স প্ত দ্বী পা অ ধি কা রী -র গল্পঃ গানটি এবং শ্রীময়ী

পরিচিতিঃ
লেখিকার বাংলা সাহিত্য নিয়েই পড়াশুনো, গবেষনা ও চর্চা।মূলত গদ্য-সাহিত্যেই তাঁর বিচরণ। দীর্ঘদিন বিদেশে থাকেন। চর্চা করেন লিটল ম্যাগাজিন নিয়ে। “কথাকাব্য” ও “রাজকন্যা”(শিশু কিশোরদের জন্য) নামে দুটি পত্রিকারও সম্পাদনা করেন যা করোনার কারণে এবারের সংখ্যা মাঝ পথে পড়ে আছে।
প্রথম গল্পগ্রন্থঃ “মৃত্যুর মুখ” দশটি গল্প নিয়ে এই সংকলন।
দ্বিতীয় গল্পগ্রন্থ–“খেজুর গাছের ঘাট এবং পঞ্চীর ইন্দ্রীয় সকল”
প্রকাশকঃ কবিতীর্থ।এই বইএর একটা গল্পের নাম- ‘হলুদ বুটি’।আন্ডারওয়ার্ল্ড এর ভাষা ব্যবহার করা।
তৃতীয় গল্পগ্রন্থঃ জায়ান্ট কিলার( কিশোর গল্প-সংকলন)
চতুর্থঃ খেঁদির কথা( উপন্যাস)
নিম্নবর্গের মানুষের যুদ্ধ কাহিনি।এটিও কিশোর উপন্যাস।
একটা কাব্যগ্রন্থ করেছে ৯ নম্বর সাহিত্য পাড়া লেন।কাব্যগ্রন্থের নামঃ প্রায়শ্চিত্ত পর্ব।
ইনিও বাইফোকালিজম্ পরিবারের একজন সদস্যা।

স প্ত দ্বী পা অ ধি কা রী

সেই গানটি এবং শ্রীময়ী

স্রষ্টা পুরুষ বলেই হয়তো এত পার্থক্য।নইলে চোখ থাকতেও এভাবে অন্ধ করতেন না শ্রীময়ীকে।হ্যাঁ,আমাদের এ গল্প শ্রীময়ীকে নিয়ে।কেমন পটল চেরা দুখানি চোখ রয়েছে শ্রীময়ীর! অথচ সে অন্ধ।সৃষ্টিকর্তার কাজটাই এমন।সোনা সবসময়েই থাকে খনির ভিতরে।শ্রীময়ী না-চাইতেই সব পেয়েছিল।ব্যবহারযোগ্য তখন সে নিজেই ছিল না।ফলে প্রতিমুহূর্তে তাকে আছাড় খেতে হয়েছে।রক্তাক্ত হতে হয়েছে।তবে শ্রীময়ী কিন্তু এটুক ঠিক বুঝেছে যে,পথেই হাঁটতে হবে তাকে।পিছু ফেরার পথ নেই।এই চিন্তাটাই তাকে কিছুটা বাস্তবমুখী করেছে।সে বুঝেছে,ব্যথা-যন্ত্রণার মুক্তি শুয়ে থেকে নয়।চলতে চলতেই।চলতে চলতেই শিখতে হয় চলার আনন্দ!আছে সার্থকতা।কিন্তু শ্রীময়ী সঠিক পন্থাটাই হয়তো খুঁজে পাচ্ছে না।তাই সে খোঁজে।মরীয়ার হয়ে খোঁজে।আকাশে দিনে তো চাওয়াই যায় না।ঝলসে দেওয়া রোদ।রাতে গভীর অন্ধকার!নদীর দিকে চাইলেই বুকটা তার কেঁপে ওঠে।সে দেখেছে, প্রতিটি নদীরই তটভূমি থাকে।সঠিকভাবে চলতে না পারা শ্রীময়ী দৃষ্টি ফিরিয়ে নেয়।ভিতরে তার যন্ত্রণা,ভিতরে তার আগুন,ভিতরে তার অভাব কিন্তু বাইরে সে পটল- চেরা দুটো চোখ নিয়ে অন্ধ! অন্ধ কেননা তার হাতে তুলি নেই এবং সে জানেনা,সে তুলি কার হাতে! অথচ মনে তার রঙের ফোয়ারা!

শ্রীময়ী প্রতি মাসের নির্দিষ্ট কয়েকটা দিন অসুস্থ হয়।এবং তখনি সে একটা কিছুর অনুরণন টের পায়।একটা সূক্ষ্ম কিন্তু তীব্র অনুভূতি।অচেনা এক তীব্র জলোচ্ছ্বাসে ভেসে যায় সে।এ সময় দূর এবং বহুদূর থেকে বয়ে আসা এক ফাগুনি বাতাস হঠাৎ জড়িয়ে ধরে তাকে।শ্রীময়ী হয়তো বোঝার চেষ্টাটুকও করতো না কিন্তু হঠাৎ থরথর কেঁপে ওঠে সে। ফাগুনি বাতাস শুধু জড়িয়েই ধরেনি তাকে, তার কানে কানে ফিসফিস কিরে কিছু বলেছে।সে স্পষ্ট শুনেছে।কথাগুলো একদম মানুষের মতো।এবং সম্পূর্ণ।তবুও কোথায় যেন পার্থক্য।এই ভাষা তার নিজের মতো নয়।তার আপনজনদের মতোও নয়।অথচ সে এটুক বুঝতে পারছে,এই ভাষাই তাকে করে তুলবে পূর্ণ! কিন্তু এ ভাষার উচ্চারণকারী কন্ঠের ব্যক্তিকে সে এক অবোলা অসহায় নারী কোথায় পাবে খুঁজে??
একদিন সে বাতাসকেই দূত করতে চাইল।এবং বলেই ফেলল মনের গোপন কথাটা।বাতাস শুনে হা হা করে হেসে উঠল।শ্রীময়ী খানিক দমে গেল।তার চাহিদার কী কোনো মূল্য নেই??
শ্রীময়ীর অভিমানী চোখ দেখে বাতাস বলল—” আমি খবর দিয়ে দেব।কিন্তু তারপর?? চিনবে কী করে??জানোতো কন্ঠের উচ্চতার উপরই অনেকের যোগ্যতা ও সততা এমন ভেবে ভুল করে অনেক শ্রোতা!”
শ্রীময়ী হাসল।বলল—” আমি চিনতে পারবো!”
বাতাস বলল—” যদি ভুল হয়?”
শ্রীময়ী যেন ধ্রুবতারা!
হাসতে হাসতে বলল—” আমি অবিশ্বাস করে জিততে চাই না। বরং বিশ্বাস করে হারতেও প্রস্তুত!”
বাতাস বেশ খুশি হল।এবং প্রেমিকের মতো শিষ দিতে দিতে
বয়ে চলল ঝিরঝির করে।
অদ্ভুতভাবে এরপর থেকে শ্রীময়ীর জীবনে উৎসব লেগে রইলো যেন!শত শত কন্ঠের আমদানি করতে লাগলো বাতাস।
শ্রীময়ী চরম বিরক্ত হয়ে উঠল।বাতাসকে একদিন সে বলল—” আমি এতো বিশেষ চাই না।বৈচিত্র্য চাই না।আসল চাই।চূড়া চাই।যাতে আকাশকে ছাদ ভাবতে পারি!”
বাতাস মৃদু মৃদু বয়ে চলল।কিছু একটা ছিল বাতাসের উচ্চারিত সুরে! কিছু একটা স্মৃতি! অথবা কিছু মধুর সুগন্ধ! কেউ যেন ডাকছে হাতছানি দিয়ে শ্রীময়ীকে।কিন্তু কে ডাকে?? একটা ছন্দ কি?? কিম্বা সুর?? অথবা নিছক ভালোলাগা?? শ্রীময়ী কিচ্ছু বুঝতে পারছে না।তবে তার শ্রবণযন্ত্র কিছু বুঝতে পারছে হয়তো!
“কানের ভিতর দিয়ে মরমে পশিল গো
আকুল করিল মোর প্রাণ
সই,কে বা শুনাইল শ্যাম নাম!”

বাতাস এক্কেবারে হঠাৎ থেমে গেল।আর মুহূর্তে কেমন গুমোট হয়ে উঠলো চতুর্দিক।বাতাস আবার ধেয়ে এলো।শ্রীময়ীর চুলগুলো ঘেটে দিল সে।শ্রীময়ী চোখ বন্ধ করল।ঠান্ডা বাতাসেও কান গরম হয়ে ওঠে কেন যে তার! তার অবস্থা সম্ভবত বাতাস কিছুটা আন্দাজ করতে পেরেছে।তাই সে এক মুহূর্তে প্রবল সাইক্লোন হয়ে উঠল। শ্রীময়ী শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে অনুভব করতে পারল বাতাসের সেই প্রতাপ।সমস্ত শরীরে পোষাক লেপ্টে বাতাস শ্রীময়ীকে ক্লান্ত করতে চাইল। ক্লান্ত ও শ্রান্ত। শ্রীময়ীও দুই হাত দুই পাশে মেলে দিল।উড়িয়ে নিয়ে যাক।ভাসিয়ে নিয়ে যাক… সেও ভেসে যেতে চাইছে তখন বাতাসের সাথে…এই একাকী জীবনে বৃক্ষের মতো শেকড় মাটির গভীরে প্রবেশ করিয়ে আর লাভ নেই।দীর্ঘকালের চেপে রাখা,লুকিয়ে রাখা ইচ্ছেরা শ্রীময়ীকে বদ্ধ জলাশয়ে আবদ্ধ করে রেখেছিল। শ্রীময়ী এখন উন্মুক্ত সাগর!ভাসিয়ে নিতে পারে দেশ-কাল।
বাতাসের ঝিরিঝিরি বয়ে যাওয়ার শব্দে শ্রীময়ী কেমন করে যেন এক মধুর সুগন্ধে নিমজ্জিত হল।সেই সুগন্ধ এক মায়াবীচাঁদের আলোমাখা জ্যোৎস্না রাত!শুধুই কি জ্যোৎস্না?? জ্যোৎস্নার পরতে পরতে মাখানো কিছু জানা কিম্বা অজানা সুর!জ্যোৎস্না আসলে তরল রূপো।তাহলে সেখানে এতো সুর কীভাবে এলো?শ্রীময়ীর পক্ষে এখন আর পিছিয়ে যাওয়া অসম্ভব নয়। সে ফিরে চলল পিছনে।সামনে এগুবার থেকেও গতি তার কয়েক হাজার গুণ বেশি।
শ্রীময়ী তখন ছয়-সাত।সেই নির্মল গ্রাম্য পরিবেশ।মানুষের সাথে মানুষের হৃদ্যতা ছিল সহজলভ্য।কিন্তু নিয়মের বেড়াজালে আবদ্ধ ছিল প্রকৃত সুখ।শ্রীময়ীর কাকু বেশ সুদর্শন।কাকুর চোখদুটো দেখে অধিকাংশ মেয়েরা কিংকর্তব্যবিমূঢ় হয়ে যেত।আর তাই নিয়ে শ্রীময়ীর বাবা মা খুব হাসতেন।কতো যে সুন্দরী মেয়েরা কাকুকে প্রপোজ করতো।
মা বলতেন—” ঠাকুর পো,এবার তুমি ধৃতরাষ্ট্র হয়ে যাও।বেচারা মেয়েগুলো তো এরপর পাগল হয়ে যাবে গো!”
আর খিলখিল করে হাসতেন।বাবাও। কিন্তু কাকু একদম হাসতেন না।শ্রীময়ী ছিল যাকে বলে অকালপক্ক।পাশের বাড়ির পুপু আন্টির দিকে তার কাকু যে কেমন কেমন করে তাকায় তা সে ঠিক বুঝতে পেরেছিল।অথচ সে তখন এক্কাদোক্কা,সে তখন গোল্লাছুট,সে তখন আঙুলে আঙুল ছুঁইয়ে আড়ি-ভাব,দু হাত দুদিকে মেলে দিয়ে সে তখন পৃথিবীকে দুই ডানায় ধরে সরু ধান-আলপথে নিজেই ফাগুন-বাতাস! শীর্ষদেশ তখন তার অজানা। অথচ সেই বয়সেই এবং সেই বয়সেও সে এক গভীর মায়াজালে আবদ্ধ হয়ে যায়।প্রতি মুহূর্তে বাড়ে তার গভীরতা।যত বাড়ে গভীরতা ততই হয়ে পড়ে সে বেসামাল।আর ততই ছটফট করে মরে সে।হঠাৎ সেইদিন সে স্তব্ধ হয়ে গেল।যেদিন ছিল কোজাগরি লক্ষ্মী পুজো।তার চকোলেট বয় কাকুর যে চোখের দিকে চাইলেই মেয়েরা স্থির হয়ে যেত,সেই চোখ তুলে শ্রীময়ীর কাকু চাইতেন পাশের বাড়ির পুপু আন্টির দিকে।পুপু আন্টির কী যেন সব গন্ডোগোল হয়েছিল।একটা ছয়-সাত মাসের পুচকু ছিল পুপু আন্টির।তাকে নিয়ে একাই থাকতো।আন্টিকে শ্রীময়ীর একটুও আন্টি আন্টি লাগতো না। কী যে ভালো লাগতো তার পুপু আন্টিকে! মাঝে মাঝে আন্টির সাথে খাতির করার বাসনায় শ্রীময়ী আন্টির বাসায় ঘুরঘুর করেছে।পুপু আন্টি পাত্তাও দিত না। অতিরিক্ত মনোযোগ আকর্ষণের বাসনায় শ্রীময়ী পুচকুকে কোলে নেবে ভেবে ছুঁয়েছে কী ছোঁয় নি,আন্টি রে রে করে তেড়ে এসেছে! যশোদা হয়ে মুহূর্তে তার কৃষ্ণকে বুকে জাপ্টে ধরেছে!শ্রীময়ী খুব আদুরে।এইটুক কাঠিন্য তার চোখদুটোকে ঝাপসা করে দিয়েছে।এবং এক ছুটে সে বাড়ি চলে এসেছে।তারপর আর পুপু আন্টির সাথে খাতির করতে যায় নি সে।কিন্তু আজ কোজাগরির দিন সে দেখেছে পুপু আন্টি একটা লাল পেড়ে সাদা শাড়ি পরেছে।ঘরে ঘরে আজ লক্ষ্মী পুজো।পুপু আন্টি তাদের বাড়িতেও এসেছিল।প্রসাদ দিতে।আন্টির গায়ে কী অসাধারণ মিষ্টি একটা গন্ধ।শ্রীময়ীর কী যে ভালো লেগেছিল তা সে ভাষায় প্রকাশ করতে পারবে না!সে চোখ বন্ধ করে পুপু আন্টির কাছে দাঁড়িয়ে মন ভরে গন্ধটা নিচ্ছিল যখন,ঠিক তখনি সে দেখল তার কাকুর চোখদুটো।সে যতই ছোটো হোক,ঠিকই বুঝতে পারল। কাকুর যে চোখদুটো দেখে সমস্ত মেয়েরা বাক্যহারা হয়ে যেত,সেই সুন্দর চোখদুটো কেমন নিজেরাই বাক্যহারা হয়ে পড়ে রয়েছে পুপু আন্টির চোখের উপরে!কিন্তু পুপু আন্টি এক পলক মাত্র দেখেই যেন পাত্তাই দিল না!শ্রীময়ীর সেই ছুটে ছুটে চলা-বলা যেন থমকে গেল এক মুহূর্তে।সেই বয়সেই সে যেন বুঝতে পেরেছিল,এইখানেই,এই পুজো মন্ডপে,এই ধূপ ধুনোর গন্ধের ভিতরে,এই প্রসাদ প্রসাদ অনুষ্ঠান ছাড়িয়েও অন্য কোথাও বেজে চলেছে আরতির ঘন্টা।পুজোর উপকরণ সাজানো হয়ে গেছে!!শুধু দেবতা আর দেবীর উদ্বোধনটুকই যেন বাকি! এমনই একটা অন্যরকম অনুভূতি শ্রীময়ীর মনকে তৃষ্ণার্ত করে তুলেছে যেন!আবার এই তৃষ্ণা পাওয়াটাকেও পরিপূর্ণ লাগছে! শ্রীময়ী তখন এই অনুভূতির অর্থ বোঝেনি।আচ্ছা,এখন কি সে বোঝে? সবটা?? বোঝে কি? শ্রীময়ী অবাক হয়ে ভেবে যায়।নিরুত্তর মন তার!

সেদিন সারাটাক্ষণ শ্রীময়ী কাকুর সাথে সাথে থেকেছে।আর বারবার কাকুর মুখের দিকে চোখের দিকে চেয়েছে।কাকুর মুখটা যেন কেমন! আর চোখদুটোও।বারবার কাকু পুপু আন্টির দিকে চাইছে।একটু রাতের দিকে কাকু বলল—” চল শ্রী!” শ্রী ভাবলো,তার কাকু ঠিক পুপু আন্টির বাড়ি যাবে।কিন্তু না,কাকু শ্রীময়ীর হাত ধরে ফটফটে জ্যোৎস্নায় পুকুরের পাড়ে গিয়ে বসলো।শ্রীময়ীও বসলো কাকুর পাশটিতে।সে বারবার সেদিন কাকুর মুখের দিকে চাইছিল।কাকুর কী ভীষণ মন খারাপ যেন! আবার সব কিছু মিলে একটা অসম্ভব ভালোলাগায় দুলছে সে নিজেই।সে জানে এখনই সেই মাহেন্দ্রক্ষণ! কী যেন পেতে চলেছে সে নিজে! কিন্তু সে কেন?? সে কেন?? সে-ই কেন??সে নয়।সে জানে,সে নয়!হঠাৎ সে দেখল তার কাকু যেন কেমন করে একটা দীর্ঘশ্বাস ছাড়ল।আর তার সাথে সাথে কাকু তার কেমন করে যেন কেঁপে উঠল।শ্রীময়ী চমকে উঠল।কেন কে জানে!নির্জন আর সুন্দর পুকুর ঘাটে ছোটো বড়ো সব রকম পায়ের শুকিয়ে যাওয়া জল-দাগও বোঝা যাচ্ছে। তারা বসে আছে যে সান বাঁধানো ঘাটের উপরে ঠিক তার পিছনে একটা সাস্থবতী আমগাছ।কী সুমিষ্ট ঘ্রাণ গাছটার!! আর সেই গাছটাও যেন তার কাকুকে বড্ড ভালোবেসে কাকুর বুকের উপরে এক ঝাকড়া ডালের ছায়া ফেলে রেখেছে।মৃদু মৃদু দুলছে সেই ডাল তার সবুজ পাতাসকল নিয়ে।আর কী যে অসম্ভব মিষ্টি এক গন্ধ বাতাসে বয়ে বেড়াচ্ছে!! আকাশ থেকে ঝরে পড়া জ্যোৎস্না যেন শ্রীময়ীর বন্ধু হয়ে ওঠে,এমন ব্যাকুল আবেদন মাখানো দৃষ্টি নিয়ে উর্ধমুখী শ্রীময়ী হঠাৎ শোনে তার কাকু গুনগুনিয়ে গান করছে। ” হু হু হু হু উউউ” কাকুর কন্ঠে যাদু মাখানো।কী আকুলতা সে কন্ঠে!
কাকু গাইছে—” তোমারে লেগেছে এত যে ভালো,চাঁদ বুঝি তা জানে/ রাতের বাসরে ধূসর হয়ে তাই সে আমারে টানে!”
শ্রীময়ী জানে না,এ গান শুনে তার গায়ে কাঁটা দিচ্ছে কেন! ছোট্ট মানুষ সে।গভীর আর কালো দুটো চোখ।অবাক দৃষ্টি মেলে সে এতোকাল সব কিছু দেখে এসেছে।এই প্রথম সে অনুভব করল চোখ ছাড়াও অনেক কিছু দেখা যায়!সে কাকুর পাশে বসে মুখ নীচু করে গান শুনে যাচ্ছিল।কাকু গাইছিল—“এতো যে কাছে চেয়েছি তোমারে/ এতো যে প্রীতি দিয়েছো আমারে/ আকুল পাপিয়া ছড়ায়ে এ কথা/ আকাশেরও কানে কানে/ চাঁদ বুঝি তা জানে…”
গানের কথা,সুর যখন শ্রবণযন্ত্রে মিশে যায় তখনই তৈরি হয়ে যায় ভালোবাসা।আর উদ্দেশ্য যদি সাক্ষাৎ দেখা দেয় তাহলে তা পরিপূর্ণতা প্রাপ্ত হয়।তাই শ্রীময়ীর কন্ঠে তখনো রেশ রয়ে গেছে গানের! পুরো পৃথিবীটা তখন ভালোবেসে মরে যেতে চাইছে। তাই সে এমন নিঃঝুম! নির্বাক চেয়ে রয়েছে চাঁদ। শ্রীময়ী মুখ দিয়ে কোনো শব্দ বার না করতে পারলেও সে সেই মুহূর্তটুকই যে আসলে মাহেন্দ্রক্ষণ তা বুঝতে পেরেছিল এক মিষ্টি চেনা গন্ধের অস্তিত্বের অনুভূতিতে।চমকে মুখ তুলেই সে সামনে পুপু আন্টিকে দেখতে পেল।পুপু আন্টির পরণে এখনো সেই লাল পেড়ে সাদা শাড়িটাই।শ্রীময়ী কাকুর দিকে চাইতেই দেখে কাকু কেমন সম্মোহিতের মতো উঠে দাঁড়িয়েছে…

হঠাৎ একটা হ্যারিকেনের মৃদু আলো আর কারো ক্রুদ্ধ চিৎকার ভেসে এলো—“অ বউমা,কোম্নে গিইচো,ইদিকি কোলেরডা যে চিল্লে চিল্লে মরি যাতিচে…”
চমকে উঠল শ্রীময়ী।কোথায় সে ভালোলাগা! কোথায় সে সুর! কোথায় জ্যোৎস্না?? সে এক ঘন অন্ধকার-পরিপূর্ণ ঝিঁঝি ডাকা রাতে একাকী এই ঘন জঙ্গলের মধ্যে কখন এসেছে?? কেনই বা! কী শনশন করে বাতাস বইছে! বিদ্যুৎ চমকাচ্ছে থেকে থেকে। তার মনে পড়ল সব।সে এখন যে আর বাপের বাড়িতে নয়।একইরকম আর একটি গাঁয়ে।তার শ্বশুরবাড়িতে।
” অ বউমা,বলি পাগলামো বন্দ করি একোন ঘর পানে এস্যো দিকি।বাচ্চা কান্তিচে… ভ্যালা ঝামেলায় পড়িচ তো মুই… বিদবা মেয়েমানুষ তুই… আন্দারে-কান্দারে কোম্নে কোম্নে ঘুরি মরতিচিস বলদিন…”
মন্ত্রপূত সাপিনীর মতো ঘরে ফিরছে শ্রীময়ী।ফিরতেই হবে যে তাকে।তার দুগ্ধপোষ্য কাঁদছে।বুক টনটন করছে তার দুগ্ধভারে।সে ভুলেই গেছিল সমস্ত কিছু।কখন যে এই ভয়ানক দুষ্টু বাতাস তাকে লোভীর মতো হিড়হিড় করে টেনে এনেছে সে তা টেরও পায়নি।এখন সে দৃঢ় প্রতিজ্ঞ।ফিরতেই হবে তাকে।হঠাৎ বাতাস যেন কীভাবে বুঝতে পেরেছে,যে,শ্রীময়ী ফিরছে।সেও পাগলা হয়ে উঠলো যেন! নিমেষেই ঝাঁপিয়ে পড়ল শ্রীময়ীর উপর।হঠাৎ আঘাত সামলাতে পারল না শ্রীময়ী।সে হুমড়ি খেয়ে পড়ল।আর এক মুহূর্ত দেরি করল না বাতাস।শ্রীময়ীকে পেড়ে ফেলল।শনশন আওয়াজ তুলে চুলগুলো ঘেঁটে দিল।তীব্র কষাঘাতে ঠোঁটদুটো জ্বলে উঠল শ্রীময়ীর।লন্ডভন্ড করে দিল সমস্ত পোষাক।এক ঝটকায় উড়িয়ে নিল আঁচল।তীব্রবেগে শরীরের রন্ধ্রে রন্ধ্রে বয়ে চলল।কোথাও বাজ পড়ল।তীব্রতম আওয়াজে কেঁপে উঠল শ্রী।ঝলসানো আলোয় দুহাতে ঢেকে ফেলল বুকের গভীর।পরক্ষণেই তার মনে পড়ল,ওই জঙ্গলে কোনো দুপেয়ে নেই।সে উঠে দাঁড়াল।ততক্ষণে বাতাস তার দোসর নিয়ে এসেছে।প্রথমে ঝির ঝির তারপর মুষলধারায় নেমে এলো সে।চুপচুপে ভিজে গেল শ্রী।শাড়ি নিরুদ্দেশ।ভেজা সায়া আর ব্লাউজের আবরণে এক অপূর্ব নারী মূর্তি ঠিক দেবীর মতো শক্তি সঞ্চয় করে এগিয়ে চলেছে।নাহ।সে আর বাতাসকে ভয় পায় না।বাতাসের সীমায়িত ক্ষমতার পরিচয় বাতাসই এইমাত্র তাকে বুঝিয়েছে।মনে মনে সে বাতাসের কাছে কৃতজ্ঞতা প্রকাশ করল! ভাগ্যিস বাতাস প্রবাহিত হয়েছিল।নইলে সে যে নিজেকেই চিনতে পারতো না! সে আজ দৃষ্টি ফিরে পেয়েছে।সে যে আসলে ধীরে ধীরে কিন্তু নিশ্চিতভাবে পুপু আন্টি হয়ে উঠেছে, তা আজ বুঝতে পেরেছে।পুপু আন্টি সেদিন রাতে তার কাকুর বুকের মধ্যে মিশে গিয়েছিল। আর গুঁড়ের গন্ধে পিঁপড়ের মতো গাঁয়ের মানুষগুলো জড়ো হয়েছিল।পরদিন গ্রাম-প্রধানের সামনে বিচারের বিধান যে আসলে শাস্তির নামে একজন স্বামী-পরিত্যক্তা যুবতীকে গণধর্ষণের বিকৃত কামনা চরিতার্থ করার উপায় মাত্র,তা সকলেই বুঝেছিল।কিন্তু পুপু আন্টি সে সুযোগ কাউকে দেয়নি।সমাজের মুখে একদলা থুতু ছুঁড়ে দিয়েছিল পুপু আন্টি।সেই সুন্দর শাড়িটাই গলায় পেঁচিয়ে নিয়েছিল পুপু আন্টি নিজের উঠোনের একটা কাঁঠাল গাছের সাথে।শ্রীময়ী পায়ে পায়ে ঘরে ফিরছে… শ্রীময়ীরা ঘরেই ফেরে… মনের ভেতর ঘাপটি মেরে বসে আছে সুখ… বাতাস সেই সুখকে উসকে দিয়েছে শুধু… বাতাস জানে না কতোখানি অক্সিজেন তার নিঃশ্বাসে মিশে আছে… শ্রীময়ী পুড়ছে ধিকি ধিকি দাউদাউ…আর অপেক্ষা করছে, অপেক্ষা করছে তার জন্য… অপেক্ষা করবে সে জন্ম-জন্মান্তরেও… কবে কখন কেউ একজন শুধুমাত্র তাকেই পেতে চেয়ে গেয়ে উঠবে–+ ” তোমারে লেগেছে এতো যে ভালো,চাঁদ বুঝি তা জানে…”

Leave a Comment

Comments

No comments yet. Why don’t you start the discussion?

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *