে ছুটে চলেছিল। মুরগিরা চিক চিক করে ছুটে বেড়চ্ছিল। মহিলারা আমার বোনকে নিয়ে গল্পগুজব করছিল। আমাদের বাড়ি থেকে আমি দেখতে পাচ্ছিলাম, আরও লোক আসতেই বিশৃঙ্খলা আরও জমে উঠছে।
আমি আমার বোনের দিকে চাইলাম, তার মুখটা দেখলাম, অতীতের মতোই উদাস। গত কয়েক দিনে সে আমার মনে আশা জাগিয়ে তুলেছিল যে সে তার নিজের মধ্যে ফিরে এসেছে। এখন তার চোখের জল গাল বেয়ে গড়িয়ে পড়ছে। তখন আমি বুঝলাম সে কিছু একটা অনুভব করছে। গত কয়েক দিনে হাতে হাত ধরে থাকা, হাসতে হাসতে গড়িয়ে পড়া, বৃষ্টিতে ভিজতে ভিজতে লাফালাফি করাটা কোনো খোয়াব ছিল না।
কুয়াশা সরে যেতে শুরু করল। সবকিছু স্পষ্ট হোয়ে চোখে পড়তে লাগল। পাহাড়, প্রকৃতি, নদী ও অন্যান্য সব গ্রাম যেমন ছিল, তেমনই অনড়।
একটা বুড়ো মানুষ যে বেড়ার (ক্র্যালের) পিছনে পাইপে টান দিচ্ছিল, তার তামাক ফুরিয়ে এল, এবং সেটা সে পাকেটে ঢুকিয়ে রাখল। শাস্ত্রকর্ম্ম শুরু হোল। ছুরি ছোরা বেরিয়ে এল। প্রথমে ছাগলটার পেটে ছুরি খুঁচিয়ে আমার পূর্ব্ব-পুরুষদের আহ্বান করা হোল তাদের জগৎ থেকে। এবং তারপর শুধু মাংস।
কিছুক্ষণ পর এক বুড়ি খুড়িমা এল, আমাদেরকে বাড়ির বাইরে আসতে বলল। আমি ও আমার বোন তাকে জড়িয়ে ধরলাম। আমরা একে অপরের চোখ মুছিয়ে দিলাম। তার আমাদের বাড়ির দিকে এগিয়ে আসার শব্দ শুনেই আমরা বেরিয়ে আসি, হাতে হাত ধরে, আঙ্গুলে আ¹ুল জড়িয়ে। আমরা এমন জোরে জড়িয়ে ধরে ছিলাম যে আমাকে তার কাছ থেকে ছাড়িয়ে আলাদা করতে হোলে আমাদের কেটে ফেলে তবেই তা করতে হয়।
গ্রামের লোকেরা ব্যাপার-স্যাপার দেখে চিৎকার করে অনেক অকথা কুকথা বলল, কিন্তু তা যে কী তা জানার উপায় ছিল না। কারণ সেটা একটা গোটা জীবনের অনুভূতির মতো মনে হোল। আমি ও আমার বোন ক্র্যালের এক কোনে এসে বসলাম, আমাদের মাথা অবনত, বঢ়িষ্টরা এটাকে শয়তান ও দানবের কর্ম্ম বলে ধারণা করল। তাদের কেউই আমার বোনকে জানত না। তাদের কেউই সেটা জানার ধার ধারত না। সূর্য্য তখন অনেকটা উঠে এসেছে। আমাদের বাড়ির আশেপাশে তার ঘন ছায়া ছড়িয়ে পড়েছে। যদিও বাতাস ছিল না, মাঠের হাওয়া-কলগুলো ক্রিক ক্রিক আওয়াজ করে চলেছিল।
আমার মা ভেঙ্গে পড়েছিল, তাকে হতাশ লাগছিল, সওয়াল করছিল ঈশ্বর কেন আমার বোনের এমন কেেছ – এবং আমার বাবার। গোপন কথাটা অনেক দিন ধরেই চাপা পড়ে ছিল, কিন্তু একদিন সেটা মৃত্তিকা ভেদ করে বীজের মতো জেগে উঠল। কেউ কখনো মুখ ফুটে বলেওনি যে আমার বাবারও এমন হয়েছিল। বাবা একদিন তার ঘোড়ায় চড়ে আত্মীয়ের বাড়ি গিয়েছিল, সেই যে গিয়েছিল আর ফিরেও আসেনি। তাকে দেখতে পাওয়া মানে মৃত্যুর পরে মৃতকে স্বপ্নে বা মায়াদর্শনে দেখতে পাওয়ার মতো।
বার দু’য়েক বাবাকে কোনো গ্রামে দেখতে পাওয়া গিয়েছিল, আমার মা তাই বলল। যে-লোকটা তাকে চিনত সে তার উদ্দশ্যে চিৎকার করে হাঁক পেড়ে হাত নেড়েছিল কিন্তু বাবা তার দিকে তাকিয়ে দেখতেও চায়নি। তারা নিশ্চিতও ছিল না সে আমার বাবা কি না। কিন্তু তারা বুঝেছিল সে আমার বাবা-ই। এখন কুড়ি বছর কেটে গিয়েছে, তাকে কখনো সমাধি দেওয়া হয়নি। সমাধি দেওয়ারও কিছু ছিল না। আমার মনে বাবার কোনো স্মৃতি নাই। তবে একটা আশা অবশ্য জেগে ছিল যে একদিন বাবা কোথাও থেকে ফিরে আসবে। যতদিন না সে ফিরে আসে, কেউ জানত না সে কোথা থেকে ফিরে আসবে, তা নিয়ে কারুর মাথাব্যথাও ছিল না।
শাস্ত্রানুষ্ঠানের রাতে আমার বোন ও আমি একইভাবে শুয়ে ছিলাম, অন্যদিকে মাথা রেখে নয়। আমি জেগে উঠলাম, সে আমাকে আঁকড়ে ধরল, পিষে চেপে ধরল। এবং সে দাঁতগুলো বালিশে ডুবিয়ে দিল যাতে না সে কেঁদে পারে। তার শরীরটা কিছুক্ষণ ঝাঁকুনি খেয়ে উঠল, তারপর সে আমার বুকের উপর ঘুমিয়ে পড়ল।
সকালে আমি ছাগলটার দুধ দুইতে গেলাম। দেখলাম দু’টো মনুষ্য ছায়া ক্র্যালের উপর ভেসে আছে। প্রথমে এটা অস্বাভাবিক মনে হলেও, এমন কি তারা যখন নিজেদের মধ্যে বিড়বিড় করে কিছু বলছিল, আমি তা নিয়ে কিছু ভাবলামও না। ছায়ার মধ্যেই তারা ক্র্যালের ভিতর লাফিয়ে পড়ল, গোবরের গন্ধ নাকে ভেসে এল। আমি আমার মাকে দেখতে পেলাম, তার সঙ্গে এক কাকা যে আমাদের সঙ্গে অনুষ্ঠানের দিন থাকতে এসেছিল। মনে হোল তাদের মাথা দু’টো একসঙ্গে জোড়া, দু’টো মিশে একটা বিশাল মাথা, এমন কি একটা ভূতও হোতে পারে। আমি উঠবো উঠবো করছিলাম, ঠিক তখনই আমি তাদের আমার বোনের কথা বলতে শুনতে পেলাম। আমি দুধের জগটা নামিয়ে রাখলাম এবং বসে পড়লাম ছাগলের গা’য়ে ঠেস দিয়ে যাতে ছাগলটা না নড়তে পারে। আমার মা ও কুচুটে লোকটা যে আমার মা’য়ের সঙ্গে বাড়ি ছেড়ে বেরিয়ে এসেছিল তারা আমার বোনকে কোথাও নিয়ে যাওয়ার মতলব করছিল।
ওষুধপালা ও পূজার্চ্চনা করে তো কিছু কাজ হোল না, আমার মা বলল। সে যা বুঝল তা হোল আমার বোনকে নকুঞ্জির কাছেই নিয়ে যাওয়াটাই ঠিক হবে। এই ব্যাপারটা আবারও ঘটবে, সে বলল।
নকুঞ্জি এক প্রত্যন্ত গ্রামের মাঙ্গোমা, সেই গ্রামের বাড়িগুলো এমনই যে একটা বাড়ি থেকে আর একটা বাড়ির দূরত্ব মাইলের পর মাইল। লোকটা আমার বোনের মতো কাউকে আগুনে ঝলসে মারার জন্য সিদ্ধহস্ত। শোনা যায় যে কোনো গাড়ি গ্রামে এসে থামলেই তার লোকজন নকুঞ্জিকে চিৎকার করে ডেকে বাড়ি থেকে বেরিয়ে আসতে বলে। তোমার দানবরা এসেছে, তারা বলত।
আমার বোন তাকে কুচুটে বলে ডাকত, মা কুচুটের কথায় সায় দিল। আমরা তার সন্তান ছিলাম না, সে কেন আমাদের ব্যাপারে নাক গলাবে? সেটাই হবে বলে তারা ঠিক করল : পরের দিন আমার বোনকে নকুঞ্জির কাছে নিয়ে যাওয়া হবে, সে তাকে আগুনে ঝলসাবে। সেটাই তারা সেইসব লোককে করত যারা কারুর কণ্ঠস্বর শুনতে পেত, তাদেরই তারা দানব বলত। তাদের তারা পুড়িয়ে ঝলসাত যতক্ষণ দানবভূত ভেগে পালায়। পুড়িয়ে ঝলসানোর চেয়ে আরও ভয়ঙ্কর ছিল লোকেদের বিশ্বাস করে তাদের কাছে আসাটা।
নকুঞ্জি কীভাবে লোকজনকে পুড়িয়ে ঝলসায় তা আমি শুনেছিলাম। সে গোবর আর কাঠ দিয়ে আগুন জ্বালত, আগুন যখন লাল হোয়ে উঠত, সে দানবগ্রস্ত লোককে দস্তার ছাদের একপাশে বাঁধত, তারপর দস্তার ছাদটাকে আগুনের কাছে টেনে নিয়ে আসত। দাবি করত সে দানবকে পুড়িয়ে মারছে, পোড়া ঘা এক সপ্তাহের মধ্যে ভালো হোয়ে যাবে। আমি শুনিনি তাতে কেউ মরে যেত কি না, এটাও শুনিনি কেউ বেঁচে থাকত কি না।
আমি আমার বোনের এইরকম হোতে দিতে পারি না।
সূর্যাস্তের পর আমি জিনিসপত্র গুছিয়ে নিলাম এবং আমরা একসঙ্গে বাড়ি ছেড়ে চলে গেলাম। গোধূলি আলো নেমে আসছিল। কোথায় যাবো আমি কিছু ভাবতে পারলাম না। প্রথমে আমরা প্রধান সড়কের এদিকে ওদিকে ঘুরে বেড়ালাম, তারপর আমি দেখলাম অনেক চোখ আমাদের দিকে সন্দেহের চোখে তাকিয়ে আছে। তখন আমি উল্টো রাস্তা ধরলাম এবং উপত্যকার গভীরে অদৃশ্য হোয়ে গেলাম। আমার বোন আমার হাতটা শক্ত কোরে ধরে ছিল। সে যা জানার দরকার মনে করেনি আমি তাকে তা বললাম না। আমরা একজন অসুস্থ খুড়িকে দেখতে যাচ্ছিলাম। কাল ভোরের সূর্য্য ওঠার আগেই তাকে দেখতে পেতে হবে, আমি তাকে বললাম।
খুড়ি বলে সত্যিই এমন কেউ ছিল না যার অসুখ হয়েছে।
নদীর পার ধরে আমরা উপত্যকা দিয়ে হেঁটে চললাম। তারপর এসে পৌঁছালাম একটা জলভর্তি টিলার বেড়ার উপরে, বেড়াটা ভেঙ্গে মাটিতে পড়ে আছে। পিচের রাস্তা ধরে আমরা একটা সেতুতে এসে উঠলাম। আমরা দু’জনই জলকে ভয় করতাম, তাই আমরা সেতু পার হোয়ে নদীর ধার ঘেষা একটা রাস্তা ধরে হাঁটতে লাগলাম।
আমরা বুঝতেই পারিনি যে কখন রাত্তির হোয়ে এসেছে। হঠাৎই একটা বিশাল চাঁদ আমাদের মাথার উপর চোরের মতো উঁিক মেরে উঠল। নক্ষত্ররা এমন নকশা বুনে চলল যা শুধু ঈশ্বররাই বুঝতে পারে। পর্ব্বত ও নিসর্গের ছবি এখন শুধু নিছকই আকারের বিশাল অস্ফুট আকৃতি, তা আমাদের ক্ষুদ্রকায় করে তুলছে, তখন আমাদের সত্যিই তেমন লাগছিল, তখন দুনিয়ায় আমরাই শুধু যা কিছটাু উপস্থিত।
আমরা নদী ধরে হাঁটতে হাঁটতে সেটা ছেড়ে একটা পাহাড়ের উপর হাঁটতে লাগলাম, অন্য দিক দিয়ে নেমে তারপর একটা গ্রামে। আমি ঠিক বুঝতে পারলাম না সেটা ফিলানি গ্রাম না কি অন্য গ্রাম। আগে একবারই মাত্র আমি সেখানে গিয়েছি, এমন কি সেই যাওয়া বাস্তবও ছিল না। নতুন বাড়িতে উঠে আসার আগে আমার মা তার একটা কিস্যায় কথাটা বলেছিল – কুচুটেকে নিয়ে আমার বাবা ও আমাদের ত্যাগ করার একসপ্তাহ পরে।
পাহাড় থেকে নেমেই দেখলাম আমরা একটা অদ্ভুত গ্রামে এসে পড়েছি। এসেই প্রথম বাড়ির দরজায় ঠক ঠক করে আওয়াজ করলাম। সেখানে সবাই ঘুমিয়ে, আলো জ্বলছিল। সেটাই আমাদের প্রথম পরিকল্পনা ছিল, কিন্তু ভুল পরিকল্পনা। গ্রামের সবাই সবাইকে চেনে। আমি ভাবলাম যাকেই কাছেই কোথাও ঘুমোবার একটা জায়গার কথা কাউকে জিগ্যেস করব, যদি আমাদের মিথ্যা বলতে হয় এবং মিথ্যা নাম বলতে হয়, তাই বলব। তাদের বলব আমরা পাশের গ্রামে যাব, কিন্তু কোনো কারণে আমরা দেরী করে ফেলেছি। তারা নিশ্চয় আমাদের চিনে ফেলবে, কারণ আমাদের কানটা আমার ঠাকুর্দার মতো কিম্বা নাকটা আমার মা’য়ের মতো কিম্বা যখন আমরা হাঁটি হাঁটি পা-পা করতাম তখন তারা অমাদের দেখে থাকবে, এবং অমাদের পোঁদে চাপড় মেরে থাকবে। লোকে সবসময় বলত, আমার বোনের কপালটা আমার ঠাকুর্দার মতো। পরিকল্পনাটা ছিল খুব ঝুঁকির।
আমরা খুব কাছে এসে পড়েছি, আমি আমার বোনকে বললাম। কীসের কাছে, আমার ধারণা ছিল না। তবুও আমরা এগিয়ে চললাম, মনে হোল যেন আমরা যেখানে যাচ্ছি সেখানে এসে পড়েছি, সেটা যে কোথায় তার কোনো নিশ্চয়তা ছিল না। একটাই বলার মতো ব্যাপার যে আমরা বাড়ি থেকে বহুদূরে চলে এসেছি।
আমরা কোথায় রাত কাটাব, আমরা কী খাব, আমরা কীভাবে বাঁচব সেই সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না, কিন্তু বাড়ি ফিরে যাওয়ার কোনো সম্ভাবনা ছিল না। হয়ত’ কখনো যদি আমার মা মারা যায়, আমি বললাম, হয়ত’ তখন আমরা ফিরে যেতে পারি।
আমরা ফিলানি গ্রাম পার হোয়ে এলাম – আমি তখনো ঠিক জানতাম না এটা কোন গ্রাম – আমাদের দেখে বা অন্য কিছুর উদ্দেশ্যে কুকুররা ঘেউ ঘেউ করছে, হয়ত’ কাছেই খাড়া হোয়ে থাকা একটা খুঁটির দিকে তাকিয়ে। কিছুক্ষণ না কাটতে কাটতেই আমরা আর একটা গ্রামে এসে পৌঁছালাম। আমরা কেন বাড়ি ছেড়ে চলেছি তা নিয়ে আমার বোন আর সওয়াল করছিল না। মাঝেমধ্যে সে আমার হাতটা চেপে ধরছিল, আমিও তাই করছিলাম।
আমরা কেন বাড়ি ছেড়ে পালিয়ে যাচ্ছি কয়েকবারই আমি আমার বোনকে বলার জন্য গভীরভাবে ভাবছিলাম কিন্তু আমি পারিনি। আমি বুঝতে পারছিলাম না ঠিক কোথা থেকে শুরু করব। শুরু করার মতো ঠিক জায়গাটা তখনো ছিল না, এখনো নাই, সত্যিকার কাহিনীটা বললে সেটা তাকে ভেঙ্গে গুঁড়িয়ে খানখান করে দিতে পারে।
আমার মা তার অসাড় ভাবটাকে খুব পছন্দ করে চলত। আমি একটা ভগ্নীকে পছন্দ করতাম। একটা হাস্যমুখ ভগ্নী, একটা উচ্ছ্বল উৎ.জ্জ্বল কথার ভগ্নী, একজন ভগ্নী যে আমার দিকে চেয়ে তাকিযে থাকবে – কাঁদবে, হাসবে। যখন কেউ জলের গভীরে তাকিয়ে জলকে ছলাৎ ছলাৎ করে চলে, তখন যেমন কারুর ভাবনায় কল্পনার উদয় হয, ঠিক তেমন। ঠিক এই রকমই হয় আমার বোনেরও। আমি তাকে বলতে চাই, সে মানসিক বিকারে ভুগছে যার কারণে সে বাস্তব থেকে কল্পনাকে আলাদা করতে পারে না।
কোথাও আমাদের চোখে আলো পড়ল না। বহুক্ষণ আগেই লোকজন সব ঘুমিয়ে পড়েছে। আমরা যে কোথায় আছি সেই সম্বন্ধে আমাদের কোনো ধারণা ছিল না কিন্তু বুঝতে পারলাম আমরা আরও একটা গ্রামে এসে পড়েছি। চাঁদটা কখন অন্তরালে চলে গিয়েছে, আকাশের নক্ষত্রগুলো বিন্দুর মতো লাগছে। সকাল হোয়ে এল বলে, আমি ভাবলাম, এবং আমি আমার বোনকে বললাম, সে ঘাড় নেড়ে হাসল।
এখন সময় কত তা নিয়ে আমরা ধারণা করতে পারলাম না। কিন্তু এটা ঠিক যে বাড়ি ছেড়ে আসার পর দীর্ঘ সময় কেটে গিয়েছে। আমাদের পা’য়ে ব্যথা করছিল। আমরা ঠিক করলাম, আমরা একটা গাছের তলায় ঘুমিয়ে কাটাব, সূর্য্য উঠলেই জেগে উঠে আবার হাঁটতে শুরু করব, এখান থেকে আর কোথাও যাওয়ার উদ্দেশ্য নিয়ে।