আমার শিক্ষকেরা–প্র দী প   ভ ট্টা চা র্য্য

প্রদীপ ভট্টাচার্যের জন্ম ১৯৫২ সালে কোচবিহার জেলার দিনহাটায় ।দিনহাটায় স্কুল জীবন শেষ করে শিলিগুড়িতে কলেজ জীবন শুরু।বর্তমান বাসস্থান শিলিগুড়ি পুরসভার 31নং ওয়ার্ডে সুকান্তপল্লীতে । ৭০ এর দশকের শুরু থেকেই নাট্যকার, অভিনেতা ও পরিচালক হিসেবে যথেষ্ট সুনাম অর্জন করেন। পরবর্তী কালে গল্প , কবিতা ও প্রবন্ধ উত্তরের বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় প্রকাশিত হয়। এই করোণা আবহে ঘরে বন্দি । ছোটবেলার বিভিন্ন স্মৃতি বিশেষ করে এবারের পূজোর পরিমণ্ডলে নিজের ছোটবেলার অভিজ্ঞতা তুলে ধরেছেন।বাইফোকালিজম-র পাতায় প্রতি বুধবার থাকছে তারই নস্টালজিয়ার খসড়া।

আমার শিক্ষকেরা

প্র দী প   ভ ট্টা চা র্য্য

বছর বিশেক আগে একদিন বিকেলে এক অতিবৃদ্ধ মানুষ আমার পাড়ায় এসে আমার খোঁজ করায় একজন উনাকে আমার বাড়িতে নিয়ে আসেন। আমি অনেকক্ষণ দেখেও ঠিক চিনতে পারছিলাম না। উনি কিন্তু আমাকে দেখে বললেন প্রায় চল্লিশ বছর পরে দেখলাম। তবুও দিব্যি চিনতে পারছি। মুখের আঁচের খুব একটা পরিবর্তন হয়নি। আমি তাও চিনতে না পারায় উনি নিজেই পরিচয় দিলেন। উনার পরিচয় পেয়ে খুবই লজ্জা পেয়েছিলাম। আবার খুব আনন্দও পেয়েছিলাম। উনি আমার প্রাইমারি স্কুলের হেডস্যার নলিনীবাবু, নলিনী সরকার। শিলিগুড়িতে প্রথমবার ছেলের সাথে দার্জিলিং-এ বেড়াতে এসেছিলেন। আসার আগে আমার খুড়তুতাে ভাইয়ের কাছ থেকে আমার ঠিকানাটিও নিয়ে এসেছিলেন। ছেলে-ছেলেবউ, নাতি হােটেলে বিশ্রাম নিচ্ছে সেই অবসরে স্যার আমার সাথে দেখা করতে এসেছেন। সেই মুহূর্তে আনন্দে আমার চোখে জল এসে গিয়েছিল। ঘটনাটা উল্লেখ করলাম এই কারণে যে, এ থেকে আমার ছোটবেলা ছাত্র-শিক্ষকের মধ্যে সম্পর্ক প্রাণের স্পন্দন কেমন ছিল তার একটা টুকরো পরিচয় মাত্র।

কতদিন আগে দিনহাটা ছেড়ে চলে এসেছি। তারও কতদিন আগে প্রাইমারি স্কুলে পড়তাম অবশ্য দিনহাটায় থাকার সময় নিয়মিত স্যারের সঙ্গে যােগাযােগ ছিল। সারের পশ্চিমপাড়ার বাড়িতে গিয়ে কতবার গাছে উঠে কাশির পেয়ারা পেড়ে খেয়েছি। আমার যতদূর মনে হয় আমার ছােটবেলায় মাস্টার মশাইদের সাথে আমাদের একটা প্রাণের বন্ধন ছিল। সেটা অবশ্য ভাল ছাত্র বা খারাপ ছাত্র এসব ভেবে নয়। তখন ছাত্র-শিক্ষকের সম্পর্ক কোন ভাবেই আখ্যায়িত ছিলনা। ছোটবেলায় আমাদের দিনহাটার বহু পরিবারের সাথে আমাদের খুবই সুসম্পর্ক ছিল। বহু সম্পন্ন অথবা দরিদ্র পরিবারেও আমাদের সম্মান ছিল অর্থাৎ তাদের বাড়ির সমস্ত ধর্মীয় আচার-অনুষ্ঠানে বাবা ছিলেন পুরােহিত আবার শিক্ষক হিসেবেও বাবা যথেষ্ট সম্মানীয় ছিলেন। ফলে দিনহাটায় বহু পরিবারের কাছে আমরা হয় ঠাকুরমশাইয়ের ছেলে অথবা মাস্টারমাশাইয়ের ছেলে বলে খাতির পেতাম। বাবা ছাত্র হিসেবে খুবই মেধাবী ছিলেন। সংস্কৃত এবং ইংরেজীতে মেধা ছিল প্রশ্নাতীত। বাবা আমার স্কুলের শিক্ষক ছিলেন ঠিকই কিন্তু স্কুলের শিক্ষকদের সাথে সখ্যতা ছিল গভীর অনেক স্যার আমাদের বাড়ীতে আসতেন, বাবার সাথে বসে বিভিন্ন বিষয় আলােচনা করতেন। ফলে শিক্ষকদের সাথে আমরা তিন ভাই-বােন খুবই স্বাচ্ছন্দ্য ছিলাম। আবার দুশ্চিন্তাও ছিল, ক্লাসে পড়া না পারলে বাবাকে বলে দেবার ভয়।
কত যে স্মৃতি!! আমার এক শিক্ষক ছিলেন শ্রদ্ধেয় উদয় মুন্সী। ক্লাস ফাইভ থেকে ইলেভেন পর্যন্ত কোন শিক্ষক যদি কোন কারণে আসতে না পারেন তবে সেই ক্লাস নেবার জন্য দু-জন শিক্ষক ছিলেন যারা ক্লাস নাইন থেকে ইলেভেনের ফিজিক্স, কেমিস্টি এবং ম্যাথ বাদে) সব বিষয়ে সাবলীল ভাবে পড়াতেন। এরা হলেন বাংলার শিক্ষক সুভাষ নাগ এবং ভূগোল শিক্ষক উদয় মুন্দী। সুভাষ স্যারের বাড়ি ছিল বারাে কিলােমিটার দুরে বাংলাদেশ সীমান্তে। স্যার প্রতিদিন সাইকেল চালিয়ে আসতেন। স্যার বাংলা পড়ালে ক্লাসের কোন ছাত্রকেই আর গল্প বা কবিতা বাড়িতে গিয়ে আলাদা করে পড়তে হত না। মানে বই-এর প্রয়োজন হত না। উদয় মুন্সী স্যার ভূগােল পড়াতেন। তাঁর ক্ষেত্রেও একই কথা প্রযােজ্য। উদয় স্যারের বাড়ি থানার দীঘির ঠিক উত্তর দিকে দীঘির ঠিক পাড়েই। স্যার খুব ভীতু ছিলেন। সারের সাথে আমাদের পারিবারিক ভাবে খুবই ভাল সম্পর্ক ছিল। স্যারের বাড়ীতে সুস্বাদু এবং প্রচুর ফলনশীল একটা মজফরপুরি লিচুগাছ ছিল। স্যারের মাতই স্যারের স্ত্রীও খুবই ভীতু ছিলেন। ছেলে খুবই ছোট ছিল। স্যার সন্ধে হওয়ার সাথে সাথেই ঘরে ঢুকে দরজা বন্ধ করে দিতেন। আমি খুবই সাহসী ডাকাবুকো ছিলাম। স্যার আমাকে বলতেন হ্যাঁ রে যদি সন্ধ্যের পর এদিকে আসিস তাহলে লিচুগুলাে একটু দেখিস তাে প্রতি বছর অনেক লিচু চুরি হয়।
আসলে প্রতি বছর আমি আর আমার এক বন্ধু জুড়ান মিলে মাঝে মাঝেই স্যারের গাছের লিচু চুরি করতাম। স্যার টের পেলেও দরজা খুলতেন না। মনে আছে এক রবিবারে দশটা-এগারােটা নাগাদ স্যার এক ব্যাগ ভর্তি লিচু নিয়ে এসে বাবাকে বললেন, “ক্ষেত্র এবার আর লিচু গাছটা বিক্রি করিনি। আজ লােক দিয়ে লিচুগুলাে পাড়ালাম। তাই তাের জন্যও নিয়ে এলাম বলে ব্যাগটা রাখলেন। তারপর গল্পগুজব করে চা খেয়ে চলে গেলেন। যাওয়ার সময় আমাকে বলে গেলেন তাের আর পাহারা দেবার দায়িত্ব থাকলাে না। লজ্জা পেয়েছিলাম কিনা জানিনা তবে তারপর থেকে আর কোনদিন স্যারের গাছের লিচু চুরি করিনি। আমরা ছােটবেলায় শিক্ষকের স্নেহ-ভালবাসা যেমন পেয়েছি তেমনি স্যারকে তার প্রাপ্য সম্মান দিতে কার্পণ্যও করিনি। আমার মনে আছে আমরা ছাত্ররা রাস্তা দিয়ে যাওয়ার সময় যদি স্যার আসছে দেখাতে পেতাম তাহলে স্যারকে অতিক্রম না করা পর্যন্ত মাথা নীচু করে পথ হাঁটতাম। কেউ সাইকেলে থাকলে সাইকেল থেকে নেমে মাথা নীচু করে হেঁটে স্যারকে অতিক্রম করে তবেই আবার সাইকেলে উঠতাে।
স্যারদের নিয়ে যে কত মজার স্মৃতি! কৃষ্ণবাবু বলে আমাদের এক ইতিহাসের শিক্ষক ছিলেন। স্যার ক্লাসে ঢুকেই ইতিহাসের একটা অংশ দিয়ে পরপর সবাইকে একটা করে লাইন পড়তে বলতেন এবং স্যার চোখ বুজে ঘুমােতেন। আমরা বই খুলে প্রত্যেকে পরপর একটা করে লাইন পড়ে যেতাম। কেউ যদি স্যারকে কারো বিরুদ্ধে নালিশ করতাে তাহলে স্যার ঘুমের মধ্যেই দুজনকে কান ধরে বেঞ্চের উপর দাঁড়াতে বলতেন। আমরাও ক্রমাগত নালিশ করতাম। একবার অনেকক্ষণ কেউ নালিশ করছে না দেখে চোখ খুলে দেখেন ক্লাসের সবাই বেঞ্চের উপর কান ধরে দাঁড়িয়ে আছে। জানিনা তারপর স্যারের কি হল। আর কোনদিন কান ধরে বেঞ্চের উপরে দাঁড়াতে বলেননি।
রােগা পাতলা ফজলুল স্যার আসতেন একটা টুপি মাথায় দিয়ে। ফজলুল স্যার স্কুলের পাশেই দিনহাটার একমাত্র মসজিদ, সেই মসজিদের মৌলবীও ছিলেন। উনি ক্লাস ফাইভ এবং সিক্স এই দুই ক্লাসের ছেলেদের আরবী পড়াতেন। তারপরে অবশ্য আর পড়তে হত না। আমাদের স্কুলে প্রতি শুক্রবার দুই পিরিয়ডে টিফিন হত। মুসলিম ছেলেদের নামাজের জন্য। ফজলুল স্যার মসজিদের মধ্যেই একটা ছোট্ট ঘরে থাকতেন। বিয়ে করেননি তাই নিজেই রান্না করে খেতেন। স্যার ছাত্রদের খুব স্নেহ করতেন। শুক্রবার স্যার একটা সাটিন কাপড়ের ঝোলা থেকে আমাদের প্রত্যেককে একটা করে নারকোল লজেন্স দিতেন। শুনেছিলাম স্যারের গীতালদহের কাছে অনেক জমি-জমা ছিল।
সাদা ধুতি-পাঞ্জাবী নিখুঁত ভাবে কাটা দাড়ি, ফর্সা সুন্দর, বিমানবাবু ছিলেন আমাদের বাংলা শিক্ষক। দেখলেই ভক্তি, শ্রদ্ধা, সব মিলিয়ে একটা অন্যরকম অনুভূতি হত। স্যারের দাদা বিকাশ বােস ছিল বদ্ধ উন্মাদ। বিকাশ পাগলা আর গজা পাগলা এই দুই পাগলকে নিয়ে অনেক মজার ঘটনা আছে সে সব অন্যসময় বলব। বিমানবাবুকে দেখলে ভক্তি শ্রদ্ধা ও সম্ভ্রমে মাথা এমনিই নত হয়ে যেত। মাঝে মাঝেই আসতেন বাবার কাছে।
    সুরেন স্যারের কথা না বললে লেখাটা অসম্পূর্ণ থেকে যাবে বাবার অন্তরঙ্গ বন্ধু আমাদের অঙ্ক স্যার। এমন অমায়িক মানুষ খুব কমই দেখেছি। ছাত্রদের কখনাে বকা তাে দুরের কথা একটু উঁচু গলায় কথা পর্যন্ত বলতেন না। ছােড়দির স্কুল ফাইনাল দেবার বছর নিয়ম করে নির্দিষ্ট সময়ে টেস্ট পেপার সল্ভ করাতে আসতেন। কোন টাকা পয়সার সম্পর্ক ছিল না।তাই বলে কখনও পড়ানােয় গাফিলতি দেখিনি একটাই দুঃখ স্যারেরা নিয়মিত বেতন পেতেন না। হাটবার করে ছাত্রদের মাইনে যা আদায় হত, তাই হেড স্যার সবাইকে ভাগ- বাটোয়ারা করে দিতেন। এখন অবশ্য সবই পাল্টেছে।

লেখা পাঠাতে পারেন
Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *