জ য় ন্ত    কু মা র    ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্যঃ অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা(দ্বাদশ পর্ব)

পরিচিতিঃ জন্ম- ১৯৫২, হুগলী শহর শিক্ষাদীক্ষাঃ স্নাতক- কবি, স্নাতকোত্তর- ববি; গবেষণাপত্রঃ উত্তরবঙ্গ উপ-হিমালয়ের বনবস্তির আর্থ-সামাজিক সমীক্ষা; প্রাক্তনী- বন্যপ্রাণ শাখা, বনবিভাগ (১৯৭৬-২০১২); জীববৈচিত্র্য-বাস্তুসংস্থান বিষয়ে গ্রন্থকার, জার্নাল-পর্যালোচক; দেশবিদেশে প্রকাশনা ১৪০। মুক্তির সন্ধানে সঙ্গীত চর্চা। বাইফোকালিজম্-র পাতায় আজ তাঁরই ধারাবাহিক গদ্য।

জ য় ন্ত    কু মা র    ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য(দ্বাদশ পর্ব)

 

অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা

 দ্বাদশ পর্ব
 চোরাশিকার

২০১৯ সালের মে মাসের কথা। বেলজিয়ামের ল্যামবুয়ার জঙ্গলে বসানো সিসিটিভি ক্যামেরায় ধরা পড়েছিল তার গতিবিধি, সঙ্গে ছিল তার ছানারাও। সেই শেষ। তার পর থেকে আর দেখা মেলেনি ‘নায়া’র। পরে বনকর্মীরা জানতে পারেন, চোরাশিকারির দল সন্তান-সহ শেষ করেছে নায়াকে। সম্ভবত অন্য জায়গায় থাকায় বেঁচে গিয়েছে তার পুরুষ সঙ্গীটি। নায়ার হত্যাকারীকে খুঁজতে বিপুল অঙ্কের পুরস্কারের ঘোষণা করেছিল পরিবেশপ্রেমী সংগঠনগুলি। ভারতীয় মুদ্রায় যার অঙ্ক প্রায় ২৩ লক্ষ টাকা।
কয়েক দশক পরে এই প্রথম বেলজিয়ামে কোনও নেকড়ের দেখা মিলেছিল। তাও আবার জার্মানি থেকে আসা। আসলে গত কয়েক দশকে ইউরোপের মূল ভূখণ্ড থেকে ক্রমে হারিয়ে যাচ্ছিল নেকড়ের বংশ। নেকড়ের সংখ্যা বাড়াতে বিশেষ উদ্যোগ নিয়ে ঝাঁপিয়েছিলেন পরিবেশপ্রেমীরা। একাধিক উদ্যোগ নেওয়া হয়েছিল। যার জেরে গত কয়েক বছরে ইউরোপের দেশগুলিতে ফের নেকড়ের দেখা মিলতে শুরু করেছিল। এমনকী, যে সব দেশ থেকে নেকড়ে উধাও হয়ে গিয়েছিল, সেখানেও ফের তাদের দেখা মেলে। তালিকায় সর্বশেষ নাম ছিল বেলজিয়ামের। সেই নেকড়ে নায়াকেই খুন করে চোরাশিকারিরা। ক্ষুব্ধ পরিবেশপ্রেমীদের বক্তব্য, ‘দোষী কোনও ভাবেই পার পাবে না।’ তাদের অনুমান, কোনও পেশাদার শিকারি এই কাজ করেছে। জঙ্গলের সংরক্ষিত এলাকায় ঢুকে নায়া এবং তার বাচ্চাদের মারা হয়েছে।
জার্মানির স্যাক্সনি রাজ্যের বাউৎসেন শহরের লেকে ভেসে ওঠে ১ বছর বয়সি এক নারী নেকড়ের মরদেহ৷ বার্লিনের ওয়াইল্ড লাইফ রিসার্চ ইন্সটিটিউট নেকড়ের মরদেহ পরীক্ষা করেছে৷ তারা বলছে, খুব কাছ থেকে বুকে গুলি করে হত্যা করা হয়েছে নেকড়েকে৷ জার্মান সংগঠন প্রটেকশন অব উলভস-এর প্রধান ব্রিগিটে যমার বলছেন, ‘‘এর মাধ্যমে আরো একবার প্রমাণিত হলো, নেকড়ে নয়, মানুষই আসলে বেশি পাশবিক৷” যমারের সংগঠন, বাউৎসেন শহর কর্তৃপক্ষ এবং ‘উলভস: ইয়েস প্লিজ’ নামের ফেসবুক গ্রুপ খুনিকে ধরতে পুরষ্কার ঘোষণা করেছে৷ পুরষ্কারের পরিমাণ ৭ হাজার ইউরো৷ যমার মনে করেন, ‘‘কেউ যদি এই হত্যাকাণ্ড সম্পর্কে কিছু জেনে থাকে, ৭ হাজার ইউরো তাঁর মুখ খোলার জন্য যথেষ্ট৷” ইউরোপীয় ইউনিয়ন এবং জার্মান আইনে নেকড়েরা সংরক্ষিত৷ নেকড়ে হত্যাকে এখানে অপরাধ হিসেবে গণ্য করা হয়৷ স্যাক্সনি স্টেট ক্রিমিনাল পুলিশ এই হত্যার তদন্ত করছে৷ জার্মান আইন অনুযায়ী, বন্য নেকড়ে হত্যার শাস্তি কয়েক হাজার ইউরো জরিমানা এবং ক্ষেত্রবিশেষে ৫ বছর পর্যন্ত জেলও হতে পারে৷ ‘উলভস ইন স্যাক্সনি’ নামের বন্যপ্রাণি রক্ষা সংগঠনের তথ্য বলছে, ২০০৯ সাল থেকে ৮টি নেকড়ে হত্যার ঘটনা ঘটেছে৷ নেকড়ের সংখ্যা বৃদ্ধি এবং কিভাবে তাদের সাথে খাপ খাইয়ে নেয়া যায়, এ নিয়ে সাধারণ মানুষ তো বটেই, রাজনীতিবিদরাও দ্বিধাবিভক্ত৷
আর একটি নেকড়ে হত্যার কথা জানা যায়। ২০১৮ সালের জানুয়ারি মাসের কথা। ভালোবাসার সঙ্গীর খোঁজে ঘর ছেড়ে দূরে পাড়ি জমায় ওআর-৫৪ নামে একটি নেকড়ে। নামটি বিজ্ঞানীদের দেওয়া। তার গলায় বাঁধা রেডিও ট্রান্সমিটার কলারের মাধ্যমে জানা যায় পরের দু’বছরে ৮ হাজার ৭১২ মাইল পাড়ি দিয়েছে সে। ঘুরে বেড়িয়েছে পাহাড় ও তৃণভূমি। খাবারের প্রয়োজনে করেছে শিকার।
কম বয়সী নেকড়েদের জন্য ঘর ছেড়ে দূরে পাড়ি জমানো খুব স্বাভাবিক ঘটনা। এ তথ্য জানান অলাভজনক প্রতিষ্ঠান জীববৈচিত্র্য কেন্দ্রের জীববিজ্ঞানী আমারক ওয়েইস। তিনি বলেন, নেকড়েদের বয়স দেড় বা দুই বছর হলেই সঙ্গীর খোঁজে বের হয় ওরা।
নেকড়েটির বয়স ছিল মাত্র তিন বছর। ওয়েইস বলেন, নেকড়েরা সঙ্গীর খোঁজে যাত্রার সময় পথে মূত্র বিসর্জনের মাধ্যমে নিজেদের চিহ্ন রাখে। পরে সেসব জায়গায় আবারও ফিরে আসে তারা। এটা অনেকটা ‘পি-মেইল’। কিন্তু ওআর-৫৪ কোনো সঙ্গী খুঁজে পায়নি; এর মানে এ অঞ্চলে খুব বেশি নেকড়ে নেই।
যুক্তরাষ্ট্রে একসময় প্রচুর ধূসর নেকড়ে বাস করতো। ১৯ ও ২০ শতাব্দীতে সরকারের মদতে তাদের একেবারে নির্মূল করে ফেলা হয়। তবে এখন সংরক্ষণবাদীরা তাদের বাঁচিয়ে রাখার চেষ্টা করছেন। তারপরও তাদের সংখ্যা নগণ্য।
ওয়েইস বলেন, যদি এ অঞ্চলে যথেষ্ট নেকড়ে থাকতো, তাহলে ডিসেম্বর বা জানুয়ারির মধ্যেই ওআর-৫৪ সঙ্গী খুঁজে পেতো এবং ফেব্রুয়ারির মধ্যে সে গর্ভবতী হতো। তাহলে এপ্রিলেই কয়েকটি বাচ্চা নেকড়ের জন্ম দিতো সে।

নেকড়েটির মৃত্যু প্রসঙ্গে ওয়েইস বলেন, দলে থাকুক কি একা, নেকড়েদের জীবন বেশ সংগ্রামের। তরুণ ও স্বাস্থ্যবান একটি নেকড়েও নানা কারণে মারা যেতে পারে। হতে পারে হরিণ শিকারের সময় মাথায় আঘাত পেয়েছে সে বা র‍্যাকুন খাওয়ার সময় দম আটকে গেছে। ইয়েলোস্টোনে এক নেকড়ের সঙ্গে এমন হয়েছিল। কোনো গাড়ি তাকে ধাক্কা দিয়েছে বা শিকারি তাকে হত্যা করেছে, সেটাও হয়ে থাকতে পারে।
এর আগে ওরেগনের নেকড়ে ওআর-৫৯ ক্যালিফোর্নিয়ায় মারা গেছে। ২০১৮ সালে ডিসেম্বরে তার গুলিবিদ্ধ মরদেহ পাওয়া যায়। পরে সংশ্লিষ্ট কর্মকর্তারা ঘোষণা করেন, নেকড়েটির মৃত্যুর ব্যাপারে কোনো তথ্য দিলে দুই হাজার পাঁচশ’মার্কিন ডলার পুরস্কার দেওয়া হবে।
নেকড়েদের রক্ষার জন্য ‘ফেডারেল এনড্যাঞ্জারড স্পিসিজ অ্যাক্ট’ও ‘ক্যালিফোর্নিয়া এনড্যাঞ্জারড স্পিসিজ অ্যাক্ট’ নামে আইন রয়েছে।

ক্যালিফোর্নিয়ার মৎস্য ও বন্যপ্রাণী বিভাগ বলে, নেকড়ে সংখ্যা রক্ষায় যে কোন ঝুঁকি খুব গুরুত্বের সঙ্গে দেখি আমরা। এখন আমরা ওআর-৫৪’র মৃত্যুর বিষয়টি তদন্ত করছি। আমরা জনগণকে মনে করিয়ে দিতে চাই, নেকড়ে হত্যা করা অপরাধ এবং এর সাজা হবে। এতে কারাদণ্ডও হতে পারে।

লেখা পাঠাতে পারেন

আগের পর্বটি পড়তে নিচের লিংকে ক্লিক করুনঃ

জ য় ন্ত    কু মা র    ম ল্লি ক-র একটি ধারাবাহিক গদ্য– অথ নেকড়ে-মানব-মানবী কথাঃ গল্প বনাম সত্যি ঘটনা (একাদশ পর্ব)

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *